ভারতের জাতীয় আন্দোলন ও আর এস এস – (পর্ব – ১৫)

ধারাবাহিক রচনায়ঃ গৌতম রায়

নরমপন্থী রাজনীতিকদের সম্বন্ধে ১৮৮৮  সালের নভেম্বর মাসে কলকাতার সেন্ট এন্ড্রুজ ডের এক নৈশভোজে তৎকালীন ভাইসরয় লর্ড ডাফরিন মন্তব্য করেছিলেন;  জাতীয় কংগ্রেস অতি অল্পসংখ্যক ভারতীয়দের প্রতিনিধিত্ব করে। নরমপন্থী রাজনীতিকদের রাজনৈতিক চরিত্রের সীমাবদ্ধতা ,তাঁদের লক্ষ্যের সীমাবদ্ধতা এবং কর্মসূচিগত ক্ষেত্রে যে ধরনের বাধ্যবাধকতার মধ্যে তাঁরা তাঁদের কর্মপদ্ধতিকে পরিচালিত করতেন ,এই বিষয়গুলি যে ব্রিটিশের ভাবনায় একটা বড় জায়গা জুড়ে ছিল, ডলফিনের মন্তব্য থেকে তা খুব পরিস্কার হয়ে যায় ।
                 

নরমপন্থী রাজনীতিকদের কার্যক্ষেত্রে অংশ নেওয়ার ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতার যে জায়গা ছিল ,তা কিন্তু ব্রিটিশ শাসকদের নজর এড়িয়ে যায়নি। এসব সত্ত্বেও কিন্তু অত্যন্ত জোরে সঙ্গে বারবার বলতে হয় যে ,ব্রিটিশের  অর্থনৈতিক শোষণের যে স্বরূপটা ভারতবর্ষের মানুষদের সামনে তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছিলেন নরমপন্থী রাজনীতিকেরা, সেটি কিন্তু পরবর্তীকালে জাতীয় আন্দোলনের সবকটি ধারা-উপধারা কে প্রসারিত করার ক্ষেত্রে একটা অত্যন্ত প্রয়োজনীয় অনুঘটক হিসেবে ভূমিকা রেখেছিল ।
                

ব্রিটিশ শাসনের নামে শোষণ ই,  ভারতবর্ষের মানুষদের দারিদ্র্যের একমাত্র কারণ; এই কথাটি বলবার মতো হিম্মত কিন্তু নরমপন্থী রাজনীতিকেরা দেখিয়েছিলেন। আরএসএস প্রতিষ্ঠার আগে যে সমস্ত ব্যক্তিরা  রাজনৈতিক  হিন্দুত্বের অবতারণা  করতেন, সেইসব  ব্যক্তিত্বেরা সাম্প্রদায়িক একটি সংগঠন তৈরিতে ব্যস্ত থেকেছেন। তারা কিন্তু একটি বারের জন্য ব্রিটিশের  অর্থনৈতিক শোষণ সম্পর্কে ভারতবর্ষের মানুষদের সচেতন করার ক্ষেত্রে এতোটুকু ভূমিকা পালন করেননি ।
                    

একই কথা প্রযোজ্য পরবর্তীকালে আরএসএসের কর্মকর্তাদের সম্পর্কেও ।আরএসএস কিন্তু তাদের জন্মলগ্ন থেকে আজ পর্যন্ত তাদের কোনো দলিল দস্তাবেজে ব্রিটিশের অর্থনৈতিক শোষণ যে ভারতবর্ষের মানুষকে ক্রমশ দরিদ্র থেকে দরিদ্রতর ,দরিদ্রতম করে দিয়েছে, সেই বিষয়ে একটি শব্দ উল্লিখিত হয়নি ।উনিশ শতকের নবজাগরণের যুক্তিবাদের ওপর নিজেদের চিন্তা-চেতনার ধারা কে প্রতিষ্ঠা করে, রাজনীতির ক্ষেত্রে যুক্তিবাদের প্রতিষ্ঠা করে, ভারতবর্ষের সামাজিক ক্ষেত্রকে যে একটি ইতিবাচক ধারার দিকে প্রবাহিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন নরমপন্থী রাজনীতিকরা ,সেই যুক্তিবাদের বিষয়টি কিন্তু রাজনৈতিক হিন্দু সাম্প্রদায়িক ব্যক্তিত্বদের ভিতর কখনো ছিল না ।আজও নেই ।
                      

