ভারতের জাতীয় আন্দোলন ও আর এস এস – (পর্ব – ১৪)

ধারাবাহিক রচনায়ঃ গৌতম রায়

জাতীয় কংগ্রেসের প্রথম পর্যায়ে যাঁরা নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, সেই সব নরমপন্থী নেতার এসেছিলেন হাজার উনিশ শতকের  নবজাগরণের ধারাবাহিকতায় অত্যন্ত অভিজাত সম্প্রদায়ের ভেতর থেকে ।সেই কারণে নিজেদের  শ্রেণীর চেতনাগত জায়গাটি , অভিজাতের   প্রতি সহমর্মিতা সূচক ছিল ।সেই সামাজিক প্রেক্ষিত থেকেই আমাদের বিচার করে দেখতে হবে নরমপন্থী রাজনীতিকদের সংস্কার আন্দোলনের ভেতর দিয়ে উঠে আসা প্রেক্ষিত টিকে।
                     

নরমপন্থী রাজনীতিকরা যে ভারতবর্ষের আপামর জনতার থেকে মোটামুটিভাবে বিচ্ছিন্ন ছিলেন সে কথা আলাদা করে বলার কোন দরকার নেই। অত্যন্ত অভিজাত ও উচ্চ সম্পদের অধিকারী এইসব ব্যক্তিত্ব দের সামাজিক প্রেক্ষিত থেকে ই  নিজেদের প্রচলিত আঙ্গিক কে তাঁরা  দেখতে অভ্যস্ত ছিলেন। জাতীয় কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠার কালে ,প্রথম অধিবেশনে যে ৭১ জন বেসরকারি ভারতীয় প্রতিনিধি যোগ দিয়েছিলেন, তাঁরা বিভিন্ন উচ্চ সামাজিক প্রেক্ষাপট থেকে উঠে এসেছিলেন। এঁদের ভেতরে বিশেষ জায়গা ছিল উকিল ,ব্যবসায়ী, মহাজন, জমির মালিক, চিকিৎসক, ধর্মগুরু ,সংস্কারক ,সাংবাদিক ইত্যাদিদের।
                

অনেকে দাবি করেন যে, জাতীয় কংগ্রেসের প্রথম অধিবেশনের সর্বস্তরের মানুষ অংশগ্রহণ করেছিলেন, কিন্তু প্রতিনিধিদের সামাজিক অবস্থান যদি আমরা অনুপুঙ্খভাবে বিশ্লেষণ করি, তাহলে দেখতে পাব যে ;উচ্চবর্ণের অভিজাত্ত মানুষের বাইরে একজন-ও কিন্তু জাতীয় কংগ্রেসের প্রথম অধিবেশনে অংশগ্রহণ করেননি ।আমাদের আরও একটি বিষয় মনে রাখা দরকার যে, জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার সময় কালে ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন, ব্রিটিশের স্বার্থরক্ষাকারী ভারতীয় জমিদারদের যে সংগঠ,ন সেটি কিন্তু অত্যন্ত শক্তিশালী ছিল। এই সংগঠনটি কিন্তু জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার সময় কাল থেকে ই পরবর্তী বেশ অনেকটা সময়  জাতীয় কংগ্রেসের সঙ্গে একটা সুসম্পর্ক বজায় রেখে চলেছিল ।
                         

এই সংগঠনের পক্ষ থেকে জাতীয় কংগ্রেসকে একটা বড় রকমের আর্থিক সাহায্য করা হত। জাতীয় কংগ্রেসের একদম প্রাথমিক পর্যায়ে তাঁদের কর্মকাণ্ড বিস্তৃত করার ক্ষেত্রে ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন থেকে পাওয়া আর্থিক সাহায্য বিশেষ রকমভাবে সহায়ক হয়েছিল। জাতীয় কংগ্রেসের নরমপন্থী ধারার প্রাবল্য থেকে শুরু করে, চরমপন্থী ধারার শক্তি বিস্তারের কালপর্ব- যদি আমরা খুব অনুপুঙ্খ ভাবে বিশ্লেষণ করি, তাহলেও দেখতে পাবো; এই সময়কালে জাতীয় কংগ্রেসের বিভিন্ন অধিবেশনে যোগদানকারী প্রতিনিধিদের ভেতর উচ্চবিত্ত অভিজাত সম্প্রদায়ের মানুষদের আধিক্য ছিল সবথেকে বেশি।
                     

