প্রাককথন
দ্বান্দ্বিক বিশ্বদৃষ্টিভঙ্গীর নিয়মাবলীকে জেনেও না জানার, সামান্য বিষয় বলে এড়িয়ে যাওয়ার অভ্যাস আজকের নয়, মার্কস-এঙ্গেলসদের যুগেও ঘটত। তারা দুজনেই এর বিরুদ্ধে কলম ধরেছিলেন। ক্যাপিটাল লেখার কাজে মার্কস যাতে মনযোগী হতে পারেন, একনিষ্ঠ থাকতে পারেন তাই ফ্রেডরিক এঙ্গেলস প্রকৃতি বিজ্ঞান ও দর্শন প্রসঙ্গে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিলেন। তারই প্রথম ফসল অ্যান্টি ড্যুরিং (১৮৭৮), পরেরটি ডায়ালেকটিকস অফ নেচার, বাংলায় প্রকৃতির দ্বান্দিকতা (১৮৮৩)।
এই প্রতিবেদনের মুখ্য প্রসঙ্গ ডায়ালেকটিকস অফ নেচার। বইটিতে এঙ্গেলস কার্যত প্রকৃতির নিয়মাবলী বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয়ে যেভাবে ধরা দেয় তারই একটি সুসংবদ্ধ পর্যালোচনা করেন। মহাবিশ্ব ও সমাজের সাধারণ নিয়মাবলী প্রসঙ্গে দার্শনিক সত্যানুসন্ধানে কতদূর এগোনো গেছে সেকথাই এঙ্গেলসের মূল আলোচনার অন্যতম একটি বিষয়।
এই লেখার মধ্যে পদার্থবিদ্যা, রসায়ন ও জীববিদ্যার বিভিন্ন প্রসঙ্গ আলোচিত হয়েছে। এসবের মধ্যেই পরিমাণ থেকে গুণের রূপান্তর যে একটি সাধারণ নিয়ম হিসাবে কার্যকর হয় তাকে প্রতিষ্ঠা করাই এঙ্গেলসের উদ্দেশ্যে ছিল। শেষ হয়েছে প্রচলিত অর্থে পণ্ডিত হিসাবে পরিচিত একদল সম্পর্কে মস্করায়, তার ঝাঁঝ এমনই যে আজও কয়েকজনকে খুঁজে পাওয়া যাবে যারা লেখাটি পড়া শেষ করেই কীভাবে একে ভুলে যাওয়া যায় সে কসরতে ব্যস্ত হয়ে পড়বেন।
সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে ইংরেজিতে প্রকাশিত বইটিকে ভিত্তি করেই বাংলা অনুবাদের কাজটি করা হল।
ফ্রেডরিক এঙ্গেলস
পরিমাণগত পরিবর্তন থেকে গুণগত পরিবর্তনের নিয়ম ও তার বিপরীতক্রম- দুটিই সত্য। আলোচনার উদ্দেশ্যে আমরা একে এভাবে ব্যাখ্যা করতে পারি যে প্রকৃতিতে, প্রত্যেকটি বিশেষ ক্ষেত্রের নির্দিষ্ট ধরনে একমাত্র বস্তু বা গতির (অথবা শক্তির) পরিমাণগত সংযোজন (বৃদ্ধি) ও বিয়োজনের (হ্রাস) মাধ্যমেই গুণগত পরিবর্তন ঘটা সম্ভব।
প্রকৃতিতে সব গুণগত পার্থক্যই হয় বস্তুর অভ্যন্তরীণ রাসায়নিক গঠনবৈশিষ্টের উপরে অথবা গতির (শক্তির) বিভিন্ন পরিমাণ বা চরিত্রের উপরে আর নাহলে প্রায়সই যা ঘটে উভয়ের উপরেই নির্ভর করে। অতএব বলা চলে বস্তু বা গতি অর্থাৎ বিবেচ্য যেকোনো একটির পরিমাণগত পরিবর্তন ব্যতীত গুণগত পরিবর্তন সাধন সম্ভব নয়। দার্শনিক অভীক্ষা হিসাবে পরিমাণ থেকে গুনের রূপান্তর প্রসঙ্গে হেগেলের যে সূত্রটি আগে রহস্যময় বলে মনে হত তাকেই বস্তুর ধর্ম প্রসঙ্গে বৈজ্ঞানিক পর্যালোচনার সুবাদে এবার শুধু যুক্তিসঙ্গত বলেই মনে হয় না বরং সুত্রটি প্রায় স্বতঃসিদ্ধ হিসাবে প্রতিভাত হয়।
