National Inequality

জাতীয় অর্থনীতির হকিকতঃ গ্লোবাল ইনইক্যুয়ালিটি প্রতিবেদনের এক বছর

সৌভিক ঘোষ

অর্থনীতি হতে নীতিকে বাদ দেওয়ার প্রচেষ্টা আকস্মিক নয়। একসময় যা ছিল রাজনৈতিক অর্থনীতি, তারই জঠর থেকে অর্থনীতি, রাজনীতি এবং সমাজবিদ্যা বিষয়গুলির বিকাশ ঘটে। নয়া-উদারবাদ প্রথম থেকেই এদের আন্তঃসম্পর্কটি নষ্ট করতে চেয়েছে, দেখাতে চেয়েছে অর্থনীতির উপরে রাজনীতির কোন নির্ভরতা নেই, রাজনীতির প্রসঙ্গ ব্যাতিরেকেই সমাজনীতির বিকাশ সম্ভব। উদারনীতির তিন দশক পেরিয়ে ভারত সহ গোটা পৃথিবীর মেহনতি মানুষ নিজেদের দুর্দশাগ্রস্থ অভিজ্ঞতায় উপলব্ধি করছেন প্রাথমিক চক্রান্তই হল যেকোনো বিষয়কে অন্য বিষয়ের সাথে সম্পর্কহীন দেখানো। ‘টেক দ্য ম্যাটার অ্যাজ ইট ইজ’ – স্পষ্টই প্রতিক্রিয়ার দর্শন, অপবিজ্ঞান। একে আটকাতে প্রয়োজন যথার্থ দার্শনিক বিশ্বদৃষ্টিভঙ্গির – যা শেখায় ‘টেক দ্য ম্যাটার উইথ ইটস্‌ মোশন’। সেই আলোকেই বিচার করতে হয় সমাজের বিকাশ, মানুষের বিকাশের ইতিহাস এবং রাজনীতির প্রাণকেন্দ্র হিসাবে সক্রিয় অর্থনীতিকে।

আজকের ভারত

ভারতে ৯১’সালের পরের সময়কে নয়া-উদারবাদের যুগ বলে ধরা হয়। এই পর্বে ধারবাহিকভাবে কর্মসংস্থানের সুযোগ কমেছে। জাতীয় অর্থনীতিতে সংগঠিত শিল্প ক্ষেত্রের অবস্থা বুঝতে নেট ভ্যালু আডিশনের ধারণা প্রয়োগ করা হয়। যত মূল্যের উৎপাদন হল তাতে মজুরি ও মুনাফার অংশীদারিত্মের তুলনামূলক পরিসংখ্যানই এর মূল কথা। সেই তালিকায় দেখা যাচ্ছে ১৯৮১-৮২ সালে মজুরির খাতে ছিল ৩০ শতাংশ, ২০১৯-২০ সালে সেই অংশ কমে ১৮.৯ শতাংশে পরিণত হয়েছে। ঐ একই পর্বে মুনাফার হার ছিল ২৩.৪ শতাংশ, এখন সেই হার বেড়ে হয়েছে ৩৮ শতাংশের চাইতেও বেশি। পাঠককে মনে রাখতে হবে নয়া-উদারবাদের পক্ষে সবচাইতে বড় সমর্থন জোটে যে তথ্যে তা হল উৎপাদনের হার বৃদ্ধি। ১৯৯১-৯২ থেকে ২০১৯-২০ অর্থবর্ষে উৎপাদন বিপুল পরিমানে বেড়েছে একথা সত্য, তেমনই এই সত্যের সাথে যদি নেট ভ্যালু অ্যাডিশনের তালিকা সম্পৃক্ত করা হয় তাহলেই বোঝা যাবে এই গোটা পর্বে যে পথে অর্থনৈতিক উন্নয়ন হয়েছে তাকেই বলে ‘কাজ ছিনিয়ে নেওয়া উন্নয়ন’ (Job Loss Growth)।