১৮৯২ সাল  থেকে ১৯০৯ --এই কালপর্ব ধরে জাতীয় কংগ্রেসের অধিবেশন গুলির প্রতিনিধিদের সামাজিক অবস্থান যদি আমরা বিশ্লেষণ করি ,তাহলে দেখতে পাব, সেইসব অধিবেশনে যোগদানকারী প্রতিনিধিদের ভেতর ১৮.৯৯  শতাংশ ছিল উচ্চবর্ণের জমিদার ।৩৯.৩২  শতাংশের প্রতিনিধি ছিলেন দেশের প্রথম শ্রেণীর উকিল। ব্যবসায়ীদের প্রতিনিধিত্ব ছিল ১৫.১০  শতাংশ ।সাংবাদিকদের প্রতিনিধিত্ব ছিল ৩.১৮  শতাংশ ।চিকিৎসকদের প্রতিনিধিত্ব ছিল ২.৯৪ শতাংশ। শিক্ষকের প্রতিনিধিত্ব ছিল ৩.১৬ শতাংশ ।তার বাইরে বিত্তবান সমাজের ভেতর থেকে ১৭.৩১ শতাংশ মানুষ,  যাঁরা বিভিন্ন রকম পেশার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন ,তাঁরা জাতীয় কংগ্রেসের এই সময়কালে বিভিন্ন অধিবেশন গুলির প্রতিনিধি নির্বাচিত হয়েছিলেন।
                  

যে উকিলদের প্রতিনিধিত্বের কথা উল্লেখ করা হলো, সেইসব উকিলদের সিংহভাগ কিন্তু ছিলেন পারিবারিক দিক থেকে জমিদার। তাঁদের জাতীয় কংগ্রেসের সঙ্গে প্রাথমিক সংযোগ তৈরি করার ক্ষেত্রে ,তাঁদের জমি সংক্রান্ত যে স্বার্থ ,তাকে বজায় রাখার ,অক্ষুন্ন রাখার বিষয়টি -ছিল যথেষ্ট রকমের শক্তিশালী ।উকিলদের এই অংশগ্রহণের ভেতর দিয়ে একটা জিনিস কিন্তু খুব পরিষ্কার হয়ে যায়, সংস্কার আন্দোলনের নামে, সামাজিক প্রেক্ষাপট পরিবর্তনের ভাবনা জাতীয় কংগ্রেস ভাবলেও ,জমিদারদের বাদ দিয়ে কংগ্রেসের প্রথম যুগের নেতৃত্ব তাঁদের ভাবনাটাকে প্রসারিত করতে পারেন নি। আর এই জমিদারদের স্বার্থ সংরক্ষণের বিষয়টি সঙ্গে ব্রিটিশের স্বার্থের বিষয়টি এতো অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত হয়ে পড়েছিল যে ,জমিদার আর ব্রিটিশ কার্যত মিলেমিশে গিয়েছিল ।
                     

এই দিক থেকে বিচার করলে জাতীয় কংগ্রেসের প্রথম কুড়ি বছরের সময় কালে কংগ্রেসের যে কৃষকদের পক্ষে কোনরকম অবস্থান না নেওয়ার ঘটনাক্রম আমরা দেখতে পাই, তার মূল কারণটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে ।চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের বিস্তৃতি দাবি নরমপন্থী রাজনীতিকেরা জানিয়েছিলেন-- একথা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই। কিন্তু এই দাবি তাঁরা কোনো অবস্থাতেই কৃষকের স্বার্থে জানাননি ।জানিয়েছিলেন, জমিদারের স্বার্থে ।কর পরিকাঠামোর পুনর্বণ্টনের যে দাবি নরমপন্থী রাজনীতিকেরা জানিয়েছিলেন ,সেই দাবির মূল উদ্দেশ্য ছিল ,জমির মালিকানা ,জমির মূল্য এবং জমির মূল্যের বিস্তার বিষয়ক সমীক্ষা যেটা ক্যাডাস্ট্রাল সার্ভে হিসেবে ব্রিটিশ ভারতের ইতিহাসে পরিচিত, সেই পর্যবেক্ষণের  বিরোধিতার উদ্দেশ্যেই ।
                  

