ভারতে ১৯৯১ সাল থেকে নয়া-উদারনীতি ভিত্তিক অর্থনৈতিক সংস্কার শুরু হয়। তিন দশক পেরিয়ে এসে অর্থনৈতিক এবং সামাজিক বৈষম্যের নিরিখে কোথায় দাঁড়িয়ে রয়েছে আজকের ভারত? এই প্রসঙ্গেই ফ্রন্টলাইন পত্রিকার পক্ষ থেকে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী)-র সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি একটি সাক্ষাতকার প্রকাশিত হয়েছে। সেই কথোপকথনের সুত্র ধরে বর্তমান নিবন্ধটি (দুই পর্বে) রাজ্য ওয়েবডেস্কের পক্ষ থেকে বাংলায় প্রকাশ করা হল।
সীতারাম ইয়েচুরি
দ্বিতীয় পর্ব
ইউপিএ (ইউনাইটেড প্রগ্রেসিভ অ্যালায়েন্স) সরকারের আমলে বামেদের চাপে বেশ কিছু বছর সংস্কারগুলি স্থগিত রাখা গেছিল বলে মনে করা হয়। ইউপিএ আমলের নীতিগুলি কি নয়া উদারবাদের তুলনায় আলাদা ছিল?
এমন নয় যে ইউপিএ আমলে কেন্দ্রীয় সরকার অর্থনৈতিক সংস্কারগুলিকে আটকে রাখে। বাম দলগুলি ইউপিএ সরকারকে বাইরে থেকে সমর্থন দিয়েছিল কারন কার্যত ন্যুনতম সাধারণ কর্মসূচী (কমন মিনিমাম প্রগ্র্যাম)-র মাধ্যমে সরকার নয়া উদারবাদী সংস্কারগুলিকেই কার্যকরী করার পথ নেয়। সরকারের বাইরে থেকেও এমন সমর্থনের কারন ছিল ভারতীয় সাধারণতন্ত্রের ধর্মনিরপেক্ষ এবং গণতান্ত্রিক চরিত্রকে রক্ষা করা এবং একইসাথে এই সমর্থন ছিল সাম্প্রদায়িক শক্তিকে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল থেকে দূরে রাখতে। বামেদের অবস্থান ছিল যাতে এমন কোন সাম্প্রদায়িক শক্তি কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন না হতে পারে যা দেশের সাধারণতান্ত্রিক কাঠামোকে নষ্ট করে দেবে।
একথা ঠিক যে বামপন্থীদেরই চাপে এক ন্যুনতম সাধারণ কর্মসূচী (কমন মিনিমাম প্রোগ্র্যাম)- তৈরি করা হয়। এই কর্মসূচীতে অগ্রাধিকারসহ উল্লেখযোগ্য কিছু আইন ছিল যেমন এমএনরেগা, বনসম্পদ অধিকার আইন, খাদ্যের অধিকার, ভূমি অধিগ্রহণের জন্য নতুন আইন, তথ্যের অধিকার, শিক্ষানীতি এবং এই ধরনের আরও কিছু ব্যবস্থা যা বামেরা না থাকলে কোনোদিনই কার্যকরী হতো না।
আমাদের সংবিধান ভারতের সকল নাগরিককে কিছু মৌলিক অধিকার এবং নিশ্চয়তা দিয়েছে। আমরা মনে করি এই সমস্ত অধিকার এবং নিশ্চয়তাগুলির পরিসর ভারতের বিকাশের সাথে সাথে আরও প্রসারিত করতে হবে। কাজের অধিকার আজও সংবিধান স্বীকৃত মৌলিক অধিকার নয়। এমএনরেগা’র কারনে আজ দেশের গ্রামাঞ্চলে কাজের অধিকারটুকু নিশ্চিত করা গেছে। এই আইনের সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও এবং শাসক শ্রেণী কর্তৃক একে বাস্তবায়িত না করার ইচ্ছাকৃত যাবতীয় প্রচেষ্টা সত্ত্বেও, এই প্রকল্প গ্রামীণ কর্মসংস্থানের অধিকার সম্প্রসারণে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করেছে।