জনমানসে অর্থনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে একটি প্রচলিত ধারণা হল যা চলছে এর থেকে খুব একটা আলাদা কিছু হওয়া সম্ভব নয়। এমন একটা অবসাদগ্রস্থ, দিশাহীন মনোভাবের প্রচারে আসলে কার লাভ –সেকথা বুঝতে বেগ পেতে হয় না। এই হতাশারই সরল বহিঃপ্রকাশ ঘটে সরকারের কিছুই করার নেই গোছের কথাবার্তায়। জেনে রাখা ভালো এই মুহূর্তে ভারতের গরীব জনগণকে প্রতি মাসে নগদ একুশ হাজার টাকা দিতে গেলে মোদী সরকারের বছরে ২৮.৮০ লক্ষ কোটি টাকার সংস্থান প্রয়োজন। অতি ধনী, ধনীদের উপরে ৭০’র দশকে প্রযোজ্য হারে বাড়তি কর (প্রোগ্রেসিভ ট্যাক্স) চাপিয়েই এই টাকাটুকু আদায় করা যায়, অথচ ২০২১ সালে কর্পোরেট কর আদায় হয়েছে মাত্র ৭.১৯ লক্ষ কোটি টাকা। দেশের সংগঠিত ক্ষেত্রে নেট অ্যাডেড ভ্যালুতে মজুরির অংশ কমছে, মুনাফা ক্রমশ বাড়ছে। অর্থাৎ ভারতে পুঁজিবাদী কর্পোরেট ব্যবস্থা যত দিন যাচ্ছে শ্রমিক-কর্মচারীদের সংখ্যা কমিয়ে বাকিদের উপরে বাড়তি কাজের বোঝা চাপিয়ে দিয়ে (অর্থাৎ উৎপাদন খরচ কমিয়ে) মুনাফা বাড়িয়ে নেওয়ার পন্থা নিয়েছে। এই পথ পুঁজিবাদের ইতিহাসে চিরায়ত কৌশল। আমাদের দুর্ভাগ্য, অতীতে ইউরোপের মাটিতে যেসকল কুকীর্তির জোরে পুঁজিবাদ আজ আন্তর্জাতিক লগ্নী-পূঁজির জামা গায়ে গলিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে, সেইসব পুরানো কৌশলই আমাদের দেশে নতুন অর্থনৈতিক বাস্তবতা বলে চিহ্নিত হয়।

২০২২ সালে গ্লোবাল ইনইক্যুয়ালিটি রিপোর্টে প্রকাশের সাথেই প্রধানমন্ত্রী মোদীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টামণ্ডলী ‘স্টেট অফ ইনইক্যুয়ালিটি ইন ইন্ডিয়া’ সংক্রান্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল। দেশের অবস্থা বিবেচনা করে গরীব দেশবাসীদের জন্য রাজকোষ নিরপেক্ষ সর্বজনীন ন্যুনতম রোজগার (ফিস্ক্যালি নিউট্রাল ইউনিভার্সাল বেসিক ইনকাম) প্রকল্প চালু করার পরামর্শ দেয় সংশ্লিষ্ট কমিটি। সেই প্রতিবেদনে উল্লেখ ছিল ভারতে শ্রমজীবী মানুষের সবচাইতে বড় অংশই (৪৫.৭৮%) স্বনিযুক্তি অথবা অসংগঠিত ক্ষেত্রে কর্মরত। এদের জন্য ন্যুনতম রোজগার সংক্রান্ত আইনই নেই। গত বছরের সমীক্ষায় উঠে এসেছিল অসংগঠিত ক্ষেত্রে কর্মরতদের গড় রোজগার মাসিক দশ হাজার টাকাও নয়। ঐ একই সময়ে দশ শতাংশ ধনীদের মোট সম্পত্তির পরিমাণ ছিল দেশের মোট সম্পদের তিন ভাগের একভাগ। এবছরের হিসাব এখনও সবটা স্পষ্ট না, শাস্ত্রীয় পরিভাষায় এমন অবস্থাকে বলা হয় সম্পদ অর্থাৎ পূঁজির কেন্দ্রীভবন (কনসেন্ট্রেশন অফ ক্যাপিটাল)। অবশ্য সেই লুট শুরু হয়েছে নয়া-উদারবাদের শুরুর দিন থেকেই, আজকের ভারতে উৎকট অসাম্য তিন দশক পেরিয়ে চলা লুটেরই ফল ভোগ করছে। দুর্দশা, বেকারি এবং মূল্যবৃদ্ধির পরিস্থিতি মোকাবিলায় দ্রুত পদক্ষেপ করতেই সর্বজনীন ন্যুনতম রোজগার প্রকল্পের সুপারিশ করে কেন্দ্রীয় মন্ত্রক।