এই পর্যায়ক্রম টি কিন্তু হয়েছিল ১৮৯৩-৯৪ সালে। সেই সমীক্ষার কিন্তু  স্পষ্ট উদ্দেশ্য ছিল জমিদার আর জমিদারের পরিকাঠামোর ভেতরে থাকা হাজারো রকমের আমলা বাহিনীর নানা ধরনের কৌশল ,যেগুলি ব্যবহৃত হতো কৃষকদের বিরুদ্ধে ,সেই জায়গায় কৃষকদের প্রতি একটা সহমর্মিতার দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তোলা।  একথা ভুলে গেলে চলবে না যে, রমেশচন্দ্র দত্তের নেতৃত্বে একটি প্রজা- কৃষকদের প্রতি সহানুভূতিশীল  গোষ্ঠী কিন্তু জাতীয় কংগ্রেসের প্রথম পর্যায় থেকেই  এই সংগঠন টির( কংগ্রেস)  মধ্যে অত্যন্ত কার্যকরী ভূমিকা পালন করে গিয়েছিল।
                    

এই গোষ্ঠীটি প্রজাস্বত্ব আইনে  যে সংশোধনী আনার প্রচেষ্টা ব্রিটিশ চালিয়েছিল, তার চরম বিরোধিতা করে ।জাতীয় কংগ্রেসের প্রথম যুগের নেতৃত্বে কিন্তু এই প্রজা সংশোধনী আইনের বিরোধিতা প্রশ্নে সুস্পষ্ট অভিমত ছিল না। অর্থাৎ; প্রজাস্বত্ব আইন সংশোধিত হয়ে জমিদারদের স্বার্থ ক্ষুন্ন হোক -এটা খুব পরিষ্কারভাবে জাতীয় কংগ্রেসের প্রথম স্তরের নেতারা চান নি। অথচ এমন চাইবার কথা খুব প্রকাশ্যেই বলেছিলেন রমেশচন্দ্র দত্তের নেতৃত্বাধীন এই গোষ্ঠীটি ।
                  

জাতীয় কংগ্রেসের নেতৃত্বে সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ এই বিষয়টি না চাইবার ফলে রমেশচন্দ্র দত্তের সেই গোষ্ঠীটি ১৮৯৮  সাল থেকে জাতীয় কংগ্রেসের ভেতরে অত্যন্ত কোণঠাসা হয়ে পড়তে শুরু করে ।১৮৯৯ সালে পাঞ্জাবের জমি হস্তান্তর সংক্রান্ত বিল পাঞ্জাব  ল্যান্ড এলিয়েনেশন বিল ,সেখানকার ভূমি ব্যবস্থার ক্ষেত্রে সামন্ততান্ত্রিক পরিকাঠামো কে আরো শক্তিশালী করার লক্ষ্যেই পরিচালিত হয়।
                

এই বিলটি ঘিরে নরমপন্থীদের অবস্থান কোনো অবস্থাতেই কৃষকের পক্ষে পরিপূর্ণভাবে ছিল না। বরঞ্চ বলা যায়, এই বিলটিকে ঘিরে নরমপন্থী রাজনীতিকদের অবস্থান, জমিদার কেন্দ্রিক সহানুভূতির  পর্ব কে আরো প্রসারিত করেছিল ।নরমপন্থীদের ভেতরে কিন্তু বণিক সম্প্রদায়ের  একটা বড় অংশের প্রতিনিধিত্ব ছিল। আর আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে;  অবিভক্ত পাঞ্জাবে এই বণিক সম্প্রদায় কিন্তু নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির তাগিদে প্রচলিত হিন্দু ধর্মের সাম্প্রদায়িক ব্যাখ্যার ভেতর দিয়ে ধীরে ধীরে একটা সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের মানসিকতাকে স্পষ্ট করে তোলবার পথে এগোতে শুরু করেছিল।
                  

