CPIMCC

কেন্দ্রীয় কমিটির বিবৃতি

৩০ জানুয়ারি,মঙ্গলবার,২০২৪

২৮-৩০ জানুয়ারি ২০২৪ তিরুবনন্তপুরমে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি(মার্কসবাদী)-এর কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এই বৈঠকের পরে পার্টি নিম্নলিখিত বিবৃতি জারি করেছে : 

অযোধ্যা: মন্দির উদ্বোধন

২২ জানুয়ারী, ২০২৪-এ অযোধ্যায় মন্দির উদ্বোধন কার্যত ধর্মনিরপেক্ষতার মৃত্যুঘণ্টা বাজিয়েছে, ধর্মনিরপেক্ষতাকে সংজ্ঞায়িত করা হয় রাষ্ট্র, প্রশাসন এবং রাজনীতি থেকে ধর্মকে পৃথক করা হিসাবে। অযোধ্যার পুরো অনুষ্ঠানটি ছিল একটি রাষ্ট্রীয় মদতপুষ্ট অনুষ্ঠান যাতে সরাসরি প্রধানমন্ত্রী, উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী, ঐ রাজ্যেরই রাজ্যপাল সহ সমগ্র রাষ্ট্রযন্ত্র জড়িত ছিল। ভারতের রাষ্ট্রপতি এবং উপ-রাষ্ট্রপতি উভয়েই প্রধানমন্ত্রীকে অভিনন্দন বার্তা পাঠিয়েছেন বিভিন্নভাবে তাকে 'একটি অঙ্গীকার পূরণ করা', "সভ্যতার গতিপথে ভাগ্যের সাথে ভারতের মেলবন্ধন" ইত্যাদি বলে অভিনন্দন জানিয়েছেন। পুরো অনুষ্ঠানটি ছিল রাষ্ট্র পরিচালনার মৌলিক নীতির সরাসরি লঙ্ঘন। ভারতের শাসন ব্যবস্থা,যেমন সুপ্রিম কোর্টের দ্বারা সুস্পষ্ট করে বলা হয়েছে যে, সংবিধানের অধীনে রাষ্ট্রের কোনও ধর্মীয় অনুষঙ্গ বা পছন্দ থাকা উচিত নয়। 

এই অনুষ্ঠানটি করা হয়েছিল সরাসরি রাজনৈতিক এবং নির্বাচনী লাভের লক্ষ্যে। আরএসএস/বিজেপি এই ঘটনাকে সামনে রেখে দেশব্যাপী ব্যাপক প্রচার চালায়। সরাসরি সম্প্রচার প্রকাশ্যে দেখানোর জন্য বিভিন্ন স্থানে বিশাল স্ক্রিনের বন্দোবস্ত করা হয়েছিল। এদিন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিল। কর্মচারীদের অংশগ্রহণের সুবিধার্থে সমস্ত কেন্দ্রীয় সরকারী অফিস দুপুর আড়াইটা পর্যন্ত বন্ধ ছিল। ব্যাংকসহ সরকারি অনেক প্রতিষ্ঠান ও সংস্থার ক্ষেত্রেও তাই করা হয়েছিল। প্রতিটি রাজ্য এবং সংসদীয় নির্বাচনী এলাকা থেকে মন্দির দর্শনের জন্য লোকেদের একত্রিত করার পরিকল্পনা করা হয়েছে। এটি ২০২৪ সালের মার্চ পর্যন্ত, অর্থাৎ নির্বাচনের প্রাক্কাল অবধি করা হবে।

এই ঘটনাটিও ইঙ্গিত দেয় যে উপাসনাস্থল আইন, ‍১৯৯১ যা বাধ্যতামূলক করে যে অযোধ্যা ব্যতীত সমস্ত ধর্মীয় স্থানের স্থিতাবস্থা ১৫ আগস্ট,১৯৪৭ এর মতোই থাকবে, এখন হিমঘরে ঠাঁই হবে। কাশী এবং মথুরার বিরোধ আবারও আংশিকভাবে বিচার বিভাগীয় যোগসাজশে প্রকাশ্যে এসেছে । অযোধ্যা রায়ের জন্য সুপ্রিম কোর্টকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন মোদি।

সিপিআই(এম) এর নীতি হল ধর্মীয় বিশ্বাসকে সম্মান করা যা প্রত্যেক ব্যক্তির ব্যক্তিগত পছন্দ। পার্টি অটলভাবে প্রতিটি ব্যক্তির তাদের বিশ্বাস অনুসরণ করার অধিকারকে সমুন্নত রেখেছে। কিন্তু একই সঙ্গে রাজনৈতিক লাভের হাতিয়ার হিসেবে জনগণের ধর্মীয় বিশ্বাসের অপব্যবহার এবং ধর্মকে রাষ্ট্রের সঙ্গে মিলিয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টার বিরোধিতা করেছে।