২০১৭’র ইকোনমিক সার্ভে’তে প্রথমবার সর্বজনীন ন্যুনতম রোজগার প্রকল্পের কথা বলা হয়েছিল। তখন আইএমএফ’র তরফে প্রস্তাব দেওয়া হয় জনকল্যাণে (পেট্রোপণ্য এবং খাদ্যসামগ্রী) যাবতীয় ভর্তুকি খারিজ করে দিয়ে ন্যুনতম রোজগার প্রকল্প প্রণীত হোক। দেখা যাক ভারতের বর্তমান প্রেক্ষাপটে এমন প্রকল্পের প্রভাব কেমন হতে পারে।

আমাদের দেশে গম একটি অন্যতম খাদ্যশস্য, ফুড কর্পোরেশন অফ ইন্ডিয়াকে সেই জন্যই উৎপাদিত গমের সরকারী মজুত রাখতে হয় যাতে গণবণ্টন ব্যবস্থার মাধ্যমে বিলি করা যায়। শেষ কয়েকবছর ধরেই কেন্দ্রীয় খাদ্য মজুতভাণ্ডারে গমের পরিমাণ কমানো হয়েছে, গত বছর মজুতের পরিমাণ ছিল ৪৩.৩৪ মিলিয়ন টন; এবছর সেই লক্ষ্যমাত্রা আরও কমিয়ে হয়েছে ১৯.৫ মিলিয়ন টন। অর্থাৎ মোদী সরকার একদিকে সরাসরি ক্যাশ ট্র্যান্সফারের মাধ্যমে জনকল্যানের কথা বলে আরেকদিকে গরীব মানুষকেই ক্রমাগত সরকারী প্রকল্পের বাইরে ঠেলে দিচ্ছে। এই অবস্থায় আইএমএফ’র সুপারিশ মেনে যাবতীয় ভর্তুকি বাতিল করে দিয়ে সর্বজনীন ন্যুনতম রোজগার প্রকল্পের অর্থ দেশের জনসাধারণের অর্জিত অধিকারগুলিকেই সরাসরি অস্বীকার করা। ১৯৯১ থেকে ২০১৯ অবধি সময়কালে গড় বেকারির হার ৫ থেকে ৫.৫ শতাংশের মাঝে বেড়েছে কমেছে। করোনা সংক্রমণ জনিত মহামারীর প্রভাবে এবং তার মোকাবিলার নামে আকস্মিক লকডাউন ঘোষণায় ভারতের বেকারির হার আরও বেড়ে দাঁড়ায় প্রায় ৮.১০ শতাংশ। এই একই সময়কালে উৎপাদনে শ্রমশক্তির অংশ কমেছে নিয়মিত, ২০২১ সালের হিসাবে সেই অংশগ্রহণ নেমে এসেছে ৪০ শতাংশে - ১৯৯১ সালে যা ছিল ৫৮ শতাংশেরও বেশি। বুনিয়াদি অর্থনীতিতে যাকে প্রোডাকশন পসিবিলিটি ফ্রন্টিয়ার বলে, সেই লেখচিত্র থেকে ছাত্রছাত্রীরা যা শেখে সেই সবকিছুই ভুল প্রমান করে দিচ্ছে আজকের ভারত।

