সাত্যকি রায়
সরকারি তথ্য অনুযায়ী গত বছর আমাদের দেশের আর্থিক বৃদ্ধির হার ছিল ৮.৭% যা আপাত দৃষ্টিতে যথেষ্ট ভালো। এবং এ বছরে দেশের আর্থিক বৃদ্ধির হার ৭-৭.৫% হবে বলে বিভিন্ন দেশি ও আন্তর্জাতিক সংস্থা মনে করছে। এই পরিসংখ্যানগুলি সত্য হলেও তা প্রকৃত অর্থে আর্থিক অবস্থার হাল কে প্রতিফলিত করে না। গত বছরের আগে ২০২০-২১ এ আমাদের দেশে আর্থিক সংকোচনের মাত্রা ছিল -৬.৬%। এর মানে কি দাঁড়ালো? একটা সহজ অংক শুরু করা যাক। ধরা যাক ২০১৯-২০ তে আমাদের জি ডি পি ছিল ১০০ টাকা। ২০২০-২১ এ তা সংকুচিত (-৬.৬%) হয়ে হলো ৯৩.৪০ টাকা এবং ২০২১-২২ এ এর উপর ৮.৭% বৃদ্ধি ধরলে জি ডি পি হবে ১০১.৫৩ টাকা। অর্থাৎ ২০১৯-২০ র সঙ্গে তুলনা করলে ২০২১-২২ এ জিডিপি বেড়েছে মাত্র ১.৫৩%। অর্থাৎ কার্যত আমরা ২০১৯-২০ র জিডিপি’কে কোনোমতে ধরতে পেরেছি। প্রকৃত পরিসংখ্যান এই সত্যকেই তুলে ধরে। ২০১৯-২০ সালে ভারতের জিডিপি (২০১১-১২ র মূল্য অনুযায়ী) ছিল ১৪৫.১৬ লক্ষ কোটি টাকা যা ২০২১-২২ এ নামমাত্র বেড়ে হয়েছে ১৪৭.৩৫ লক্ষ কোটি টাকা। মনে রাখা দরকার যে দেশের গড় বার্ষিক মাথা পিছু আয় ২০২১-২২ এ ছিল ১.০৭ লাখ যা আসলে ২০১৯-২০র মাথা পিছু বার্ষিক আয় ১.০৯ লাখ থেকে কম। বাজারে চাহিদা সে ভাবে বাড়ে নি। এর লক্ষন বোঝা যাবে যদি প্রকৃত মাথা পিছু বার্ষিক ব্যাক্তিগত ভোগ ব্যয় মাপা হয়। ২০১৯-২০ সালে (২০১১-১২স্থির মূল্য শুচকে) যা ছিল ৬১.২ হাজার টাকা সেই ব্যক্তিগত মাথাপিছু বার্ষিক ভোগ ব্যয় দু বছর পরে সামান্য বেড়ে মাত্র ৬১.৬ হাজার টাকা হয়েছে। বাজারের অবস্থা বুঝে এবং মুনাফার সম্ভাবনা বিবেচনা করে পুঁজিপতিদের বিনিয়োগ ও কমের দিকে। চলতি বছরে অর্থাৎ ২০২২-২৩ এর প্রথম কোয়ার্টারে (এপ্রিল -জুন) নতুন বিনিয়োগের ঘোষণা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় ২৭% কমেছে। দেশের ম্যানুফ্যাকচারিং ও নির্মাণ ক্ষেত্রে আমরা সবে মাত্র কোভিড পূর্ববর্তী অবস্থায় পৌঁছতে পেরেছি। ব্যবসা, হোটেল রেস্টুরেন্ট ও পরিবহন ইত্যাদি পরিষেবা ক্ষেত্রে আমরা এখনো ২০১৯-২০ র উৎপাদনের মাত্রা থেকে পিছিয়ে আছি। অতএব অর্থনীতির যে সমস্ত ক্ষেত্রগুলিতে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হতে পারে, সেগুলিতে বৃদ্ধির হার যথেষ্ট আশাব্যঞ্জক নয়।
এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে মুদ্রস্ফীতির সমস্যা। এ কথা ঠিক যে খুচরো মূল্য সূচক অনুযায়ী এবছর জুন মাসে মুদ্রস্ফীতির হার ছিল ৭.০১% যা মে মাসের মুদ্রস্ফীতির ৭.০৪%হারের তুলনায় কম। মাস ভিত্তিতে তুলনা করলে খাদ্য দ্রব্যের মুদ্রস্ফীতির হার সামান্য কমেছে। কিন্তু মুদ্রস্ফীতির হার কম হওয়া মানে জিনিসের দাম বাড়ার গতি কমা। কিন্তু তার মানে এই নয় যে জিনিসের দাম কমছে। খেয়াল করলে দেখা যাবে যে যদি আমরা গত বছরের তুলনায় বিবেচনা করি ২০২১-২২ সালে এপ্রিল– জুন এই সময়ে খাদ্য দ্রব্যের মুদ্রস্ফীতির হার ছিল ৫.৪৮% আর এ বছর এপ্রিল -জুন সময় কালে এই হার ছিল ৭.৫১%। মাস ভিত্তিক তুলনায় খাদ্যদ্রব্যের মুদ্রস্ফীতির হার যেমন সামান্য কমেছে কিন্তু জামা কাপড় এবং জুতোর দাম বৃদ্ধির গতি বেড়েছে। একটু লম্বা সময়ে ফিরে দেখলে দেখা যাবে যে গত দশ বছরে সবজির দাম ৮২.৪% বেড়েছে এবং আমিষ খাবার অর্থাৎ মাছ মাংস ডিমের দাম ১১৪.২০% বেড়েছে অর্থাৎ দাম দ্বিগুনেরও বেশি হয়েছে। এর উপর খাদ্য দ্রব্যের উপর ৫% জি এস টি চালু করেছে সরকার। এর ফলস্বরূপ খাদ্য দ্রব্যের দাম আবার দ্রুত গতিতে বাড়তে শুরু করবে। অথচ এই সময়কালে বহু মানুষের কাজ চলে গেছে, অনেকের আয় কমে গেছে এবং সাধারণ ভাবে শ্রমিকদের প্রকৃত মজুরি কমেছে। যেটা এর সঙ্গে আরও নজরে রাখা দরকার তা হলো পাইকারি মূল্য সূচক বৃদ্ধির হার এখনো যথেষ্ঠ চড়া। এ বছরের জুন মাসে এই সূচক অনুযায়ী সমস্ত জিনিসের মুদ্রস্ফীতির হার ১৫.১৮% ছিল এবং খাদ্য দ্রব্যের ক্ষেত্রে মুদ্রস্ফীতির হার ১৪.৩৯%। পাইকারি মূল্যসূচক বেশি থাকার অর্থ হলো ক্রেতার কাছে দাম কমার বিশেষ সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। আবার পাইকারি ও খুচরো মূল্যসূচকের পার্থক্য বেশি হওয়ার মানে হলো ছোটো ব্যবসায়ী যারা মূল্যবৃদ্ধির বোঝা বেশিদিন সহ্য করার ক্ষমতা নেই তারা ক্রমাগত বাজারের প্রতিযোগিতায় পরাস্ত হতে থাকবে এবং এর ফলেও এক ধরণের পুঁজির কেন্দ্রীভবন ঘটবে।
এ প্রসঙ্গে এ কথাও বলা দরকার যে মুদ্রস্ফীতির প্রায় দুই -তৃতীয়াঅংশ যোগান জনিত সমস্যার জন্য। অর্থাৎ মানুষের চাহিদা বেড়েছে অথচ সেই তুলনায় যোগান কম তাই জিনিসের দাম বাড়ছে এমনটা নয়। মূলত উৎপাদন খরচ বাড়ার কারণে জিনিসের দাম বাড়ছে। এমতাবস্থায় ব্যাংকের রেপো রেট বাড়িয়ে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রনের রিজার্ভ ব্যাংক ও সরকারের নীতি অর্থনীতিতে চাহিদার সংকটকে আরও তীব্র করে তুলতে পারে।
