Prabhat GDP 14.05.24 Cover

Fetishizing the Growth Rate of GDP

প্রভাত পট্টনায়েক

‘জন স্টুয়ার্ট মিল’ ছিলেন আধুনিক সময়ের অগ্রগণ্য উদারনৈতিক চিন্তাবিদদের মধ্যে একজন, যিনি অর্থনীতি এবং দর্শনের উপর প্রচুর লিখেছেন। যদিও তার স্ত্রী হ্যারিয়েট টেলর মিলের প্রভাবে, তিনি তার জীবনের শেষ দিকে সমাজতান্ত্রিক মনোভাবের কাছাকাছি এসেছিলেন, কিন্তু, যা তাকে আকৃষ্ট করেছিল সেটি ছিল এক ধরনের সহযোগিতামূলক সমাজতন্ত্র (cooperative socialism) মাত্র; তিনি প্রধানতঃ একজন প্রখ্যাত উদার চিন্তাবিদ হিসাবেই বিবেচিত হন। মিলের সময়ের অর্থনীতিবিদরা একটি স্থিতাবস্থা, অর্থনৈতিক স্থবিরতা (যেখানে আর কোনও পুঁজি-র সঞ্চয় হবে না) বা বৃদ্ধির হার শূন্য হয়ে যাবার আসন্নতার ভয়ে আতঙ্কিত ছিলেন। মিল অবশ্য মনে করতেন ‘শুধুমাত্র উৎপাদন বৃদ্ধির’ পরিবর্তে ‘উন্নত বন্টন এবং শ্রমের বড় পারিশ্রমিকের প্রতি মনোযোগ দেওয়া উচিত’। ঊনবিংশ শতাব্দীর একজন উদারচিন্তকের এই অবস্থানের সাথে আজকে আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান এবং জাতীয় (ভারত সরকার সহ) সরকারগুলির একটি ‘সংগঠিত ব্যুহ’-র বক্তব্যের তুলনা করুন, যারা জিডিপি বৃদ্ধির সাথে ক্রমবর্ধমান দারিদ্র্যের অপ্রতিরোধ্য প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও, জিডিপি বৃদ্ধির উপর জোর দেয়, অর্থাৎ, প্রাথমিক উদ্দেশ্য হিসাবে ‘উন্নত বন্টন এবং শ্রমের বৃহৎ পারিশ্রমিক’-র পরিবর্তে ‘নিছক উৎপাদন বৃদ্ধি’কেই বেশী গুরুত্বপূর্ণ মনে করে। একটা সময় ছিল, যখন আমাদের মতো দেশে বেকারত্ব ও দারিদ্র্য দূরীকরণের জন্য জিডিপি-র উচ্চ বৃদ্ধির হার প্রয়োজনীয় বলে বিবেচিত হত, তাতে করে, ‘নিছক উৎপাদন বৃদ্ধি’ এবং ‘শ্রমের বড় পারিশ্রমিক’ এর মধ্যে কোনো অনুভূত দ্বন্দ্বের কথাই ছেড়ে দিন, কোনো পার্থক্যও করা হয়নি। বেশী জিডিপি বৃদ্ধি-র পক্ষে এই যুক্তি ছিল যে, এটা কর্মসংস্থান বৃদ্ধির হার বাড়াবে, যা শ্রমের মজুদ ভান্ডারের আপেক্ষিক আকারকে হ্রাস করবে, শ্রমবাজারে সন্নিবিষ্টতা/নিবিড়তা তৈরি করবে এবং প্রকৃত মজুরির হার বাড়াবে। এমনকি যদি প্রকৃত মজুরির হার (এই ধরনের ক্ষেত্রে) শ্রম উৎপাদনশীলতার মতো দ্রুত বৃদ্ধি না পায়, তবে এটি অবশ্যই শ্রম উৎপাদনশীলতার তুলনায় দ্রুততর বৃদ্ধি পাবে; যে কোনো হারে, জিডিপির দ্রুত বৃদ্ধি শ্রমিকদের অবস্থা আরও ভালো করে তুলবে, উভয় ক্ষেত্রেই বেকারত্ব হ্রাস পাবে এবং প্রকৃত মজুরি বৃদ্ধি করবে।