বস্তুর বিভিন্ন অবস্থা সম্পর্কে বুঝতে বহুরূপতার (অ্যালোট্রপিক) বৈশিষ্টকে মাথায় রাখতে হয়। আণবিক গঠনের বিভিন্নতা ও অভ্যন্তরস্থ গতির কম বা বেশি হওয়ার উপরে নির্ভর করেই একটি বস্তুর সাথে অন্য বস্তুর পার্থক্য ঘটে।
এতো গেল বস্তুর কথা, গতির বিভিন্ন রূপের পরিবর্তন বা তথাকথিত শক্তির সম্বন্ধে আমাদের অবস্থানটি কেমন? যদি তাপকে যান্ত্রিক শক্তিতে রূপান্তরিত বা এর উল্টোটা করা হয় তবে পরিমাণ অপরিবর্তিত থাকলেও কি পূর্বের শক্তির সুনির্দিষ্ট গুণটির বদল ঘটে না? অবশ্যই ঘটে। এই প্রসঙ্গে হাইনের ব্যখ্যার ত্রুটি সম্বন্ধে যা বলা যায় গতির রূপ পরিবর্তনের বেলাতেও সে নিয়মই খাটে। কেউ নিজের চেষ্টায় গুণবান হতেই পারে, কারণ চরিত্রগত দোষও একপ্রকার গুণই। গতির রূপ পরিবর্তন এমনই এক প্রক্রিয়া যার জন্য অন্তত দুই প্রকার শক্তির প্রয়োজন। এক নির্দিষ্ট গুণবিশিষ্ট (যেমন তাপ) গতির খানিকটা নির্দিষ্ট পরিমাণ হ্রাস পায় আর সেই সঙ্গেই অন্য আরেক গুণবিশিষ্ট গতির সেই নির্দিষ্ট পরিমাণ বৃদ্ধি ঘটে, যেমন যান্ত্রিক গতি, বিদ্যুৎ কিংবা রাসায়নিক বিয়োজন। আর তাই বলা যায় পরিমাণ ও গুণ একে অন্যের মধ্যে পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়া বজায় রাখে। এখনও পর্যন্ত বিচ্ছিন্ন কোনও বস্তুর মধ্যে এক রূপ থেকে অন্য রূপে গতির রূপান্তর ঘটানো সম্ভব হয়নি।
আমরা প্রাথমিকভাবে প্রাণহীন বস্তু প্রসঙ্গেই আলোচনা করছি। জীবদেহের বেলাতেও একই নিয়ম প্রযোজ্য, তবে জীবদেহের বেলায় ঐ নিয়মগুলি খুবই জটিল চেহারায় কার্যকরী হয়। সেই প্রাসঙ্গিক জটিলতা সহ আলোচনার জন্য পরিমাণগত পরিমাপ করার মতো কোনও কিছু এখনও সম্ভবপর হয়ে ওঠেনি।
যদি কোনো নির্জীব পদার্থকে ক্ষুদ্র এবং আরও ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র খণ্ডে ভাগ করা যায় তবে প্রাথমিক অবস্থাতেই কোনোরকম গুণগত পরিবর্তন ঘটে না। কিন্তু এহেন অপরিবর্তনীয় থাকার একটি সীমা রয়েছে। যদি বাষ্পীভবনের মাধ্যমে বিভিন্ন অণুগুলিকে মুক্ত করা যায়, তবে সেগুলিকে আরও বিভক্ত করা যাবে। অবশ্য একধরণের সার্বিক গুণগত পরিবর্তনের মাধ্যমেই এমন ভেঙ্গে চলা সম্ভব হবে। তখনকার অবস্থায় অণুটি নিজের ভিতরের পৃথক পৃথক পরমাণুসমূহে বিয়োজিত হবে। ঐ সকল পরমাণুর বৈশিষ্ট অণুটির নিজস্ব বৈশিষ্টের তুলনায় একেবারেই ভিন্ন হয়। বিভিন্ন প্রকার রাসায়নিক উপাদান নিয়ে নির্মিত অণুগুলির ক্ষেত্রে একটি যৌগিক অণুর জায়গায় ঐ পদার্থগুলির পরমাণুগুলি আবির্ভূত হবে। মৌলিক পদার্থের অণুসমূহের বেলাতেও মুক্ত পরমাণুগুলির বিশেষ বৈশিষ্ট্য থাকে। জায়মান অক্সিজেনের মুক্ত পরমাণুগুলি রাসায়নিক বিক্রিয়ার উপরে সহজেই যেমন প্রভাব ফেলে আণবিক অক্সিজেনের (বাতাস থেকে সংগৃহীত সাধারণ অবস্থার অক্সিজেন) পক্ষে তেমন আচরণ করা কখনোই সম্ভব হয় না।
