Indian Economy I

স্বাধীন ভারতের অর্থনীতি (১ম পর্ব)

ভারতের স্বাধীনতার ৭৫ বছর। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে ভারতের জাতীয় অর্থনীতি প্রসঙ্গে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী)-র কেন্দ্রীয় মুখপত্র পিপলস ডেমোক্র্যাসি’র ১৪ অগাস্ট সংখ্যায় ‘দ্য ইন্ডিয়ান ইকোনমি সিন্স ইন্ডিপেন্ডেন্স’ শিরোনামে প্রভাত পট্টনায়েকের লেখা প্রবন্ধটি প্রকাশিত হয়েছে। সেই প্রবন্ধেরই বাংলা অনুবাদ (দুই পর্বে) পার্টির রাজ্য ওয়েসাইটে প্রকাশিত হল।

১ম পর্ব   

স্বাধীনতা পরবর্তী ভারত রাষ্ট্রকে দুটি জরুরী কর্তব্য সমাধান করতে হয়। একচেটিয়া সাম্রাজ্যবাদী কর্তৃত্বের মোকাবিলায় পূঁজির প্রধান প্রধান কেন্দ্রগুলির সামনে মাথা না ঝুঁকিয়েই নিজেদের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতিকল্পে স্বনির্ভরতা অর্জনই ছিল প্রাথমিক লক্ষ্য। দ্বিতীয় যে কর্তব্যটি জরুরী ছিল তা হল অভ্যন্তরীণ দেশীয় বাজারে চাহিদার বৃদ্ধি ঘটানো। এই কাজের প্রয়োজনেই জমিদারি প্রথার উচ্ছেদ করতে হত- জমিদারদের হাত থেকে দেশের কৃষিজ ফসল উৎপাদক সহ গোটা কৃষিক্ষেত্রকে মুক্ত করতে না পারলে উৎপাদনের পরিমানে বৃদ্ধি ঘটানো কিছুতেই সম্ভব হত না। দ্বিতীয় কাজটি অসমাপ্ত থাকলে শিল্পায়নের ভিত্তি নির্মিত হয় না, ক্রমবর্ধমান উন্নত বাজার ব্যতীত শিল্পায়ন সম্ভব নয়। এই দুটি কর্তব্য একে অন্যের পরিপূরক। জমিদারী প্রথার উচ্ছেদ ব্যতীত কৃষিক্ষেত্রের উন্নতিসাধন সম্ভব হয় না, আবার কৃষিক্ষেত্রের উৎপাদন সময়োপযোগী না হলে অভ্যন্তরীণ বাজার শক্তিশালী হয় না- তার ফলে মূল্যবৃদ্ধি ও আয়-ব্যয়ের ভারসাম্য রক্ষা করা যায় না, আর্থিক বৃদ্ধি স্তব্ধ হয়ে যায়। এমন অবস্থায় সামাজিক অসন্তোষের ধাক্কা সামলাতে ক্রমশ বড় পূঁজির সামনে হাত পাততে বাধ্য হতে হয়, সাম্রাজ্যবাদের সমীপে পুনরায় আত্মসমর্পণ করতে হয়।

আমাদের দেশে জমিদারি প্রথা উচ্ছেদের কাজ রেখে ঢেকে করা হয়। যেসমস্ত জমিতে জমিদারি দখল নেই, কিংবা জমিদারের মৃত্যু ঘটেছে কেবল সেইসব জমিই উদ্ধার করা হয়। অন্যান্য জমিদারেরা প্রায় সকলেই কৃষিজ ক্ষেত্রের পুঁজিবাদী মালিকে রূপান্তরিত হন। তাদের থেকে বাড়তি কিছু পরিমাণ জমি কেড়ে নিয়ে সরকারী বন্দোবস্ত মারফত অবস্থাপন্ন পরিবারগুলির হাতে ভাড়াটে মালিকানার সত্ত্ব বণ্টন করে দেওয়া হয়। জমিদারদের ব্যাক্তিগত মালিকানাধীন জমি ‘খুদকস্ত’ বলে চিহ্নিত হয়, সেই জমির জোরেই তারা পরবর্তীকালে ফসলের কারবারে বড় পুঁজির মালিক হয়ে ওঠেন। দখলে থাকা জমির পরিমাণের ভিত্তিতে যদি শতাংশের হিসাবে বিবেচনা করা হয় তাহলে দেখা যাবে জমির মালিকদের সর্বোচ্চ ১৫ শতাংশের দখলের পরিমাণ প্রায় একই অর্থাৎ আগের মতোই রয়েছে, শুধু দখলকারীদের সামাজিক পরিচয়ে কিছুটা বদল ঘটেছে। এরাই স্বাধীন ভারতে পুঁজিবাদী কায়দায় কৃষিকাজের সূত্রপাত ঘটায়। একই সময়ে কৃষিকাজে সহায়তা প্রদান, সেচ ব্যবস্থার সম্প্রসারণ সহ সরকারী বন্দোবস্তের পরিসর ক্রমশ বাড়তে থাকে।