নরমপন্থী রাজনীতিকদের কর্মকাণ্ডের যুক্তিবাদী প্রসঙ্গটি ভারতের রাজনৈতিক আন্দোলন কে পরবর্তীকালে শুধু প্রসারিত ই  করেনি, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক প্রেক্ষিত কে ও  অনেকখানি প্রসারিত করেছিল ।সেই প্রসারণের  ভেতরে কিন্তু নিহিত ছিল আধুনিক ভারতের চিন্তা-চেতনার বীজ।এই পথ দিয়ে কিন্তু সাম্প্রদায়িক রাজনীতিরা একটি বারের জন্যে ও হাঁটেননি। নরমপন্থী রাজনীতিকদের সঙ্গে ধীরে ধীরে কংগ্রেসের ভেতরে র তরুণ প্রজন্মের নেতৃত্বের  সংঘাত ,সেই সংঘাতই কংগ্রেসের ভেতরে চরমপন্থী প্রতিক্রিয়ার বিকাশ ঘটাতে সাহায্য করে ।
                  

সেই ভাবনার একটা সর্বাঙ্গীন প্রকাশ  আমরা দেখতে পাই ১৯০৭ সালের জাতীয় কংগ্রেসের সুরাট অধিবেশনে। জাতীয় কংগ্রেস সরাসরি দুটি দলে বিভক্ত হয়ে যায়। চরমপন্থী ও নরমপন্থী। যাকে ইংরেজিতে নো চেঞ্জার আর প্রো চেঞ্জার বলা হয় ।জাতীয় কংগ্রেসের ভেতর আবার সার্বিক ঐক্যের পরিবেশ ফিরে আসতে আমরা দেখি প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে ,যখন ধীরে ধীরে জাতীয় কংগ্রেসের নেতৃত্বে উঠে আসছেন মহাত্মা গান্ধী ।
             

কংগ্রেসের সুরাট অধিবেশন - ১৯০৭

চরমপন্থার এই বিকাশের সঙ্গে হিন্দু সাম্প্রদায়িক রাজনীতিকরা নিজেদের কে একাত্ম করে দেখিয়ে জাতীয় কংগ্রেসে তাদের ভূমিকার কথা অসত্য উপস্থাপনার ভেতর দিয়ে তুলে ধরার চেষ্টা করে। বস্তুত উনিশ শতকের  একদম শেষ লগ্ন থেকে শুরু করে বিশ শতকের একদম প্রারম্ভ পর্বে বঙ্গভঙ্গ কেন্দ্রিক প্রতিক্রিয়ার পর , গোটা ভারতবর্ষ জুড়েই বিভিন্নভাবে যুব সমাজের  ভিতরে ব্রিটিশবিরোধী সশস্ত্র প্রতিরোধের ভাবনা দানা বাঁধতে শুরু করে।
                  

এই ভাবনার ভেতর সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক মতাদর্শের কোনো প্রয়োগ না থাকার দরুন নানা ধরনের ধর্মীয় অভিঘাত এসে সেখানে জড়ো হয় ।সেই ধর্মীয় অভিঘাত কে পরবর্তীকালে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করতে রাজনৈতিক হিন্দুরা কখনো পিছপা হয়নি। এই ধর্মীয় অভিঘাত কে বোঝবার জন্য আমাদের জাতীয় কংগ্রেসের প্রথম কুড়ি বছরের আবেদন-নিবেদন নীতির কালের কাল পর্বে গোটা ভারত জুড়ে, বিশেষ করে বাংলায় ,যে একটা মননশীল সাংস্কৃতিক পরিবেশ ধীরে ধীরে বিকাশ লাভ করতে শুরু করে ,সে সম্পর্কে  সম্যক আলোচনা দরকার।
                    

