সংকটে শ্রীলঙ্কা - দায় কার?

শ্রীলঙ্কায় সংকট

বলা হচ্ছে, ‘চীন’

দায়ী আসলে কে?

শান্তনু দে

চরম অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে শ্রীলঙ্কা। ভারত মহাসাগরীয় দ্বীপরাষ্ট্রের এই সংকটের জন্য একতরফাভাবে দায়ী করা হচ্ছে চীনকে। মার্কিন কর্পোরেট মিডিয়া থেকে সঙ্ঘের প্রচার: চীনের ‘ঋণের ফাঁদে’ জড়িয়েই এই অবস্থা!

যদিও শ্রীলঙ্কার এই পরিস্থিতি একদিনে ঘটেনি। কয়েকদশকের এক ভ্রান্ত রাজনীতির অনুশীলন দেশটিকে আজ এই অবস্থায় এনে দাঁড় করিয়েছে। শ্রীলঙ্কার বর্তমান সংকটের নেপথ্যে রয়েছে আসলে আইএমএফ-আরোপিত শর্তসাপেক্ষে ঋণগ্রহন। এবং সেই নির্দেশ মেনে আর্থিক সংস্কারের বুলডোজার। যা ভয়াবহ চেহারা নেয় করোনা-বিশ্বে, আর রাজাপক্ষে সরকারের জৈব চাষের খামখেয়ালি রোমাঞ্চকর পদক্ষেপে। আজকের চরম রাজনৈতিক অস্থিরতা আসলে তারই পরিণতি। বিদেশি ঋণ শোধ করা আর সম্ভব নয় দেখে শেষে নিজেকে ‘ঋণখেলাপি’ ঘোষণা ‘দেউলিয়া’ শ্রীলঙ্কার।

অতএব, সরল ব্যাখ্যা ‘দায়ী চীন’। অথচ, শ্রীলঙ্কার মোট বিদেশি ঋণে চীনের অংশ ১১ শতাংশেরও কম। বরং, দেশটি অনেক বেশি ঋণ নিয়েছে আন্তর্জাতিক সার্বভৌম বন্ডের মাধ্যমে। এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাঙ্ক এবং জাপান থেকে। পশ্চিমী প্রচারমাধ্যমে চীনকে সামনে আনা হচ্ছে আসলে এই সংকটের জন্য দায়ী দেশি-বিদেশি এজেন্ট, বিশেষত আইএমএফের কেন্দ্রীয় ভূমিকাকে আড়াল করার জন্য।

শ্রীলঙ্কার মোট বিদেশি ঋণে আন্তর্জাতিক সার্বভৌম বন্ডের অংশ ৩৬.৪ শতাংশ। দু’নম্বরে এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাঙ্ক, ১৪.৬ শতাংশ। তিনে জাপান, ১০.৯ শতাংশ। চারে চীন, ১০.৮ শতাংশ (হিন্দুস্তান টাইমস, ২৯ মার্চ ২০২২)।

চীনের ‘ঋণ-ফাঁদ’! বিষয়টিকে প্রথম প্রচারে নিয়ে আসে ওয়াশিংটনের নির্দেশে চলা আর্থিক প্রতিষ্ঠান আইএমএফ। ২০০৬ সালে। এরপর ২০১১-তে মার্কিন বিদেশসচিব হিলারি ক্লিনটন আফ্রিকায় চীনের ঋণদান প্রকল্পকে ‘ডেট-ট্র্যাপ ডিপ্লোমেসি’ আখ্যা দিয়ে চীনকে ‘নয়া ঔপনিবেশিক’ বলে দাবি করেন। সেইসঙ্গে চীনের থেকে ঋণ নেওয়ার বিষয়ে আফ্রিকার দেশগুলিকে সতর্ক করেন। ২০১৮-তে মার্কিন উপরাষ্ট্রপতি মাইক পেন্স চীনের ঋণদান প্রকল্পকে ‘ঋণ-ফাঁদ কূটনীতি’ বলে মন্তব্য করেন। এবং একে চীনের সামরিক উচ্চাকাঙ্খার প্রমাণ বলে দাবি করেন।

আইএমএফ ঋণ দিলে হয় ‘স্ট্রাকচারাল অ্যাডজাস্টমেন্ট’, আর চীন দিলে ‘ডেট-ট্র্যাপ ডিপ্লোমেসি’!