ইউপিএ আমলে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল, এমএনরেগা আইন করার সাথে শহরাঞ্চলে কর্মসংস্থানের একই ধরনের নিশ্চয়তা সংক্রান্ত আইন প্রণীত হবে, এখনো আমরা সেই আইনের বাস্তবায়ন সম্পর্কে দাবী করছি। একইভাবে উল্লেখ্য, শিক্ষার অধিকার এখনো সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত মৌলিক অধিকার হিসাবে স্বীকৃতি পায় নি। আমরা বলছি রাইট টু এডুকেশন আইন সেই অধিকারকে বাস্তবায়িত না করতে পারলেও অন্তত সেই লক্ষ্যে কিছুটা অগ্রসর হওয়া সূচিত করে। একইভাবে আরটিআই, উপজাতি সম্প্রদায়ের জন্য বনসম্পদ অধিকার আইন, এসবই ছিল মানুষের অধিকার এবং নিশ্চয়তার সম্প্রসারিত রুপ। বলা যেতে পারে এগুলি ছিল এমনসব আইন যা নয়া উদারবাদী অর্থনৈতিক পরিসরে কোনোদিন প্রযোজ্য হতো না যদি না বামেরা ইউপিএ সরকারকে বাধ্য করতে সমর্থ হতো।
ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ এবং গণতান্ত্রিক কাঠামোর উপরে নয়া-উদারবাদের কি প্রভাব পড়েছে এবং এই নয়া-উদারবাদই কী আজকের ভারতে কর্তৃত্ববাদী রাজনৈতিক শক্তির উত্থানের জন্য দায়ী?
২০১৪ সাল থেকে দেশের শাসনক্ষমতা চলে গেছে কর্পোরেট ও সাম্প্রদায়িক রাজনীতির একটি বিষাক্ত আঁতাতের হাতে। জাতীয় সম্পদের লুট, সরকারি ব্যয়বরাদ্দ কমিয়ে ব্যাপকহারে বেসরকারীকরণ, যাবতীয় পাবলিক ইউটিলিটি থেকে শুরু করে খনিজ সম্পদ সবকিছুকেই মুনাফার লক্ষ্যে বেচে দিতে এই আঁতাত অত্যন্ত সক্রিয়। এই আমলেই ভারতে ধান্দার ধনতন্ত্র মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে এবং একইসাথে রাজনৈতিক দুর্নীতি অভূতপূর্ব মাত্রায় পৌঁছেছে। এরই সাথে চলছে মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার, নাগরিক স্বাধীনতা এবং মানবাধিকারের উপর নির্মমতম আক্রমনের ঘটনা; যেকোনো বিরোধিতাকেই দেশবিরোধী তকমা দিয়ে, ইউএপিএ [বেআইনি কার্যকলাপ প্রতিরোধ আইন] কিংবা রাষ্ট্রদ্রোহের মতো অমানবিক আইনের জোরে সাধারণ মানুষকে নির্বিচারে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে — সাংবাধিানিক অধিকাসমুহ এবং সংশ্লিষ্ট যাবতীয় নাগরিক নিশ্চয়তাকেই উচ্ছেদ করতে চায় এরা।
আজ ভারত সারা পৃথিবীতে এক "নির্বাচনী স্বৈরতন্ত্র" মূলক রাষ্ট্র হিসাবে পরিচিত হচ্ছে। অর্থনৈতিক স্বাধীনতার সূচকে ভারত সারা পৃথিবীতে ১০৫ নম্বরে রয়েছে , গত বছর আমরা ছিলাম ৭৯ নম্বরে, এখন পরিস্থিতি প্রতিদিন আরও খারাপ হচ্ছে। নাগরিক স্বাধীনতার সুচকে আমরা পৌঁছেছি ১১১ নম্বরে, আগে ছিলাম ৯৪-তে।
বেনিতো মুসোলিনি ফ্যাসিবাদের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেছিলেন ফ্যাসিবাদ হল প্রশাসনের সাথে কর্পোরেটদের সংমিশ্রণে তৈরি এক ব্যবস্থা। আজকের ভারতে দেশের জনসাধারনের ক্রমবর্ধমান দুর্দশার কোন সুরাহা হচ্ছে না অথচ রাজনৈতিক কর্তৃত্ববাদ ক্রমশ শক্তিশালী হচ্ছে। বলা যেতেই পারে দেশের এমন অবস্থা কার্যত মুসোলিনির সেই ব্যাখার কাছাকাছি একটা অবস্থান।
এখন নয়া-উদারবাদ নিজেই কোভিড পরিস্থিতিতে উদ্ভূত সংকটের মুখোমুখি হয়েছে, এই সংকটের ভবিষ্যত এবং সম্ভাব্য বিকল্প কী হতে পারে?