সেই মননশীল সংস্কৃতিক পরিবেশকেই চরমপন্থী রাজনীতিকরা তাঁদের ভাবাদর্শগত ভিত্তি হিসেবে ধরে নিয়েছিল ।এই কারণে এই পর্বটি কে অনেকে' হিন্দু পুনরুজ্জীবন' হিসেবে ধরে নিয়ে ,পরবর্তীকালে রাজনৈতিক হিন্দুদের কর্মকাণ্ড, তাদের ভয়াবহ জাতিবিদ্বেষ, ধর্মবিদ্বেষ ,পরমত অ সহিষ্ণুতার যে নোংরা কুৎসিত রাজনীতি , তার সঙ্গে একাত্ম করে দেখে। উনিশ শতকের সেই সামাজিক- সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডকেও সাম্প্রদায়িক হিন্দু আবেগের সঙ্গে অঙ্গীভূত করে দেখার একটা প্রবণতা অনেকক্ষেত্রেই প্রকট হয়ে ওঠে।
                        

জাতীয় কংগ্রেসের প্রথম পর্যায়ের কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি যে মননশীল সাংস্কৃতিক আন্দোলন বিকাশ লাভ করার কথা উল্লেখ করা হলো, সেখানে প্রচলিত হিন্দু ধর্মের নানা ধরনের দ্যোতনা গুলিকে ,কল্পকাহিনীর গুলিকে, ইতিহাস হিসেবে উপস্থাপিত করবার একটা প্রবণতা প্রথম থেকেই লক্ষ্য করতে পারা যায়। প্রচলিত হিন্দু ধর্মের এই সমস্ত কল্পকাহিনী গলির ভেতর দিয়েই ভারতবর্ষের মানুষ কে চিনে নেবার একটা প্রবণতা এই সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিত্বদের প্রবল হয়ে ওঠে।সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিত্বদের একটা বড় অংশের ভেতরে ছিল নানারকম পরস্পর বিরোধী অবস্থান এবং অসংগতি ।
                        

এইসব ব্যক্তিত্বদের  ভেতরে সীমাবদ্ধতা থাকলেও ধর্মীয় প্রতীক চিহ্ন এবং কল্পকাহিনীর সম্মিলনে সংস্কৃতিক পরিকাঠামো কে গড়ে তোলবার যে প্রবণতা,তা  ধর্ম আর রাজনীতি কে একসাথে মিশিয়ে দেখার একটি প্রবণতাতে  পর্যবসিত হয়ে উঠেছিল। ভারতবর্ষে বহুত্ববাদী সংস্কৃতির চিরকালীন বিস্তৃতি সত্বেও প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম আর রাজনীতির মধ্যে ভেদরেখা টা সব সময় খুব প্রকট ছিল না। ধর্ম যে কেবলমাত্র মানুষের ব্যক্তি জীবনের আঙ্গিকে সীমাবদ্ধ ছিল-- চিরদিন তেমনটাও নয়।
                     

ধর্ম নিয়ে ভারতীয় সমাজের চিরকাল যে আলাপ-আলোচনা হয়েছে ,তার তাতে যে ধারা-উপধারা গুলি ছিল , সে গুলি উনিশ শতকের  শেষ প্রান্তে এসে দুটি ভাগে ভাগ হয়ে যায় ।সংস্কারের একটি ধারা খুব প্রবল হয়ে ওঠে ।অপর একটি ধারার  ভিতর পুনরুজ্জীবনের একটা চিন্তা-ভাবনা প্রকট হতে থাকে। এই সংস্কারমূলক আন্দোলনের  আন্দোলনের সঙ্গে জাতীয় কংগ্রেসের প্রথম পর্যায়ের কয়েকজন নেতা, যাঁদের নরমপন্থী হিসেবে পরিচিতি ছিল ,তাঁদের একটা গভীর সম্পর্ক কিন্তু গড়ে উঠেছিল।
                      

