Price Hike Part 2

মূল্যবৃদ্ধি – কোন দিকে (পর্ব – ২)

ওয়েবডেস্ক প্রতিবেদন

mamatabbanerjee

“১৬টাকা কেজি আলুর দাম! আমি তো বিশ্বাস করতে পারছি না!”

২০১২ সালে কলকাতার কয়েকটি পরিচিত সবজি বাজারে প্রথমবারের জন্য সারপ্রাইজ ভিজিট দিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, তখন ১৬টাকা কিলো দরে আলুর বিক্রিতে নিজের প্রতিক্রিয়ায় উপরের কথাটি তারই বলা। (সুত্র – ইকোনমিক টাইমস)

সেই থেকে প্রায় প্রতি বছরই মূল্য বৃদ্ধি রুখে দিতে সরকারী টাস্ক ফোর্স গঠিত হয়েছে পশ্চিমবঙ্গে। ২০২২ সালেও তার অন্যথা হয় নি, ফারাক একটাই – আজকের বাজারে এক কেজি আলু বিক্রি হচ্ছে ৫০টাকায়!

প্রাবন্ধিক ধরে নিচ্ছে পাঠকেরা সাধারণ পাটিগণিত জানেন, ১৬টাকা থেকে শুরু করে কোন সামগ্রীর একই পরিমানের দাম ৫০টাকায় পৌঁছালে বৃদ্ধির হার বলতে হয় না – ছোটদের অংক শেখার উদাহরণ হিসাবেই তা উপযুক্ত।

করোনা মহামারীর কারনে কাজ হারানো, লকডাউনের ধাক্কায় আয় কমে যাওয়া কিংবা পশ্চিমবঙ্গে কর্মসংস্থানের চিত্র - এই তিনটি প্রসঙ্গই আলোচনার তাত্ত্বিক পরিসর ছাড়িয়ে লোকজনের দৈনন্দিন আলাপচারিতায় এতটাই সামনে চলে এসেছে যার প্রভাবে আজকের পরিস্থিতি সম্পর্কে মুখ্যমন্ত্রী কিংবা রাজ্য সরকারের তরফে কেউই মুখ খুলছেন না।  

কেন্দ্রীয় মন্ত্রকের প্রকাশিত প্রতিবেদন - ‘মূল্যবৃদ্ধির হারে সারা দেশের মধ্যে প্রথম স্থানে রয়েছে পশ্চিমবঙ্গ’।

টাস্ক ফোর্স ব্যাপারটি ঠিক কিরকম?

আচমকা কোন সংকট উদ্ভুত হলে সরকারের তরফে স্বল্পমেয়াদী সাধারন পরিকল্পনার প্রাথমিক পর্যায়ে টাস্ক ফোর্স গঠন করা হয়। এধরনের টিম দ্রুত সমস্যার কারণ খুঁজে বের করে, সরকার সেই অনুযায়ী উপযুক্ত সিদ্ধান্ত নেয়। ২০১১ সালের পর থেকে পশ্চিমবঙ্গে এধরনের যাবতীয় টাস্ক ফোর্স প্রথম কাজটি কি করেছে বা করেনি সেই নিয়ে সংশ্লিষ্ট মহলে বিতর্ক হতে পারে, কিন্তু দ্বিতীয় কাজটি যে কিছুই হয় নি এই বিষয়ে কোথাও কোন বিতর্কই নেই। অর্থনীতি, মূল্যবৃদ্ধি এই প্রসঙ্গে জনজীবনের সমস্যাকে প্রধান গুরুত্ব দিতে খাদ্যসামগ্রীর মূল্যবৃদ্ধিতেই আমরা সীমিত থাকতে চাইছি।

সরকার কিছুই করছে না। একথার জবাবে বলা হবে সরকারের পক্ষে এধরনের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির রোধে রাতারাতি কিছু করা সম্ভব না। হাল ফ্যাশনের সোশ্যাল মিডিয়ার পণ্ডিতবর্গ এভাবেই কোন প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে প্রশ্নকর্তাকেই গুলিয়ে দিতে, কিংবা সম্পূর্ণ অবান্তর, অপ্রাসঙ্গিক মন্তব্য করে ওয়ার রুম থেকে পরিচালিত ক্ষণিকের যুদ্ধ জিতলেও বাস্তবের সমস্যা সমাধানে এহেন পন্থা কোন কাজে আসে না।

কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে যে প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে তার দিকে তাকালেই দুটি পরস্পর নির্ভর সত্য উপলব্ধি করা যায়। প্রথমটি হল পশ্চিমবঙ্গ মূল্যবৃদ্ধিতে সবার উপরে রয়েছে। এর মানে দেশের বাদবাকি রাজ্যগুলির অবস্থা এক নয়, মূল্যবৃদ্ধি সবজায়গাতে হলেও রাজ্যভেদে তার প্রাবল্যের ফারাক আছে, তীব্রতার কম বেশি রয়েছে – এই হল দ্বিতীয় সত্য। এই দ্বিতীয় সত্যের দিকে মনযোগী হলেই জনকল্যাণে সরকারের প্রকৃত ভূমিকা সম্পর্কে সচেতন হওয়া যায়। মনে রাখতে হবে মূল্যবৃদ্ধির তালিকায় সবার শেষে রয়েছে কেরালা – সেখানে এলডিএফ শাসন।

বাজারে জিনিসপত্র অত্যন্ত চড়া দামে বিকোচ্ছে এই প্রসঙ্গে কেন্দ্রীয় সরকারী প্রতিবেদন প্রকাশিত না হলেও আমাদের রাজ্যে সরকার যথেষ্ট ওয়াকিবহাল। কি করে? কারণ এহেন মূল্যবৃদ্ধিতে রাজ্য সরকারের ভূমিকা রয়েছে।

এক এক করে জরুরী প্রসঙ্গগুলি আলোচনা করা যাক।

আমাদের রাজ্যে উৎপাদিত হয় এমন ফসলগুলির মধ্যে চাল, ডাল, আলু, ভুট্টা, তৈল বীজ ও বিভিন্ন শাকসবজিই প্রধান। তা স্বত্বেও আমাদের রাজ্যে আলুর দাম ৫০ টাকায় পোঁছে গেছে, ভোজ্য তেল, ডাল সহ রোজকার খাদ্য হিসাবে শাকসবজির দামও আকাশছোঁয়া। এটিই পশ্চিমবঙ্গে আজকের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি আলোচনার প্রেক্ষিত। তাহলে সহজ যুক্তিতে যা উঠে আসে তা হল রাজ্যে উৎপাদনের ঘাটতি হয়েছে, বাইরের রাজ্য থেকে আমদানি করে চালাতে হচ্ছে তাই বাড়তি দর। উৎপাদন কম হল কেন? এখানেই অর্থনীতির প্রসঙ্গ – কেউ মন্তব্য করতে পারেন কৃষিকাজ লাভজনক না থাকায় কৃষিজীবীরা অন্য পেশায় নিযুক্ত হচ্ছেন, বিরাট পরিমাণ চাষের জমি অব্যবহৃত পড়ে রয়েছে তাই উৎপাদন কম হয়েছে। ফসলের দাম না পেয়ে অন্তত ২২০ জন চাষির আত্মহত্যার ঘটনার কথা জানিয়েছে রাজ্য কৃষক সভা (২০১৯ সাল পর্যন্ত হিসাব – সুত্রঃ দ্য হিন্দু)। করোনা অতিমারির সময়ে টেলিভিশনে বাইরের রাজ্যগুলি থেকে আমরা যাদের পায়ে হেঁটে পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় নিজেদের বাড়ি ফিরতে দেখেছিলাম তারাও মূলত এধরনের কাজের সাথেই যুক্ত শ্রমজীবী মানুষ।

কিন্তু রাজ্য সরকার নিজেই কৃষকসভার দেওয়া সেই তথ্যকে অস্বীকার করেছে। এনসিআরবি’র প্রতিবেদনে ২০১৯ সালে মোট ১২৮৪ জন আত্মহত্যা করেছিলেন – তাদের মধ্যে একজনও কৃষক না। অর্থাৎ রাজ্য সরকারের বয়ান অনুযায়ী আমাদের রাজ্যে কৃষকদের এমন কোন সংকট নেই যাতে তাদের আত্মহত্যা করতে বাধ্য হতে হয়। তাহলে উৎপাদনে ঘাটতি হবে কেন? ফসলের লাভজনক দাম না হোক, অন্তত ন্যায্য দামটুকু পেলে কৃষক চাষ করতে অনীহা বোধ করবেন কেন?