দুটি বিষয় স্পষ্ট। প্রথম, ভারতে ক্রমবর্ধমান বেকারত্মের কারণ আর শুধু অ-শিক্ষা নয় (সংশ্লিষ্ট সময়কালে শিক্ষিত, কর্মক্ষম বেকার সম্পর্কে সরকারী প্রতিবেদনেই তার প্রমান পাওয়া যাবে)। এই কর্মহীনতার প্রধান কারণ ক্রমবর্ধমান মুনাফা (সুপার প্রফিট) নির্ভর আন্তর্জাতিক লগ্নী পুঁজি নিয়ন্ত্রিত নয়া-উদারবাদ। নয়া-উদারবাদ কাজের সুযোগ কিছুতেই বাড়ায় না (বিনিয়োগ এলেই কর্মসংস্থান বাড়বে বলে প্রচার করে এফআইআই’র রাস্তা পরিস্কার করা হয়), বরং জনজীবনকে আরও দুর্দশার দিকে পৌঁছে দেয়। বর্ধিত বেকারত্ম বাজারে চাহিদার ঘাটতি তৈরি করে, এর জবাবে পুঁজিবাদ মূল্যবৃদ্ধি ঘটায়। ফলে বেকারি ও মূল্যবৃদ্ধি একে অন্যকে চক্রাকার পথে বাড়িয়েই চলে। যোগান বাড়িয়ে চাহিদার ঘাটতি জনিত সমস্যার সমাধান হয় না। এমন চলতে থাকলে এক নৈরাজ্যের পরিস্থিতি গড়ে ওঠে যার মোকাবিলায় একমাত্র সঠিক পদক্ষেপ পরিকাঠামো (শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পরিবহন ইত্যাদি) খাতে সরকারী ব্যয়বরাদ্দ বৃদ্ধি সহ যাবতীয় নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যসামগ্রীর দাম নিয়ন্ত্রণ অর্থাৎ সেইসবকিছুকেই সরকারী গণবণ্টনের আওতাধীন করা। প্রয়োজনে বিনামূল্যে খাদ্যসামগ্রী বিলি করতে হয়।

দ্বিতীয়, পূঁজির সাথে শ্রমশক্তির দ্বন্দ্ব বৃদ্ধি পাচ্ছে। গোটা ব্যবস্থাই যখন বাজার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত এবং নীতি হল নয়া-উদারবাদ তখন পুঁজি বিনিয়োগের উদ্দেশ্য একমাত্র মুনাফা, উৎপাদন নয়। এই কারনেই লকডাউনের সময় উৎপাদন না করেও (যখন কাজ হারানোর জন্য লক্ষ লক্ষ মানুষ চরম দুর্ভোগের শিকার হচ্ছেন) বিরাট মুনাফা করেছে দেশের কর্পোরেটরা। শেয়ার বাজার কোন দেশেরই অর্থনীতির হকিকত দেখাবে না, যা দেখায় তা কণামাত্র উৎপাদন না করেও বিপুল মুনাফা করে নেওয়ার খেলা ছাড়া আর কিছুই নয়। এই বিপুল মুনাফা নিশ্চিত করতেই সরকারী নীতিতে এমনসব পরিবর্তন করা হয় যাতে জনসাধারণ নিজেদের ভবিষ্যতের জন্য ব্যংকে টাকা জমা না রেখে বাজারের ঝুঁকি মাথায় নিয়েই বিনিয়োগে বাধ্য হন। সেই বিপুল বিনিয়োগে বাজার ফুলে ওঠে, প্রচার চলে সুদিন সমাগত। একটা নির্দিষ্ট সময় এলে স্বাভাবিক কারনেই এহেন উন্নয়নের বুদবুদ ফেটে গেলে জনসাধারণ ‘রক্ত জল করা পয়সা কোথায় গেল’ খুঁজতে থাকেন এবং পুঁজি নিজের ডিভিডেন্ড পকেটে পুরে উধাও হয়ে যায়। আমাদের দেশের রিজার্ভ ব্যাংক সরকারী ইচ্ছার বিরুদ্ধে নিজেদের স্বতন্ত্র অবস্থানে এখনো কিছুটা দৃঢ় রয়েছে বলেই সংকটে থাকাকালীন শ্রীলঙ্কার মতো এদেশের মানুষকে ২৫০টাকায় একটি পাঁউরুটি কিনতে হয়নি। ব্যংকের সুদ, পেনশন, গ্র্যাচ্যুইটি, এলআইসি সহ সংবিধানসম্মত শ্রমআইন অবধি যাবতীয় সুরক্ষাকবচ তুলে দিতে মোদী সরকারের ব্যাগ্র মনোভাবের কারণ বুঝতে খুব পণ্ডিত হতে হয় না।