১৯৪৮ সালে ব্রিটিশদের থেকে স্বাধীনতা লাভ ইস্তক শ্রীলঙ্কার অর্থনীতি কখনও এমন খারাপ সময়ের মধ্য দিয়ে যায়নি। ২০২১-এর শেষে শ্রীলঙ্কার বিদেশি ঋণের পরিমাণ মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের (জিডিপি) ১১৯ শতাংশ। চলতি বছর বিদেশি ঋণ এবং সুদ মেটাতে অন্তত ৬৯০ কোটি ডলার ব্যয় করতে হবে শ্রীলঙ্কাকে। অথচ মে মাসের গোড়ায় অর্থমন্ত্রী নিজে জানাচ্ছেন, বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয় এসে ঠেকেছে ৫ কোটি ডলারেরও নিচে। এর অবধারিত প্রভাব পড়েছে আমদানিতে। বিশেষত, জ্বালানি তেল কেনা কমে গিয়েছে অনেকটাই। বিদেশি মুদ্রার ভাঁড়ারে টান। পরিণতিতে আকাশ ছোঁয়া মূল্যবৃদ্ধি। এক কাপ চায়ের দাম ১০০ টাকা! এক কিলোগ্রাম চাল ৫০০ টাকা। চিনির কিলোগ্রাম ৪০০ ছুঁইছুঁই। এমনকি, শিশুখাদ্যের দামও সাধারণের নাগালের বাইরে। অপ্রতুল জীবনদায়ী ওষুধ। কাগজের অভাবে বন্ধ স্কুল-কলেজের পরীক্ষা।

শ্রীলঙ্কা দস্তুরমতো জানে, সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক কাঠামোর যে সংস্কার করা হয়েছে, তার পিছনে রয়েছে আইএমএএফ-র নির্দেশ।

ঔপনিবেশিক শোষণের পথ ধরেই শ্রীলঙ্কার কৃষি ব্যবস্থার পরিবর্তন ঘটেছে। ইউরোপীয় বাজারের চাহিদা পূরণ করতে ব্রিটিশরা শুরু করে চা, কফি, রাবার চাষ। তামিলনাড়ু থেকে নিয়ে আসা হয় প্রচুর অদক্ষ শ্রমিক। ১৯৪৮ সালে শ্রীলঙ্কার স্বাধীনতার সময়, জিডিপি’র এক-তৃতীয়াংশ আসত এইসব বাণিজ্যিক পণ্য রপ্তানি থেকে। কৃষি উৎপাদনের এই ঔপনিবেশিক কাঠামো স্বাধীনতার পর অর্থনৈতিক বিকাশে বাধা সৃষ্টি করে। স্বাধীনতার পর বিদেশি পুঁজি শ্রীলঙ্কার প্রাথমিক পণ্যের ক্ষেত্রে বিপুল বাণিজ্যিক উপকরণ ব্যবহার করে প্রচুর বিদেশি মুদ্রা কুক্ষিগত করে। অন্যদিকে ফসল চাষে বৈচিত্র্য আনতে ব্যর্থ হওয়ার কারণে খাদ্যশস্য, ডাল, দুধ, চিনির মতো জরুরি পণ্যসামগ্রীর আমদানির উপর ক্রমশ বাড়তে থাকে নির্ভরশীলতা।

কর-রাজস্ব থেকে সংগৃহীত অর্থ দিয়ে শ্রীলঙ্কায় চালু করে অবৈতনিক শিক্ষা। বিনামূল্যে প্রাথমিক চিকিৎসার সঙ্গেই ভর্তুকিতে খাদ্যশস্য সরবরাহ। এসবের মধ্য দিয়ে একটি দরিদ্র দেশে কীভাবে সামাজিক কল্যাণ কর্মসূচি গ্রহণ করা সম্ভব, সে ব্যাপারে শ্রীলঙ্কা তৈরি করে একটি দৃষ্টান্ত।

কোরীয় যুদ্ধের সময় এই পরিস্থিতির বড়ো ধরনের পরিবর্তন ঘটে। বাণিজ্যিক ফসলের মূল্যায়ন কমে যাওয়ায় রপ্তানি বাণিজ্যে তার প্রতিফলন ঘটতে শুরু করে। কিন্তু আমদানি হ্রাস পায় না। ফলে দেখা দেয় বৈদেশিক বাণিজ্যে ঘাটতি। এবং ক্রমশ তা বৃদ্ধি পেতে শুরু করে। বিদেশি মুদ্রার ভাণ্ডারে টান পড়তে শুরু করে।