যদিও এই যুক্তির কোন সারবত্তা নেই। GDP বৃদ্ধির একটি নির্দিষ্ট হারের সাথে কর্মসংস্থানের বৃদ্ধির হার নির্ভর করে  সেই বৃদ্ধির প্রক্রিয়ার প্রকৃতি-র উপর। এবং এই বৃদ্ধি কোন ধরণের পণ্য ও সেক্টরের জন্য, বা কোন শ্রেণীর চাহিদাপূরণের জন্য বৃদ্ধি হচ্ছে তার উপর নির্ভশীল। জিডিপি-র বৃদ্ধি যদি কৃষি এবং ক্ষুদ্র উৎপাদনের মতো সেক্টর দ্বারা চালিত হয় তবে এর কর্মসংস্থান সৃষ্টিকারী প্রভাবগুলি যথেষ্ট উল্লেখযোগ্য হবে। কিন্তু একটি নব্য-উদারনৈতিক অর্থনীতিতে, যেখানে শাসনব্যবস্থার প্রকৃতি এমন যে কৃষি এবং ক্ষুদ্র উৎপাদন একটি বহুবর্ষজীবী সঙ্কটে আক্রান্ত, সেখানে এই জিডিপি বৃদ্ধির অভিমুখ সাধারণত সেসব খাতেই থাকে যেগুলো আন্তর্জাতিক বাজারের চাহিদা এবং অর্থনৈতিক মুনাফার থেকে যারা বেঁচে থাকে তাদের ভোগের চাহিদা পূরণ করে। এগুলি এমন সেক্টর, যেখানে কর্মসংস্থানের তীব্রতা কম এবং ক্রমাগত পণ্যের উদ্ভাবনের মাধ্যমে হ্রাস পেতে থাকে। একটি নব্য-উদারবাদী শাসনের মধ্যে জিডিপি বৃদ্ধির উচ্চ হার তাই খুব কমই কর্মসংস্থানের বৃদ্ধি ঘটায়; বা, যাকে আউটপুট এবং সম্পর্কিত কর্মসংস্থানের সম্পর্কের স্থিতিস্থাপকতা বলা হয়, অর্থাৎ, কর্মসংস্থানের শতাংশ পরিবর্তন যা আউটপুটে ১ শতাংশ পরিবর্তনের সাথে থাকে, তা খুবই কম, এমনকি শূন্যের কাছাকাছি (যাকে প্রায়শই ‘Jobless Growth’ হিসাবে উল্লেখ করা হয়)। আরও বলা যায়, আউটপুট বৃদ্ধির হার বৃদ্ধির সাথে সাথে কর্মসংস্থানের পরিলক্ষিত স্থিতিস্থাপকতা হ্রাস পায়, যাতে উচ্চতর জিডিপি বৃদ্ধি, কর্মসংস্থান বৃদ্ধি-র ক্ষেত্রে শুধুমাত্র অতিক্ষুদ্র পরিমাণ বৃদ্ধি নিয়ে আসে।

যেহেতু জনসংখ্যা, এবং তার সাথে শ্রমশক্তিও, ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে, নব্য উদারনীতিবাদের অধীনে জিডিপি বৃদ্ধির হারের সাথে কর্মসংস্থানের বৃদ্ধির হার এত কম যে এটি শ্রমশক্তির বৃদ্ধির হারের নিচে নেমে আসে এবং এমন একটা অবস্থায় শ্রমের রিজার্ভের আপেক্ষিক আকারে হ্রাস নয় বরং এই আপেক্ষিক আকার বৃদ্ধি পায়। এই ধরনের ক্ষেত্রে মজুরির হার খুব কমই বৃদ্ধি পায়, ফলে জনপ্রতি কম কর্মসংস্থান, কর্মরত জনসংখ্যাকে ক্রমাগত অভাবের দিকে ঠেলে নিয়ে যায়।

ভারতীয় অর্থনীতির ক্ষেত্রেও ঠিক এমনটাই হচ্ছে। যদিও ভারতবর্ষ বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতির মধ্যে একটি বলে জানা গেছে, সেখানে কিন্তু এই নয়া-উদারবাদী অর্থনৈতিক যুগে, পরম দারিদ্র্যের মধ্যে বসবাসকারী জনসংখ্যার অনুপাত, ক্রমশঃই বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশেষ করে ‘মোদি যুগ’-এর সময়ে যখন নব্য উদারনীতি তার সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।

তাই এই প্রেক্ষাপটে দুটি প্রশ্ন জাগে:- প্রথমতঃ, জে.এস.মিলের মতো একজন উদারপন্থী চিন্তাবিদও যে বিষয়গুলির উপর ‘মনোযোগ দেওয়া উচিৎ’ বলে বিবেচনা করেছিলেন সেদিকে মনোযোগ না দিয়ে কেন সরকারগুলি এখনও জিডিপি বৃদ্ধির হারের উপর জোর দিচ্ছে? দ্বিতীয়তঃ, আমরা কীভাবে উচ্চ জিডিপি বৃদ্ধির হার ব্যাখ্যা করব যখন শুধু আয় বৈষম্য নয়, এমনকি দারিদ্র্যও বাড়ছে, এবং যেহেতু এই ধরনের ক্রমবর্ধমান বঞ্চনা, সামগ্রিক চাহিদার সংকোচনের কারণ হওয়া উচিত এবং তাই বৃদ্ধি বন্ধ হয়ে যাওয়া উচিত?