আজকের অর্থনীতি

আজকের মূল্যবৃদ্ধির কারণ বুঝতে কারোর অসুবিধা হলে অতীতের কিছু তথ্যে মনোনিবেশ করা জরুরী। ২০০১ পরবর্তী সময়ে আমাদের দেশে কৃষিকাজে লাভ ক্রমাগত কমতে থাকে। ঐ একই সময়ে বড় বড় কর্পোরেট সংস্থাগুলি কৃষিক্ষেত্রে বাণিজ্য বিস্তার করতে শুরু করে। কৃষিকাজে জরুরী সামগ্রীর (চাষের বীজ, সার, বিদ্যুৎ, জল এবং সবশেষে ফসলের ন্যায্য বিক্রয়মূল্য) দামে সরকারী নিয়ন্ত্রণ শিথিল করা থেকে সেই চক্রান্ত শুরু হয়েছে। ভারতে শ্রমজীবী জনগণের বেশিরভাগই কৃষিকাজে যুক্ত ছিল, চাষের কাজ ক্রমাগত লোকসানে যেতে থাকলে এরাই দল বেঁধে কাজের খোঁজে শহরে চলে আসতে থাকে। প্রয়োজন ছিল সরকারী মান্ডি ব্যবস্থার যথার্থ সম্প্রসারণ (স্বামিনাথন কমিশনের সুপারিশ), প্রয়োজন ছিল ফসলের ন্যায্য দাম নির্ধারণে বিজ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতির প্রয়োগ (সি টু + ৫০ %) এবং একইসঙ্গে দেশুজূড়ে গণবণ্টন ব্যবস্থাকে আরও শক্তিশালী করা। আয়কর সীমার বাইরে থাকা পরিবারগুলির হাতে ন্যুনতম অর্থ ক্যাশ ট্রান্সফার করার দরকার ছিল। গ্রামাঞ্চলে রোজগার প্রকল্প (এমএনরেগা)-কে আরও বাড়ানোর (দুশো দিনের কাজের দাবী রয়েছে) একইসঙ্গে শহরাঞ্চলেও উপযুক্ত কর্মসংস্থান প্রকল্প প্রণয়ন। এছাড়া গ্রামীণ শ্রমজীবী জনতার শহর অভিমুখে অভিবাসন (মাইগ্রেশন) আটকানো যায় না, চাহিদার সংকট মোকাবিলা করা যায় না, মূল্যবৃদ্ধি রোখা যায় না।

মোদী সরকার এসবের একটিও করেনি। কারণ এসবই নয়া-উদারবাদের স্বার্থের পরিপন্থী পদক্ষেপ, যাদের পয়সায় ভোট জিতে এরা ক্ষমতায় এসেছে তাদের মুনাফা লুটে নেওয়ার সুযোগ দেওয়াই কেন্দ্রীয় সরকারের অর্থনীতি। সেই উদ্দেশ্যেই সরকারী ভান্ডারের খাদ্যসামগ্রীর মজুত ক্রমশ কমে, আর ন্যাশনাল মানিটাইজেশন পাইপলাইনের নাম করে নির্দিষ্ট কতিপয় কর্পোরেট সংস্থাসমূহকেই দেশের যাবতীয় সম্পদ বিক্রি করে দেওয়া হয়। এই প্রেক্ষিতেই নয়া কৃষি আইনকে বিবেচনা করতে হয়। যদিও ব্যাপক জনগণের প্রতিরোধের মুখে পড়ে মোদী সরকারকে সেই সিদ্ধান্ত রুপায়ন থেকে পিছিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছে। এ ছিল এক ঐতিহাসিক শিক্ষার পুনর্পাঠ। সংসদ যখন কর্পোরেটদের স্বার্থ দেখতেই ব্যস্ত তখন উত্তাল রাজপথ সরকারকে মনে করিয়ে দিল- গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সরকার জনগণের প্রতিনিধি, প্রভু না।

