Logo oF Communism

কেন্দ্রীয় বাজেট সম্পর্কে পলিট ব্যুরোর বিবৃতি

কেন্দ্রীয় বাজেটঃ জনগণের প্রতি বেইমানি

তারিখঃ সোমবার, ১লা ফেব্রুয়ারি, ২০২১

ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী)-এর পলিট ব্যুরো নিম্নলিখিত বিবৃতি জারী করেছেঃ

কেন্দ্রীয় বাজেট ২০২১-২২ - জনগণের সাথে এক বিরাট বেইমানি

অতিমারি এবং আর্থিক মন্দার জোড়া সংকটের সময়ে ২০২১-২২ অর্থবর্ষের কেন্দ্রীয় বাজেট ঘোষণা করা হল। এই বাজেটে দেশের জনগণের সাথে এক বিরাট বিশ্বাসঘাতকতা করা হয়েছে। শ্রমিক জনতার দুর্দশা এবং দারিদ্রের বিনিময়ে বড় ব্যাবসায়ী সংস্থার স্বার্থরক্ষায় মোদী সরকার কতটা নিবেদিতপ্রাণ এই বাজেটের বয়ানেই সেই প্রমাণ মেলে। নিজেদের ঢাক পেটানো বন্ধ না করে সরকার এই সংকটের সময়েও যেভাবে জনস্বার্থে ব্যায়বরাদ্দ বাড়াতে অস্বীকার করেছে তাতে সেই নির্লজ্জতাই স্পষ্ট হয়। ২০২১-২২ অর্থবর্ষে কেন্দ্রীয় বাজেটে মোট অর্থবরাদ্দের পরিমান ৩৪.৮ লক্ষ কোটি টাকা। ২০২০-২১ সালের অর্থবরাদ্দের সাথে তুলনা করলে এবারের বরাদ্দের পরিমানবৃদ্ধি নগন্য পর্যায়ের - কার্যত সরকারী ব্যায়বরাদ্দ কম করে দেওয়া হয়েছে। বলা যায় এই বাজেটে একদিকে সরকার জনগণের প্রতি নিজের দায়বদ্ধতা অস্বীকার করেছে আরেকদিকে দেশের লাভজনক সম্পদসমুহ কর্তৃত্বে মাধ্যমে বিশেষ সুবিধাভোগী কতিপয় বিত্তবানেদের সৌভাগ্যান্বেষণে সহায়তা যুগিয়েছে।

চলতি অর্থবর্ষের (২০২০-২১) শেষভাগে রাজকোষ ঘাটতি এবং জিডিপি'র অনুপাতে যে ৯.৫ শতাংশের আপাত বৃদ্ধি হয়েছে বলে সরকার দাবী করছে তার আসল কারন এই সময়কালে ব্যাপক চেহারায় রাজস্ব আদায় কমে যাওয়ার ফলে প্রাথমিকস্তরে খরচ বেড়ে গেছিল। সংকটকালে রাজস্ব আদায়ে ধস নামা সত্বেও জনগণের উপরে আরও বোঝা চাপাতে মোদী সরকার পেট্রোল এবং ডিজেলের উপরে বাড়তি কর ধার্য করে। গতবারের বাজেটের সাথে তুলনা করলে এই বাজেটের হিসাবে দেখা যাচ্ছে  রাজ্য এবং কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলগুলির জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে অর্থবরাদ্দের মোট পরিমান কমিয়ে দেওয়া হয়েছে চল্লিশ হাজার কোটি টাকারও বেশী। ২০২০-২১ অর্থবর্ষে কর্পোরেট এবং আয়কর খাতে রাজস্ব আদায় বিপুল পরিমানে কমেছে, তবুও ধনী এবং কর্পোরেট ক্ষেত্রের 'দুর্দশা' গ্রস্থ অবস্থায় কাতর কেন্দ্রীয় সরকার ভরসা রাখতে পারেনি যে ২০২১-২২ অর্থবর্ষে ভারতে কর্পোরেটরা কোভিড - পূর্ব অবস্থায় যেটুকু কর দিত সেটুকুও দিতে সক্ষম হবে। সেইকারনেই ২০২০-২১ অর্থবর্ষে কর্পোরেট এবং আয়কর বাবদ আদায়ের পরিমান ধরা হয়েছিল যথাক্রমে ৬.৮১ লক্ষ কোটি টাকা এবং ৬.৩৮ লক্ষ কোটি টাকা। ২০২১-২২ অর্থবর্ষে এই দুয়ের পরিমান কমে এসে দাঁড়িয়েছে ৫.৪৭ লক্ষ কোটি টাকা এবং ৫.৬১ লক্ষ কোটি টাকায়।

২০২০-২১ অর্থবর্ষে সরকারী ব্যায়ের সংশোধিত পরিমান পৌঁছেছিল ৩৪.৫ লক্ষ কোটি টাকায়, যদিও ২০২০ সালের ডিসেম্বর মাস অবধি মাত্র ২২.৮ লক্ষ্য কোটি টাকা খরচ করা হয়েছিল। সংশোধিত ব্যায়বরাদ্দে বাড়তি ৪ লক্ষ কোটি টাকা আসলে পূর্বের বাজেট ঘোষণায় ফুড কর্পোরেশন অফ ইন্ডিয়াকে এনএসএসএফ'র তরফে যে অর্থ ধার দেওয়া হয়েছিল সেই পরিমাণের সমান, এই টাকা আগের বাজেটের হিসাবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। ২০২০-২১ অর্থবর্ষের সাথে তুলনা করলে দেখা যাবে এবারের বাজেটে খাদ্যে ভর্তুকির পরিমান ৪১ শতাংশ কমিয়ে দেওয়া হয়েছে।

