Chandan Das On RSS

নাগপুর থেকে মুচিপাড়া: সঙ্ঘের ‘নেশানহুড ডিফাইনড’

চন্দন দাস

১৯৪৬-’৪৭-এ কলকাতায় রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের কর্মী ছিলেন ১০০জন। অবিভক্ত বাংলায় অন্তত ১লক্ষ!

জানাচ্ছে পুলিশ রিপোর্ট।

দেশভাগ পূর্ববর্তী ‘স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের উপর গোয়েন্দা শাখার স্মারক, জিবি এসবি ‘পিএম সিরিজ, ফাইল নং-৮২৯/৪৫ এবং ৮২২/৪৭১-এ এর উল্লেখ আছে।

সেই সময়ে সবচেয়ে শক্তিশালী ‘হিন্দু স্বেচ্ছাসেবক সংগঠন’ ছিল বৌবাজারের মুচিপাড়ায়। সেখানে ৩০০-৫০০জন স্বেচ্ছাসেবক ছিল। পার্ক সার্কাসের এমন দলটির নাম ছিল ‘আর্য বীর দল।’ সদস্য ছিল ১৬জন।

এমন আরও সংগঠন ছিল। ব্রিটিশের বিরুদ্ধে লড়াই এদের আদর্শ নয়। এদের লক্ষ্য ছিল ‘হিন্দু স্বার্থ রক্ষা।’

এদের সহায়তা করত কিছু ব্যবসায়ী। যেমন যুগল কিশোর বিড়লা। তবে বাংলা জুড়ে আরএসএস টাকা পেত মূলত জমিদারদের। যেমন সুসঙ্গ রাজ পরিবারের বাবু পরিমল সিংহ ছিলেন আরএসএস-র প্রবল সমর্থক। সুসঙ্গ মানে ময়মনসিংহ। তাছাড়াও রাজশাহী, পাবনা, বর্ধমান, মেদিনীপুরের মত জেলায় সঙ্ঘের অস্তিত্ব গড়ে উঠেছিল গরিব কৃষকদের উপর অত্যাচারে ফেঁপে ওঠা জমিদারদের সহায়তায়।

কেন? ১৯৩৬-৩৭ থেকে এই জমিদার-ব্যবসায়ীদের একটি বড় অংশ কংগ্রেসের পাশ থেকে সরে হিন্দু মহাসভা, আরএসএস-র পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। কারন তাদের মনে হয়েছিল — ‘হিন্দু স্বার্থ বিঘ্নিত হচ্ছে। কংগ্রেস উচ্চবর্ণের হিন্দুদের স্বার্থ রক্ষা করছে না। আর এই ক্ষেত্রে ‘হিন্দু স্বার্থ’ নিয়ে উদ্বিগ্ন বাবুদের প্রধান অভিযোগ ছিল ‘বসু ভ্রাতৃদ্বয়’-র বিরুদ্ধে।

একজন শরৎ বসু। অন্যজন সুভাষ চন্দ্র বসু।

এই দুই ভাইয়ের ‘অপরাধ’? তাঁরা ‘ম্লেচ্ছ, কমিউনিস্টদের’ গুরুত্ব দিচ্ছিলেন। একটি বিবরণ দিই?

১৯৩৭-এ কোলকাতার বঙ্গীয় ব্রাহ্মণ সভার স্মারকলিপি জানাচ্ছে —‘‘কংগ্রেস তার পুরানো ধ্যানধারনা থেকে বিচ্যুত হয়েছে এবং তার বৈশিষ্ট্যের পরিবর্তন ঘটেছে। এর রাজনৈতিক নেতারা ও তাদের অনুসারীদের অনেকেই এখন কম শিক্ষিত ও তাদের জানাশোনা কম। তারা আমদানি করা আইরিশ ইতিহাস, ইতালি ও অস্ট্রিয়ার বিপ্লব, ফরাশি প্রজাতন্ত্রবাদ ও সোভিয়েত শাসন নিয়ে পড়াশোনা করে। পশ্চিমা সভ্যতার পরীক্ষা-নিরীক্ষা তারা ভারতের ওপর প্রয়োগের চেষ্টায় আগ্রহী।...এটা করতে গিয়ে তারা ব্রাহ্মণ্যবাদী পুরোহিততন্ত্র ও জমিদারির মতো ভূস্বামীদের প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠানগুলি বাতিল করতে চায়...সামাজিক সংস্কারের নামে হিন্দুত্ববাদের মূলে আঘাত করছে।’’