এইসব আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিত্বেরা চেয়েছিলেন প্রচলিত হিন্দু সমাজের সামাজিক সংগঠন এবং আচারণের ভেতরে পর্যায়গত কিছু অদল-বদল ঘটাতে ।সেই পর্যায়গত অদল-বদল ঘটানোর ক্ষেত্রে তাঁরা পাশ্চাত্যের যুক্তিবাদীদের ধারণার প্রয়োগের পক্ষপাতি ছিলেন ।এইসব ব্যক্তিত্বেরা চেয়ে ছিলেন ,পাশ্চাত্যের যুক্তিবাদী চিন্তা-চেতনার প্রয়োগ হিন্দু ধর্মের প্রচলিত রীতিনীতি আচার-আচরণের ভিতরে এসে পড়ুক। এঁদের এই লক্ষ্যের একটা বাস্তবায়নের উদ্যোগ আমরা দেখতে পাই ১৮৮৭ সালে ন্যাশনাল সোশ্যাল কনফারেন্স প্রতিষ্ঠার ভেতর দিয়ে ।পৃথকভাবে এই সংগঠনটি প্রতিষ্ঠিত হলেও ,এই সংগঠনটি কিন্তু অঙ্গাঙ্গীভাবে জাতীয় কংগ্রেসের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল ।তবে সংগঠনটি র যাবতীয় কার্যসূচি ও কর্মসূচির ভেতরে ধর্মের কোনরকম সংযোগ কিন্তু ছিল না। সংগঠনটি বিভিন্ন সভা-সমিতিতে যে সমস্ত আলাপ আলোচনা হতো ,সেখানে সব থেকে বেশি গুরুত্ব আরোপ করা হতো সংস্কারের উপরে। সংস্কার বিষয়ক কি ধরনের সুপারিশের দিকে যাওয়া হবে ,তাই নিয়ে আলাপ-আলোচনার পর, সেই সমস্ত সুপারিশ গুলি সংগঠনের প্রাদেশিক নেতৃত্তের কাছে পাঠানো হতো ।তবে সেইসব সুপারিশগুলি যে একেবারে ধর্মীয় তাৎপর্যের বাইরে থাকত তা কিন্তু বলা যায় না ।
                

এই পর্বে সঙ্গে পাশ্চাত্যের যুক্তিবাদী ধ্যান-ধারণার একটা বিশেষ রকমের প্রভাব ছিল ।প্রচলিত হিন্দু ধর্মের সমালোচনা করে ই হিন্দু ধর্মের ভেতর একটা যুক্তিবাদী চিন্তা-চেতনার প্রয়োগ ঘটিয়ে ,তাকে একটা সময় উপযোগী মাত্রা দান করা ছিল এই আন্দোলনের লক্ষ্য। অপরপক্ষে সংস্কারবাদী আন্দোলনের যে দ্বিতীয় পর্যায়ের  কথা উল্লেখ করা হলো, সেই  দ্বিতীয় পর্যায়ে  কিন্তু প্রচলিত হিন্দুধর্মের পুনর্জাগরণের বিষয়টিকে খুব বিশেষভাবে গুরুত্ব দেয়া হয়েছিল।
                