আন্তর্জাতিক বৃহৎ পুঁজির কবল থেকে সুরক্ষিত থাকতে কিছু অর্থনৈতিক বিধিনিষেধ অবলম্বন করা শুরু হয়। বড় পুঁজির অনুপ্রবেশ আটকে রেখে অভ্যন্তরীণ দেশীয় অর্থনীতিকে সুরক্ষা প্রদান করা, মূলত ছোট ও মাঝারি কৃষকদের যতদূর সম্ভব পুঁজিবাদী বানিজ্য রীতিনীতি এমনকি দেশীয় পুঁজিপতিদের থেকেও দূরে রাখার বন্দোবস্ত করা হয়। আমদানি রপ্তানি বাণিজ্যের অজুহাতে পুঁজির সঞ্চরণ অনিয়ন্ত্রিত হতে বাধা দেওয়া হয়। কিছু গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক ক্ষেত্রের জাতীয় করণ- যেমন ব্যাংক ইত্যাদি; এর ফলে লগ্নী সংক্রান্ত বিষয় সমুহ সরকারী নিয়ন্ত্রণাধীন থাকে। বৃহৎ পুঁজির একচেটিয়া দখল রোধে পাবলিক সেক্টরগুলির দ্রুত উন্নতিসাধন করা হয়। এই সমস্ত বন্দোবস্তের কারণে আমাদের দেশে ক্রমবর্ধমান পুঁজিবাদী ব্যবস্থা কিছুটা হলেও রাষ্ট্রীয় নজরদারির আওতাধীন থেকে নিয়ন্ত্রিত পথে চলতে বাধ্য হয়, যদিও এমন নীতিসমূহের কার্যকারীতার অপরিহার্য শর্তই ছিল পুঁজিবাদী ব্যবস্থার নিরবিচ্ছিন্ন সমৃদ্ধি। ভারতে পুঁজিবাদের উপরে মূলত তিনটি ক্ষেত্রেই সেই নিয়ন্ত্রণ প্রযোজ্য ছিল - লগ্নী সংক্রান্ত নীতি, বৈদেশিক মুদ্রা আদানপ্রদান এবং লাইসেন্সিং বিধির মাধ্যমে আন্তর্জাতিক পুঁজি নির্ভর বাণিজ্যচুক্তি সমুহ।

এহেন নিয়ন্ত্রণাধীন ব্যবস্থা সত্বেও দেখা গেল ঔপনিবেশিক শাসনের ফলে ঘাড়ে চেপে বসা বেহাল অর্থনৈতিক দশা অনেকটাই কাটিয়ে ওঠা গেছে। মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের হার এবং কৃষিক্ষেত্রে উৎপাদনের পরিমাণ উভয় ক্ষেত্রেই অতি দ্রুত সমৃদ্ধির লক্ষণ দেখা দিল। খাদ্য শস্যের মাথাপিছু পরিমাণে ব্যাপক উন্নতি ঘটল। বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে ব্রিটিশ শাসনে যে পরিমাণ ছিল বছরে ২০০ কেজি, ১৯৪৬-৪৭ সালে তাই কমে হয় মাত্র ১৩৬.৮ কেজি। সেই ভয়ানক পরিস্থিতি থেকে স্বাধীন ভারতে নিয়ন্ত্রিত অর্থনীতির জোরে ১৯৮০ সালের শেষ ভাগে মাথাপিছু খাদ্য শস্যের বার্ষিক গড় পৌঁছায় ১৮০ কেজিতে।

