Prakash Karat

উগ্র দক্ষিণপন্থার উত্থান ও আমাদের কর্তব্য (চতুর্থ পর্ব)

গত ৩ জানুয়ারি কলকাতার প্রমোদ দাশগুপ্ত ভবনে গনশক্তি পত্রিকার ৫৭তম বার্ষিকী উপলক্ষে বক্তৃতা করেন পার্টির পলিট ব্যুরো সদস্য প্রকাশ কারাত। তার সেই বক্তব্যের সম্পূর্ণ বাংলা অনুবাদ চারটি পর্বে রাজ্য ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হবে। আজ তারই চতুর্থ তথা শেষ পর্ব। বিজেপি-আরএসএস কে রুখতে গেলে দ্বিমুখী কৌশল গ্রহণ করতে হবে। কোন একটা ভাবে এদেরকে আটকানো সম্ভব না। এটা এখন স্পষ্ট যে আরএসএস-বিজেপি নয়া উদারবাদী আর্থিক নীতির হাত ধরেই এগোবে, আর তার ফলে মানুষের কী অবস্থা হচ্ছে তাও আমরা দেখতে পাচ্ছি। আমি এই নিয়ে বিস্তারিত আলোচনায় যাচ্ছি না, কিন্তু ডিসেম্বর ২০২২ এর শেষে কোথায় দাঁড়িয়েছে দেশের অর্থনীতি ? মুদ্রাস্ফীতির হার কোথায়?দেশে বেকারের সংখ্যা একটা পরিসংখ্যান অনুযায়ী ৫ কোটি ছাড়িয়ে গেছে! খুচরো বাজারে মুদ্রাস্ফীতির হার (retail inflation) ৭% ছাড়িয়ে গেছে । ডলারের তুলনায় টাকার দাম কমতে কমতে এখন ১ ডলার সমান ৮২ টাকায় এসে ঠেকেছে। ধনী অংশ বাদ দিলে সমাজের সকল অংশ - কৃষক,ক্ষেত মজুর,ছোট ব্যবসায়ী থেকে মধ্যবিত্ত কর্মচারী সকলের নিত্য দিনের খরচ বেড়েছে এই সময়কালে। অর্থাৎ রাষ্ট্রের আর্থিক নীতির ফলে মানুষের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। আমাদেরকে এইসব নীতির বিরুদ্ধে সমাজের বৃহত্তর অংশকে ঐক্যবদ্ধ করতে হবে,  সে সমাজের যেই অংশেরই হোক না কেন যারাই নীতির ফলে ক্ষতিগ্রস্ত তাদেরকে একত্রিত করাই আমাদের কাজ। আরো বেশি করে এর বিরুদ্ধে যৌথ সংগ্রাম গড়ে তুলতে হবে। এই ধরণের যৌথ সংগ্রাম গড়ে উঠেছে, এখনও গড়ে উঠছে। ২০২১ সালের কৃষকদের ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম তারই উদাহরণ, সারা বছর ধরে এই সংগ্রাম চলল, তার কিছু সুফল ও মিলেছিল। এই সময়ে আমরা দেখেছিলাম শ্রমজীবিদের সংগঠন,ট্রেড ইউনিয়ানগুলোর সাথেও বিভিন্ন কৃষক সংগঠন ঐক্যবদ্ধভাবে এই সংগ্রাম চালিয়ে গেছে। একই সাথে এর বাইরে সমাজের অন্যান্য অংশের মানুষদেরকেও লড়াইয়ে শামিল করার একটা প্রয়াস লক্ষ্য করা গিয়েছিল, এই ধারা বজায় রাখতে হবে। কেন্দ্রের বা যেই ক্ষেত্রগুলো রাজ্যের সরকারের আর্থিক নীতি মানুষের জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলছে, জনবিরোধী নীতি যেই যেই জায়গায় নেওয়া হচ্ছে সেই সমস্ত ক্ষেত্রে মানুষের বৃহত্তর অংশকে সাথে নিয়ে আমাদের এই সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে-এর