কবিতা আছে, কাজের প্রশ্নে দিশাহারা বাজেট : চন্দন দাস

তোমরাই পারবে, তোমরা ছাত্র যৌবন/ নবান্নতে আসুক ধন-ধান্য-প্লাবন।’’ মমতা ব্যানার্জির কবিতা আছে এবারের রাজ্য বাজেটের শেষে। সেই কবিতার শেষদুটি লাইন এমনই। কিন্তু বাজেটে ছাত্র-যৌবনের প্রধান সমস্যার বিষয়ে কোনও দিশা নেই।
সেই প্রধান সমস্যা কর্মসংস্থানের। শুধু ছাত্র, যৌবনেরই নয়, রাজ্যের সবচেয়ে বড় সঙ্কট কাজের। কিন্তু রাজ্যের বাজেটে সেই সঙ্কট মেটানোর কোনও দিশা দেখাতে পারলেন না মমতা ব্যানার্জি।
করোনার পরে, ২০২২-র বাজেট পেশ করতে গিয়েও সরকার দাবি করেছিল, মহামারীর একবছরে তারা ৩০ লক্ষ কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেছিল। সেবার বাজেট পেশ করতে গিয়ে অর্থ দপ্তরের রাষ্ট্রমন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য ঘোষণা করেছিলেন,‘‘আগামী ৪ বছরে আমরা সরকারি ক্ষেত্রে, বেসরকারি ক্ষেত্রে এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে ও স্বনিযুক্তির মাধ্যমে ১.২০ কোটি নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করতে পারব।’’
২০২৩-র বাজেটে তার কোনও হিসাব ছিল না। এবার সেই কর্মসংস্থানের দাবিটুকুও রাখার সাহস দেখাতে পারেননি মমতা ব্যানার্জির সরকার! অথচ কাজের দাবিতে রাজ্য উত্তাল। ছাত্র, যুবরা কোচবিহার থেকে কলকাতা যে ইনসাফ যাত্রা করেছেন, তারও প্রধান দাবি ছিল কাজ। ব্রিগেডে ডিওয়াইএফআই’র বিরাট সমাবেশ থেকেও কাজের দাবিতে সোচ্চার হয়েছিলেন মানুষ। সেই কাজ প্রশ্নেই কোনও দিশা মমতা ব্যানার্জির বাজেটে নেই।


গত বাজেটে এবং বিগত বেশ কয়েক মাস দুটি প্রকল্পকে কর্মসংস্থানের উজ্বল প্রকল্প হিসাবে মমতা ব্যানার্জি ঘোষণা করে এসেছেন। একটি তাজপুরে বন্দর। দ্বিতীয়টি দেউচা পাঁচামীতে খোলামুখ কয়লা খনি। এবারের বাজেট থেকে তাজপুরে বন্দর প্রসঙ্গ স্রেফ উধাও। আর দেউচা পাঁচামী সম্পর্কে একটিই বাক্য— ‘এই এলাকায় প্রয়োজনীয় পরীক্ষামূলক খননকার্য সম্পন্ন হয়েছে।’
অর্থাৎ বিশ বাঁও জলে আগের ঘোষণা। কাজের সুযোগও প্রশ্নের মুখে।
বাজেটে কর্মসংস্থান সম্পর্কে একাধিক জায়গায় লেখা হয়েছে ‘লক্ষ লক্ষ’, ‘কয়েক লক্ষ’। কিন্তু ঠিক কত? কোথাও লেখা নেই। অথচ এর আগে বিভিন্ন বাজেটে বছরে কত কর্মসংস্থান হবে, তা ঘোষিত হয়েছে। পরের বছরের বাজেটে তার হিসাব দেয়নি সরকার। এবার অর্থমন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য এই রাস্তাতেই যাননি। লিখেছেন ওই ‘লক্ষ লক্ষ’, ‘কয়েক লক্ষ’ প্রভৃতি।
কতটা দিশাহীন সরকার কাজের প্রশ্নে? বাজেট বইয়ের এক জায়গায়, পৃষ্টা ৯-এ সরকার লিখেছে, ৬টি ইন্ডাস্ট্রিরিয়াল ও ইকোনমিক করিডর হবে এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাঙ্কের আর্থিক এবং কারিগরি সহায়তায়। ‘এই উদ্যোগে প্রভূত বিনিয়োগ এবং কয়েক লক্ষ কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হবে বলে প্রত্যাশিত’— সরকার লিখেছে। ‘প্রত্যাশিত’ মানে সরকার নিশ্চিত নয়, আশা করছে। অর্থাৎ প্রকল্পগুলিও নিশ্চিত নয়। নাহলে সরকার লেখে ‘প্রত্যাশিত’? এমন ধোঁয়াশা, আধা খ্যাচরা কথা অনেক জায়গায়।