বস্তুর অন্তর্ভুক্ত হয়েও কোনও অণুর চরিত্র তার থেকে গুণগতভাবে আলাদা হয়। বস্তু স্থির থাকা সত্বেও অণুগুলি স্বাধীনভাবে চলাচল করতে পারে- উদাহরণস্বরূপ, তাপজনিত কম্পনের কথা বলা যায়। স্থানীয় অবস্থিতি ও চারপাশের অন্যান্য অণুগুলির সাথে পারস্পরিক সম্পর্কের পরিবর্তন ঘটিয়ে অণু বস্তুর বিভিন্ন বহুরূপ নির্মাণ করতে পারে। আণবিক সমষ্টিকরণের বিভিন্ন অবস্থায় এমন রূপান্তর সম্ভব। তাহলে কি দেখা গেল? বিশুদ্ধ কায়দায় পরিমাণগত পরিবর্তন কেবল একটি নির্দিষ্ট সীমার মধ্যেই কার্যকর, তার পরে সেই পরিবর্তন গুণগত পার্থক্যে রূপান্তরিত হয়। ঠিক যেমন পরমাণুর তুলনায় অনুর পার্থক্য থাকে সেভাবেই অনুর দ্বারা নির্মিত হলেও বস্তুর বৈশিষ্ট অনুর তুলনায় স্বতন্ত্র হয়। এই পার্থক্যই মহাবিশ্ব ও পার্থিব বস্তুসমূহের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য বিজ্ঞান হিসাবে সুপরিচিত বলবিদ্যার সাথে পারমাণবিক জগতের বিজ্ঞানকে আলাদা করে দেয়। অনু-পরমাণুর বিজ্ঞানই হল রসায়ন, পদার্থবিদ্যার সাথে রসায়নকে পৃথকীকরণের ভিত্তিই ঐ পার্থক্য।
বলবিদ্যার আলোচনায় বস্তুর অভ্যন্তরস্থ গুণাগুণের কোনও গুরত্বই নেই। এই বিজ্ঞানে আলোচনার পরিসরে বস্তুর অভ্যন্তরীণ গুণ বলতে খুব বেশি হলে ভারসাম্যের কথা থাকে। বস্তুর গতি, স্থিতিশক্তি ইত্যাদির কথাও বলা যায়, তবে সেসবই হল শেষ বিচারে গতিরই স্থানান্তরের দ্বারা নির্মিত এমন গুণাবলী যা পরিমাপযোগ্য। সুতরাং এগুলির অভিঘাতে গুণগত পরিবর্তন যাই ঘটুক না কেন সংশ্লিষ্ট পরিমাণগত পরিবর্তনের দ্বারাই তা নির্ধারিত হয়।
পদার্থবিদ্যার অন্তর্ভুক্ত আলোচনায় পদার্থসমূহকে রাসায়নিক দিক থেকে অপরিবর্তনীয় বা নির্লিপ্ত বলে বিবেচনা করা হয়। আমাদের আলচনার প্রসঙ্গ সাধারনভাবে বস্তুর অভ্যন্তরের আণবিক গতি সংক্রান্ত। সেই গতির পরিবর্তন আসলে তাদের আণবিক অবস্থাগুলিরই পরিবর্তন এবং সর্বক্ষেত্রে সে গতির দুদিকের অন্তত একদিককার অণুকে সক্রিয় করেই। প্রতিটি পরিবর্তনই প্রকৃতপক্ষে পরিমাণ থেকে গুণে রূপান্তরকরণ। এহেন রূপান্তর হয় সে পদার্থে অন্তনির্হিত অথবা তাতে সঞ্চারিত গতির কোনো না কোনো রূপের পরিমানগত পরিবর্তনেরই পরিণতি। ‘যেমন প্রথমদিকে জলের তাপমাত্রা তার বাহ্যিক বৈশিষ্ট অর্থাৎ তারল্যের কোনও পরিবর্তন ঘটায় না, কিন্তু তাপমাত্রার ক্রমাগত বৃদ্ধি বা হ্রাসের ফলে এমন একটা মুহূর্ত আসে যখন পূর্বেকার সহাবস্থানের অবস্থাটা বদলে যায় এবং জল হয় বাষ্পে বা নাহলে বরফে রূপান্তরিত হয়।’