কোন বিকল্প নেই। জীবন জীবিকার জন্য সংগ্রাম,বেসরকারীকরণের বিরুদ্ধে সংগ্রাম, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির বিরুদ্ধে সংগ্রাম এইগুলো এই দ্বিমুখী লড়াইয়ের একটা ভাগ। কিন্তু এটা কখনই একক ভাবে সাফল্য লাভ করতে পারবে না। কোন ধরণের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনও করতে পারবে না - এটা হয়ে থাকবে খন্ডিত, অসম্পূর্ণ যতক্ষণ না আমরা আরএসএস বিজেপির হিন্দুত্বের আদর্শ, তাদের রাজনীতির বিরুদ্ধে আমাদের রাজনৈতিক ও মতাদর্শগত লড়াইকে শক্তিশালী করতে পারছি। ওদেের রাজনীতি আজকের সময়ে আধিপত্য কায়েম করতে পারছে কারণ গোটা কর্পোরেট মিডিয়া তাদের হয়ে প্রচার চালাচ্ছে- তারা এই রাজনীতিকেই পছন্দ করে। খবরের কাগজ,টিভি,শোশ্যাল মিডিয়া সর্বত্রই দেখবেন শুধুমাত্র আরএসএস-বিজেপির মতাদর্শ আর রাজনীতিই তুলে ধরা হচ্ছে, মানুষের মাথার দখল নেওয়া হচ্ছে। হিন্দুত্বের  আদর্শ আজ সর্বত্র প্রচারিত হচ্ছে, আধিপত্য করছে এবং এর বিরুদ্ধে মতাদর্শগত লড়াই চালিয়ে যাওয়া ছাড়া কোন বিকল্প নেই। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি এটাই যে বেশ কিছু অ-বিজেপি বুর্জোয়া রাজনৈতিক দলও এই হিন্দুত্বের মতাদর্শ দ্বারা প্রভাবিত হচ্ছে। এরা মনে করছে সরাসরি হিন্দুত্বের মতাদর্শের বিরুদ্ধে লড়াই করা যখন কঠিন হয়ে যাচ্ছে তখন আমরা বরং এই ধারণার মধ্যে কিছু রদবদল করি, নরম-হিন্দুত্বের রাস্তায় হাঁটি আর এইভাবেই মানুষের যে ক্ষোভ আছে তাকে কাজে লাগিয়ে বিজেপিকে ক্ষমতাচ্যুত করতে পারব। কেজরীবাল এইবার গুজরাটের নির্বাচনে এই পথেই হেঁটেছিল, কিন্তু বড় কোন সাফল্য পায়নি।এটা সম্পূর্ণ ভুল একটা ধারণা। এরফলে বরং হিন্দুত্বের মতাদর্শই আরো শক্তিশালী হবে। আরএসএস এতে খুশিই হবে, তারা বলবে যে - আমরা তো এইটাই চাই যে সমস্ত হিন্দুদের একই ধরনের রাজনৈতিক অবস্থান -বোঝাপড়া হবে, হোক না তারা বিভিন্ন রাজনৈতিক দল করে কিন্তু তারা তো দিনের শেষে হিন্দুত্বের মতাদর্শের প্রচারই করছে। এইখানেই আসে বামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলোর গুরুত্ব। কারণ অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলো এই হিন্দুত্বের মতাদর্শকে কিভাবে মোকাবিলা করবে তার কোন বোঝাপড়া তৈরি করতে অক্ষম, মানুষের কাছে বিকল্প মতাদর্শ নিয়ে পৌঁছাতেও অক্ষম। বামপন্থীরা তাদের আদর্শের কারণেই, যা একটা বৈজ্ঞানিক মতাদর্শ, জানে কোন বিকল্প মানুষের সামনে নিয়ে যেতে হবে। আরএসএস-এর বিভেদকারী, নেতিবাচক প্রচারকে