প্রাককথন
ইউজিন ড্যুরিং জার্মানির বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক ছিলেন। তার কৃতিত্ব সম্পর্কে বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালকমন্ডলী এমনই অভিভূত ছিলেন যে তাকে বিজ্ঞান, ইতিহাস এবং রাজনৈতিক অর্থনীতি- তিন বিষয়েই অধ্যাপনার সুযোগ দেওয়া হয়। জার্মান সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টির একজন উল্লেখযোগ্য নেতৃত্ব হয়ে বসেন। শুরুর দিকে সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টির পত্রিকা ভরোয়ার্টস-এ তার প্রতিভাস্ফুরিত ধারাবাহিক নানা লেখার ভক্ত হয়ে ওঠেন এডুয়ার্ড বার্নস্টেইন, অগাস্ট বেবেল এমনকি উইলহেলম লিবনেখটও। অবশ্য কয়েকবছরেই লিবনেখট’র মোহমুক্তি ঘটে। তিনি উপলব্ধি করেন সোশ্যাল-ডেমোক্র্যাসি না, ড্যুরিং আসলে নিজেকেই নরশ্রেষ্ঠ প্রমাণে সচেষ্ট।
দার্শনিক কান্ট এবং ফ্যুরিয়ের-কে শিশুসুলভ, হেগেল-কে বড় বেশি বুনিয়াদি, ডারউইনের আবিষ্কারকে 'মানবতার বিরুদ্ধে এক বর্বরোচিত আঘাত' বলে তার ঢাকপেটানো শুরু হয়। এখানেই না থেমে ড্যুরিং সাহেব আরও বিশেষ মর্যাদা পেতে উদগ্রীব হয়ে পড়েন। শেষ অবধি পালের গোদা হিসাবে কার্ল মার্কস প্রসঙ্গে ‘অত্যন্ত সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি সম্বলিত, দুর্বল যুক্তি ও অভাবি মনোনিবেশের সমাহারে বিশিষ্ট এমন একজন- আড়বোঝা তর্কের ভারে যিনি ন্যুব্জ। জঘন্য সব লেখার ধরন, দার্শনিক ও বৈজ্ঞানিক মতবাদের দিক থেকে পশ্চাদপদও তিনি’ গোছের কথাবার্তা বলে ফেলেন।
জার্মানির সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি সিদ্ধান্ত নেয় ড্যুরিং-এর এইসব কথাবার্তার একটা ‘উপযুক্ত জবাব’ দিতে হবে। সেই মুসাবিদাটি লেখার দায়িত্ব নেবেন ফ্রেডেরিখ এঙ্গেলস! ১৮৭৫ সালে লিবনেখট সেই উদ্দেশ্যেই দুবার হাজির হন এঙ্গেলসের সামনে। 'সেই যুগের জার্মানিতে নিস্কর্মা বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের একজন যথাযথ প্রতিনিধি হিসাবে বিজ্ঞানের নামে ড্যুরিং’র আবিষ্কার আসলে এক মহোত্তম ছাইপাঁশ ছাড়া আর বিশেষ কিছু নয়' - ড্যুরিং-এর সেই বিখ্যাত 'সিস্টেম' সংক্রান্ত তত্ত্বটি অধ্যয়নের শেষে এঙ্গেলসের তাৎক্ষনিক প্রতিক্রিয়া ছিল এটুকুই।
শেষ পাতে মিষ্টান্ন সাজিয়ে দেওয়ার রুচির মতো করে ড্যুরিং-এর বিশ্বজয়ের নামে কিম্ভূতকিমাকার তত্ত্ব প্রসঙ্গে এঙ্গেলস নিজের লেখা শেষ করেছেন –‘When a man is in possession of the final and ultimate truth and of the strictly scientific approach’ it is only natural that he should have a certain contempt for the rest of erring and unscientific humanity.’
