ভারতে শ্রমিকশ্রেণীর লড়াই এবং সাম্প্রদায়িকতার প্রভাব
প্রভাত পট্টনায়েক
মূল প্রবন্ধটি ইংরেজিতে ‘কম্যুনালিজম অ্যান্ড ওয়ার্কিং ক্লাস স্ট্রাগলস’ - শিরোনামে পিপলস ডেমোক্র্যাসি পত্রিকার ১৫ই এপ্রিল ২০১৭ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। সেই প্রবন্ধের সম্পূর্ণ বাংলা অনুবাদ রাজ্য পার্টির ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হল।
স্বাধীনতাপূর্ব বোম্বে (তখন ঐ নামই ছিল)-তে কমিউনিস্টদের নেতৃত্বে শক্তিশালী ট্রেড ইউনিয়নগুলির আহ্বানে সারা শহর জূড়েই অনেকগুলি ধর্মঘট - হরতাল সংগঠিত হয়েছে। সেইসব হরতাল, ধর্মঘটে হিন্দু এবং মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের শ্রমিকেরা একে অন্যের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াইতে সামিল হতেন – নিজস্ব স্মৃতি থেকে সেই আন্দোলনের ইতিহাস প্রায়শই উল্লেখ করতেন কমরেড বি টি রণদিভে। উপনিবেশের যুগে এইসব আন্দোলন সংগ্রামের সাফল্যের সাথেই উল্লিখিত হতো এধরণের কোনও আন্দোলন ব্যার্থ হলেই কিভাবে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হয়ে যেত।
শ্রমিকদের সংগ্রামী ঐক্য যা ধর্মঘট সফল করে তুলত এবং তাদেরই অভ্যন্তরে এক ভয়ানক অনৈক্য যার পরিণতিতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সুত্রপাত হয় এই দুয়ের মধ্যে এক চক্রাবর্ত সম্পর্ক ছিল যা আসলে শ্রমিকশ্রেণীর চেতনায় প্রতিদ্বন্দ্বী দুই ধারণার ইঙ্গিত দেয়। একদিকে কাজ করত সার্বিক শোষণের বিরুদ্ধে লড়াই করে সবার মুক্তির লক্ষ্যে সংগ্রামের জন্য তিলে তিলে গড়ে ওঠা শ্রেণীঐক্যের অভিজ্ঞতালব্ধ চেতনা, আরেকদিকে প্রতিক্রিয়াশীল কায়েমি স্বার্থে সাম্প্রদায়িক ধারণার প্রচার করা হতো যাতে প্রচলিত ব্যাবস্থার নামে বর্তমান শোষণের জোয়াল থেকে শেষ অবধি কেউই মুক্তি না পেয়ে সেই জাঁতাকলের নিষ্পেষণেই আরও বেশি করে জড়িয়ে পড়ে।
দুই প্রতিদ্বন্দ্বী ধারণার এই চক্রাকার সম্পর্ক আরেকটি ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক সত্যকে তুলে ধরে, সেই সত্য হল এই যে, মানুষের অস্তিত্ব শেষ অবধি সামাজিক ঐক্যের উপরে নির্ভরশীল। সামাজিক, গোষ্ঠীবদ্ধ জীবনের উপরে মানুষের নির্ভরতা আদৌ সময়ের সাথে শেষ হয়ে যায় না বরং তাকেই প্রয়োজনীয় হিসাবে আরও নির্দিষ্ট করে তোলে। উদারপন্থী রাজনীতিজ্ঞেরা জীবনের এই সত্যকে বরাবর এড়িয়ে যেতে চেয়েছেন, সেই উদ্দেশ্যেই তাদের চর্চা, চর্যা পরিশীলিত হয়েছে। এই উপলব্ধি থেকে মানুষকে যতই দূরে ঠেলে রাখার প্রচেষ্টা হোক না কেন, কায়েমি স্বার্থবাহী প্রতিক্রিয়াশীল চেতনার আগুনে পোড়া মানুষ একদিন নিজেই বুঝতে পারে জনগণকে একে অন্যের থেকে আলাদা করে দেখানোর যে ধ্বংসাত্মক রাজনীতি তার বিকল্প কোনও একক চেতনার ধারণাসমৃদ্ধ ব্যাক্তিদর্শন হতে পারে না, বরং মুক্তির দিশা দেখতে পাওয়া যায় যদি একক অস্তিত্বের উর্ধে উঠে কোনও দর্শন সঠিক অর্থে শ্রেণীচেতনার কথা বলে, জনসাধারনের মধ্যে প্রত্যেক একক কেই সেই দর্শন প্রকৃতরুপে চিহ্নিত করতে সক্ষম হয়।