ঠেকিয়ে সঠিক বিকল্প মতাদর্শ একমাত্র বামেরাই মানুষের কাছে হাজির করতে পারে। যদিও জাতীয় পর্যায়ে আমরা এখন হয়ত অত বড় শক্তি নই , কিছু অ-বাম দলের শক্তি আমাদের থেকে বেশি এটাও ঠিক , কিন্তু বামেরাই একমাত্র সক্ষম মতাদর্শগত ও রাজনৈতিক লড়াইয়ে প্রধান ভূমিকা গ্রহণ করতে যেখানে পরবর্তীতে অন্যান্য নানান রাজনৈতিক মঞ্চ,দল যুক্ত হয়ে এই লড়াইকে শক্তিশালী করতে পারে এবং একটা বিকল্প, বিজেপি-আরএসএস বিরোধী বৃহত্তর মঞ্চ গড়ে তুলতে পারে। অর্থাৎ , এই দ্বিমুখী কৌশল যেখানে একদিকে মানুষের দৈনন্দিন দাবি-দাওয়া নিয়ে লড়াই আন্দোলন চালিয়ে যেতে হবে, যার বিষয়ে আমাদের অতীতে যথেষ্ট অভিজ্ঞতা আছে, বর্তমানেও আমরা এই ধরনের লড়াই-সংগ্রাম চালিয়েছি, কিন্তু শুধুমাত্র এইভাবে বিজেপি কে রাজনৈতিক ভাবে ভিচ্ছিন্ন বা পরাস্ত করা সম্ভব নয়। কিষাণ সংগ্রামের পরে উত্তরপ্রদেশের বাইরের বহু মানুষ বলেছিল যে উত্তরপ্রদেশে বিজেপির ফল খারাপ হবে, অন্তত পশ্চিম উত্তরপ্রদেশে তো হারবেই, কিন্তু আমরা কী দেখলাম? কিন্তু বিজেপি বিধানসভায় তো হারলোই না এমনকি সামগ্রিকভাবে পশ্চিম উত্তরপ্রদেশেও তারা হারে নি, হ্যাঁ তারা কিছু আসনে পরাস্ত হয়েছিল কিন্তু এটা হয়েছিল কারণ তাদের যে মেরুকরণের রাজনীতি,হিন্দু -মুসলমান বিভেদের রাজনীতি সেটা কিছুটা ধাক্কা খেয়েছিল কিষাণ সংগ্রামের জন্য, আমরা কিছুটা সমতার পরিবেশ আনতে পেরেছিলাম।  কিন্তু সেই মেরুকরণ সম্পূর্ণ মুছে যায়নি, আর তার ওপর ভরসা করেই বিজেপি বিধানসভায় জিতে যায়। বিজেপিকে ছোট করে দেখার কোন কারণ নেই, আমরা ২০০০ সালে যখন আমাদের পার্টি কর্মসূচী সময়োপোযোগী করেছিলাম আমরা স্পষ্ট বলেছিলাম- বিজেপি আর পাঁচটা বুর্জোয়া পার্টির মত নয়, এটার বিশেষত্ব হল এটা পরিচালিত ও নির্দেশিত হয় রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ দ্বারা,যাদের একটা ফ্যাসিবাদী মতাদর্শ আছে। স্পষ্টতই মোদি সরকারকে হঠাতে, বিজেপিকে হারাতে গেলে আমাদেরকে মতাদর্শের দিক থেকেও আরো শক্তিশালী হতে হবে। বিজেপ, নরেন্দ্র মোদি আমাদের মতাদর্শের শক্তি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল। ২০১৮ সালের বিধানসভা নির্বাচনে ত্রিপুরাতে বিজেপি আমাদের পরাস্ত করার পরে , বিজেপি সরকারের শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানের পরবর্তী সভায় গিয়ে মোদি তাই বলেছিল - এটা  আমাদের কাছে একটা মতাদর্শগত বিজয়। এরথেকে বোঝা যায় বিজেপির কাছে কমিউনিস্টদের হারানো শুধুমাত্র একটা রাজনৈতিক জয় নয়,এটা একটা