অবিভক্ত পাঞ্জাব সহ গোটা উত্তর ভারতের বণিক সম্প্রদায়, যারা জন্মসূত্রে হিন্দু ,সেইসব মানুষদের এই শ্রেণী স্বার্থবাহী অবস্থান আর প্রচলিত হিন্দু ধর্মের ভাবাবেগকে একাত্ম করে দেওয়ার যে প্রবণতা সেই সময় থেকে শুরু হয় ,সেটিকে আরএসএসের সাম্প্রদায়িক বিভাজনের রাজনীতির একদম আদিপর্ব বলা যেতে পারে ।বস্তুত আরএসএস প্রতিষ্ঠার অনেক আগেই সাম্প্রদায়িক রাজনীতির ক্ষেত্র প্রস্তুতের ক্ষেত্রে হিন্দু সম্প্রদায়ের রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির বিষয়টিকে অনুপ্রবেশ ঘটিয়ে , রাজনৈতিক হিন্দুত্বের যে অঙ্কুরোদগম ঘটেছিল, সেটি জাতীয় কংগ্রেসের প্রথম যুগের নেতৃত্ব তাঁদের সংস্কার আন্দোলনের  ভেতর দিয়ে প্রতিহত করবার দিকে কিন্তু এগোন  নি ।
                    

শুধু যে তাঁরা এগোননি তা নয় ।তাঁদের ভেতরে অভিজাত সম্প্রদায়ের স্বার্থরক্ষার যে ভয়ঙ্কর প্রবণতা ছিল ,সেই প্রবণতার দরুন, তাদের ভিতর কৃষক- শ্রমিকের স্বার্থ দেখার বিষয়টিও চরমভাবে অবহেলিত হয়েছিল ।এই সময়কালে খনি সংক্রান্ত একটি বিল ,যে বিল টি  মাইনিং বিল নামে ইতিহাসে আলোচনা করা হয়, সে সম্পর্কেও কিন্তু এই নরমপন্থী রাজনীতিকেরা যথাযথ অবস্থান পালন করতে পারেননি ।সংশ্লিষ্ট বিলটিতে শিশুদের এবং মহিলাদের জীবনযাপন উন্নত করার প্রস্তাব করা হয়েছিল ।একটা সুনির্দিষ্ট বয়সের তলায় অবস্থানরত কর্মীদের শিশুদের যাতে কোনো অবস্থাতেই কর্মী হিসেবে ব্যবহার করা না হয় ,তেমন সংস্থানের কথাও  কিন্তু বলা হয়েছিল।
                

সেগুলির প্রতি এই নরমপন্থী রাজনীতিকরা আদৌ সুবিচার করেন নি।নরমপন্থীদের এই আবিমৃষ্যকারিতার পাশাপাশি একটি কথা বিশেষ ভাবে বলতে হয়; এইসব সংস্কারের ভাবনা কিন্তু ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহারের উদ্দেশে যে রাজনৈতিক হিন্দুদের নানা ভাবে অসংগঠিত পর্যায়ে বিকাশ তখন শুরু হয়েছিল, তাদের ভিতরে ও বিন্দুমাত্র দেখা যায় নি।
             

সংস্কারের সীমাবদ্ধতা ঘিরে নরমপন্থী রাজনীতিকদের নিয়ে সেই সময় যুব সমাজের ভেতর রাজনীতিসচেতন যাঁরা ,তাঁরা ধীরে ধীরে বিক্ষুদ্ধ হয়ে উঠতে শুরু করেছিলেন। বিশেষ করে বোম্বাইয়ের শ্রম সংস্কারের বিরোধিতা যখন নরমপন্থী রাজনীতিকেরা করেন ,সেটি কিন্তু অভিজাত সম্প্রদায় ব্যতীত, নব উত্থিত মধ্যবিত্ত শ্রেণীর একটা বড় অংশ ,যাঁদের মধ্যে রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি ধীরে ধীরে বিকশিত হতে শুরু করছে ,তাঁরা কোনো অবস্থাতেই ভালোভাবে নেননি ।   
                  