কিন্তু ব্রিটিশ শাসনের তুলনায় অর্থনৈতিক পরিস্থিতির এহেন উন্নতিসাধন সত্বেও জনসাধারণের প্রত্যাশা পূরণ করা যায়নি। ১৯৭৩-৭৪ সাল নাগাদ ন্যূনতম পুষ্টির নিরিখে দেশজুড়ে দারিদ্র্য কিছুটা কমলেও গ্রামীণ এলাকার অন্তত ৫৬ শতাংশ মানুষই দৈনিক ২২০০ ক্যালোরি যুক্ত খাদ্যের চাহিদা পূরণে ব্যর্থ ছিল। ঐ একই সময়ে শহরাঞ্চলে দৈনিক ২১০০ ক্যালোরি যুক্ত খাবার জুটতোনা অন্তত ৬০ শতাংশ শহরবাসীর। একই চিত্র দেখা যায় কর্মসংস্থানের বিষয়ে। সেই সময় জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারের সাথে কিছুটা সাযুজ্য বজায় রেখেই নিয়োগের হার ছিল প্রায় ২ শতাংশ। যদিও কর্মক্ষম যুবসমাজে উপযুক্ত কাজে যুক্ত হওয়ার চাহিদা ক্রমশ বাড়তে থাকায় বেকারির সমস্যাও ক্রমবর্ধমান ছিল। দেশীয় বৃহৎ পুঁজিপতিরা এহেন পরিস্থিতির সম্পূর্ণ সুযোগ নেয়। আর্থিক বৃদ্ধির হার একটি নির্দিষ্ট সীমা অতিক্রম করলে যখন দেশের অর্থনীতি কিছুটা পাকাপোক্ত ভিতের উপরে ভর করে এগোতে শুরু করেছে ঠিক তখনই তারা দাবি তোলে যে অর্থনৈতিক উন্নতির হার সন্তোষজনক নয়। আসলে ততদিনে দেশীয় পুঁজিবাদী গোষ্ঠী আর্থিক সমৃদ্ধির উচ্চাকাঙ্খায় ভুগতে শুরু করেছে। এই অবস্থায় রাজকোষীয় ঘাটতি এমন একটা পর্যায়ে পৌঁছে যায় যার ফলে পূর্বতন আর্থিক বৃদ্ধির হারটুকু ধরে রাখাও কষ্টকর হয়ে পড়ে।

নিয়ন্ত্রিত অর্থনীতি থেকে দেশকে নয়া উদারনীতির দিকে ঠেলে নিয়ে যেতে সরকারের উপরে মূলত বৃহৎ পুঁজিপতিদের তরফেই চাপ দেওয়া শুরু হয়। ৭০’র দশকে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের মূল্যে ব্যাপক ধ্বস নামে এবং সেই সুযোগে আন্তর্জাতিক লগ্নী পুঁজি নিজেকে যথেষ্ট শক্তিশালী হিসাবে প্রতিপন্ন করতে সমর্থ হয়। সেই পুঁজির সাথে গাঁটছড়া বাঁধতেই ভারতের দেশীয় পুঁজিপতিরা লালায়িত ছিল। অবাধ বৈদেশিক বাণিজ্যের ফলে দেশের মাটিতে কাজের সুযোগ ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাবে এমন প্রত্যাশায় ভর করে মধ্যবিত্ত ভারতীয়েরাও বড় পুঁজির মালিকদের দাবিকে সোচ্চারে সমর্থন জানায়। ততদিনে নিয়ন্ত্রিত অর্থনীতির ব্যবস্থা আমাদের দেশের শ্রমজীবী জনগণের ধৈর্য্যচ্যুতি ঘটিয়েছিল, তাই যত যাই হোক অন্তত তারা অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণের পক্ষে দাঁড়াবে বলে ভাবা হলেও বাস্তবে তেমনটা হয়নি। ১৯৮৫’র পরবর্তী সময় থেকে যাবতীয় অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণ তুলে দেওয়ার দাবি উঠতে শুরু করে। ১৯৯১ সালের পরে ভারত নয়া উদারবাদী অর্থনীতি গ্রহণ করে। প্রথমে বৈদেশিক বাণিজ্যের নামে পণ্য ও পরিষেবার বাজারকে উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়, পরে পুঁজির চলাচলে যাবতীয় বিধিনিষেধ তুলে নেওয়া হলে লাইসেন্সিং প্রথার অবলুপ্তি ঘটে।