প্রথম প্রশ্নের সহজ উত্তর হল ‘নব্য উদারতাবাদ’ জে.এস.মিল-এর মতো, ‘উন্নত বন্টন এবং ‘শ্রমের বড় পারিশ্রমিক’-র প্রতি মনোযোগ দেওয়া উচিত’-এই দর্শন মেনে নেয় না। রাষ্ট্রকে তার ‘শ্রমের জন্য বড় আকারের পারিশ্রমিক’ অর্জনের জন্য একটি হস্তক্ষেপকারী ভূমিকার পরিবর্তে তাকে দেশের সীমানা জুড়ে অর্থ সহ পণ্য ও পরিষেবা এবং পুঁজির তুলনামূলকভাবে সীমাবদ্ধ চলাচলের জন্য একটি ব্যবস্থা হিসাবেই চিহ্নিত করা হয়েছে এবং তাই পুঁজির জন্য একটি সহায়ক ভূমিকায় রাষ্ট্রকে পরিণত করা হয়েছে। আসলে নব্য-উদারবাদ ঘৃণা করে মিলের মতবাদকেই কারণ শ্রমের পক্ষে রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপকে বৈধতা দেবার মতন যে কোনও মতবাদই নব্য-উদারবাদের পরিপন্থী। তাই নব্য-উদারবাদী রাষ্ট্রে সবসময়েই প্রচার করে যে পুঁজির স্বাধীনতা প্রদানের মাধ্যমে (সাধারণত রাষ্ট্রকে পুঁজির স্বার্থের প্রচার করার জন্য), এবং একমাত্র উচ্চ জিডিপি বৃদ্ধির মাধ্যমেই অন্যান্য সমস্ত জণকল্যাণ স্বয়ংক্রিয়ভাবে অর্জিত হবে। বিষয়টি ঐ বক্তব্য সত্য কি মিথ্যা তা নিয়ে নয় (যদিও ওটি সর্বাঙ্গীণ মিথ্যা); মোদ্দা কথা হল, এটা নয়া-উদারবাদী পুঁজিবাদের মূল আদর্শ। ভারত সরকার, আই.এম.এফ এবং বিশ্বব্যাঙ্কের মতো সংস্থাগুলি এই মতাদর্শেই চলে।

দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তর হল যে জিডিপি বৃদ্ধির হার প্রকৃতপক্ষে বৈষম্য ও দারিদ্র্য বৃদ্ধির দ্বারা প্রভাবিত হয়। “নব্য-উদারনীতিবাদ দ্রুত ক্রমবর্ধমান আয় বৈষম্যের কারণে, যেটা সামগ্রিক চাহিদার বৃদ্ধিকে শ্বাসরুদ্ধ করে দিয়েছে এবং অতিরিক্ত-উৎপাদন এর দিকে একটি প্রবণতা তৈরি করেছে, বলা যায় অর্থনৈতিক বৃদ্ধি একটি শেষ সীমায় চলে গেছে” এটি কেবল বিশ্ব অর্থনীতির স্তরেই সত্য নয়, ভারতীয় অর্থনীতির ক্ষেত্রেও এটা সত্য।

যাই হোক না কেন, প্রাক্তন প্রধান অর্থনৈতিক উপদেষ্টা অরবিন্দ সুব্রামানিয়ান থেকে শুরু করে অশোক মোদি, দেশের প্রাক্তন প্রধান পরিসংখ্যানবিদ প্রণব সেন পর্যন্ত লেখকেরা একটি সম্পূর্ণ বিষয়ে একমত যে ভারতের জিডিপি বৃদ্ধির হার উল্লেখযোগ্যভাবে অতিরিক্ত অনুমান করা হয়েছে। তারা এই অত্যধিক মূল্যায়নের জন্য বিভিন্ন কারণ উল্লেখ করেছে এবং প্রতিটি কারণের যথেষ্ট প্রমাণাদি রয়েছে; তাই অত্যধিক মূল্যায়নের সত্যটি একদমই বিতর্কিত নয়। তবে প্রশ্ন থেকে যায় কতটা অতিরিক্ত? যদি অত্যধিক মূল্যায়নকে বার্ষিক ২ শতাংশ হিসাবে ধরা হয় (যা কিছু লেখকের মতে) তাহলে নয়া-উদারবাদী যুগে জিডিপি বৃদ্ধির হার পূর্ববর্তী শাসনের তুলনায় কেবলমাত্র একটি কণামাত্র বেশি এবং তাই এর সম্পর্কে বাড়তি হৈচৈ করার কিছুই নেই।