বোম্বাইয়ের শ্রম সংস্কারের বিরোধিতা করেছিলেন নরমপন্থী রা এই যুক্তিতে যে ,এই শ্রম  সংস্কারের পেছনে ব্রিটেনের ল্যাঙ্কাশায়ারের স্বার্থ দারুণ  ভাবে জড়িত ।অপরপক্ষে আসামের চা বাগানের শ্রম ও সংস্কার কিন্তু নরমপন্থিরা  সমর্থন করেছিলেন ।কারণ; আসামের চা বাগানের শ্রম সংস্কারের পেছনে মালিকের স্বার্থ ,যে মালিকরা মূলত বিদেশি, ধনী  সম্প্রদায় থেকে উঠে এসেছে, তাদের স্বার্থের বিষয়টি ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিল।
                 

বোম্বের মিলমালিকরা যে তাদের শ্রমিকদের উপর ভয়ংকর শোষণ করছে- এই বিষয়টি দেখেও যেন না দেখার ভান করে থেকেছিলেন নরমপন্থী রাজনীতিকেরা। ভারতের দারিদ্র্য মোচনের জন্য ঔষধ হিসেবে দেশীয় ধনতন্ত্রের পক্ষে নরমপন্থীদের যে পৃষ্ঠপোষকতা ,তার ভেতরেই তাদের প্রকৃত উদ্দেশ্য পরিষ্কার হয়ে উঠেছিল। এই জমিদার , বুর্জোয়াদের খুশি করার  দৃষ্টিভঙ্গি, তার  বিরুদ্ধতার ভেতর দিয়েই জাতীয় কংগ্রেসের একটা অংশের ভেতর থেকেই নরমপন্থী বিরুদ্ধতার পর্বটি শুরু হয়।
                   

জাতীয় কংগ্রেসের সংস্কারবাদী মানসিকতা, যাকে অবলম্বন করে গরিবের মাসিহা  হিসেবে ব্রিটিশ নিজেদেরকে তুলে ধরতে শুরু করে ,এই বিষয়টি কিন্তু তৎকালীন আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত ভারতীয় যুব সমাজ কোনো অবস্থাতেই ভালো চোখে দেখেনি। এই অংশের যুব সমাজের প্রতিনিধিরা সশস্ত্র উপায় নানা ধরনের ব্রিটিশ বিরোধী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত থেকে ছিল ।এই অংশের বরিষ্ঠ নেতৃত্ব বাল গঙ্গাধর তিলকের সঙ্গে সামান্য কিছু সখ্যতা কে ঘিরে বিএস মুজ্ঞে কে জাতীয় আন্দোলনের এক উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব হিসেবে আরএসএস প্রতিষ্ঠা করতে চায়।
                   

অথচ নরমপন্থীদের যে  অর্থনৈতিক নীতি ,তার সম্পর্কেও কিন্তু হিন্দু সাম্প্রদায়িক মানসিকতা সম্পন্ন ব্যক্তিত্বরা নীরবতা পালন করে গেছে। বিএস মুজ্ঞে নীরবতা পালন করেছে।  পরবর্তীকালে যখন ধীরে ধীরে নরমপন্থীদের নানা ধরনের সীমাবদ্ধতাকে ঘিরে জাতীয় কংগ্রেসের মধ্যে একটা দ্বন্দ্ব প্রকট হচ্ছে সেই পর্বেও এইসব বি এস মুজ্ঞে    বা তার  সহযোগীদের কোনোরকম উদ্যোগী মনোভাবের সাক্ষ্য ইতিহাস দেয় না।
                        