রাজ্য ওয়েবসাইটের ধারাবাহিক মতাদর্শ সিরিজে আজকের প্রসঙ্গ ‘অ্যান্টি ড্যুরিং’।
মার্কসবাদের সম্ভারে এক অসামান্য কীর্তি।
প্রতি সপ্তাহের শুক্রবার।
আজ একাদশ পর্ব।
ফ্রেডরিক এঙ্গেলস
‘পরিমাণ থেকে গুনে রূপান্তরিত হওয়ার প্রসঙ্গে হেগেলীয় বিভ্রান্তিটি বেশ মজাদার, অত্যন্ত হাস্যকর কৌশলে এরা যা বলতে চাইছেন তা হল বিকশিত হওয়ার পথে এক নির্দিষ্ট আয়তনে পৌঁছালে শুধুমাত্র পরিমাণগত পরিবর্তনের জোরেই কিছু পরিমাণ অর্থ পুঁজিতে রূপান্তরিত হয়।’
উপরের কথাগুলি পড়লেই বোঝা যায় মহাশয় ড্যুরিং মার্কসের লেখার মধ্যে থেকে নিজের অপছন্দের অংশগুলি বাদ দিয়েই সে প্রসঙ্গে সমালোচনা করতে নেমেছেন। অবশ্য বলতেই হবে তার এধরণের কথাবার্তার চোটে খানিক নড়াচড়া সৃষ্টি হয়েছে, তাই আরেকবার দেখে নেওয়া যাক পুঁজি গ্রন্থে মার্কস ঠিক কি লিখেছেন। স্থির পুঁজি (কনস্ট্যান্ট ক্যাপিটাল) ও পরিবর্তনশীল পুঁজি (ভ্যারিয়েবল ক্যাপিটাল)-র সম্পর্কে আলোচনা করার সময় মার্কস উল্লেখ করেছেন ‘যে কোনও অর্থকেই ইচ্ছামতো পুঁজি বলে বিবেচনা করা চলে না। অর্থ থেকে পুঁজিতে রূপান্তরিত হওয়ার জন্য বিনিময়ের পূর্বেই পণ্য কিংবা অর্থের যোগানদারের হাতে ন্যুনতম কিছু পরিমাণ অর্থ থাকতে হবে।’
পুঁজি, প্রথম খণ্ড, একাদশ অধ্যায়,
১৯৫৮ সালে মস্কো হতে প্রকাশিত সংস্করণ অনুসারে ৩০৭-৩০৮ নং পৃষ্ঠা
এই আলোচনা করার সময় উদাহরণ হিসাবে মার্কস এমন একটি কারখানা শ্রমিকের কথা ধরে নিয়েছেন যে বারো ঘণ্টার শ্রমের মধ্যে আটঘন্টার বিনিময়ে নিজের মজুরি রোজগার করে, বাদবাকি চারঘন্টা মালিকের উদ্বৃত্ত মূল্য উৎপাদনে বেগার খাটে। সেই উদ্বৃত্তে অন্য কারোর অধিকার নেই, উৎপাদন হওয়া মাত্র তা মালিকের পকেটে গিয়ে ঢোকে। এমন একটা পরিস্থিতির কিছু আবশ্যিক পূর্বশর্ত রয়েছে। ঐ কারখানায় অন্তত দুজন শ্রমিক থাকতে হবে, তাদের কাজ করার মতো যথেষ্ট পরিমাণ কাঁচামাল থাকতে হবে, কাজ চালাবার মতো উপযুক্ত যন্ত্রপাতিরও প্রয়োজন, শ্রমিকদের মজুরি দিতে হবে- আর এসবের জন্য কাজ শুরু হওয়ার আগে থেকেই বেশ কিছু পরিমাণ টাকাপয়সা মালিকের হাতে থাকতে হয়। এটুকু না হলে কোনও মালিকই শ্রমিকের থেকে উদ্বৃত্ত মূল্য শোষণ করতে পারে না। পুঁজিবাদী উৎপাদনের মূল লক্ষ্য সমাজে বেঁচে থাকার জন্য জরুরী সামগ্রী উৎপাদন নয় বরং উৎপাদনের মালিক হিসাবে নিজের সম্পত্তি বাড়িয়ে নেওয়া। আর তাই কোনও মালিকের জন্যই দুজন মাত্র শ্রমিককে খাটিয়ে গেলে চলে না, তার দরকার বহু বহু মজুরি-শ্রমিক। নিয়োগপ্রাপ্ত মজুরি-শ্রমিকের জীবনমানের তুলনায় মালিকের বেঁচে থাকার গুণমান দ্বিগুণ করতে গেলেও অন্তত আটজন শ্রমিকের প্রয়োজন হবে। কারন এক এক জন শ্রমিকের থেকে প্রাপ্ত উদ্বৃত্ত