প্রাককথন
১৮৪৯-র আগস্ট মাসে মার্কস ইউরোপ ছেড়ে ইংলন্ডের উদ্দেশ্যে রওনা দেন। লন্ডনে বসেই তিনি পুঁজি লিখেছিলেন, যদিও অর্থশাস্ত্র সম্পর্কিত তার পড়াশোনা, গবেষণা এর অনেক আগেই শুরু হয়। ১৮৪২-এ সাংবাদিক হিসাবে নিউ রাইনিশে জাইতুং পত্রিকায় কাজ করতে গিয়েই তিনি উপলব্ধি করেন ‘সমাজব্যবস্থার গঠন বুঝতে গেলে রাজনৈতিক অর্থনীতি ব্যতীত এগোনো যায় না’। লন্ডনের ইম্পিরিয়াল লাইব্রেরীতে বসে অর্থশাস্ত্রের পড়াশোনাকে মার্কস আরও এগিয়ে নিয়ে যান। ১৮৫৯ সালে প্রকাশিত হয় ‘আ কন্ট্রিবিউশন টু দ্য ক্রিটিক অফ পলিটিক্যাল ইকনমি, এই বইটিই মার্কসের অর্থশাস্ত্র চর্চার ভ্রুন। ১৮৬১-৬৩ নাগাদ বেরোয় ‘থিওরিজ অফ সারপ্লাস ভ্যালু’।
বইয়ের সমস্ত খণ্ডের কাজ শেষ হলে তবে ছাপতে দেওয়া হবে- প্রাথমিকভাবে তার ভাবনা কিছুটা এমনই ছিল। শারীরিক অবস্থার ক্রমাবনতি ঘটতে শুর করলে সেই ভাবনা বদলাতে বাধ্য হন। এঙ্গেলসই প্রথম মার্কস’কে পুঁজির প্রথম খন্ডটি আগে ছাপানোর প্রস্তাব দেন। ঐ পর্বের তাদের চিথিপত্রের দিকে নজর দিলে ফ্রেডরিক এঙ্গেলসকেই পুঁজি প্রকাশের মূল কৃতিত্ব দিতে ইচ্ছা হওয়া অস্বাভাবিক না। প্রাথমিক খসড়ায় মার্কস প্রায় ৫২টি নোটবুক জুড়ে নিজের লেখাটি সাজিয়েছিলেন। ১৮৬৭ সালের ১৪ই সেপ্টেম্বর পুঁজির প্রথম খণ্ড ছেপে বেরোয়।
ক্যাপিটালের ত্রয়োদশ অধ্যায়ের শিরোনামটিই এ প্রতিবেদনের উদ্দেশ্য স্পষ্ট করতে যথেষ্ট। ঐ অধ্যায়ের শিরোনাম সহযোগিতা (ইংরেজিতে কোঅপারেশন)।
দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের মূল সূত্রাবলী প্রসঙ্গে পরিমাণগত পরিবর্তন থেকে গুণগত পরিবর্তনে রূপান্তরের আলোচনায় আমরা ইতিমধ্যে প্রকৃতির নিয়মাবলী ও সামাজিক বন্দোবস্তের নিরিখে ফ্রেডরিক এঙ্গেলসের লেখা দুটি আকর গ্রন্থের অংশবিশেষ প্রকাশ করেছি। সেই আলোচনারই তৃতীয় ও শেষ পর্বে কার্ল মার্কসের লেখা ক্যাপিটালের অংশবিশেষ আজ প্রকাশিত হল।
বাংলা অনুবাদের কাজে লেফটওয়ার্ড থেকে প্রকাশিত বইটির সাথে পেঙ্গুইন ক্ল্যাসিকস’র তরফে ১৯৯০ সালে প্রকাশিত ইংরেজি সংস্করণটিকেও আমরা কমবেশি ব্যবহার করেছি।
মতাদর্শ সিরিজ রাজ্য ওয়েবসাইটে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হচ্ছে।
প্রতি সপ্তাহের শুক্রবার।
আজ দ্বাদশ পর্ব।
কার্ল মার্কস
যুযুধান প্রতিপক্ষের উদাহরণরূপে দুটি সেনাবাহিনীকে ধরে নেওয়া যায়। একদিকের বাহিনীতে গোলন্দাজ সেনার যেরকম আক্রমণাত্মক মনোভাব কিংবা তাদের বিপরীতে পদাতিক সেনাদের রক্ষণাত্মক মেজাজের কথাও ধরে নেওয়া চলে। দুটি বাহিনীতেই দায়িত্বরত প্রত্যেক সেনার একক রণনৈপুণ্য তার সামগ্রিক বাহিনীর রণকৌশলকে ছাপিয়ে যেতে পারে না। কোনও সেনাবাহিনীরই সার্বিক কার্যকারীতা তার অন্তর্ভুক্ত সেনা সদস্যদের একক রণকৃতিত্বের নিছক একটি সোজাসাপটা যোগফলের সমান হয় না।