জাতীয় কংগ্রেসের প্রথম পর্যায়ের নেতৃত্বে সিংহভাগই ছিলেন জন্মসূত্রে হিন্দু ।তা বলে তাঁদের মধ্যে কিন্তু সাম্প্রদায়িক চিন্তা চেতনা বা হিন্দু পুনরুত্থাণবাদী চিন্তা চেতনা  বিন্দুমাত্র স্থান পায়নি ।অভিজাত  হিন্দু সম্প্রদায়ের ব্যক্তিত্বদের পাশাপাশি বোম্বাইয়ের রাজনীতিবিদ বদরুদ্দিন তৈয়বজীও কিন্তু জাতীয় কংগ্রেসের প্রথম পর্যায় থেকে এই সংগঠনটি সঙ্গে যুক্ত থেকেছেন।
                        

১৮৯২ সাল থেকে ১৯০৯ সাল, এই সময়কালে জাতীয় কংগ্রেসের যে সব বার্ষিক  অধিবেশন ঘটেছে ,তার প্রায় সিংহভাগ প্রতিনিধিদলে ছিলেন হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ। মাত্র ৬.৫  শতাংশ মুসলমান এই সময়কালে কিন্তু জাতীয় কংগ্রেসের অধিবেশনে প্রতিনিধি হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন। আর জাতীয় কংগ্রেসের এই সময়কালের প্রথম অধিবেশনে যোগদান কারী প্রতিনিধিদের  ৯০ শতাংশ হিন্দুদের ভেতর ৪০ শতাংশই ছিলেন উচ্চবর্ণের। মূলত ব্রাহ্মণ ।তার বাইরের যাঁরা ছিলেন, তাঁরাও মূলত উচ্চবর্ণ থেকেই এসেছিলেন ।নিম্নবর্গীয় হিন্দুদের উপস্থিতি কিন্তু এই সময়কালে জাতীয় কংগ্রেসের বার্ষিক অধিবেশনে প্রতিনিধিদের ভেতরে আমরা দেখতে পাই না ।
                      

প্রতিনিধি সংক্রান্ত এ বিষয়টিকে এক ধরনের সমসাময়িক গোঁড়ামির পরিচায়ক হিসেবে অনেকে দেখানোর চেষ্টা করলেও এটা কিন্তু অত্যন্ত জোটের সঙ্গে বলতে হয় যে ;সাম্প্রদায়িক- জাত্যাভিমানি কোনো প্রস্তাব কিন্তু জাতীয় কংগ্রেসে র কার্যকালের প্রথম কুড়ি বছরে গৃহীত হওয়া তো দূরের কথা ,আলোচনার জন্যই উত্থাপিত  হয় নি।বস্তুত ১৯০৭  সালের কংগ্রেস অধিবেশনের আগে জাতীয় কংগ্রেসের বার্ষিক অধিবেশন গুলিতে কোনোসামাজিক সমস্যা নিয়ে সে অর্থে আলোচনা ই হতো না।
                  

জাতীয় কংগ্রেসের প্রথম যুগের নেতারা যে নির্বাচিত আইনসভার দাবি জানাতেন, সেই দাবির প্রতি কিন্তু স্যার সৈয়দ আহমেদ সহ বেশ কিছু প্রভাবশালী মুসলমান নেতাদের সেই মুহুর্তে তেমন একটা সমর্থন ছিল না। তাঁদের এই দাবির প্রতি সহমর্মিতা জ্ঞাপন না করার সবথেকে বড় কারণ ছিল যে; নির্বাচিত আইন পরিষদ তৈরি হলে, সেখানে হিন্দু সংখ্যাধিক্যের দ্বারা সবকিছুর নিয়ন্ত্রণের একটা বিষয় থেকে যেতে পারে। তার পাশাপাশি বাঙালি প্রাধান্য তৃতীয় এঁরা  কিন্তু খুব একটা ভালো চোখে দেখেন নি। বাঙালি হিসেবে মুসলিম নবজাগরণের প্রথম যুগের ব্যক্তিত্বরা বাঙালি মুসলমানদের কিন্তু সব সময় যে খুব একটা গুরুত্ব সহকারে দেখেছিলেন এমন ভাবার কোনো কারণ নেই। বাঙালি হিসেবে তাঁরা প্রধানত হিন্দু বাঙালিদের কথাই এই সময় তাঁদের বিভিন্ন অভিমতের ভেতর দিয়ে ফুটিয়ে তুলতেন ।
                