বিধানসভা নির্বাচন

বিধানসভা নির্বাচনের শেষ দুই পর্বে, বিজেপি মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান এবং ছত্তিশগড়ে জয়লাভ করেছে, যেখানে কংগ্রেস কর্ণাটক, হিমাচল প্রদেশ এবং তেলেঙ্গানার মত  প্রধান রাজ্যগুলিতে জিতেছে।

বিজেপির জয়গুলি প্রধানত হিন্দুত্ববাদী সাম্প্রদায়িক ভোটের একীকরণ এবং জাতিগত অনুভূতির ক্ষতিকারক অপব্যবহারের কারণে হয়েছে।

হিন্দুত্ববাদী সাম্প্রদায়িকতার সুসংহতকরণকে স্পষ্টভাবে মোকাবিলা করতে হবে। প্রতিযোগিতামূলক নরম হিন্দুত্ব এবং হালকা গৈরিক অবস্থানের আশ্রয় শুধুমাত্র জনগণের উল্লেখযোগ্য অংশে হিন্দুত্বের দখলকে আরও শক্তিশালী করে। এটি আরএসএস/বিজেপি এবং অন্যান্য সমস্ত হিন্দুত্ববাদী সংগঠনকে সমাজকে আরও সাম্প্রদায়িক করার এবং সংখ্যালঘুদের লক্ষ্যবস্তু করার সুযোগ দেয়।

বিজেপি: ইডি এবং আর্থিক শক্তির নির্লজ্জ অপব্যবহার

অযোধ্যাকে কেন্দ্র করে ধর্মীয় অনুভূতির প্রকাশ্য অপব্যবহার এবং সাম্প্রতিক নির্বাচনী জয়গুলি সত্ত্বেও, বিজেপি ২০২৪ সালের নির্বাচনের ফলাফল সম্পর্কে অনিশ্চিত বলে মনে হচ্ছে।

বিজেপি বিভিন্ন রাজ্যগুলিতে ক্ষমতাসীন বিরোধী দলগুলির মধ্যে দলত্যাগের প্রবনতা বৃদ্ধি করার জন্য ইডি এবং আর্থিক ক্ষমতার নির্লজ্জ এবং আক্রমণাত্মক অপব্যবহার করেছে এবং তাদের লোকসভা নির্বাচনে জয়লাভের সম্ভাবনা বাড়ানোর আশায় প্রাক্তন প্রতিদ্বন্দ্বীদের সাথে জোট গঠন করেছে। আগে মহারাষ্ট্রে ও পরে কর্ণাটকে তারা এই কাজ করেছে এবং এখন বিহারে জেডি(ইউ) সবচেয়ে বেশি সংখ্যক ভোলদবলের একটি অভূতপূর্ব রেকর্ড স্থাপন করেছে। নীতীশ কুমার রেকর্ড নবম বার বিহারের মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে শপথ নিলেন, এবার বিজেপির সমর্থনে। এই রাজ্যের জনতা, যারা বিজেপিকে পরাজিত করেছিল, তারা এই ধরনের ভোলবদলকারীদের শিক্ষা দেবে।

সিএএ

২০১৯-এর ডিসেম্বর থেকে, মোদি সরকার এই আইনের অধীনে কোন বিধি তৈরি করেনি। এখন, সাধারণ নির্বাচনের প্রাক্কালে, বিজেপি সাম্প্রদায়িক মেরুকরণকে আরও তীক্ষ্ণ করার লক্ষ্যে এবং বিশেষ করে পূর্ব ভারতে নির্বাচনী লাভের আশায় এর বাস্তবায়নের জন্য জোর দিচ্ছে।

ইন্ডিয়া ব্লক

জেডি(ইউ) ইন্ডিয়া ব্লক পরিত্যাগ করে বিজেপির সাথে সমঝোতা করা সত্ত্বেও, সিপিআই(এম) এই ব্লককে আরও শক্তিশালী করার জন্য সমস্ত প্রচেষ্টা চালাবে এবং আমাদের সাংবিধানিক প্রজাতন্ত্রের ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক চরিত্রকে রক্ষা করার জন্য বিজেপিকে পরাস্ত করার কাজ চালিয়ে যাবে। 

এখন মূল লক্ষ্য হল এই ব্লকের দলগুলির মধ্যে আসন ভাগাভাগির বিষয়ে চলমান রাজ্য স্তরের আলোচনা দ্রুত সম্পন্ন করা এবং তারপরে মানুষের জীবনযাত্রার উন্নতি এবং সাংবিধানিক মূল্যবোধ রক্ষার লক্ষ্যে মূল বিষয়গুলির ভিত্তিতে জনগণের কাছে পৌঁছানো।