এই পুনর্জাগরণবাদীর চিন্তা-চেতনায় যাঁরা বিশ্বাসী ছিলেন, তাঁরা খুব গভীরভাবে বিশ্বাস করতেন যে, যাঁরা হিন্দু ধর্মের সংস্কারের কথা বলেন ,তাঁরা বিশেষভাবে ব্রিটিশ সরকারের মদদপুষ্ট। ব্রিটিশ যেভাবে তাদের সংস্কারের নাম করে ,নিজস্ব ধ্যান-ধারণা আমাদের দেশের মানুষদের উপরে চাপিয়ে দিতে চায়, সেই ধ্যান-ধারণাকে এই সমস্ত ব্যক্তিত্বরা আমাদের দেশের মানুষদের উপর প্রয়োগ ঘটাতে চাইছে ।আমরা খুব স্পষ্টতই ব্রিটিশের ধ্যান ধারণা থেকে বেরিয়ে আসা যুক্তিবাদী চিন্তাভাবনার প্রতি এই অংশের সামাজিক নেতারা এতোটুকু শ্রদ্ধাশীল ছিলেন না। তাঁরা মনে করতেন ,যুক্তিবাদী ধারণার কাছে আত্মসমর্পণ করা মানে ব্রিটিশের ধ্যান-ধারণার কাছেই আত্মসমর্পণ ।
             

এই দৃষ্টিভঙ্গিকে তাঁরা পাশ্চাত্যের কাছে প্রাচ্যের একেবারে বিকিয়ে যাওয়া হিসেবে দেখেছিলেন ।জাতীয়তাবাদের জাগরণের কালে সংস্কারবাদীদের  সঙ্গে জাতীয়তাবাদের চেতনা সম্পৃক্ত ব্যক্তিত্বদের   যে দ্বন্দ্ব এবং সংঘাত তৈরি হয় ,তাকে একটা পরস্পর বিরোধী ধারণা হিসেবেও কখনো কখনো তুলে ধরা যায়। এই দ্বন্দ্ব ,সংস্কার বিরোধী শক্তিকে বিকশিত হতে সাহায্য করেছিল কিনা তাও আমাদের খুব গভীরভাবে ভেবে   দেখা দরকার ।
               

সংস্কার বিরোধীদের যে ভারতীয় হিসেবে সবকিছুকে গর্ব করার একটা প্রবণতা ,এই বোধের ভেতর থেকেই পুনর্জাগরণের চিন্তা সমাজের বুকে গেঁথে দেওয়ার প্রচেষ্টা ,সেটি এই গোটা কর্মকাণ্ডের বাইরে থাকা হিন্দু সাম্প্রদায়িক শক্তি ,সেই সময়ের গোটা ভারতের বিভিন্ন প্রান্তের যে সমস্ত কর্মকাণ্ড ,সেগুলিকে এক সুতোয় গাঁথার কাজটিকে বেশ কিছুটা সাফল্যের পথে এগিয়ে দিতে পেরেছিল ।অতীত ভারতের গর্ব হিসেবে তথাকথিত হিন্দু সভ্যতা কে ঘিরে গর্ববোধ করা ,সেই সময়ের সংস্কার বিরোধীদের এই যে প্রচলিত দৃষ্টিভঙ্গি, সেই দৃষ্টিভঙ্গি কিন্তু আরএসএস প্রতিষ্ঠার পক্ষে একটা উর্বর মৃত্তিকা তৈরি করে দিতে সক্ষম হয়েছিল ।
                

এই সংস্কার বিরোধীরা মনে করতেন ;প্রাচীন হিন্দু সভ্যতার শেষ হয়ে গেছে মুসলমান শাসনের কারণে। আর ব্রিটিশেরা এসে সেই প্রাচীন সভ্যতার যাবতীয় অস্তিত্বকেই একেবারে বিনষ্ট করে দিয়েছে ।ইউরোপের সভ্যতা আর তার পাশাপাশি ইসলামী সভ্যতা থেকে অনেক উঁচুতে প্রাচীন ভারতীয় সভ্যতা কে একটা এককেন্দ্রিক ধারাতে, যেখানে বহুত্ববাদী চিন্তা-চেতনার ইতিহাসাসৃত  উপাদানগুলিকে দূরে সরিয়ে রেখে উপস্থাপিত করার প্রবণতা তীব্র হয়ে উঠেছিল ।সেই দৃষ্টিভঙ্গির একটা অসম্ভব ইতিবাচক ফলাফল সমাজের বুকে গেঁথে দিতে সংস্কার বিরোধীরা সচেষ্ট ছিলেন।
                     