যদি ঘাটতির সম্ভাবনা মেনে নিতে হয় তাহলে সরকারের অপদার্থতা প্রমান করতে আর কিছুই লাগে না। উৎপাদনে ঘাটতি অস্বীকার করা হলে যে সম্ভাবনাটি পড়ে থাকে তাতেও রাজ্য সরকারের মুখরক্ষা হয় না। অর্থনীতি সত্যিই বোঝেন এমন কেউ কেউ মন্তব্য করছেন এমন পরিস্থিতির জন্য দায়ী জনকল্যাণের নামে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অনুপ্রাণিত যাবতীয় শ্রী’প্রকল্প। অর্থাৎ রাজ্য সরকার যেভাবে সর্বজনীন ডোল দিতে শুরু করেছে তাতে পরিকাঠামো খাতে সরকারী ব্যয়বরাদ্দের আর সংস্থান নেই এবং এরই ফলে অভ্যন্তরীণ উৎপাদন ব্যহত হয়ে মূল্যবৃদ্ধির সংকট ক্রমশ চেপে বসছে। মূল্যবৃদ্ধির অনুবন্ধী সংকট হিসাবেই বাড়ছে বেকারির সমস্যা, মনে রাখতে হবে এরা সবসময় একে অন্যকে বাড়িয়ে দেয়। চাকরি চেয়ে গান্ধীমূর্তির পাদদেশে বসে থাকা শিক্ষিত যুবক-যুবতীদের ভিড় সেই কারণেই অর্থনীতি আলোচনার বাইরের প্রসঙ্গ নয়।

বর্তমান প্রবন্ধকার মনে করে সংকটের মূল কারণ ও তদজনিত ফলাফল একে অন্যের পরিপূরক। ২০১১ সালের পর থেকে পশ্চিমবঙ্গে গ্রামীণ কর্মসংস্থান প্রকল্পে (MGNREGA) নিযুক্তির জব কার্ড এবং মজুরি দেওয়ার ক্ষেত্রে ব্যাপক দুর্নীতি সহ স্থানীয় তৃণমূল নেতাদের নিয়ন্ত্রণে ফড়েদের কারসাজির শিকার হয়ে উৎপাদিত ফসলের ন্যায্য দাম না পাওয়ার কারনে উদ্ভুত ক্ষোভকে চাপা দিতে বিভিন্ন শ্রী’প্রকল্পের প্রাথমিক পরিকল্পনা গ্রহণ। পরে আবার সেইসব প্রকল্পের সুবিধা ‘ও পেলে আমিও পাব না কেন’ জাতীয় মনোভাবকে সামলাতে না পেরে একেবারে যাচ্ছেতাই অবস্থা। এই মুহূর্তে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের মোট খরচের হিসাব ২.৬১ লক্ষ কোটি টাকা, সরকারী আয় বাবদ প্রাপ্তি মাত্র ১.৯৮ লক্ষ কোটি টাকা – অর্থাৎ আয়-ব্যয়ের ঘাটতির পরিমাণ ৬২৩৯৭ কোটি টাকা। এই ঘাটতি মেটাতে সরকার চড়া সুদে বাজার থেকে ঋণ নিচ্ছে, আবার পেট্রোপন্যে বাড়তি সেস ইত্যাদিও চাপাচ্ছে। সম্প্রতি আয় বাড়াতে ট্রাফিক আইন ভাঙ্গার ঘটনায় অভূতপূর্ব জরিমানাও নির্ধারিত হয়েছে। কিন্তু সেইসব অর্থও সরকারী বয়ান অনুসারে যাবতীয় শ্রী’প্রকল্পেই খরচ হয়ে যাচ্ছে, অন্য কোন বরাদ্দ করা যাচ্ছে না। এমন হরেন্ডাস পরিস্থিতির জন্য সরকারের দূরদৃষ্টির অভাবকেও দায়ী করা যায় আবার সরাসরি অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক যোগ্যতার প্রশ্নেও সন্দিহান হতে সাহস যোগায়।  

মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বারে বারে রাজ্যের প্রাপ্য অর্থ কেন্দ্র মঞ্জুর করছে না বলে অভিযোগ করেছেন। প্রাপ্য অর্থের একটা বিরাট পরিমানই জিএসটি বাবদ নির্ধারিত ক্ষতিপূরণের ব্যালেন্স অ্যামাউন্ট। একথা সত্যি যে বিজেপি শাসিত কেন্দ্রীয় সরকার জিএসটি’র ক্ষতিপূরণ বাবদ রাজ্যগুলির প্রাপ্য দিতে অহেতুক ঢিলেমি করেছে। কিন্তু সেইসব প্রাপ্য যে শুধু পশ্চিমবঙ্গই পাচ্ছেনা এমনটা নয়, কেরালার এলডিএফ সরকার আর যাই হোক বিজেপি’র ‘স্বাভাবিক মিত্র’ নয় একথা না বললেও সবাই জানে।