মতাদর্শগত বিজয়। গতবছর একটা সাক্ষাৎকারে মোদি বলেছে যে এখন দেশের একটা কোনায় (কেরালায়) ছাড়া কমিউনিস্টদের বিশেষ আর কোথাও দেখা যায় না, কিন্তু তবুও তারা দুশ্চিন্তার কারণ। সংখ্যায় নগন্য হলেও কমিউনিস্টরা,বামপন্থীরা ওদের মতাদর্শের জন্য প্রকৃত ও সবথেকে বড় ভয়ের কারণ। সুতরাং,আমাদেরকে এই দ্বিমুখী লড়াই আগামী দিনগুলোতে চালিয়ে যেতে হবে, এটাই আমাদের প্রধান কাজ । নাহলে কোন একটা দিকে বেশি নজর দিলে এখানেও তুরস্কের মত পরিস্থিতি হতে পারার সম্ভাবনা আছে। ওখানে কুর্দদেরকে এমনভাবে শত্রুতে পরিণত করা হয়েছে যে তারা এখন প্রতিরোধের জন্য সশস্ত্র , হিংসাত্মক পন্থা বেছে নিয়েছে। মানুষের মধ্যে তুরস্কের মত জাতীয়তাবাদী মনোভাব বেড়ে গেলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা, দ্বিমুখী লড়াই চালানো খুব কঠিন হয়ে পরে। কিন্তু আমাদের দেশের ক্ষেত্রে এই ঐতিহ্য আছে যেখানে ব্যাপকতর জনগণকে একজোট করে বিশাল বড় বড় সংযুক্ত গণ-আন্দোলন গড়ে তোলা হয়েছিল। জাতি,ধর্ম,বর্ণ নির্বিশেষে মানুষ একজোট হয়েছিলেন এই সংগ্রামগুলোয়। এই ঐতিহ্যকে এতো সহজে নষ্ট করে দেওয়া যাবে না। আমরা কিষাণ সংগ্রামের ক্ষেত্রেও এটা দেখেছি। পশ্চিম উত্তরপ্রদেশের মুজফফরনগরেই জাঠ কৃষকেরা মুসলমানদের হত্যা করেছিল, কিন্তু কিষাণ সংগ্রামের সময় দেখলাম জাঠ সম্প্রদায়েরই কৃষক নেতারা মুসলমান দের বলছেন- আমরা হর হর মহাদেব বলব, তোমরা আল্লাহু আকবার বলবে, কিন্তু এই লড়াইটা একসাথে চলবে। অর্থাৎ আমাদের এই ঐতিহ্য আছে যেখানে কৃষকসমাজ সাম্রাজ্যবাদ, উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে একজোট হয়ে লড়াই করেছিল। ১৮৫৭-এর মহাবিদ্রোহের সময়তেও আমরা দেখেছিলাম শুধুমাত্র হিন্দু আর মুসলমান সৈনিকরাই নয়, জাত ধর্ম নির্বিশেষে কৃষক সমাজও কিভাবে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ব্রিটিশ-রাজের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিল। আমাদের এই অতীত ঐতিহ্য থেকেই আমরা শিখতে পারি। মানুষের মধ্যে যাওয়া , ধৈর্য্য ধরে তাদের মধ্যে কাজ করে আমরা এই দ্বিমুখী সংগ্রামের কৌশলে এগিয়ে যেতে পারবো। এই নিরন্তর প্রয়াসের মধ্যে দিয়েই আমরা এই স্বৈরশাসনকে শেষ করতে পারব এবং দীর্ঘ লড়াই আন্দোলনের ফলে পাওয়া স্বাধীন ভারতের যা যা অর্জন- ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র তাকে আমরা রক্ষা করতে পারব যা আজ আরএসএস-বিজেপির শাসনে বিপন্ন। ধন্যবাদ ওয়েবডেস্কের পক্ষে অনুবাদ – সরিৎ মজুমদার
শেয়ার করুন

উত্তর দিন