নয়া কৃষি আইনের প্রসঙ্গে বিপদটি ছিল সেখানেই। বেকারি এবং মূল্যবৃদ্ধির সমস্যা যত ভয়াবহ চেহারা নিচ্ছে, তার সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে মুনাফার পরিমাণ। গ্লোবাল ইনইক্যুয়ালিটি সম্পর্কিত প্রতিবেদনে ছিল আমাদের দেশে নিম্নতম আয় করেন এমন মানুষ মোট জনসংখ্যার অর্ধেকেরও বেশি। যদি অর্ধেকও ধরে নেওয়া হয় তবে তাদের অবস্থা কেমন? পারচেজিং পাওয়ার প্যারিটি হল এমনই উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত এক আন্তর্জাতিক সূচক। সহজ কথায় কিছু নিত্য প্রয়োজনীয় অভিন্ন সামগ্রীর একটি গাঁটরি (যেমনটা কোভিডের সময় রেড ভলান্টিয়ারদের উদ্যোগে বাড়িতে বাড়িতে বিলি করা হয়) কোন দেশে কত টাকায় বিকোয়।

এই সূচকের মাধ্যমে বোঝা যায় কোনও একটি দেশে উপযুক্ত জীবনমান বজায় রাখতে ন্যুনতম আর্থিক মূল্য হিসাবে জনসাধারণকে কত খরচ করতে হচ্ছে। আবার বিভিন্ন মুদ্রার (কারেন্সির) তুলনামূলক মূল্যও এর দ্বারা নির্ধারিত হয় (যেমন ডলারের সাথে ভারতীয় টাকার মূল্যের অনুপাত)। আমাদের দেশে একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষের ক্ষেত্রে সেই সূচক এক বছরের জন্য ৫৩৬১০ টাকা। অর্থাৎ দুইজন কর্মক্ষম ব্যক্তি সহ দুটি শিশু অথবা কম বয়সী সদস্য রয়েছে এমন একটি পরিবারের ন্যুনতম মাসকাবারি ব্যয় হয় ৮৯৩৫ টাকা। লকডাউন শুরুর দিন থেকে বামেরা সহ বিভিন্ন অর্থনীতিবিদ এবং বিশিষ্টজনেরা এই কারনেই ন্যুনতম ৭৫০০ টাকা মাসিক ক্যাশ ট্রান্সফারের দাবী জানিয়ে এসেছিলেন। সহজ হিসাব হলেও কেউ শোনেনি।

২০১৭ সালে কেন্দ্রীয় পে-কমিশনের সুপারিশ ছিল ন্যুনতম মজুরির পরিমাণ হতে হবে মাসিক ১৮০০০ টাকা, যার সাথে যুক্ত হবে সময়োপযোগী ‘ডিয়ারনেস অ্যালাউন্স’ যা মূল্যবৃদ্ধিজনিত সংকটের সমাধান করবে (প্রাপ্য ডিএ সম্পর্কে পশ্চিমবঙ্গ সরকার বনাম রাজ্য সরকারী কর্মচারীদের মামলা এক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক)। এটুকু জানলেই স্পষ্ট হয় দেশের অর্ধেকের বেশি মানুষ কি অবস্থায় দিন গুজরান করছেন। এমন অবস্থাতেও মোদী সরকার ভর্তুকি তুলে দিতে চায়, নিয়ন্ত্রণহীন করতে চায় খাদ্যসামগ্রীর দাম। এরই নাম মোদীনমিক্স। আগের অনুচ্ছেদে উল্লিখিত বিপদটি হল এই মিক্সেরই নিশ্চিত ফলাফল।