কোভিড মহামারী মোকাবিলায় এবং মানুষের জীবন-জীবিকা রক্ষা করতে দেশের স্বাস্থ্যপরিকাঠামো যে চূড়ান্তভাবে অপর্যাপ্ত তা প্রকাশ হয়ে পড়েছে। আজ আমরা যে গভীর অর্থনৈতিক মন্দা লক্ষ্য করছি তা নয়া-উদারবাদী অর্থনীতিরই ফলশ্রুতি। এই ব্যবস্থায় মানুষের উপরে ন্যাস্ত শোষণকে ক্রমাগত তীব্র করার মাধ্যমে যতদূর সম্ভব মুনাফা বাড়ানো হয়। মজুরি কমে যাওয়া থেকে শুরু করে চাকরি থেকে ছাঁটাই অবধি সবটাই সেই বন্দোবস্তেরই ফল। নোটবাতিলের সময় আমরা যা বলেছিলাম সেই কোথা মনে রাখতে হবে, ঐ সিদ্ধান্তের ফলেই আজ গোটা দেশে ক্ষুদ্র উৎপাদক সংস্থাগুলি ধ্বংস হয়ে গেছে। দেশের যাবতীয় অর্থনৈতিক ক্রিয়াকলাপের উপরে নিজেদের দখল প্রতিষ্ঠা করতে চাইছে কর্পোরেটরা। নিজেদের মুনাফা নিশ্চিত করার জন্য দেশের কৃষিব্যবস্থাকে ধ্বংস করে চুক্তি চাষ প্রণয়ন করতে চাইছে এবং তারই ফলস্বরূপ দেশে খাদ্য সংকট দেখা দিচ্ছে।
সারা পৃথিবীতেই অর্থনীতিকে পুনরুজ্জীবিত করতে গিয়ে নয়া-উদারবাদী সংস্কার নিজেকে দেউলিয়া প্রমান করছে। ক্রমবর্ধমান অসমতা সমীক্ষা করে দ্য ইকনমিস্টের বক্তব্য : "বৈষম্য এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যেখানে চালু ব্যবস্থা পরিস্থিতির মোকাবিলা এবং অবস্থার পুনরুদ্ধারে অসমর্থ প্রমানিত হবে যার ফলে ভবিষ্যৎে অবস্থা আরও খারাপ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে"। “দ্য প্রাইস অব ইনইক্যুয়ালিটি” বইতে জোসেফ স্টিগলিতজ পৃথিবীর শীর্ষস্থানীয় ৯৯শতাংশ মানুষের বিরুদ্ধে গিয়ে সর্বোচ্চ ধনী ১ শতাংশের ভাষায় কথা বলেছেন এবং শেষ করেছেন এই বলে: " যদি মানবসমাজ আরও বেশি বেশি করে বিভক্ত থাকে তবে আমাদের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি যে উচ্চতায় পৌঁছাতে পারে বলে আজ হিসাব করা যাচ্ছে তার চাইতে অনেক অনেক বেশি হবে"।
পরিস্থিতির মোকাবিলায় সমস্ত উন্নত দেশই ব্যাপকহারে রাষ্ট্রীয় ব্যয়বরাদ্দ খাতে সংস্থান বাড়িয়েছে। এই সব দেশই উচ্চ মূল্যের “কোভিড মোকাবিলা প্যাকেজ” ঘোষণা করেছে, এর ফলে নয়া-উদারবাদী অর্থনীতির জন্য অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। ব্যাপকহারে রাষ্ট্রীয় ব্যয়বরাদ্দের বৃদ্ধি আসলে কোন দেশের আভ্যন্তরীণ চাহিদা এবং অর্থনৈতিক ক্রিয়াকলাপ পুনরুজ্জীবিত করার লক্ষ্যে কার্যকরী হয়। সম্প্রতি এক বক্তৃতায় ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন সরকারী ব্যয় বাড়ানোর প্রসঙ্গে বলেছেন: "যদিও আমি কমিউনিস্ট নই, তবুও ..."।
যদিও ভারতে পরিস্থিতি বিপরীত। জনস্বার্থে বড় আকারের সরকারী ব্যয়বরাদ্দের বদলে মোদী সরকার এদেশে ধান্দাবাজ ব্যবসায়ীগোষ্ঠীগুলির ব্যাংক থেকে নেওয়া বিশাল পরিমানে অশোধিত ঋণসমূহ মুকুব করছে। এমন সিদ্ধান্তের ফলেই পেট্রোল এবং ডিজেলের দাম অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং তারই ফলস্বরূপ সামগ্রিক মুদ্রাস্ফীতি ঘটছে। মানুষের উপর ক্রমশ মুল্যবৃদ্ধির চাপ তৈরি হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদা ক্রমশ কমছে, এমন অবস্থার অবশ্যম্ভাবী ফল হতে চলেছে আরও গভীরতর অর্থনৈতিক মন্দা।