গত শতকের ছয়ের দশকের মাঝামাঝি নাগাদ, বিশেষত ১৯৬৫-৬৬ সালে দেশের বৈদেশিক বাণিজ্যের বিপুল ঘাটতি তৈরি হয়। এই পরিস্থিতিতে আইএমনএফ শ্রীলঙ্কার অর্থনীতিতে প্রবেশ করে। একাধিক শর্তে ঋণের প্রস্তাব দেয়। যার ফলে শ্রীলঙ্কার সরকার খাদ্যে ভরতুকি ছাঁটাই, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে দেয় অনুদানের পরিমাণ হ্রাস-সহ প্রভৃতি বিভিন্ন পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হয়। ছয়ের দশকের শেষের দিকে শ্রীলঙ্কার সরকার জাতীয় মুদ্রার বিশ শতাংশ অবমূল্যায়ন ঘটাতে বাধ্য হয়। আমদানি ও বৈদেশিক বাণিজ্যের উদারীকরণ ঘটানো হয়।

সাতের দশকের প্রথম অর্ধে শ্রীলঙ্কার বামপন্থী ঘেঁষা সিরিমাভো বন্দরনায়েকের সরকার প্রতিষ্ঠিত হলে আইএমএফ নির্দেশিত এই আর্থিক নীতির বেশ কিছুটা পরিবর্তন ঘটতে শুরু করে। এই সরকার ভূমিসংস্কার, রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প নির্মাণ এবং সমাজকল্যাণমূলক খাতে ব্যয়বৃদ্ধির কর্মসূচি নেয়। আইএমএফ, বিশ্বব্যাঙ্কের মতো আন্তর্জাতিক ঋণদানকারী সংস্থাগুলি এইসব কর্মসূচি গ্রহণের জন্য শ্রীলঙ্কা সরকারের সমালোচনা করে। ১৯৭৩ সালে আন্তর্জাতিক দুনিয়ায় জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির জন্য অন্যান্য দেশের সাথে শ্রীলঙ্কাও সংকটগ্রস্ত হয়ে পড়ে।

১৯৭৭, ইউনাইটেড ন্যাশনাল পার্টি (ইউএনপি) জে আর জয়বর্ধনের নেতৃত্বে সরকার গঠন করে। এই সরকারের নেতৃত্বে শ্রীলঙ্কায় মুক্ত বাজার অর্থনীতি গ্রহণ করে। আপন করে নেয় নয়া উদার নীতিকে। এই সরকার আইএমএফ থেকে তিনটি বড়ো পরিমাণের ঋণ নেয়: ১৯৭৫-৭৮, ১৯৭৯-৮২ এবং ১৯৮৩-৮৪ সালে। এই ঋণের শর্ত অনুযায়ী শ্রীলঙ্কাকে তাদের আর্থিক নীতির পরিবর্তন ঘটাতে হয়। এইসব পরিবর্তনের মধ্যে ছিল মুদ্রার বিনিময়যোগ্য হারের পরিবর্তন, মুদ্রার অবমূল্যায়ন, মূল্যের উপর নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার বিলোপ, খাদ্যে ভরতুকি প্রত্যাহার, বেতন সংকোচন নীতি, দেশি-বিদেশি পুঁজির ওপর থেকে নিয়ন্ত্রণ প্রত্যাহার এবং রাজনৈতিক সংস্কারের কর্মসূচি। যা পরে দুনিয়ার কাছে ‘ওয়াশিংটন সহমত’ নামে পরিচিত।

শ্রীলঙ্কার অর্থনীতিতে আইএমএফ-র এই দাওয়াই প্রয়োগের পরিণতি হয়েছে ভয়াবহ। প্রথমত, এই মুক্ত অর্থনীতির পরিণতিতে শ্রীলঙ্কার আর্থিক বৈষম্য ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়, যে আর্থিক বৈষম্য ১৯৭০-৭৭ সালে কমতে শুরু করেছিল। ১৯৭৩ সালে শ্রীলঙ্কার জাতীয় আয়ে দেশের সবচেয়ে দরিদ্র ৪০ শতাংশ মানুষের আয়ের অংশ ছিল ১৯.৩ শতাংশ। ১৯৮১-৮২ সালে তা কমে হয় ১৫.৩ শতাংশ। এই সময়ে শ্রমিক-কর্মচারীদের প্রকৃত বেতন ব্যাপকভাবে ছাঁটাই করা হয়। শুধু তাই নয়, সামাজিক খাতে ব্যয় বরাদ্দ ১৯৭৭ সালে যেখানে ছিল ৩৩ শতাংশ, ১৯৮৩-তে তা কমে হয় ২২ শতাংশ। ১৯৭৯-৮৩, এই সময়ে স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ ছাঁটাই করা হয় ১৩ শতাংশ। খাদ্যে ভরতুকি তুলে দিয়ে চালু করা হয় ‘ফুড কুপন’। ১৯৭৮-৭৯ সাল থেকে ১৯৮১-৮২ সালের মধ্যে বিশ শতাংশ জনগণের ক্যালোরি প্রাপ্তির পরিমাণ ১৫০০ ক্যালোরি থেকে কমে হয় ১৩৭০ ক্যালোরি। এই সময় শ্রীলঙ্কার গ্রামীণ এলাকার ছ’মাস থেকে শুরু করে পাঁচ বছর বয়সী শিশুদের অপুষ্টির পরিমাণ ৬.১ শতাংশ থেকে বৃদ্ধি পেয়ে হয় ৯.৪ শতাংশ। এই সময় পাঁচ থেকে চোদ্দ বছর বয়েসীদের সাক্ষরতার হার ৮৮ শতাংশ থেকে কমে হয় ৮৬ শতাংশ (ফ্রন্টলাইন, ২২ এপ্রিল ২০২২)।