কিন্তু এখানে আমাদের উদ্বেগের বিষয় হল বৃদ্ধির হারের চেয়ে জিডিপি বৃদ্ধির হার কমে যাওয়া নিয়ে, যদিও অবশ্যই মাত্রাটি অতিমাত্রায় অনুমিত করা হয় তবে সময়ের সাথে সাথে এর গতিবিধির কোনো অনুমান কিছুটা বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়ে ফেলে। তবুও সরকারী পরিসংখ্যান থেকে একটি নির্দিষ্ট মন্দা-র উপস্থিতি স্থাপন করা যেতে পারে। ২০০১-০২ এবং ২০১১-১২ এর মধ্যে, ভারতীয় অর্থনীতিতে প্রকৃত মোট মূল্য সংযোজন বৃদ্ধির বার্ষিক চক্রবৃদ্ধি হার, সরকারী পরিসংখ্যান অনুসারে, ছিল ৬.৭ শতাংশ; কিন্তু ২০১১-১২ এবং ২০১৯-২০ এর মধ্যে বার্ষিক চক্রবৃদ্ধি বৃদ্ধির হার ৫.৪ শতাংশে নেমে এসেছিল (অর্থাৎ কোভিড-কালের আগেই বৃদ্ধির হার কমে যায়)। ২০২২-২৩ সালের মধ্যে অর্থনীতিতে পুনরুদ্ধার সম্ভব হয়েছিল: ২০১১-১২ এবং ২০২২-২৩ এর মধ্যে, চক্রবৃদ্ধি বার্ষিক বৃদ্ধির হার ছিল সেই ৫.৪ শতাংশই। এই ধরনের মন্দা কোন আশ্চর্যের বিষয় হওয়া উচিত নয়। আয়ের ক্রমবর্ধমান অসাম্যের সাথে, অর্থাৎ অর্থনৈতিক উদ্বৃত্তের অংশ বৃদ্ধির সাথে, সামগ্রিক চাহিদা বৃদ্ধির মন্দগতি অনিবার্য হয়ে ওঠে।

রাশিয়ান অর্থনীতিবিদ মিখাইল তুগান-বারানভস্কি এই প্রস্তাবের বিরোধীতা করে বলেছিলেন যে কনসাম্পশন হ্রাসের ফলে বিনিয়োগ বৃদ্ধির সম্ভাবনার থাকে; তবে এই তত্ত্বের একটি যৌক্তিক সম্ভাবনা থাকলেও, পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে বিনিয়োগের আচরণে এটি ঘটবে বলে বিশ্বাস করার কোন কারণ নেই, যেহেতু পুঁজিপতিরা তখনই বিনিয়োগ করে যখন তার জন্য একটি বাজার খুঁজে পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। সরকার নিঃসন্দেহে অতি-উৎপাদনের প্রবণতার মোকাবেলায় পদক্ষেপ নিতে পারে, তবে নব্য-উদারনৈতিক অর্থনীতিতে, রাজস্ব ঘাটতি-র বৃদ্ধি এবং ধনীদের উপর আরও ট্যাক্সের বিরোধিতার যে আদর্শিক নীতি আছে তার দ্বারা বাধাগ্রস্ত হয়। বৃহত্তর সরকারী ব্যয় বরাদ্দই একমাত্র উপায় যা সামগ্রিক চাহিদাকে বাড়িয়ে তুলবে। এই কারণেই নয়া-উদারনীতিবাদের অধীনে দারিদ্র্য বৃদ্ধি বাধাপ্রাপ্ত হয় না বা জিডিপি বৃদ্ধিও বজায় রাখতে সফল হয় না।

মূল নিবন্ধটি ২১শে এপ্রিল, ২০২৪-এ পিপলস ডেমোক্রেসি পত্রিকায় প্রকাশিত।

অনুবাদঃ অঞ্জন মুখোপাধ্যায়

Spread the word

Leave a Reply