বাংলায় ‘হিন্দুত্ববাদ’ স্পষ্ট চোখে পড়ল। সুভাষ চন্দ্র বসু পরিচালিত কংগ্রেস এবং কমিউনিস্ট, বামপন্থীরা অভিযুক্ত হল। এবং ‘আবির্ভূত’ হলেন ‘বীর’ সাভারকার — মমতা ব্যানার্জির ‘অটলজীর মত অটল’ শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জির হাত ধরে।

১৯৩৯-র ২৭শে ডিসেম্বর। ওয়েলিংটন স্কোয়ারে ফাগোয়া ঝান্ডা তুললেন হিন্দু মহাসভার নেতা সাভারকার। ততদিনে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদকে তার ৪টি মুচলেকা দেওয়া হয়ে গেছে।

যখন দেশের স্বার্থে বাংলার সবচেয়ে বেশি ঐক্যবদ্ধ হওয়ার কথা, তখন এলো ‘হিন্দুত্ববাদ।’ তখন এলেন সাভারকার। এলো ‘ফাগোয়া ঝান্ডা’ — সাভারকার বর্ণিত ভারতের জাতীয় পতাকা।

কী এই ‘ফাগোয়া ঝান্ডা’র আদর্শ?

বলবেন এমএস গোলওয়ালকার — ১৯৩৮-এ। বইয়ের নাম — ‘We or Our Nationhood Defined.’

ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম শুধু বৃটিশের বিরুদ্ধে লড়াই নয়। ভারতের স্বাধীনতার সংগ্রাম তাই শুধুমাত্র প্রায় ২০০ বছরের বৃটিশ শাসন ছুঁড়ে ফেলার লড়াই নয়। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম বৃটিশ ভারতের মাটিতে পা রাখার অনেক আগে থেকে চলছে। এবং সেই ‘স্বাধীনতার সংগ্রাম’ অন্তত এক হাজার বছরের। তা মূলত মুসলমান শাসনের বিরুদ্ধে চলেছে।

দেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম সম্পর্কে এটিই রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ(আরএসএস)-র ধারনা। স্বাধীনতা সংগ্রামে তাদের ভূমিকা এই ধারনার উপর পরিচালিত হয়েছে।

এই ক্ষেত্রে মাধব সদাশিব গোলওয়ালকারের বক্তব্যই গ্রাহ্য। তিনি সঙ্ঘের দ্বিতীয় সরসঙ্ঘচালক — অর্থাৎ সর্বোচ্চ নেতা। ১৯৪০ থেকে ১৯৭৩ পর্যন্ত তিনি সঙ্ঘকে পরিচালনা করেছেন। জন্ম ১৯০৬-এ। জাতীয় রাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ সময়কালে তিনি এই দেশে বাস করেছেন। কিন্তু কখনও বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সংগ্রামে অংশ নেননি। ‘বাঞ্চ অব থট’ শীর্ষক তাঁর প্রবন্ধ, সাক্ষাৎকারের সংকলনে যে বিস্তৃত জীবনী উল্লেখিত আছে, সেটি পড়ে মনে হওয়ার কোনও সুযোগ নেই যে, সেই সময়ে ভারত পরাধীন ছিল এবং বিভিন্ন ধারায় জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম চলছিল।

সেই তিনি, আরএসএস-র গুরুজী ‘বাঞ্চ অব থট’-র দ্বিতীয় অংশে ব্যাখ্যা করেছেন ‘দ্য নেশন অ্যান্ড ইট্‌স প্রবলেম।’ সেই ব্যাখ্যার পঞ্চম অংশ ‘টেরিটোরিয়াল ন্যাশনালিজ্‌ম।’ সেখানে, ১৪২ পাতায় গোলওয়ালকার বলছেন,‘‘যে অঞ্চলভিত্তিক জাতীয়তাবাদ এবং সাধারন বিপদের তত্বে আজ আমাদের রাষ্ট্রের ধারনা গড়ে উঠেছে, তাতে আমাদের প্রকৃত হিন্দু জাতীয়তাবাদের যথার্থ এবং উৎসাহব্যঞ্জক বিষয়বস্তু থেকে আমাদের বঞ্চিত করা হচ্ছে। আর স্বাধীনতা আন্দোলন প্রকৃতপক্ষে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে পর্যবসিত হচ্ছে। দেশাত্মবোধ এবং জাতীয়তাবোধের সঙ্গে ব্রিটিশ-বিরোধিতা সমার্থক হয়ে পড়ছে।’’

অর্থাৎ ‘বৃটিশ বিরোধিতা’ দেশাত্মবোধ নয়। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সংগ্রাম প্রকৃতপক্ষে স্বাধীনতা সংগ্রাম নয়। আরএসএস তাদের ‘গুরুজী’র ধারনায় পরিচালিত হয়েছে। স্বাধীনতা সংগ্রামের বিরোধী শক্তিতে পরিণত হয়েছে।