এই পরিবর্তন নেহাতই কোন অর্থনৈতিক বিধি-নিয়মের বদলমাত্র ছিল না। নয়া ব্যবস্থার ফলে পুনরায় ভারতের অর্থনীতিতে আন্তর্জাতিক বৃহৎ পূঁজির কর্তৃত্ব কায়েম হল। যদিও এইবার সেই কর্তৃত্ব কার্যকর হল বেশ নতুন একটা চেহারায়। সম্পুর্ন নিজের জোরে ঘাড়ে চেপে না বসে দেশীয় বৃহৎ পুঁজির সহযোগিতায় এবং উচ্চ-মধ্যবিত্তদের এক বিরাট অংশের সমর্থন আদায় করে আন্তর্জাতিক পুঁজি ভারতের বাজারে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করল। ঔপনিবেশিক জমানায় সাম্রাজ্যবাদ বনাম ভারতীয় সমাজের দ্বন্দ্বে আমাদের দেশের একাধিক শ্রেণীগুলির মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হয়, স্বাধীনতা পরবর্তী জমানায় ‘নিয়ন্ত্রণমূলক অর্থনৈতিক পরিকল্পনা’ সেই আসলে রাজনৈতিক ঐক্যেরই ফলাফল। স্বাধীনতার পরে সেই নিয়ন্ত্রিত অর্থনীতিকেই দেশের অভ্যন্তরে জনসাধারণের ঐক্য ভাঙতে কাজে লাগানো হল। সাম্রাজ্যবাদ বনাম ভারতীয় জনসাধারণের দ্বন্দ্ব বদলে গিয়ে দেশীয় বড় পুঁজিপতি ও আন্তর্জাতিক লগ্নী পূঁজি বনাম ভারতের শ্রমিক শ্রেণীর দ্বন্দ্বে পরিণত হল।

নতুন পরিস্থিতিতে ভারত রাষ্ট্র নতুন ভূমিকায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে। যে রাষ্ট্র সমস্ত শ্রেণী পরিচিতির উর্ধে উঠে নিজেকে জাহির করে সেই প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোই এইবার আন্তর্জাতিক লগ্নী পুঁজি, বৃহৎ দেশীয় পুঁজিপতি এবং বড় জমিদারদের স্বার্থরক্ষা করতে শুরু করে, বড় বড় বাণিজ্যের পক্ষে বাধা কাটিয়ে ওঠার হাতিয়ার হয়ে ওঠে। কৃষক নির্ভর কৃষিকাজ, ছোটখাটো উৎপাদন ক্ষেত্রগুলির সহযোগীতায় নিজের অতীত ভূমিকাকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে ভারত সরকার এই সকল ক্ষেত্রগুলিকে আন্তর্জাতিক কৃষিবিপণন সংস্থা ও দেশীয় বৃহৎ পূঁজির দখলে যেতে পথ করে দেয়। বহুবিধ সরকারী সহায়তার বন্দোবস্ত যেমন খাদ্যশস্যের বিক্রয়মূল্যে ভর্তুকি তুলে দিয়ে অর্থকরী ফসলে ভর্তুকি দেওয়া শুরু হয়। যদিও কৃষকদের ঐতিহাসিক আন্দোলনের ফলে সরকারকে সেই সিদ্ধান্ত খারিজ করতে হয়েছে। কিন্তু সরকারী সুযোগসুবিধা বহুলাংশেই বাতিল করে দেওয়ার ফলে কৃষকদের উপরে নির্ভরশীল কৃষিকাজের যে ব্যবস্থা আমাদের দেশে এতদিন কার্যকর ছিল তা ক্রমশ অলাভজনক হয়ে পড়েছে। এরই প্রভাবে দেশজুড়ে কৃষকদের আত্মহত্যার ঘটনা যেমন বাড়ছে তেমনই কৃষিকাজ ছেড়ে দিয়ে কাজের খোঁজে কৃষক ও খেতমজুরেরা দলে দলে শহরে এসে ভিড় করছেন। তারা বেশিরভাগই আদৌ উপযুক্ত কোন কাজ পাবেন না, উল্টে বেকারবাহিনী ক্রমশ বাড়তে থাকলে মজুরি ও অন্যান্য ন্যায্য সুযোগবিধা আদায়ে শ্রমিক ও মালিকপক্ষের দর-কষাকষির লড়াইতে মালিকরাই বাড়তি সুবিধা ভোগ করবেন।    

ওয়েবডেস্কের পক্ষে অনুবাদঃ সৌভিক ঘোষ

ছবিঃ সোশ্যাল মিডিয়া


শেয়ার করুন

উত্তর দিন