এই কারনেই মূল্যবৃদ্ধির তালিকায় একেক রাজ্যের পরিস্থিতি একেক রকম। প্রতিটি রাজ্যেই রাজ্য সরকারকে নিজস্ব উদ্যোগে কিছু কাজ করতে হয়। তার কিছুটা রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতা (যেমন জ্ঞানবাপী’ সংক্রান্ত ব্যাপক প্রচার আসলে বিজেপি’র মাস লাইন) আর বাকিটা দক্ষতা। সেই দক্ষতার প্রশ্নেই অর্থনীতি কাজ করে। একটা সরকার তাদের নিজেদের রাজ্যে ফসল উৎপাদনের ঘাটতি হবে কিনা আন্দাজ করতে পারে, বাজারে কোন জিনিস কতটা বাড়তি দামে বিকোতে পারে তা অনুধাবন করতে পারে এবং সেইসব ক্ষেত্রে জরুরী আগাম সতর্কতামূলক বন্দোবস্তও করা যায় – যদি সরকার আসলেই এমন কিছু করতে চায়।

এই প্রবন্ধের প্রথম পর্বে আমরা কেন্দ্রীয় সরকারের ভুমিকা আলোচনা করেছি। সেই লেখায় কেন্দ্রীয় সরকারের বিভিন্ন কাজকে সমালোচনা করা হয়েছে। আমাদের রাজ্যে পরিস্থিতি কিছুটা স্বতন্ত্র। কোন কাজ করা হলে তার ঠিক ভুল বিচার করার বিভিন্ন স্বীকৃত পদ্ধতি রয়েছে, যখন বাড়তি কর এবং বাজার থেকে বাড়তি ঋণ আদায় করা ছাড়া একটা সরকার আর কিছুই করেনি তখন তাকে সমালোচনার ভিত একটাই – রাজনীতি।

আজকের পশ্চিমবঙ্গে সরকারী টাস্ক ফোর্স এই কারনেই অকেজো, কারণ টাস্ক ফোর্স পরিস্থিতির মোকাবিলায় যা কিছুই বলবে তার কিছুই করবে না এই সরকার। রাজ্যের উন্নয়নে পরিকাঠামো খাতে সরকারী ব্যয়বরাদ্দ বাড়ানোর মতো হিম্মত মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেই। এমন কাজ করতে বলার মতো অর্থনৈতিক দর্শনে তার দলে কিংবা তার সরকারের নির্বাচনী কৌশলীরা কেউই বিশ্বাস রাখেন না।

পরিকাঠামো খাতে যাতে কোন উন্নয়নমূলক, জনকল্যানমূলক ব্যয়বরাদ্দ না হয় তা মনিটর করার জন্য প্রতি বছর আন্তর্জাতিক লগ্নী পুঁজি লক্ষ লক্ষ কোটি ডলার খরচ করে। ভারতে তাদের প্রতিনিধিরা বিজেপি চালিত কেন্দ্রীয় সরকার এবং তৃণমূল কংগ্রেস পরিচালিত রাজ্য সরকার উভয়ের পারফর্মেন্সেই খুব খুশি। কারণ উভয়েই নিজেদের জায়গায় আসলে যার বা যাদের স্বার্থ অক্ষুণ্ণ রাখছেন তাকে ফাটকাবাজ-মুনাফাখোর ছাড়া আর কিছুই বলা যায় না।

পপ্যুলিজম বলুন, মডেল বলুন এসবের পিছনে আসলে বিচার করতে হয় যা চলছে তাতে কার লাভ, কাদের লাভ?    

এই প্রশ্নের জবাব পাওয়া কঠিন না। আজকের পশ্চিমবঙ্গের দিকে তাকালে একথা বোঝাও শক্ত নয় যে রাজ্য সরকার আসলে নিজের সাধ্যানুযায়ী ফাটকাবাজির সুযোগ নির্মাণ করে চলেছে। সেই ফাটকাবাজি হল আন্তর্জাতিক লগ্নী পূঁজির প্রেসক্রিপশন। জনগণের জীবন-যন্ত্রণা বাড়িয়ে চলা নয়া-উদারবাদ নামের নরখাদক ব্যবস্থাটাকে বিজেপি কিংবা তৃণমূল কংগ্রেস প্রত্যেকেই নিজেদের যোগ্যতা অনুযায়ী রসদ যুগিয়ে চলেছে এটুকুই বর্তমান অর্থনীতির আসল কথা।

কেরালা যে কেন মূল্যবৃদ্ধির তালিকায় সবার নিচে সেকথাও এই থেকেই বোঝা যায়।

ওয়েবডেস্কের পক্ষেঃ সৌভিক ঘোষ


শেয়ার করুন

উত্তর দিন