মূল্যের অর্ধেকটাই নতুন করে উৎপাদনের জন্য পুনরায় বিনিয়োগ করতে খরচ হয়ে যায়। আর তাই একজনের কাছ থেকে মালিকের পকেটে উদ্বৃত্ত মূল্য হিসাবে যেটুকু ঢোকে তার হিসাবে নিজের কারখানায় নিযুক্ত মজুরি-শ্রমিকের তুলনায় দ্বিগুণ ভালোভাবে বেঁচে থাকতে গেলে সেই উদ্বৃত্তকে অন্তত চতুর্গুণ বৃদ্ধি করার দরকার পড়ে। সুতরাং যে কোনও পরিমাণ অর্থই পুঁজিতে রূপান্তরিত হতে পারে না, অমন রূপান্তর হতে একটা ন্যুনতম পরিমাণের প্রয়োজন হয়। আর সেই প্রক্রিয়াটিও সরলরৈখিক নয়, উৎপাদন প্রক্রিয়ার ক্রমবর্ধমান ও ক্রমপ্রসারমান কাঠামোর সাথে সাথে পুঁজি গড়ে ওঠাকে বিচার করতে হয়, উৎপাদনের কাজে জরুরী প্রতিটি ছোট বড় পর্যায়ের সাথে সেই গঠন আরও জটিল হয়ে ওঠে। এহেন গঠনবৈশিষ্টকে বিচার-বিশ্লেষণের জন্য মার্কসের বুনিয়াদী দৃষ্টিভঙ্গিটি হেগেলের দর্শন থেকেই সংগৃহীত। মার্কস বলেছেন- ‘বিকাশের একটি নির্দিষ্ট মাত্রার পরে নিছক পরিমাণগত পরিবর্তনই গুণগত পরিবর্তনে রূপান্তরিত হয়, এ যে প্রকৃতি বিজ্ঞানেরই নিয়ম নিজের বইতে হেগেল সে বিষয়ে অত্যন্ত সঠিকভাবেই বিশ্লেষণ করেছেন’।
কিন্তু ড্যুরিং মহাশয় এতো সহজে হাল ছাড়তে রাজি নন। তিনি অসাধারণ কায়দায় মার্কসের সমালোচনা লিখেছেন, পাঠকদের অনুরোধ করব সেদিকে নজর দিন। এহেন সমালোচনার বৈশিষ্ট হল মার্কস যা লেখেননি সেই অপরাধেই তাকে দোষী সাব্যস্ত করা, এমনকি তিনি ঠিক যা লিখেছেন তার বিপরীত যুক্তির অজুহাতে তাকে বিদ্ধ করা! দেখা যাক! মার্কসের লেখায় রয়েছে- ‘উৎপাদনী বিকাশের প্রত্যেক পর্যায়ে পুঁজি হিসাবে গুণগত রুপান্তরের জন্য একেকটি পর্যায়ে নির্দিষ্ট ন্যুনতম পরিমাণ অর্থ থাকা জরুরী বলে উপলব্ধি করার সাথে সাথেই ঐ প্রসঙ্গে হেগেলের আবিস্কার অত্যন্ত সঠিক হিসাবেই প্রমাণিত হয়।’ ড্যুরিং বলছেন মার্কস নাকি লিখেছেন-‘ যেহেতু হেগেলের দর্শনে পরিমাণগত পরিবর্তন থেকে গুণগত রূপান্তরের উল্লেখ রয়েছে তাই বিকশিত হওয়ার পথে এক নির্দিষ্ট আয়তনে পৌঁছালে শুধুমাত্র পরিমাণগত পরিবর্তনের জোরেই কিছু পরিমাণ অর্থ পুঁজিতে রূপান্তরিত হয়’। ব্যাপারটা কেমন হল? মার্কস যা বলেছেন আর ড্যুরিং তাকে যা বলার জন্য অভিযুক্ত করছেন সেদুটি একে অন্যের ঠিক বিপরীত।
ড্যুরিং মহাশয় ডারউইনের আবিস্কারকে নিজস্ব পরীক্ষা-নিরীক্ষার অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন। তার ফলাফল ইতিমধ্যে সকলের জানা হয়ে গেছে। খুব ভুল না হলে তখনও তিনি নিজেকে ‘পরিপূর্ণ সত্যের প্রতি একনিষ্ঠ’ এমন একজন যিনি ‘জনস্বার্থরক্ষায় যে কোনও গোষ্ঠীর প্রভাব মুক্ত’ বলেই অভিহিত করেছিলেন। এহেন কথাবার্তা থেকে বুঝতে অসুবিধা হয় না তিনি যে ‘বাস্তবসম্মত দর্শন’-এর কথা বলেন তার জন্য