কারখানায় সমবেত হয়ে উৎপাদনের কাজে নিযুক্ত মজুরি শ্রমিকদের বেলাতেও এই একই যুক্তি খাটে। কোনও একজন শ্রমিকের পক্ষে যতটা যান্ত্রিক শক্তি ব্যয় করা সম্ভব তার নিরিখে কারখানার কাজে যুক্ত মোট শ্রমিকের সংখ্যা হিসাবে সকলের সম্মিলিত উৎপাদিকা শক্তির হিসাব করা চলে না। একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্যে নিযুক্ত বহু শ্রমিকের সমবেত মোট শ্রমশক্তির উৎপাদনক্ষমতা তাদের প্রত্যেক কে আলাদা আলাদা করে বিবেচনায় রেখে উৎপাদনক্ষমতার যোগফলের চাইতে অনেকটাই বেশি হয়।
এ কারণেই একক ব্যক্তির পক্ষে ব্যয়সাপেক্ষ শ্রমশক্তির তুলনায় সামাজিক উৎপাদন প্রক্রিয়ায় নিযুক্ত মোট শ্রমশক্তির ফলাফল গুণগতরূপে ভিন্ন। বিশাল পরিমাণ ওজনকে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় স্থানান্তর করতে, বিরাট আকৃতির কপিকল ইত্যাদি যন্ত্রচালনায় যে ধরনের শক্তির প্রয়োজন তা কেবলমাত্র বিচ্ছিন্ন শ্রমশক্তিকে এক করতে সাধারণ অর্থে যুক্ত করলেই মেলে না। দেখা যাবে এহেন প্রক্রিয়ায় বহু শ্রমিকের থেকে আলাদা আলাদা হিসাবে প্রাপ্ত শ্রমদক্ষতার যোগফল হয় মূল উৎপাদনের সামান্য কিছু অংশ সম্পন্ন করতেই কার্যকরী অথবা উৎপাদনের জন্য জরুরী সাধারণ শ্রমসময়ের চাইতে অনেকটা বাড়তি সময় ব্যয় করতে হবে।
কারখানার কাজে নিযুক্ত বহু শ্রমিকের সমবেত সামাজিক উৎপাদনের সাথে একক শ্রমশক্তির ফারাক কেবলমাত্র পরিমাণের পার্থক্য না, উভয়ের মধ্যে একটি গুণগত ফারাকও রয়েছে। সমবেত সামাজিক উৎপাদনে যে শক্তি উদ্ভূত সেটি প্রকৃতপক্ষে সম্মিলিত মানবিক শ্রমশক্তির মাধ্যমে নির্মিত এক নতুন প্রকারের উৎপাদিকা শক্তি। কারখানার এক ছাতের তলায় সমবেত হয়ে সামাজিক উৎপাদনের সময় আসলে কি ঘটে যাতে এমন নতুন শক্তির উদ্ভব হয়? উৎপাদনের ঐ নির্দিষ্ট কাঠামোই বহুজনের বিচ্ছিন্ন শ্রমশক্তিকে এক নতুন উৎপাদিকা শক্তিতে রূপান্তরিত করে। এটুকুতেই সেই রূপান্তর থেমে থাকে না। সমবেত হয়ে সামাজিক উৎপাদন প্রক্রিয়ায় যুক্ত প্রত্যেক ব্যক্তির অন্তরে নিহিত পাশবিক প্রবৃত্তিকে সেই রূপান্তর উজ্জীবিত করে, তাকে দক্ষতার এক নতুন মাত্রায় পৌঁছে দেয়। বিচ্ছিন্ন একক শ্রমশক্তি রূপান্তরের মাধ্যমে নতুন এমন এক উৎপাদিকা শক্তিতে পরিণত হয় যা ইতিপূর্বে সম্ভবপর ছিল না।
এই প্রসঙ্গে আরেকটি উদাহরণ দেওয়া যায়। বারো জন শ্রমিকের প্রত্যেকে যদি বারো ঘণ্টার জন্য একই কাজে আলাদা আলাদা করে শ্রমশক্তি ব্যয় করে তবে তারা যা উৎপাদন করবে তার তুলনায় ঐ বারোজনের একসাথে সমবেত হয়ে বারো ঘণ্টার সামাজিক উৎপাদনের ফলাফল আলাদা হবে। এবার যদি তাদের যেকোনও একজন একাই একশো চুয়াল্লিশ ঘণ্টা উৎপাদনের কাজ করে তাতেও ফলাফল সামাজিক উৎপাদনের সমান হবে না। প্রতিটি ক্ষেত্রে সামাজিক উৎপাদন, একক শ্রমশক্তির তুলনায় এগিয়ে থাকবে।
মানুষকে রাজনৈতিক জীব প্রতিপন্ন করতে অ্যারিস্টটল বহু তর্ক-বিতর্কের অবতারণা করেছেন। বাস্তব হল মানুষ কেবলমাত্র রাজনৈতিক না, একইসাথে তারা বিশেষ ধরনের সামাজিক জীবও বটে। একক শ্রমশক্তিকে পিছনে ফেলে সামাজিক উৎপাদনের কার্যকারীতার রহস্য এখানেই।