হেগেল, এনসাইক্লোপিডিয়া, কালেক্টেড ওয়ার্কস. খণ্ড ৬, পৃষ্ঠা নং ২১৭
একইভাবে বৈদ্যুতিক বাল্ব জ্বলার জন্য তার ফিলামেন্ট হিসাবে প্ল্যাটিনামের তারটির একটি নির্দিষ্ট ও ন্যুনতম মাত্রার বিদ্যুৎ সরবরাহের প্রয়োজন হয়। জ্বলবার জন্য কিংবা একটির ধাতুর সাথে অন্য ধাতুকে জোড়া-লাগানোর জন্য প্রতিটি ক্ষেত্রে নিজস্ব তাপমাত্রা রয়েছে। যেকোনো তরলেরই নিজস্ব স্ফুটনাংক ও হিমাংক থাকে, গ্যাসের ক্ষেত্রেও একটি নির্দিষ্ট সংকট বিন্দু থাকে যখন চাপ হ্রাস করে এবং শীতলীকরণের মাধ্যমে তাকে তরলে পরিণত করা যায়। এসমস্ত বিষয়কে সংক্ষিপ্ত আকারে নিয়ে এলে যা দাঁড়ায় তা হল বস্তুর ভৌতধর্ম সম্পর্কিত যে সকল ধ্রুবক রয়েছে সেসবই কার্যত এমনই কেন্দ্রবিন্দু যেখানে উপনিত হওয়ার পরে বস্তু বা শক্তির পরবর্তী পরিমাণগত বৃদ্ধি বা হ্রাস বস্তুর বাহ্যিক অবস্থার গুণগত পরিবর্তন সাধন করে, তার ভৌত অবস্থার রূপান্তর ঘটে।
একথা বলতেই হবে প্রকৃতির নিয়মাবলী প্রসঙ্গে যে বিষয়ে হেগেলের আবিস্কারসমূহ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সাফল্য অর্জন করেছে তার নাম রসায়ন। রসায়ন হল পরিমাণগত পরিবর্তন হতে বস্তুর গুণগত পরিবর্তনের বিজ্ঞান।
মানুষের ইতিহাস যেমন ঐ নিয়মের (পরিমাণ থেকে গুণের) প্রমাণ, জীববিজ্ঞানের প্রতি পদক্ষেপেও তার কার্যকারিতা লক্ষ্য করা যায়। আলোচনার সময় আমরা এখনও অবধি ব্যাপকভাবে জানা গেছে এমন সমস্ত বিজ্ঞানের প্রসঙ্গেই সীমাবদ্ধ থাকব, তার কারন এসকল ক্ষেত্রেই পরিমাণগত পরিবর্তনগুলি নিখুঁতরূপে পরিমাপ ও পর্যবেক্ষণ করা যায়।
এক দীর্ঘকাল যাবত কেতাসম্পন্ন ব্যক্তিবর্গেরা পরিমাণ থেকে গুণের পরিবর্তনকে রহস্যবাদ ও দুর্বোধ্য অতীন্দ্রিয়বাদ বলে নাকচ করেছেন। আজকের পরিস্থিতিতে তারাই সম্ভবত একে অতি সাধারণ, স্বাভাবিক বিষয় বলে ঘোষণা করবেন। এসবই এমন সাধারণ ও তুচ্ছ ব্যাপার যা অনেকদিন ধরেই তাদের বিচার-বিবেচনার অন্তর্গত এমন একটা ভঙ্গিমায় তারা বোঝাতে চাইবেন একথায় তাদের জন্য নতুন কিছু নেই। তারা যাই করুন না কেন প্রকৃতি, সমাজ ও মানবিক চিন্তার ইতিহাসে এহেন সুত্র নির্মাণের স্থপতি যিনি তাকে ভুললে চলে না। যদি ধরেও নেওয়া হয় এতদিন যাবত কিছু না বুঝেই তারা এ নিয়মের চর্চা করে এসেছেন তবে তাদের জন্য অন্তত একটি সান্তনা রয়েছেই। মলিয়ের‘র রচনায় মঁসিয়ে জুরদাঁ সারাজীবন বুঝতেই পারলেন না যে তিনি আসলে গদ্যে কথা বলে গেলেন, এরাও তেমনই কিছু করেছেন।