এর সাথে আরও সমস্যা হলো ডলারের সাপেক্ষে টাকার দাম ক্রমাগত কমছে। জুন মাসে এক ডলার সমান ৭৯.০৬ টাকা। আমাদের দেশের সাধারণ ভাবে রপ্তানির তুলনায় আমদানির পরিমান বেশি এবং সাম্প্রতিক সময়ে বাণিজ্য ঘাটতি আরও বেড়েছে। এই অবস্থায় টাকার দাম কমার অর্থ হলো আমদানির খরচ আরও বাড়বে, দেশে যে সমস্ত ক্ষেত্রে আমদানিকৃত যন্ত্রপাতি ও কাঁচামাল ব্যবহৃত হয় সেই সব জিনিসের উৎপাদন খরচ আরও বেড়ে যাবে যা আবার জিনিসের দাম বৃদ্ধির কারণ হবে। দেশের উৎপাদন কাঠামোয় আমদানি নির্ভরতা বাড়ছে। এই সমস্যা সমাধানের চেষ্টা না করে চলতি খাতে ঘাটতি মেটানোর চেষ্টা হয়েছে বিদেশী পুঁজির উপর নির্ভর করে। বিদেশী পোর্টফোলিও বিনিয়োগ বেশি লাভের আশায় যে কোনো সময় দেশ ছেড়ে চলে যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে বাণিজ্য ঘাটতি আরও নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে এবং দেশের মুদ্রার দাম আরও কমার চাপ তৈরী হবে। এ বছরের এপ্রিল-জুন এই সময়ে নেট পুঁজি বহিঃর্গমনের পরিমান ছিল ১৫.২ বিলিয়ন ডলার। বিদেশে কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলি মুদ্রাস্ফীতি রুখতে সুদের হার বাড়াচ্ছে। এর ফলে বেশি লাভের আশায় পুঁজি আমাদের দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছে। এর প্রতিক্রিয়ায় আমাদের দেশের রিজার্ভ ব্যাংকও সুদের হার বাড়িয়ে পুঁজির বহিঃর্গমণ আটকাতে চাইছে। কিন্তু এর ফলস্বরূপ দেশে বিনিয়োগ আরও কমে আসতে পারে এবং অর্থনীতির চাহিদার সমস্যা আরও গভীর হয়ে যাবে।
আমাদের দেশে বেকারীর হার গত দশক পর্যন্ত আড়াই থেকে তিন শতাংশর মধ্যে ঘোরা ফেরা করতো। সাধারণত অনুন্নত দেশে বেকারি হার সংখ্যার হিসেবে কম হয়। কারণ এই সমস্ত দেশে মানুষ কাজ না করলে জীবন চালানো কঠীন। ফলে পছন্দের কাজের জন্য বা বেশি মজুরীর কাজের জন্য অপেক্ষা করা কার্যত অসম্ভব। উন্নত দেশে সামাজিক সুরক্ষার ব্যবস্থা ও বেকারদের বেশ কিছুদিনের ভাতার ব্যবস্থা থাকায়ে তারা উপযুক্ত কাজের জন্য অপেক্ষা করতে পারে। অর্থাৎ আমাদের দেশের বেশির ভাগ মানুষই বাঁচার জন্য যে কোনো কাজ করতে রাজি হয়ে যায়। এই অবস্থাতেও গত কয়েক বছর ধরে দেশে বেকারি হার প্রায় আট শতাংশর কাছাকাছি পৌঁছে গেছে। এই অবস্থা নিতান্তই ভয়াবহ। এই বছর জুন মাসে সিএমআইই’র তথ্য অনুযায়ী বেকারীর গড় হার ছিল ৭.৮%। শুধু এই মাসে ১.