আমাদের দেশে আর্থিক সংস্কারকে বিশেষ গুরুত্ব সহকারে পুনর্বিবেচনা করে অগ্রাধিকারগুলির পুনর্বিন্যাস করতে হবে। শক্তিশালী কৃষিব্যবস্থা আমাদের অন্যতম ভিত্তি, খাদ্য নিরাপত্তা, স্বাস্থ্য, শিক্ষায় সরকারী বিনিয়োগ বাড়াতে হবে যার ফলে দেশের জন্য অতি প্রয়োজনীয় আর্থিক পরিকাঠামো গড়ে উঠবে। এহেন পরিকাঠামো অর্থনৈতিক এবং সামাজিক উভয় ক্ষেত্রেই ব্যাপক কর্মসংস্থান এবং আভ্যন্তরীণ চাহিদা বৃদ্ধি করতে দ্রুত কার্যকরী হবে।
ভারতীয় জনতা পার্টি নিজেদের জাতীয়তাবাদী দল বলে দাবি করলেও নয়ের দশকের গোড়ার দিক থেকেই তারা নয়া-উদারবাদের সমর্থনে সবচেয়ে বেশি ধারাবাহিকতা দেখিয়েছে। নয়া-উদারবাদী সংস্কার সম্পর্কে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি কি অন্যান্য দলের চেয়ে বেশি আক্রমণাত্মক ?
বিজেপি সবসময়ই নিজের অবস্থান সম্পর্কে দ্বৈতনীতি নিয়ে চলে। এরা মুখে যা বলে এবং কাজ হিসাবে যা করে তা সম্পূর্ণ ভিন্ন। একসময় এরা বিরোধী দল হিসাবে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার বিরোধিতায় স্বদেশিয়ানার স্লোগান তুলে নিজেদের জাতিয়তাবাদী দল হিসাবে জাহির করেছিল, অথচ দেশের শাসনভার গ্রহণ করার পরে এরাই সেই অবস্থানের সম্পূর্ণ বিপরীত নীতি প্রণয়ন করে চলেছে।
২০১৪ সাল থেকে বিজেপি সরকারে আসার পর থেকে অত্যন্ত আগ্রাসীভাবে নয়া-উদারবাদী সংস্কারগুলির বাস্তবায়ন করছে। এমন মাত্রায় আগ্রাসন আগে কখনো দেখা যায়নি। এর প্রধান কারন বিজেপি হল আরএসএস (রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ)-এর রাজনৈতিক পক্ষ। আরএসএস চিরকালই ধর্মীয়, হিংসাত্মক এবং অসহিষ্ণু প্রকৃতির ফ্যাসিবাদী ‘হিন্দুত্ব রাষ্ট্র’ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কাজ করে এসেছে। স্বাধীনতার সময় তারা সেই লক্ষ্য অর্জন করতে ব্যর্থ হয়, সেই থেকে তারা ধারাবাহিকভাবে দেশের সংবিধান স্বীকৃত ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, সাধারণতন্ত্রকে ধ্বংস করে সেই জায়গায় নিজেদের পছন্দসই ফ্যাসিবাদী ‘হিন্দুত্ব রাষ্ট্র’কে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছে।
সেই লক্ষ্যে সফল হওয়ার জন্য আজকের পৃথিবীতে আন্তর্জাতিক সমর্থনের একান্ত প্রয়োজন। আন্তর্জাতিক রাজনীতির মূলধারার বিরোধিতা করলে কিছুতেই সেই সাফল্য আসবে না। নিজেদের সেই রাজনৈতিক স্বার্থরক্ষার সর্বোত্তম উপায় হিসাবেই তারা নয়া উদারবাদী সংস্কারকে আগ্রাসীভাবে বাস্তবায়ন করছে। আন্তর্জাতিক ও জাতীয় পুঁজিসহ কর্পোরেটদের মুনাফা বাড়ানোর জন্য নতুন নতুন ক্ষেত্র সরবরাহ করা এবং তার বিনিময়ে সমর্থন আদায় করাই এদের রাজনীতি।
নয়া-উদারবাদের দিকে ভারতের এহেন ক্রমবর্ধমান ঝোঁকের ফলে বিশ্বরাজনীতিতে কী প্রভাব পড়বে ?