এমন কোনও দর্শনকে অবশ্যই শ্রেণীদর্শন হতে হবে, কারন শ্রেণীদর্শন হল সেই হাতিয়ার যার প্রয়োগে মানুষকে মানুষের প্রতিপক্ষ হিসাবে খাড়া না করে জনসাধারনকে একজোট করে সেই ব্যবস্থার বিরুদ্ধেই যুদ্ধ শুরু হয় যা মানুষকে বিভিন্ন শ্রেণীতে বিভাজিত করে রেখেছে। একথাও মনে রাখতে হবে ব্যবস্থা বদলে শ্রেণীসংগ্রামের উপযুক্ত শ্রেণীচেতনা বর্তমান জীবনের বিভিন্ন বস্তুগত সীমাবদ্ধতা, ক্ষয়িষ্ণু ধর্মীয় মূল্যবোধ এবং ক্রমশ মিলিয়ে যাওয়া জাত, বর্ণ এবং সম্প্রদায়গত পার্থক্যের বাস্তবতার উপরে পা রেখেই এক দীর্ঘ গণসংগ্রামের ফসল হিসাবে গড়ে ওঠে। অন্যভাবে বলা যায়, নিজেদের মধ্যেকার ধর্মীয় এবং সাম্প্রদায়িক বিভেদকে সরিয়ে রেখে শ্রমিকশ্রেণীর ঐক্যবদ্ধ গণআন্দোলনই হল ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক সমাজ গড়ে তোলার অন্যতম সামাজিক পূর্বশর্ত। ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক রাজনীতির চর্চায় মূল সংগঠনই হল ট্রেড ইউনিয়ন যা আন্দোলনের পথে মানুষকে শ্রেণীঐক্যের দিকে এগিয়ে নিয়ে যায়।
অত্যন্ত আশ্চর্যের হলেও একথা সত্যি, মুক্তির পথে ক্রিয়াশীল ঐক্যবদ্ধ শ্রেণীচেতনার বিরোধিতায় আগাগোড়া অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছে সেই পুঁজিবাদ এবং পুঁজিবাদী দর্শন যা একদিন পৃথিবীতে গনতন্ত্রের ধ্বজা উর্ধে তুলে ধরতে অঙ্গিকারবদ্ধ ছিল। মার্কস যাকে ‘কম্বিনেশনস’ বলতেন, আজকের দিনে আমরা সেই সংগঠনকেই ট্রেড ইউনিয়ন বলি। জন্মলগ্ন থেকেই পুঁজিবাদ ট্রেড ইউনিয়নের আকন্ঠ বিরোধিতা করে এসেছে এবং এর বিপরীতে একক অস্তিত্বের স্বাধীনতার ধারণাকে সমর্থন জানিয়ে এসেছে। পুঁজিবাদী ব্যবস্থার এই নির্লজ্জ দ্বিচারিতা সম্পর্কে প্রকৃত অর্থে উদারনীতির জনক যেমন অ্যাডাম স্মিথ-রা কখনো কথার আড়ালে নিজেদের লুকিয়ে রাখেন নি, সোজাসুজি জানিয়েছেন পুঁজিপতিরা নিজেরাই পৃথিবীতে একক হিসাবে অস্তিত্বশীল নয়, তাদেরও নিজস্ব গোষ্ঠী থাকে - তা সত্বেও তারাই ট্রেড ইউনিয়ন এমনকি শ্রমিকদের অন্যান্য যে কোনও চেহারার সংগঠনের বিরোধিতা করে। স্মিথের ন্যায় ধ্রুপদী অর্থনীতিবিদদের পরবর্তী যুগে উদারপন্থীরা পুঁজিবাদ প্রসঙ্গে মার্কসের উক্তি ‘ইতর অর্থনীতি’-কে প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থা থেকে মুক্তির লক্ষ্যে