সম্ভবত এমনকিছু বলে নেওয়াটা জরুরী এবং তার ঐ পরীক্ষানিরীক্ষা মিটলে পরে যা কিছু পড়ে থাকে সেসব একজায়গায় করলে অমনই কিছু একটা দাঁড়ায়। এইবারও তিনি খানিকটা সে পথেই এগিয়েছেন, অভিযোগ করেছেন মার্কস নাকি ‘বিকাশের পথে’ যাবতীয় পরিবর্তনকেই গুণগত পরিবর্তনে রূপান্তরিত হওয়ার কথা বলেছেন! বাস্তব হল মার্কস যতবার অমন ‘বিকাশের পথে’র উল্লেখ করেছেন ততবারই আবশ্যিক পূর্বশর্ত হিসাবে কাঁচামাল, যন্ত্রপাতি ও মজুরির কথাও ছিল। কিন্তু ড্যুরিং সেসব যুক্তিকে তুচ্ছ বিবেচনা করে উড়িয়ে দিয়েছেন এবং মার্কসকে দিয়ে ছাইপাঁশ যা ইচ্ছে তাই বলিয়ে নিয়েছেন! এর পরেই তিনি সিদ্ধান্তে এসেছেন মার্কসের আবিস্কার হল ‘মজাদার’ ও ‘ভ্রান্ত’। ডারউইন সম্পর্কে সমালোচনা করার সময়ও তিনি একই কায়দায় এমনসব ‘ভ্রান্তি’ চিহ্নিত করেছিলেন যেগুলি আসলে ডারউইন বলেননি, ড্যুরিং নিজেই তাকে দিয়ে বলিয়েছিলেন! ডারউইনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য তার দরকার ছিল এক ‘অদ্ভুত ডারউইন’র, আর সেটা তিনি নিজেই কল্পনা করে নিয়েছিলেন। এবারও মার্কসের বিরোধিতা করার উদ্দেশ্যে নিজের শক্তি দেখাতে তার প্রয়োজন হল এক ‘উদ্ভট মার্কস’কে, আর তাকেও তিনি বানিয়েই ছাড়লেন! এমনভাবে ‘ঐতিহাসিক চরিত্র নির্মাণের মহত্তম উদাহরণ’ সৃষ্টি করতে আর কেই বা সফল হয়েছে!
নিজস্ব ধারণা অনুসারে এগোনর পথে ড্যুরিং যে ইতিমধ্যেই একটি ছোট দুর্ঘটনা ঘটিয়েছেন তা সহজেই বোঝা যায়। দুনিয়া সম্পর্কিত তার নিজস্ব পরিকল্পনায় তিনি নিশানা করেছেন পরিমাপ সম্পর্কে হেগেলীয় মতবাদকে। বিশেষ করে যেখানে বিকাশের এক নির্দিষ্ট মাত্রায় পরিমাণগত পরিবর্তন গুণগত পরিবর্তনে রূপান্তরিত হওয়ার ব্যখ্যা রয়েছে। এর সমালোচনা করতে গিয়ে এক জায়গায় তিনি কার্যত হেগেলকেই সমর্থন করে বসেছেন যা এখন তারই বিরুদ্ধে ব্যবহার করা চলে। জলের ভৌত অবস্থা রূপান্তরের সহজ উদাহরণটিই এর জন্য যথেষ্ট হবে। আমরা জানি, ০০ সেন্টিগ্রেড ও ১০০০ সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায় যথাক্রমে জলের কঠিন থেকে তরল ও তরল থেকে গ্যাসে রূপান্তর ঘটে। এ দুটি ক্ষেত্রেই তাপমাত্রার নিছক পরিমাণগত পরিবর্তনের ফলাফল হিসাবেই জলের ভৌত অবস্থার বদল ঘটে।
এ নিয়মের আরও কয়েকশো উদাহরণ দেওয়া যায় যেগুলি প্রকৃতি ও মানবসমাজের নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। মার্কসের লেখা ক্যাপিটাল গ্রন্থের চতুর্থ অংশেই এমন একটি উদাহরণের উল্লেখ রয়েছে- ‘আপেক্ষিক উদ্বৃত্ত মূল্যের প্রসঙ্গেই সে কথা বলা যায়। উৎপাদনের কাজে একে অন্যের সাথে সহযোগিতা, শ্রমবিভাজন, আধুনিক শিল্পে যন্ত্রপাতির ব্যবহার সহ সংশ্লিষ্ট প্রক্রিয়ার