পৃথিবীজুড়ে দক্ষিনন্থার উত্থান ঘটছে কারন পুঁজিবাদ সংকটে পড়েছে। দুনিয়াজূড়ে মুনাফার হারে নিম্নগামীতা কিছুতেই সার্বিক মন্দার অবস্থাকে এড়িয়ে যেতে পারে না। সার্বিক মন্দার কারনে জনগণের অসন্তোষ মোকাবিলা করতেই পুঁজিবাদ ক্রমাগত রাজনৈতিক দক্ষিণপন্থার দিকে সরে যাচ্ছে, বর্ণবাদ, জেনোফোবিয়া এবং সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের প্রচার চলছে। গণতান্ত্রিক অধিকার দমন এবং নাগরিক স্বাধীনতা হরণ না করে পুঁজিবাদ কিছুতেই জনগণের ক্ষোভ প্রশমিত করতে পারছে না।
ভারতে উৎকট সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ এবং ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে বিষাক্ত ঘৃণা ও সহিংসতার প্রচার করে আরএসএস নিজেদের ফ্যাসিবাদী প্রকল্পকে এগিয়ে নিয়ে যেতে চাইছে। স্বাভাবিকভাবেই এর ফলে রাজনৈতিক কর্তৃত্ববাদের ক্রমাগত উত্থান ঘটছে এবং সেই অনুপাতেই রাষ্ট্র ফ্যাসিবাদী চেহারার দিকে এগিয়ে চলেছে।
বিশেষ করে ২০১৪ সাল থেকে ভারতে কর্পোরেট শক্তির সাথে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির এক আঁতাত গড়ে উঠেছে এবং সেই জোট ক্রমাগত শক্তিশালী হচ্ছে। এমন রাজনৈতিক জোট হল ধান্দার ধনতন্ত্রের (Crony Capitalism)-র সবচেয়ে খারাপ অভিব্যক্তি। ন্যাশনাল মনিটাইজেশন পাইপলাইন (এনএমপি)-র নাম করে জাতীয় সম্পদ লুঠ করতে নয়া উদারনৈতিক অর্থনৈতিক সংস্কারকেই হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করা হচ্ছে এবং এর আড়ালে আরএসএস’র নিজস্ব রাজনৈতিক উদ্দেশ্যসাধনই হল লক্ষ্য।
নিরবচ্ছিন্ন কায়দায় নয়া উদারবাদী আর্থিক সংস্কার আসলে ভারতকে আন্তর্জাতিক লগ্নীপুঁজি এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অধঃস্তন সহযোগীতে পরিণত করার লক্ষ্যেই কার্যকরী হবে। একসময় ভারত উন্নয়নশীল দেশসমুহের জোটের নেতৃত্বে ছিল, জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনে আমরা ছিলাম বিজেতা, এখন আমাদের সেই ঐতিহ্য অভাবনীয়রূপে ক্ষতিগ্রস্থ।
মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের অধঃস্তন সহযোগী হয়ে উঠতে বর্তমানে যে কায়দায় নয়া-উদারবাদী সংস্কার চলছে তার ভিত্তি লুকিয়ে রয়েছে কর্পোরেটদের সাথে সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক শক্তির আঁতাতের ভিতরে। সংবিধানের সংজ্ঞা অনুযায়ী এক ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক সাধারণতন্ত্র থেকে আরএসএস’র পরিকল্পনামতো ভারতকে এক অসহিষ্ণু, কর্তৃত্বকারী ফ্যাসিবাদী দেশে বদলে ফেলার পরিকল্পনাই হল 'হিন্দুত্ব রাষ্ট্র'।
ছবিঃ সোশ্যাল মিডিয়া