একক অস্তিত্বের স্বাধীনতার ধারনাকেই যুক্তিসঙ্গত হিসাবে খাড়া করতে নিজেদের যুক্তি হিসাবে পেশ করতে শুরু করেন। তারা এমনটা করেন সামাজিক অগ্রগতির চরম ধাপে মানুষের অবস্থান সম্পর্কে একটা মোহময় পরিবেশের গপ্পের আড়ালে। আর তাই নিস্তরঙ্গ সামাজিক জীবনে বিপদের অজুহাতে শ্রমিকদের একজোট হওয়ার দাবীর প্রতি কুৎসা করা হয়, সেই দাবীকে খারিজ করা হয়। সেই যুক্তির পরিসর আরও বাড়িয়ে নিয়ে আজকের দিনে নয়া উদারনীতির সমর্থকেরা ‘শ্রমের বাজার’-কে আরও স্থিতিস্থাপক হবার কথা বলেন, তাদের বক্তব্য সামাজিক অগ্রগতির পথে ‘সহজলভ্য শ্রম’ একান্তই প্রয়োজন। এমন স্থিতিস্থাপক এবং সহজলভ্য শ্রমের বাজার আসলে পুঁজিপতিদের ‘যখন খুশি নিয়োগ – যখন খুশি ছাঁটাই’ করার সুবিধা দেয়, ট্রেড ইউনিয়নে যুক্ত হবার অপরাধে বিনা নোটিশেই বরখাস্ত করার শক্তি যোগায়।
নয়া উদারনীতির ধামাধরাদের বক্তব্যে গরমিলের প্রধান সুত্রটি বুঝতে হয় ঠিক এই জায়গা থেকেই। আধুনিক পুঁজিবাদ একদিকে সাম্প্রদায়িকতা, এক জনগোষ্ঠীর উপরে অন্য গোষ্ঠীর কর্তৃত্ব এবং মৌলবাদের বিরোধিতা করে (অন্তত তর্কের খাতিরেই ধরে নেওয়া চলে তাদের বিরোধিতা রয়েছে), আরেকদিকে তারাই ট্রেড ইউনিয়নের ঘোরতর বিরুদ্ধে যার কারনে জনগন শ্রেণীবৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াই করতে পারে, কিংবা উপরোক্ত কর্তৃত্ব এবং মৌলবাদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হতে পারে। সামাজিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে যাবতীয় বুলির আড়ালে পুঁজিবাদই জনগণের ঐক্যের পথে সবেচেয়ে বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়।
বর্তমান যুগে পুঁজিবাদ যে চেহারায় অন্তত আমাদের দেশে উপস্থিত হয়েছে তাতে শ্রমিক-মেহনতি জনতাকে টুকরো টুকরো করে এমনভাবে দেখানো হয় যেন, শ্রমিক-মুজদুরেরা এক বিশাল জনসমুদ্রে এক একজন স্বতন্ত্র মানুষ - যাদের নিজেদের অর্থনৈতিক দুরবস্থার উন্নতিকল্পে অন্য সবার সাথে একজোট হয়ে সক্রিয় হবার কোনও ইচ্ছাও নেই, প্রয়োজনও নেই! আজকের পুঁজিবাদ দেখাতে চায় শ্রমিকশ্রেণীর অনৈক্যের ফলেই পুঁজিবাদের পক্ষে সুরক্ষিত রাষ্ট্রে বিনিয়োগের সর্বোচ্চ ফায়দা মেলে, ফলে অর্থনৈতিক উন্নয়নের দরজা খুলে যায়। এই তত্বেই জনকল্যাণকারী রাষ্ট্রের ধারনাকে নস্যাৎ করে উপরতলার হাতে জমে পাহাড় হওয়া সম্পদ চুঁইয়ে পড়ে নিচের তলায় থাকা মানুষদের হাতে সরাসরি আসবে বলে দেখানো হয়। এর সাথেই বলা হয় রাষ্ট্র ক্রমবর্ধমান আর্থিক উন্নয়নের সুবিধাকে কাজে লাগিয়ে আরও বেশি কর আদায় করবে, সরকারের রাজস্ব বাড়বে এবং সেই অর্থ জনকল্যানে খরচ হবে। সুতরাং ট্রেড ইউনিয়ন করা চলবে না!