মুসলমান সমাজে সেই সময়ের সমাজে শীর্ষস্থানে অবস্থানরত  ব্যক্তিত্বরা হিন্দু সমাজের মতোই চালাচ্ছিলেন একদম উচ্চবিত্ত অভিজাত সম্প্রদায়ের থেকে আসা মানুষেরা।তাঁরা কিন্তু নির্বাচিত আইন পরিষদ ঘিরে এই হীনমন্যতায় ভুগতেন যে, হিন্দু আধিপত্যের দ্বারা সংখ্যালঘু মুসলমান একটা সংকটজনক জায়গায় চলে আসতে পারে।
                     

১৮৮৮ সালে জাতীয় কংগ্রেসের বার্ষিক অধিবেশনে একটি নিয়ম হিসেবে এটি গৃহীত হয় যে ,কোনো প্রস্তাব যদি সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু অথবা মুসলমান আপত্তি জানান ,তাহলে সেই প্রস্তাব গৃহীত হবে না ।জাতীয় কংগ্রেসের পক্ষ থেকে আইনসভার সংস্কারের প্রস্তাব প্রথম উত্থাপিত হয় তাঁদের ১৮৮৯ সালের বার্ষিক অধিবেশনের ভেতর দিয়ে ।সেই প্রস্তাব টি তে একটি অনুচ্ছেদ যুক্ত করে বলা হয় ;সংখ্যালঘুদের আনুপাতিক হারে আইনসভার প্রতিনিধিত্ব সুপারিশের বিষয়টি ।
                    

এই ধরনের ভাবনা জাতীয় কংগ্রেসের প্রথম স্তরের নেতারা দেখানোর ভেতর দিয়ে এই জায়গাটি খুব পরিষ্কার করে দিয়েছিলেন যে; জন্মসূত্রে তাঁরা হিন্দু হলেও কোনো অবস্থাতেই কোনোরকম সাম্প্রদায়িক চিন্তা-চেতনা সঙ্গে তাঁদের কোনো রকম সংযোগ বা দুর্বলতা ছিলনা। যদিও ১৮৮৯  সালে জাতীয় কংগ্রেসের এই প্রস্তাব কিন্তু মুসলমান সমাজের ভেতরে আশঙ্কাকে একেবারে দূর করে দিতে পারেনি।
                      

এই আশঙ্কা পরবর্তীতে তীব্র হয়ে ওঠে  , তার  থেকে বড় কারণ হল ; ১৮৯৩ সালে গোটা দেশজুড়ে গোহত্যা কে কেন্দ্র করে ভয়াবহ দাঙ্গা হয়। এই দাঙ্গার সময় কিন্তু জাতীয় কংগ্রেসের প্রথম সারির নেতারা কার্যত নীরব ভূমিকা পালন করে গেছিলেন। বলা বাহুল্য এই দাঙ্গায় যে সমস্ত লোকেরা নানাভাবে মুসলমানদের উপর অত্যাচার চালিয়েছিল, তারাই পরবর্তীকালে হিন্দু সাম্প্রদায়িক চিন্তা-চেতনাকে সঙ্গত করবার কাজে  বস্তুত পরিচালিত হয়েছিল।আরএসএস প্রতিষ্ঠা র  উদ্দেশ্যে একটা জমি তৈরি করবার জন্য সেই রকম কাজের সঙ্গে গভীরভাবে সম্পৃক্ত তারা ছিল।
                  