কেউ প্রশ্ন তুলতে পারেন কোভিড এবং লকডাউনের জন্য উৎপাদন এবং কর্মসংস্থানের অবস্থা যখন বেহাল সেই অবস্থায় কর্পোরেট সংস্থাগুলি বিপুল মুনাফা করছে কি করে? এই প্রসঙ্গেই কর্পোরেট কর ছাড়ের বিষয়টি চলে আসে। উৎপাদন বন্ধ থাকার (আসলে বন্ধ রাখার) অজুহাতে কর্পোরেটদের ১.৪৫ লক্ষ কোটি টাকার কর ছাড় দিয়েছে মোদী সরকার, একইসাথে মূল্যবৃদ্ধি এবং কাজ হারানোর হিসাবকে যুক্ত করলে বিপুল মুনাফার উৎস সন্ধানে সময় লাগে না। সাধারণভাবে পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে উৎপাদনকে দুটি ক্ষেত্রে ভাগ করা যায়, একটি শ্রমনিবিড় আরেকটি অপেক্ষাকৃত কম শ্রমনির্ভর। আমরা জানি উদ্বৃত্ত মুল্য তৈরি করে উৎপাদন খরচের পরিবর্তনশীল অংশটি অর্থাৎ মূলত মজুরি। তাহলে উৎপাদন বন্ধ থেকেও মুনাফার নামে হচ্ছেটা কি? এহেন বন্দোবস্তের জোরেই ভারতে শেষ দুবছরেই নতুন বিলিওনেয়ার তৈরি হয়েছে। আরও একটি বিষয় রয়েছে, অতিরিক্ত বিনিয়োগ প্রয়োজন হয় এমনসব উৎপাদন খরচের প্রাথমিক চাপটি থাকে মূলত স্থির পূঁজি (কাঁচামাল, মেশিন ইত্যাদি সহ পরিকাঠামো)-তে। অপেক্ষাকৃত কম বিনিয়োগ লাগে এমন উৎপাদনে শ্রমশক্তির অংশগ্রহণই বেশি হয়। বাজারে যাবতীয় পণ্যেরই দাম নির্ধারিত হয় উৎপাদন খরচের সাথে গড় মুনাফা যুক্ত হয়ে। এই অবস্থায় উচ্চ মূল্যের বিনিয়োগ প্রয়োজন এমন শিল্পক্ষেত্রের তুলনায় শ্রমনিবিড় উৎপাদনে উদ্বৃত্ত সম্পদ তৈরি হয় অনেক বেশি কিন্তু গড় মুনাফা পণ্য নিরপেক্ষ বলে  উৎপাদন খরচের তারতম্যের জন্য দ্বিতীয় ধরনের পণ্যের (শ্রমনিবিড় উৎপাদন) বিক্রয়মুল্য হয়ে পড়ে কম। একদিকে উৎপাদনের স্বাভাবিক সময়ে (লকডাউন পূর্ব) চুরি করা বিপুল পরিমাণ উদ্বৃত্ত মুল্য (অ্যাবসল্যুট সারপ্লাস) দখলে রইল, পরে লকডাউনের কারনে উৎপাদন বন্ধ রেখে মুজুরির খরচ বাঁচিয়ে চড়া দামে উৎপাদিত পণ্য বিক্রি করে বিপুল মুনাফা লুটে নেওয়া হল। ছোটখাটো সংস্থাগুলি (স্বনিযুক্তি এবং অসংগঠিত ক্ষেত্র) যেখানে পাঁচজনের বেশি কর্মচারী নেই, মালিক নিজেই শ্রমিক হিসাবে কর্মরত - বাজারের নিয়মের সাথে পাল্লা দিতে পারেন না, তাদের গিলে খেয়ে নেয় বড় কর্পোরেটরা। সুতরাং বাজারী গণতন্ত্রে যতই সমান সুযোগ বলে গলা ফাটিয়ে ফেলা হোক না কেন আখেরে এই ব্যবস্থায় ক্রমাগত পূঁজির কেন্দ্রীভবন ঘটে, বাজার দখল করে কতিপয় সংস্থা যারা ‘আলপিন টু এলিফ্যান্ট’ সবকিছুই ‘সাপ্লাই’ করে। দেশের প্রায় ৯৪শতাংশ শ্রমজীবী জনসাধারণ অসংগঠিত ক্ষেত্রে মাসিক ১০ হাজার টাকারও কম রোজগারে বেঁচে থাকতে বাধ্য হচ্ছেন, ঠিক তখনই বিকেন্দ্রিত উৎপাদন কৌশলের (থার্ড পার্টি সাপ্লায়ার, কন্ট্র্যাক্ট বেইজড প্রোডাকশন এবং হাল ফ্যাশনের ওয়ার্ক ফর্ম হোম) মাধ্যমে সারা দেশের যাবতীয় ক্ষুদ্র উৎপাদনকে নিজেদের দখলে নিয়ে আসছে কর্পোরেটরা। অর্থাৎ সরাসরি নির্দিষ্ট কোন মালিকের ছাতার তলায় কাজ না করেও শ্রেণি হিসাবে ভারতের শ্রমিকরা চরমভাবে শোষিত হচ্ছেন – কর্পোরেট পূঁজির জাঁতাকলে।