আর্থিক প্রগতির নামে এমন উৎকট তত্বের ভ্রান্তি মূলত দুটি কারনে। একটি বহুচর্চিত, আরেকটির ক্ষেত্রে আলোচনার দৃষ্টান্ত বিরল। প্রথমত পরিসংখ্যানেই বোঝা যায় পুঁজিবাদী বিনিয়োগের দ্বারা জনজীবনের সার্বিক উন্নতির যাবতীয় দাবী আসলে ভুয়ো। শ্রমিকসংঘের ধারনায় আঘাত করে তাদের ক্রমশ অনুগত দাসে পরিণত করা হলেই যে পণ্যের বাজারে তেজি চলে আসবে এমন কোনও কথা নেই, বরং ক্রমবর্ধমান বেকারি এবং কাজের বাজারে মন্দার প্রভাবে বিনিয়োগে ভাঁটা পড়বেই। এতে বাজার বিস্তৃত হবার বদলে ক্রমশই আরও সংকুচিত হবে। লোকজনের হাতে বেঁচে থাকার উপযুক্ত রোজগার দেবার মতো কাজ না থাকলে শুধুমাত্র বিনিয়োগ এবং উৎপাদনের জোরে বাজার চলে না, একথাই বলেছিলেন জন ম্যাকেইনার্ড কেইন্স। কেইন্স নিজে স্বনামধন্য উদারনিতিবাদী হয়েও এই উপলব্ধি প্রকাশ করেছিলেন। এরই সাথে এমন ব্যবস্থায় যেটুকু আর্থিক উন্নতি ঘটবে তা কোনদিনই চুঁইয়ে পড়ে নিচের তলায় থাকা মানুষদের হাতে পৌঁছায় না, শ্রমিকশ্রেণী একজোট নয় বলেই এমনটা আরও বেশি হয়। নিচের তলায় থাকা জনসাধারনের হাতে সম্পদ পৌঁছে যাবার কোনও স্বতস্ফুর্ত প্রক্রিয়া নেই কারন বাজারে বেকারির প্রভাব ভয়াবহ। মানুষের আয়ের সুযোগ ক্রমশ কমে আসে, পণ্যের দাম সেই অনুপাতেই বেড়ে চলে - বাজার আরও বেশি সংকুচিত হয়। এই দুর্যোগের পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রের কিছুই করার থাকেনা কারন রাষ্ট্র কেবলমাত্র বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ চরিতার্থ করতে অঙ্গীকারবদ্ধ হয়ে পড়েছে। ফলে যাবতীয় উন্নতির সুযোগ জোটে শুধু তাদেরই কপালে যারা চড়া দামে পণ্য কিনতে পারে, এর উপরে বাজারে মন্দার অজুহাতে তাদেরকেই বাড়তি করছাড় এবং অন্যান্য ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করতে হয় রাষ্ট্রকে। এতেই রাষ্ট্রের তহবিল খরচ হতে থাকে, ফলে উন্নতির বাস্তবতা যদি থেকেও যায় তবুও জনকল্যানে সরকারী ব্যয়বরাদ্দ বাড়ে না, বরং ক্রমশ আরও কমতে থাকে।