৩ কোটি মানুষ গত মাসের তুলনায় কম কাজে নিযুক্ত হয়েছে। এর বেশির ভাগটাই কৃষিক্ষেত্রে। বৃষ্টিপাতের সমস্যার কারণে কৃষিমজুর কম নিযুক্ত হয়েছে। কিন্তু এ ছাড়াও এই এক মাসে দেশে বেতন ভিত্তিক কর্মনিয়োগ কমেছে প্রায় ২৫ লক্ষ। অল্পবয়সীদের মধ্যে বেকারি মারাত্মক অবস্থায় পৌঁছেছে। ২০-২৪ বছরের ছেলে-মেয়েদের মধ্যে বেকারি জুন মাসে ছিল ৪৩.৭% এবং ২৫-২৯ এই বয়েসে ১৪.২৫%। বড় চিন্তার ব্যাপার হলো যে আমাদের দেশে শ্রমবাজারে অংশ গ্রহণের হার ক্রমাগত কমছে। এর মানে এই নয় যে কর্মক্ষম বয়সে লোক কাজ পেয়ে যাচ্ছে তাই এই হার কমছে। আসলে এই হার কমার কারণ হলো মানুষ কাজ পাওয়ার সম্ভাবনা সম্পর্কেই সন্দীহান হয়ে পড়ছে।
এই ভয়াবহ অবস্থায় সকলেই যে উদ্বেগজনক অবস্থায় রয়েছে তা একেবারেই নয়। গত দু বছরে আমাদের দেশের কর্পোরেটদের মোট মুনাফা দ্বিগুনের চেয়েও বেশি হয়েছে। অথচ অনুমান করা হচ্ছে যে নতুন করে প্রায় ৭.৫ কোটি মানুষ কোভিড পূর্ববর্তী সময়ের হিসাব অনুযায়ী দারিদ্রসীমার নিচে চলে যাবে। অতিমারীর সময়ে যখন দেশের এক চতুর্থঅংশ মানুষের আয় মাসে তিন হাজার টাকার কম ছিল এবং ৪৬% ভারতীয় ঋণ করে সংসার চালিয়েছেন তখন মুকেশ আম্বানির আয় ঘন্টায় ছিল ৯০ কোটি। এবং এই সময় আম্বানি দুনিয়ার চতুর্থ ধনী লোকে পরিণত হন। শুধু তাই নয়, ভারতীয় বিলিয়নেয়ারদের এই সময় কালে সম্পদ বেড়েছে প্রায় ৩৫%।
অতএব মোদ্দা কথা হলো অতিমারীর পরবর্তীতে আর্থিক পুনরুদ্ধারের গতি যথেষ্ট কম, অন্যদিকে মুদ্রাস্ফীতি ও বেকারি বাড়ছে। দেশে আর্থিক বৈষম্য ক্রমাগত গভীর হয়ে চলেছে । আসলে এক দীর্ঘমেয়াদি স্ট্যাগফ্লেশনের দিকে দেশের অর্থনীতি এগিয়ে চলেছে। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণের রাস্তা হলো আর্থিক বন্টনের পরিবর্তন। ধনীদের উপর কর চাপিয়ে সেই অর্থকে সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধির অভিমুখে ব্যবহার করা। বিশেষ করে অস্বাভাবিক অবস্থার সুযোগ নিয়ে যারা অতিমুনাফা করেছে তাদের উপর অস্বাভাবিক হারে কর লাগু করার দাবি নানা মহল থেকে দেশে-বিদেশে উঠছে। এই সরকার সে কথা না ভেবে সমস্যার অভিমুখই বদলে দিতে চাইছে মন্দির-মসজিদ বিতর্কে। অর্থাৎ রাজনীতির আঙিনায় মানুষের জীবন জীবিকার প্রশ্নটিকে গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনার বিষয়বস্তু করে তুলতে না পারলে, দেশের শাসক শ্রেণী এই সংকটের সময়ও মানুষের ক্ষোভ ও যন্ত্রনাকে সহজেই একে অপরের বিপক্ষে ধর্ম ভিত্তিক মেরুকরণে রূপান্তরিত করে পার পেয়ে যাবে।