গো  সংরক্ষণ আন্দোলনের সঙ্গে কংগ্রেস প্রত্যক্ষভাবে কিন্তু যুক্ত ছিল না। প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত না থাকলেও ,তাঁদের প্রথম যুগের নেতৃত্বের  সিংহভাগে  গো সংরক্ষণ আন্দোলনের প্রতি সহানুভূতি ছিল।কারণ; তাঁরা বুঝেছিলেন ,গো সংরক্ষণ বিষয়ে বিরুদ্ধতা করলে একটা বড় অংশের হিন্দু জাতীয় কংগ্রেসের সঙ্গে থাকবে না। হিন্দু সমর্থন হারানোর এই আশঙ্কা থেকে গোরক্ষা কে ঘিরে সেই সময়ের যে কর্মকাণ্ড রাজনৈতিক  হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকেরা চালাচ্ছিল ,সেই কর্মকান্ডের প্রতি একটা নীরব সমর্থন জাতীয় কংগ্রেসের প্রথম যুগের নেতারা দেখিয়ে গিয়েছেন ।
               

১৮৯৩ সালে গোটা দেশে গো হত্যাকে কেন্দ্র করে ভয়াবহ দাঙ্গার পর কিন্তু দেখা যাচ্ছে , জাতীয় কংগ্রেসের মুসলমান প্রতিনিধিদের অংশগ্রহণের বিষয়টি অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য পরিমাণে হ্রাস পেয়েছে। এই অবস্থার ভেতরে কিন্তু জাতীয় কংগ্রেসের সেই যুগের নেতারা মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষদের জাতীয় কংগ্রেসের ছত্রছায়াতে  নিয়ে আসার ব্যাপারে কোনরকম উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেননি।  ১৯০৬  সাল পর্যন্ত জাতীয় কংগ্রেসের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারার মতো মুসলিম সংগঠন গড়ে উঠবার আগে পর্যন্ত জাতীয় কংগ্রেসের প্রথম যুগের নেতারা কিন্তু মুসলমান সম্প্রদায় সম্পর্কে কার্যত একটা শীতল মানসিকতা নিয়েই চলে ছিলেন।
                    

এই প্রেক্ষাপটই কিন্তু হিন্দু সাম্প্রদায়িকদের নানাভাবে সংহত করতে, ঐক্যবদ্ধ করতে, একটা বড় রকমের ভূমিকা পালন করেছিল। নরমপন্থী নেতৃত্বের সঙ্গে চরমপন্থীদের যে বিবাদ,  সেই বিবাদকে মতাদর্শগত ভাবে কিন্তু রাজনৈতিক হিন্দু সাম্প্রদায়িক শিবির কোনদিনই দেখেনি ।তা যদি তারা দেখত,  তাহলে কোনো না কোন পক্ষে এই বিবাদ-বিসংবাদ সময় কালে হিন্দু সাম্প্রদায়িক রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ব্যাক্তিত্বের দে র কোনো না কোনো ভূমিকার ইতিহাস গত তথ্য-প্রমাণ আমরা পেতাম।

ধারাবাহিক লেখাগুলি পড়তে ক্লিক করুনঃ www.cpimwb.org.in

ভারতের জাতীয় আন্দোলন ও আর এস এস – (পর্ব – ১৩)

ভারতের জাতীয় আন্দোলন ও আর এস এস – (পর্ব – ১২)

ভারতের জাতীয় আন্দোলন ও আর এস এস – (পর্ব – ১১)

ভারতের জাতীয় আন্দোলন ও আর এস এস – (পর্ব – ১০)

ভারতের জাতীয় আন্দোলন ও আর এস এস – (পর্ব- ৯)

ভারতের জাতীয় আন্দোলন ও আর এস এস – (অষ্টম পর্ব)

ভারতের জাতীয় আন্দোলন ও আর এস এস – (সপ্তম পর্ব)

ভারতের জাতীয় আন্দোলন ও আর এস এস – (ষষ্ঠ পর্ব)

ভারতের জাতীয় আন্দোলন ও আর এস এস – (পঞ্চম পর্ব)

ভারতের জাতীয় আন্দোলন ও আর এস এস – (চতুর্থ পর্ব)

ভারতের জাতীয় আন্দোলন ও আর এস এস – (তৃতীয় পর্ব)

ভারতের জাতীয় আন্দোলন ও আর এস এস – (দ্বিতীয় পর্ব)

ভারতের জাতীয় আন্দোলন ও আর এস এস – (প্রথম পর্ব)


শেয়ার করুন

উত্তর দিন