নয়া উদার অর্থনীতির পটভূমিতে দু’টি রাজনৈতিক ঘটনা বিশেষভাবে উল্লেখের দাবি রাখে। প্রথমত, আইএমএফের আর্থিক সংস্কার নীতি প্রয়োগের ফলে জনগণের ক্ষোভকে বিপথগামী করতে সিংহলী জনগণ এবং তামিল জনগণের মধ্যে তৈরি করা হয় বিভাজন-বিদ্বেষের পরিবেশ। দ্বিতীয়ত, তামিলদের স্বাধীনতার জন্য প্রভাকরণের নেতৃত্বে ঘটে এলটিটিই জঙ্গি সংগঠনের আত্মপ্রকাশ। যাদের আক্রমণের প্রধান লক্ষ্য ছিল সিংহলী সেনাবাহিনী। ১৯৮৩ থেকে শ্রীলঙ্কার সর্বত্র শুরু হয় গৃহযুদ্ধ। পাশাপাশি, উদার নীতির বিরুদ্ধে ট্রেড ইউনিয়ন এবং বামপন্থীদের নেতৃত্বে যে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে উঠেছিল, তাকে ধ্বংস করতে শাসকদল এবং সরকারের পক্ষ থেকে চলে যৌথ আক্রমণ।

এক দশক ধরে চলা গৃহযুদ্ধের পরিণতিতে দেশে দেখা দেয় ব্যাপক আর্থিক সংকট। রাজাপক্ষের সরকার আইএমেএফ থেকে ২৬০ কোটি ডলার ঋণ নেয়। ২০০৮ সালে বিশ্বব্যাপী আর্থিক মন্দার ধাক্কায় আক্রান্ত হয় শ্রীলঙ্কার বিদেশি মুদ্রার ভাণ্ডার। ২০১৬-১৯, পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটে। এই সময় আর্থিক বৃদ্ধির হার নেমে আসে পাঁচ শতাংশে। জাতীয় উৎপাদন ২০১৫-১৮ সালের মধ্যে ২৮.৮ শতাংশ থেকে কমে হয় ২৪.৬ শতাংশ হয়। ২০১৯, কলম্বোয় একাধিক চার্চে এবং হোটেলে বিস্ফোরণ। নিহত হন আড়াইশোর বেশি মানুষ। এর ফলে পর্যটনশিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পরে রাজাপক্ষে সরকার করের পরিমাণ হ্রাস এবং পুঁজিপতিদের জন্য ব্যাপক সুবিধা প্রদানের প্রতিশ্রুতি দেয়। আর এইসব প্রতিশ্রুতি পালন করতে গিয়ে রাজস্ব সংগ্রহ হ্রাস পায়। ফলে বিদেশি ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হয় শ্রীলঙ্কা। খাদ্যে ভরতুকি ছাঁটাই করার খাদ্যশস্যের মূল্যবৃদ্ধি ঘটে। ইতিমধ্যে দেশের কৃষি ব্যবস্থা আক্রান্ত হয়ে পড়ে। ফলে খাদ্যদ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধির প্রভাবে সাধারণ মানুষের জীবন-জীবিকা আক্রান্ত হয়। এর সঙ্গেই যুক্ত হয় কোভিড সংক্রমণ।

শেষে নিজেকে ‘ঋণখেলাপি’ ঘোষণা ‘দেউলিয়া’ শ্রীলঙ্কার!


শেয়ার করুন

উত্তর দিন