যাবতীয় ক্ষেত্রেই পরিমাণগত পরিবর্তন থেকে গুণগত পরিবর্তনে রূপান্তরিত হওয়ার অজস্র উদাহরণ মেলে। এর ঠিক বিপরীত ক্রিয়াও ঘটে চলে, অর্থাৎ গুনগত পরিবর্তনও পরিমাণকে ব্দলে দিতে প্রভাবিত করে। এসবই ড্যুরিং’য়ের বিশেষ অপছন্দের ব্যাপার হলেও পরিবর্তন ও রূপান্তরের বেলায় এমনটাই স্বাভাবিক নিয়ম। আরেকটি উদাহরণের কথা না বললেই নয়, বিভিন্ন ব্যাক্তি নিজের নিজের মতো করে কোনও কিছুর প্রতিবাদ জানালে যতটা শক্তি প্রদর্শিত হয়, তারা সকলে একসাথে মিলে প্রতিবাদ করলে আগের চাইতে অনেক বেশি কার্যকরী শক্তির সন্ধান মেলে। বিছিন্ন শক্তিসমুহের সমষ্টির চাইতে, সমষ্টিগত শক্তি সবসময়েই বেশি কার্যকরী হয়। এহেন কার্যকরী শক্তিকেই মার্কস ‘নুতন শক্তি’ বলে চিহ্নিত করেছিলেন।
পরিমাণগত পরিবর্তন কীভাবে আমাদের সমাজজীবনেও গুণগত পরিবর্তনে রূপান্তরিত হয় সে প্রসঙ্গে সবশেষে যার উদাহরণ যথেষ্ট হবে, তিনিই নেপোলিয়ন। নেপোলিয়নের লেখায় উল্লেখ রয়েছে এক যুদ্ধের ইতিহাস। একদিকে ছিল ফরাসী সেনাবাহিনী, যারা ঘোড়সওয়ার হিসাবে রীতিমত অকেজো কিন্তু বিশেষভাবে শৃঙ্খলাপরায়ণ। এদের প্রতিপক্ষ ছিল মামেলিউকরা। ঘোড়ার পিঠে চেপে যুদ্ধ করতে তারা প্রত্যেকেই ছিল অসাধারণ, কিন্তু বাহিনী হিসাবে শৃঙ্খলা বলতে তাদের কিছুই ছিল না। নেপোলিয়ন লিখেছেন- ‘দুজন মামেলিউক যোদ্ধা নিশ্চিতরূপেই তিনজন ফরাসী সেনার চাইতে অনেক বেশি দক্ষ। একশো মামেলিউক একসাথে একশো ফরাসী সেনার সমকক্ষ। তিনশো ফরাসী সেনা সাধারণ যুদ্ধে তিনশো মামেলিউককে হারিয়ে দিতে পারবে। কিন্তু দেড় হাজার মামেলিউক সেনাবাহিনীকে যুদ্ধের ময়দানে পরাস্ত করতে এক হাজার জনের ফরাসী সেনাবাহিনীই যথেষ্ট।’ ঠিক এমনই যুক্তিতে মার্কস দেখিয়েছেন কীভাবে নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে ন্যুনতম পরিমাণ অর্থ উৎপাদনের চক্রের শেষে পুঁজিতে রূপান্তরিত হয়। নির্দিষ্ট পরিমাণ সেনাবাহিনীকে সঠিক পরিকল্পনা অনুসারে মতো ব্যবহার করলে কীভাবে যুদ্ধের ফলাফল বদলে দেওয়া যায়, নেপোলিয়ন সে কথাই লিখেছিলেন। যুদ্ধক্ষেত্রে তার প্রতিপক্ষ অনেক বেশি সাহসী এবং ব্যক্তিগত নৈপুণ্যের বেশ কয়েকটি ক্ষেত্রে রীতিমত এগিয়ে থাকা সত্বেও কীভাবে তিনিই জয়ী হলেন সেই ইতিহাসই তার লেখায় পাওয়া যায়। এখন কেউ প্রশ্ন তুলতেই পারেন, ড্যুরিং’কে অপদার্থ প্রমাণ করতে নেপোলিয়নের উদাহরণ কতদূর কার্যকর? আমি নিশ্চিত, ব্যাপারটা খুবই কাজের হবে! আমরা কি জানি না ইউরোপ জুড়ে একের পর এক যুদ্ধ হারতে হারতে শেষটায় নেপোলিয়ন সর্বস্ব হারিয়ে পরাজিতই হয়েছিলেন? তার এমন পরিণতি ঘটেছিল কেন? কারন, সেনাবাহিনী পরিচালনার বিষয়ে তিনি বিভ্রান্তকর হেগেলীয় দর্শনের অনুসারী ছিলেন যে!