কাজ কিংবা চাকরি সম্পর্কে একটিই ঘোষণা আছে বাজেটে। তাও সরাসরি চাকরির। সেটি হলো— ‘বিভিন্ন সরকারি দপ্তর এবং সরকার নিয়ন্ত্রিত সংস্থাগুলিতে ৫লক্ষ চাকরির ব্যবস্থা হবে।’ ঠিক তার আগেই তৃণমূল সরকার লিখছে,‘বিভিন্ন সরকারি দপ্তর এবং সরকার নিয়ন্ত্রিত সংস্থাগুলিতে সমস্ত খালি পদ পূরণ করার জন্য জরুরি ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
তাহলে কী রাজ্যে সরকারি দপ্তর এবং সরকার নিয়ন্ত্রিত সংস্থাগুলিতে শূন্যপদ ৫ লক্ষ? সরকার কোথাও তা স্বীকার করেনি। শুধু তাই নয়, নির্দিষ্ট করে ৫লক্ষ শূণ্যপদ বলা হয়েছে। তাহলে কোন দপ্তরে কত শূণ্যপদ পূরণ হবে, তা বাজেটে উল্লেখ করা প্রয়োজন। অন্তত সাংবাদিক সম্মেলনে তা জানানো দরকার। মুখ্যমন্ত্রী বাজেট পেশের পরে দীর্ঘক্ষণের একটি সাংবাদিক সম্মেলন করেছেন। অর্থমন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য বাজেট পড়েছেন অধিবেসনে। কেউ বলেননি কোন দপ্তরে কত পদ পরণ হবে।


প্রসঙ্গত, গত বারো বছরে বারবার সরকারি দপ্তরে এবং সরকার নিয়ন্ত্রিত সংস্থাগুলিতে শূণ্যপদে নিয়োগের দাবি করেছে সিপিআই(এম)। রাজ্য সরকার তেমন কোনও উদ্যোগ নেয়নি। পুলিশে কিছু নিয়োগ ছাড়া গত বারো বছরে রাজ্য সরকার স্থায়ী নিয়োগ হয়নি। এখন লোকসভা নির্বাচনের আগে সেই সব শূণ্যপদ পূরণের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন মমতা ব্যানার্জি।
মমতা ব্যানার্জি প্রতিবছর বিশ্ববঙ্গ সম্মেলন করেন। সর্বশেষ বিশ্ববঙ্গ সম্মেলন হয়েছে গত নভেম্বরে। তার আগে ৬টি এই ধরনের সম্মেলন রাজ্যে করেছে তৃণমূল সরকার। গত নভেম্বরের ৭ম সম্মেলনে রাজ্য সরকারের দাবি বিনিয়োগের প্রস্তাব এসেছিল ৩,৭৬,২৮৮কোটি টাকার। তার আগের সম্মেলনগুলি পর্যন্ত ঘোষিত বিনিয়োগের পরিমাণ আগে পর্যন্ত ১৩,৭২,৩২৯কোটি ২লক্ষ টাকার। শেষ পর্যন্ত কতগুলি শিল্প হয়েছে? বাজেটে একটি লাইন নেই। তাতে কত মানুষের কাজ হয়েছে? বাজেটে একটি লাইন লেখা হয়নি।


শেয়ার করুন

উত্তর দিন