‘হিন্দুত্ব’ই তাদের প্রেরণা।

শত্রু? তিনটি। গোলওয়ালকারের ‘ইন্টারনাল থ্রেট’ প্রবন্ধে সেই শত্রুদের চিহ্নিত করা হয়েছে। প্রথমত, ‘দ্য মুসলিমস।’ দ্বিতীয়ত, দ্য ক্রিশ্চিয়ানস।’ তৃতীয়ত, ‘দ্য কমিউনিস্টস।’

মমতা ব্যানার্জির মত যাঁরা গোলওয়ালকারদের ‘প্রকৃত দেশপ্রেমিক’ মনে করেন তাঁরা অবধারিতভাবে এই তিন অংশের মানুষের শত্রু। এবং নিশ্চিতভাবেই তাঁদের জাতীয়তাবোধে ‘বাঞ্চ অব থট’ সম্পৃক্ত হয়ে আছে।

প্রশ্ন হল — স্বাধীনতা সংগ্রামে এই ‘হিন্দুত্ব’-র ধারনা কী ভূমিকা পালন করেছে?

এই ক্ষেত্রে ‘হিন্দুত্বর ধারনার জনক’-এর ভূমিকাই যথেষ্ট প্রমাণ হবে। ভারতের রাজনীতিতে ‘হিন্দুত্ব’র ধারনার প্রবর্তক বিনায়ক দামোদর সাভারকার। ১৯১১-র ৪ঠা জুলাই সাভারকারকে আন্দামানের সেলুলার জেলে পাঠানো হয়। আরও অনেক স্বাধীনতা সংগ্রামীই সেখানে বন্দী জীবন কাটিয়েছেন। কিন্তু সাভারকারের মত চিঠি আর কেউ লেখেননি। সেখানে ১৯১১ এবং ১৯১৩ — তিনি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী প্রশাসনের কাছে দুটি চিঠি লেখেন। পরে ১৯২৪, ১৯২৫-এও তিনি আর দুটি চিঠি দেন। এই তিনটিই ক্ষমাপ্রার্থনা এবং নির্লজ্জ মুচলেকা।

১৯১৩-র ১৪ নভেম্বরের চিঠিটির অংশ দেখা যাক। ব্রিটিশ সরকারকে লেখা দীর্ঘ চিঠিটির শেষ অংশে ‘বীর’ সাভারকার লিখছেন,‘‘...পরিশেষে ক্ষমাভিক্ষার আবেদনটি অত্যন্ত সহৃদয়তার সঙ্গে পাঠ করার সময় মহামান্য হুজুরকে আমি একথা স্মরণ করিয়ে দিতে পারি কী যে, অনুমোদনের জন্য এটিকে ভারত সরকারের কাছে পাঠাতে হবে?...কাজেই সরকার যদি তাঁদের বহুমুখী দয়ার দানে আমাকে একটু মুক্ত করে দেন তবে আমি আর কিছু পারি বা না পারি চিরদিন সাংবিধানিক প্রগতি এবং ব্রিটিশ সরকারের প্রতি আনুগত্যের অবিচলিত প্রচারক হয়ে থাকবো।...সরকার আমাকে যত কাজ করতে বলবে সেই মতোই প্রায় সব করতে আমি প্রস্তুত।...অন্যভাবে যা পাওয়া যেতে পারে সে তুলনায় আমাকে আটকে জেলে আটকে রাখলে কিছুই পাওয়া যাবে না। শক্তিশালীর পক্ষেই একমাত্র ক্ষমাশীল হওয়া সম্ভব। কাজেই অনুতপ্ত সন্তান পিতৃতুল্য সরকারের দরজায় ছাড়া আর কোথায় ফিরে যাবে?’’

এই মুচলেকা এক অধঃপতিত ব্যক্তির ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত বলে মনে করলে ভুল হবে। সাভারকারের প্রতিটি মুচলেকা আসলে তার বিশ্বাসের প্রতিফলন। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াইকে আদপে স্বাধীনতা সংগ্রাম মনে না করার ধারনা প্রতিফলিত হয়েছে তার নিদারুণ ক্ষমা প্রার্থনায়।

আরএসএস-র ইতিহাস তাই দেশের সঙ্গে, স্বাধীনতা সংগ্রামে বেইমানির ইতিহাস।

তথ্যসূত্র:

(১) Bunch of Thouthts, MS Golwalkar

(২) Bengal divided, Hindu communalism and partion, 1932-1947, Jaya Chatterjee

(৩) সাভারকার ও হিন্দুত্ব, এ জি নুরানি


শেয়ার করুন

উত্তর দিন