সেই উদ্দেশ্য নিয়েই প্রাতিষ্ঠানিক হিন্দু ধর্মের বিভিন্ন আচার-আচরণ গুলিকে ভারতবর্ষের সমাজের পক্ষে সবথেকে দরকারী এবং অত্যন্ত গৌরবের বিষয় বলে তুলে ধরবার চেষ্টা এই সময় হয়েছিল ।বলা বাহুল্য এই সব প্রচেষ্টা কিন্তু সাম্প্রদায়িক হিন্দুদের ভেতরে একাত্মতা বোধ তৈরি করতে অত্যন্ত তীব্র ভাবে উপাদান যুগিয়েছিল। সংস্কার বিরোধীদের এই যে প্রবণতা, তাকে অব্যাহত রাখার  স্বার্থে এঁদের নেতৃত্ব  প্রয়োজনীয় সামাজিক সংস্কারের ক্ষেত্রেও খুব বেশি রকম নেতিবাচক অবস্থান গ্রহণ করতেন ।
                    

উনিশ শতকের  শেষ দিক থেকে সংস্কারবাদী দৃষ্টিভঙ্গির প্রবাহ ক্রমশ শিথিল হতে থাকে ।আর সেই শূন্যতা পূরণ করবার লক্ষ্যে পুনর্জাগরণের ভাবধারা ক্রমশ শক্তি অর্জন করে। পুনর্জাগরণের ভাবধারার এই শক্তি অর্জনের বিষয়টি কিন্তু আরএসএস ,  প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করতে শুরু করে।বস্তুত এই অনুকূল পরিবেশ টি আর এস এস সর্বতোভাবে নিজেদের পক্ষে কাজে লাগিয়েছিল ১৯২৫ সালে তাদের সংগঠনের প্রতিষ্ঠাকালে।
                  

পুনর্জাগরণকে আর এস এস নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করলেও , পুনর্জাগরণ   সমাজকে একদম পিছন ফেরানোর একটা প্রচেষ্টা - সরাসরি বলে দিলেও ইতিহাসের প্রতি একদম সুবিচার করা হয় না।আধুনিক ভারতীয় জাতি গঠনের স্বার্থে এই পুনর্জাগরণের উপাদানগুলি যথেষ্ট কার্যকরী ভূমিকা পালন করেছিল।কিন্তু আর এস এস , পুনর্জাগরণের সীমাবদ্ধতাকে নিজেদের সংগঠন তৈরি এবং তার বিস্তারের লক্ষ্যে সবরকম ভাবে ব্যবহার করেছে।
                       

জাতীয় কংগ্রেসের প্রথম পর্যায়ের কুড়ি বছরের আবেদন-নিবেদন নীতির কালে  ,তাঁদের কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি যে মননশীল সাংস্কৃতিক আন্দোলনের কথা বলা হলো ,সেই আন্দোলনের দুটি ধারা উপলব্ধ করে পাঠকের মনে এই ধারণা তৈরি হতে পারে যে ;এই কর্মকাণ্ডকে কেন মননশীল সাংস্কৃতিক আন্দোলন এই অভিধায় অভিহিত করা হলো ?
                