এই উৎকট ব্যবস্থার ভ্রান্তি সংক্রান্ত দ্বিতীয় কারনটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। উদারনীতির দেখানো পথে হেঁটে শ্রমিক-মেহনতি জনতার ঐক্যকে ভেঙ্গে দিলেই যে সমাজে শান্তির বানী প্রচারে একক ব্যাক্তিত্বের মুক্তির ধারনায় সমৃদ্ধ রাজনীতি চারদিক থেকে ধেয়ে আসে এমন নয়। জনগণের মধ্যেকার অনৈক্য, বাজারে ক্রমবর্ধমান মন্দার প্রভাবে জনগণের মধ্যেকার ক্ষোভ-অসন্তোষকে কাজে লাগিয়ে রাজনীতির ময়দানে হাজির হয় এক চরম প্রতিক্রিয়াশীল, সাম্প্রদায়িক হিংসায় আস্থাশীল কায়েমি স্বার্থের দর্শন। জনগণের একটি অংশকে এই দর্শন ভাবতে শেখায় তাদের দুরবস্থার জন্য দায়ী জনগণেরই আরেকটি অংশ। জনগণের এই দুটি অংশের মধ্যেকার ফারাককে সম্প্রদায়ের ভিত্তিতে তুলে ধরে গজিয়ে ওঠা এই রাজনৈতিক শক্তি। নিজেদের হাত শক্ত করতে তারা সাম্প্রদায়িক হিংসাকে হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করে। পৃথিবীর ইতিহাসে এমন ঘটনার একাধিক উদাহরণ সকলেরই জানা। আমাদের দেশে অর্থনীতিক সংকটে জর্জর জনজীবন এমনই এক পরিস্থিতি জন্ম দিয়েছে। ভারতে সংখ্যাগুরু হিন্দু সাম্প্রদায়িকতা শক্তিশালী হয়েছে, তারই ছুতোয় মাথাচাড়া দিয়েছে সংখ্যালঘু সাম্প্রদায়িকতার বিপদ।
আজকের ভারতে সাম্প্রদায়িক হিংসায় আস্থাশীল কায়েমি স্বার্থের বিপদের কথা অস্বীকার করা চলে না। একথা ঠিক, ইতিমধ্যেই কয়েকটি সারা ভারত ধর্মঘট সংগঠিত হয়েছে – সেইসব ধর্মঘটে দেশের শ্রমিকশ্রেনী নিজেদের সংগ্রামী ঐক্যের শক্তিও দেখিয়েছে। তবুও মনে রাখতে হবে সরাসরি বেসরকারিকরণ এবং কিছু ক্ষেত্রে আউটসোর্সিং পদ্ধতিতে ঠিকা শ্রমিক নিয়োগের মাধ্যমে দেশের রাষ্ট্রায়ত্ত্ব ক্ষেত্রগুলিতে যেভাবে শ্রমিকদের ঐক্যকে নষ্ট করে দয়া হচ্ছে তাতে সামগ্রিক বিচারে শ্রমিকশ্রেণীর শক্তি কমছে। ক্যাজুয়াল শ্রমিক নিয়োগ অনেকটাই বৃদ্ধি পেয়েছে, কাজের বাজার ক্রমশ ছোট হয়ে আসছে। এসবকিছুই আগত বিপদের সংকেত। শ্রমিকদের অভ্যন্তরীণ অসন্তোষকে কাজে লাগিয়ে তাদের ঐক্যবদ্ধ লড়াই, আন্দোলনকে দুর্বল করতে চাইছে প্রতিক্রিয়াশীল রাজনীতি। ক্রমশ মাথাচাড়া দিচ্ছে সাম্প্রদায়িক হিংসার ঘটনা। শ্রেণী আন্দোলন ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে বলেই সাম্প্রদায়িক হিংসার ঘটনা সংগঠিত হতে পারছে। এই প্রসঙ্গে ১৯৭৪ সালের রেলওয়ে ধর্মঘট কিংবা লোকোমেনদের হরতালের মতো ঐতিহাসিক উদাহরণগুলি আমাদের মনে রাখতেই হবে। নয়া উদারবাদী অর্থনীতির