কেরালা

নাভা কেরালা সাদাসের অত্যন্ত সফল কর্মসূচির জন্য কেন্দ্রীয় কমিটি কেরালার জনগণ এবং এলডিএফ সরকারকে অভিনন্দন জানায়। এটি দেশের যেকোনো রাজ্য সরকার কর্তৃক গৃহীত একটি অনন্য কর্মসূচি।

রাজ্যপাল: পদের জন্য অযোগ্য

 কেরালার রাজ্যপাল নির্বাচিত রাজ্য সরকারের উপর ক্রমাগত রাজনৈতিক আক্রমণ এবং চরম বিশৃঙ্খল আচরণ করার মাধ্যমে সমস্ত সীমানা অতিক্রম করেছেন। এর সর্বশেষ নিদর্শনটি হল একটি পুরোপুরি গণতান্ত্রিক এবং শান্তিপূর্ণ ছাত্র বিক্ষোভের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে কেরালার রাস্তায় তার অবস্থান। একটি অভূতপূর্ব কায়দায় তিনি কেন্দ্রীয় নিরাপত্তা বাহিনীর কাছ থেকে সুরক্ষা এবং নিজের জন্য সর্বোচ্চ অনুমোদিত নিরাপত্তা বলয় চেয়েছিলেন এবং তা আদায় করেছেন। "সাংবিধানিক ব্যবস্থার পতনের সূচনা" এর মতো তার বিবৃতিগুলি রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে হুমকিস্বরূপ যা রাজ্যের জনগণ সরাসরি প্রত্যাখ্যান করবে। 

কংগ্রেস দল এলডিএফ সরকারের প্রতি নেতিবাচক ও গণতন্ত্রবিরোধী পন্থা অবলম্বন করছে এবং মুখ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধে ভিত্তিহীন অভিযোগ করছে। কংগ্রের কেরালার অধিকারের উপর কেন্দ্রের আক্রমণের বিষয়ে নীরব থাকে যা আসলে বিজেপিকে রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে তাদের কৌশলে সাহায্য করে। কেরালার মানুষ কংগ্রেসের এই বিঘ্ন সৃষ্টিকারী পন্থাকে প্রত্যাখ্যান করবে।

পশ্চিমবঙ্গ

 কেন্দ্রীয় কমিটি সফল ইনসাফ যাত্রার জন্য বাংলার যুবদের অভিনন্দন জানায় যা রাজ্য জুড়ে পদযাত্রার শেষে একটি বিশাল ব্রিগেড সমাবেশে পরিণত হয়েছিল।

ত্রিপুরা

ত্রিপুরায় একদলীয় স্বৈরাচারী বিজেপি সরকার ফ্যাসিবাদী সন্ত্রাসমূলক হামলাকে তীব্রতর করছে যা অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে একটা গুরুতর আশঙ্কার বিষয়। সিপিআই(এম) কর্মীদের লক্ষ্য করে আক্রমণ চালানো হচ্ছে এবং তার প্রতিরোধও করা হচ্ছে।  

কেন্দ্রীয় কমিটির আহ্বান

১. সমস্ত রাজ্য ইউনিটগুলিকে মোদি সরকারের নীতির ফলে ক্রমবর্ধমান বেকারত্ব, মূল্যবৃদ্ধি এবং জনগণের জীবিকার উপর আক্রমণের বিরুদ্ধে সংগ্রামকে আরও জোরদার করতে হবে।

২. একই সাথে কেরালার প্রতি মোদি সরকারের বৈষম্যমূলক নীতি এবং রাজ্যের অধিকার এবং যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর উপর হামলার বিরুদ্ধে ৮ ফেব্রুয়ারি নয়াদিল্লিতে কেরালা এলডিএফ সরকার আয়োজিত প্রতিবাদ ধর্নার পাশাপাশি, সমস্ত রাজ্য কমিটিকে অবশ্যই রাজ্যগুলিতে প্রতিবাদ কর্মসূচি সংগঠিত করতে হবে।

৩. কেন্দ্রীয় কমিটি ১৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪-এ সংযুক্ত কিষাণ মোর্চা এবং কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নগুলির যৌথ প্ল্যাটফর্মের দেশব্যাপী প্রতিবাদ কর্মসূচীর আহ্বানের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করেছে।

৪. ইভিএমের কার্যকারিতা নিয়ে ব্যাপক উদ্বেগের কারণে, পার্টি দেশ জুড়ে প্রচার করবে যে ভোট কেন্দ্রগুলিতে ইলেকট্রনিক ইউনিটগুলির - ভোটিং ইউনিট, কন্ট্রোল ইউনিট এবং ভিভিপ্যাটগুলির পুনরায় সিকোয়েন্সিং হওয়া উচিত । ভিভিপ্যাট-এর কমপক্ষে ৫০ শতাংশের অবশ্যই কন্ট্রোল ইউনিটের রেকর্ডের সঙ্গে মেলাতে হবে।


শেয়ার করুন

উত্তর দিন