এই প্রশ্নের উত্তরে  প্রথমেই বলতে হয়  ,জাতীয় কংগ্রেসের প্রথম যুগের এই কর্মকান্ডের পাশাপাশি যে  সংস্কৃতিক আন্দোলন প্রবাহিত হয়েছিল, সেই আন্দোলনে সংস্কারবাদী তারিকাতে  সবথেকে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা এবং অবদান ছিল ব্রাহ্মসমাজের ।আর সেটি এই বাংলার মাটি থেকে উদ্ভূত হয়েছিল। ১৮৭০ সালে এই ব্রাহ্মসমাজের সংস্কারবাদী আন্দোলনের গতিপথ, তাঁদের নানা আভ্যন্তরীণ বিরোধের কারণে দ্বিধাবিভক্ত হয়ে গেলেও, তাঁদের কর্মকান্ড ভারতবর্ষের সামাজিক পরিমণ্ডলে নব চেতনার উন্মেষের ক্ষেত্রে অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছিল। বিশেষ করে স্ত্রী শিক্ষা বিস্তারের ক্ষেত্রে তাঁদের ভূমিকা, যেটি কোনো অবস্থাতেই পুনরুজ্জীবনবাদী চিন্তা-চেতনায় বিশ্বাসী লোকদের কাছে সমর্থনযোগ্য ছিলনা ,সেই দিকটি আমাদের সমাজ জীবনের ক্ষেত্রে অত্যন্ত ইতিবাচক একটি ভূমিকা পালন করেছিল ।
                    

আদি ব্রাহ্মসমাজ প্রার্থনা কেন্দ্র - কলকাতা

ব্রাহ্মসমাজের সংস্কারবাদী আন্দোলনের ইতিবাচক ধারণা গুলি কে, হিন্দু ধর্মকে যারা রাজনৈতিক অভিধায় প্রবাহিত করার লক্ষ্যে জীবন উৎসর্গ করেছিলেন ,সেইসব ব্যক্তিত্বরা, কখনোই ভালোভাবে দেখেননি ।এইসব ব্যক্তিত্বদের ভাবনা চিন্তার মধ্যে সুসংবদ্ধ রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি না থাকলেও, সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি কিন্তু সব সময় অত্যন্ত বেশি মাত্রায় প্রবল ছিল ।এইরকম একটি পরিস্থিতির ভেতরেই হাজার  উনিশ শতকের আট নয়ের দশকে   রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ আন্দোলন ,ভারতীয় সমাজ জীবনের ইতিহাসে একটি অত্যন্ত ইতিবাচক দিগন্ত উন্মোচিত করে ।
              

এই আন্দোলনের উদার যুক্তিবাদী পরমতসহিষ্ণুতায় বিশ্বাসী, চিরন্তন ভারতবর্ষের বহুত্ববাদী ও সমন্বয়ী চিন্তা-চেতনার ফলশ্রুতি, যেকোনো সাম্প্রদায়িক চিন্তা-চেতনার পক্ষে কার্যত বিষধর সাপের ফণার মুখে ঘাতকের লাঠি ছিল।

ধারাবাহিক লেখাগুলি পড়তে ক্লিক করুনঃ www.cpimwb.org.in

ভারতের জাতীয় আন্দোলন ও আর এস এস – (পর্ব – ১৪)

ভারতের জাতীয় আন্দোলন ও আর এস এস – (পর্ব – ১৩)

ভারতের জাতীয় আন্দোলন ও আর এস এস – (পর্ব – ১২)

ভারতের জাতীয় আন্দোলন ও আর এস এস – (পর্ব – ১১)

ভারতের জাতীয় আন্দোলন ও আর এস এস – (পর্ব – ১০)

ভারতের জাতীয় আন্দোলন ও আর এস এস – (পর্ব- ৯)

ভারতের জাতীয় আন্দোলন ও আর এস এস – (অষ্টম পর্ব)

ভারতের জাতীয় আন্দোলন ও আর এস এস – (সপ্তম পর্ব)

ভারতের জাতীয় আন্দোলন ও আর এস এস – (ষষ্ঠ পর্ব)

ভারতের জাতীয় আন্দোলন ও আর এস এস – (পঞ্চম পর্ব)

ভারতের জাতীয় আন্দোলন ও আর এস এস – (চতুর্থ পর্ব)

ভারতের জাতীয় আন্দোলন ও আর এস এস – (তৃতীয় পর্ব)

ভারতের জাতীয় আন্দোলন ও আর এস এস – (দ্বিতীয় পর্ব)

ভারতের জাতীয় আন্দোলন ও আর এস এস – (প্রথম পর্ব)


শেয়ার করুন

উত্তর দিন