সুবাদে গরীব জনতা ভাল আছে আর তাই আজ দেশে শ্রমিকশ্রেণীর ঐক্যে ফাটল ধরেছে কিংবা তাদের আন্দোলন দুর্বল হয়েছে, এমন ধারনা একেবারেই ভুল। বাস্তব কারন ঠিক এর বিপরীত। এই প্রবন্ধেই আলোচনা করা হয়েছে কিভাবে নয়া উদারবাদ আমাদের দেশে ‘সহজলভ্য এবং স্থিতিস্থাপক শ্রমের বাজার’ গড়ে তুলে শ্রমিকসংগঠনের কাঠামোয় বদল করতে সক্রিয় থেকেছে, আজকের দিনে সাম্প্রদায়িক শক্তির মাথাচাড়া দেবার পিছনে সেই কাঠামোগত পরিবর্তনের ভূমিকাই প্রধান।
স্বাধীনতাপূর্ব বোম্বেতে শ্রমিকশ্রেণীর লড়াই সংগ্রামের ইতিহাস বলতে গিয়ে কমরেড বি টি রণদিভে যা বলতেন আজ আরও একবার সেই একই প্রেক্ষিত আমাদের সামনে হাজির হয়েছে। আজকের দিনে শ্রমিকশ্রেণীর চেতনায় আর শুধু দুই প্রতিদ্বন্দ্বী ধারণার চক্রাকার লড়াই চলছে না, প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি আরও একধাপ এগিয়ে গিয়ে শ্রমিকশ্রেণীর ঐক্য এবং গোটা দেশের সমাজে সর্বাঙ্গীণ সম্প্রীতি ভাঙ্গার কাজে সাম্প্রদায়িক হিংসাকে কাজে লাগাচ্ছে, সেই কাজে নয়া উদারবাদের আঘাতে দুর্বল শ্রমিকসংগঠনের কাঠামো সহায়ক ভূমিকা নিচ্ছে।
শ্রমিকশ্রেণীর উপরে অভূতপূর্ব শোষণ এবং নিপীড়ন চাপিয়ে দেবার পাশাপাশি নয়া উদারবাদ আজকের ভারতে সংখ্যাগুরু সাম্প্রদায়িক রাজনীতির ক্ষমতায় আসীন হবার ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছে। একইসাথে বিপদ বাড়িয়েছে সংখ্যালঘু মৌলবাদেরও। শ্রমিকশ্রেণীর সংগঠন ট্রেড ইউনিয়নকে দুর্বল করে দেওয়া গেছে বলেই এমন পরিস্থিতির সুযোগ তৈরি হয়। আজকের ভারতে উদ্ভুত সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিপদকে মোকাবিলা করা যাবেনা - এমন ভাবার কোনও কারন নেই। একে রুখে দেবার কাজে প্রধান শত্রুকে সঠিকভাবে চিহ্নিত করতে পারাই সেই লক্ষ্যে সফল হবার একটি ধাপ। নয়া উদারবাদ এবং সাম্প্রদায়িকতা নিজেদের দার্শনিক অবস্থানের কারনেই একে অন্যের পরিপূরক, এই সত্যটুকু প্রকাশ করাই এই প্রবন্ধের উদ্দেশ্য। একই প্রসঙ্গে মনে রাখতে হবে মার্কসবাদী বিশ্ববিক্ষায় সর্বদা একক ব্যাক্তি এবং সমষ্টিগত ঐক্যের মধ্যে একটি সুস্পস্ট পার্থক্যরেখা টানা থাকে, যেকোনো পরিস্থিতিতেই একথা সত্য।
ওয়েবডেস্কের পক্ষে অনুবাদঃ সৌভিক ঘোষ