অর্থমন্ত্রীর ঘোষণায় যা উল্লেখ করা হয় নি তা হল গতবারের বাজেটে বিভিন্ন খাতে ঘোষিত ব্যায়বরাদ্দের চেয়ে খরচ করা হয়েছে অনেক কম। কৃষিক্ষেত্র, শিক্ষা, জনকল্যাণ, মহিলা এবং শিশু কল্যান খাতে, বিজ্ঞান দফতরে, নগরোন্নয়ন, পেনশন এবং প্রতিবন্ধিদের প্রয়োজনে এমন অনেকগুলি ক্ষেত্রেই খরচ কম করা হয়েছিল। এইসব ক্ষেত্রেই বাকি বরাদ্দকে পরের বছরের জন্য লাগু করা হয়েছে তাই নয়, গতবছর যেসব ক্ষেত্রে প্রয়োজনের ভিত্তিতে ব্যায়বরাদ্দ বাড়ানো হয়েছিল যেমন গ্রামোন্নয়ন এবং স্বাস্থ্য, সেইসব খাতেও এবারের বাজেটে বরাদ্দে কাটছাঁট করা হয়েছে। স্বাস্থ্যখাতে ব্যায়বরাদ্দ যথেষ্ট বেড়েছে বলে অর্থমন্ত্রী যতই দাবী করুন না কেন বাজেটের হিসাবেই অন্য কথা লেখা রয়েছে।  আগের বারের সংশোধিত বাজেটের তুলনায় ২০২১-২২ অর্থবর্ষে স্বাস্থ্যখাতে ব্যায়বরাদ্দ প্রায় ৮০০০ কোটি টাকা কমে দাঁড়িয়েছে ৭৪,৬০০ কোটি টাকায়। এই কাটছাঁটের মাধ্যমেই অর্থমন্ত্রী বাজেটে মোট ব্যায়বরাদ্দ কমিয়েছেন। দেশের জনগণের সাথে এইভাবেই এক বিরাট প্রবঞ্চনা করা হল।

এই সরকারের জনয় যাবতীয় সমস্যার একটাই সর্বরোগহর দাওয়াই রয়েছে, তা হল দেশের জাতীয় সম্পদ বেচে দেওয়া এমনকি লাভজনক রাস্ট্রায়ত্ত্ব সংস্থাগুলিকেও বিক্রি করে দিতে এদের বাধে না। এবারের বাজেটে অর্থের সংস্থানে বিবিধ রাস্ট্রায়ত্ত্ব সংস্থার জমি বিক্রির কথা ঘোষণা করা হয়েছে। বেসরকারিকরণের মাধ্যমে ১.৭৫ লক্ষ কোটি টাকা আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নিয়েছ সরকার। অত্যন্ত আপত্তিকরভাবে বীমাক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ বেসরকারি বিনিয়োগের পরিমান যেভাবে বাড়িয়ে ৭৪ শতাংশ করে দেওয়া হয়েছে। বেসরকারিকরণের লক্ষ্যে সরকারের এই মনোভাবই হল জাতীয় স্বার্থের প্রতি অবহেলা এবং আত্ম নির্ভরতার স্লোগানের এক নির্লজ্জ বিদ্রুপ।  

করোনা সংক্রান্ত খাতে সরকারী খরচ অনেক আগেই বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে, কেবলমাত্র প্রতিষেধকের জন্য খরচটুকুই সরকারের ব্যায় হিসাবে এখন প্রয়োজন। এখন যে প্রসঙ্গে সরকারের অনেক বেশী পরিমানে ব্যায়বরাদ্দ করা প্রয়োজন তা হল মোটের উপর অর্থনৈতিক সংকট যার প্রধান খাতগুলি হল ধ্বংসপ্রাপ্ত কর্মসংস্থানের চেহারা, জীবন - জীবিকার সুরক্ষা, জনগণের আয় বৃদ্ধি এবং বাজারে চাহিদা হ্রাস পাওয়ার মোকাবিলা করা। যেভাবে সরকার গতবারের ব্যায়বরাদ্দের খরচ বকেয়া রেখেছে, এবং এবারের বাজেটেও ব্যায়বরাদ্দে কাটছাঁট করেছে তাতে বলাই যায় জনগণের উপরে এক বিপর্যয় নেমে আসতে চলেছে। এর ফলে জনগনের দুর্দশা বাড়বে এবং বৈষম্য বাড়িয়ে দেবে যার জন্য ইতিমধ্যেই ভারত সারা পৃথিবীতে সুপরিচিত।

জনগণের হাতে নগদ অর্থ পৌঁছানো, বিনামূল্যে খাদ্যসামগ্রী বণ্টন এবং সকলের জন্য নিশ্চিত কর্মসংস্থানের দাবীতে জনগণ এই কর্পোরেটমুখি বাজেটের বিরোধিতায় সোচ্চার হন, এটাই পলিট ব্যুরোর আহ্বান।  


শেয়ার করুন

উত্তর দিন