১৮৬৭ সালে প্রকাশিত হয় একটি বই -ক্যাপিটাল। তাও প্রথম খণ্ড, বাকি দুই খণ্ড লেখকের জীবদ্দশায় ছেপে বের করা যায়নি। এখনও সেই বইতে বর্ণিত শোষণের কায়দাগুলির থেকে নতুন কিছু করে উঠতে পারে নি পুঁজিবাদ। নাম বদলে লুটকে লুট বলে চিনতে না দেওয়ার উদ্দেশ্যে বলা হচ্ছে ‘গিগ ইকোনমি’ – আসলে লুঠেরা পুঁজিবাদ। দুনিয়াজূড়ে অসাম্যের বর্তমান মূল্যমান অতীতে ঔপনিবেশিক জমানায় লুঠতরাজ চালিয়ে অর্জিত মুনাফার পর্যায়ে উন্নিত হয়েছে। এক বছর আগের গ্লোবাল ইনইক্যুয়ালিটি রিপোর্টে যা চলছে তাকে ‘অর্থনৈতিক সন্ত্রাস’ বলা হয়েছে – তবু নাকি মেনে নিতে হবে আজকের পৃথিবীতে সাম্রাজ্যবাদ বলে কিছু নেই।

মুক্তির পথ

খাদ্য সুরক্ষা, উপযুক্ত সরকারী শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য পরিষেবা কোন দয়ার দান নয়, কোন মহামারী জনিত সাময়িক পরিকল্পনাও নয়, এগুলি হল দেশের শ্রমজীবী জনসাধারণের দীর্ঘ লড়াইয়ে অর্জিত অধিকার। তাই যথোপযুক্তরূপে সম্প্রসারিত গণবণ্টন ব্যবস্থা চাই, সর্বজনীন সুলভ স্বাস্থ্য পরিষেবা চাইবার সাথেই সমস্ত কাজে ন্যুনতম মজুরিকে সর্বজনীন বন্দোবস্তের আওতাধীন করার দাবী উঠছে। ইন্ডিয়ান লেবর কনফারেন্স সেই লড়াইতে জরুরী গাইডলাইন প্রস্তুত করেছে। শ্রমের প্রত্যেক ক্ষেত্রে শোষণ-নিপীড়নের কায়দা আলাদা, কিন্তু শোষণের চরিত্র একই। সংগঠিত হোক কিংবা অসংগঠিত ক্ষেত্র, লড়াই হবে কাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে কর্মরতদের নিজেদের মতো করে, আবার সবটা মিলিয়ে একসাথেও। লুঠেরা শাসকের বিরুদ্ধে ন্যায্য অর্থনৈতিক দাবী দিয়ে শুরু হয়ে, দেশের ক্ষমতায় বসে থাকা অপদার্থ মোদী সরকারকে উৎখাত করা অবধি লড়াই চলবে এবং সবশেষে লুটের ব্যবস্থাটাকে উচ্ছেদ করে তবে সেই লড়াই শেষ হবে। এই অবস্থানে অনড় থাকাই আজকের ভারতে বিকল্প রাজনীতির বুনিয়াদ।

ভারতে শ্রমিকশ্রেণি নিজের অভিজ্ঞতায় বুঝে নিয়েছেন শত্রুকে পরাজিত করতে হলে ‘ওদের প্রত্যেককেই এক এক করে আমাদের দশজনের বিরুদ্ধে লড়তে বাধ্য করতে হবে’। এটাকেই রণকৌশল বলে। হ্যাঁ, শ্রেণিবিভক্ত সমাজে যতদিন শোষক – শোষিত থাকবে ততদিনই ওরা-আমরাও থাকবে।    


শেয়ার করুন

উত্তর দিন