Idology Series 5

মতাদর্শ সিরিজ (পর্ব ৫): ঐতিহাসিক বস্তুবাদ প্রসঙ্গে (১ম চিঠি)

প্রাককথন

মার্কসবাদী ও মার্কসবাদ বিরোধী উভয় পক্ষেই একটি জনপ্রিয় ধারণা আজও রীতিমত সক্রিয়। সমাজ বিকাশের ইতিহাস ব্যখ্যায় অর্থনৈতিক উপাদানের বাইরে অন্য কিছুই নাকি ঐতিহাসিক বস্তুবাদের বিষয় না- দুপক্ষই এমনটা মনে করেন। এমন ভ্রান্তির শিকড় অনুসন্ধানে ফ্রেডরিক এঙ্গেলস নিজেদের ঘাড়েই সেই দায় নিয়েছেন। ১৮৯০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে এফ ব্লখ’কে লেখা একটি চিঠিতে এঙ্গেলস উল্লেখ করেছেন, নিজেদের মতবাদটিকে প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে তারা যাদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন তারা অর্থনীতিকে তুচ্ছ–তাচ্ছিল্য করতেন বলেই ঐতিহাসিক বস্তুবাদের সাধারণ নিয়মগুলি ব্যখ্যা করতে গিয়ে অর্থনৈতিক পরিপ্রেক্ষিতের উপরে বাড়তি জোর দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু ইতিহাসের বস্তুবাদী ব্যখ্যায় অর্থনীতি ব্যতিরেকে অন্যান্য বিষয়ের কোনও গুরুত্ব নেই, এমন কিছু ভেবে বসা আগাগোড়া ভুল দৃষ্টিভঙ্গি। মার্কস ও এঙ্গেলস তেমন কিছু আদৌ লেখেননি।

এঙ্গেলসের লেখা চিঠির বয়ানে স্পষ্ট বোঝা যায় ব্লখ সম্ভবত তাঁর কাছে ঐতিহাসিক বস্তুবাদ পড়তে, বুঝতে ও শিখতে চেয়েছিলেন, এই সম্পর্কে কয়েকটি বইয়ের নামও জানতে চেয়েছিলেন। কেন এমন প্রয়োজন হল? এর উত্তর পেতে কয়েক বছর পিছিয়ে আসা যাক। জেনির মৃত্যুর পরে কার্ল মার্কসের শরীর আর কখনোই আগের অবস্থায় ফেরেনি, গোটা দুনিয়াটা বদলে দেওয়ার রূপরেখা এঁকে ফেলা মানুষটি অবশ্য শেষ অবধি লড়েছিলেন। তাই ১৮৮২ নাগাদ শেষবারের মতো বেরিয়ে পড়েন। মার্শিলি, মন্টি কার্লো হয়ে পৌঁছেছিলেন নাইস অবধি, সেখান থেকে সোজা প্যারিস। হঠাৎ প্যারিস কেন? প্যারিসের উপকণ্ঠেই ছোট্ট শহর আর্জেন্ট্যুইল। সেখানেই তখন থাকেন তার কন্যা জেনি লঙ্গুয়েট (ফরাসী শ্রমিক আন্দোলনের বিশিষ্ট নেতা চার্লস লঙ্গুয়েটকে বিবাহ করেন জেনি)। নাতি নাতনিদের বরাবর কাছে পেতে চাইতেন মার্কস, সবচাইতে পছন্দের ক্ষুদেটির নাম ছিল জনি। জেনির লেখাজোখা থেকে জানা যায় আসলে জনি’র মধ্যে কার্ল নিজের মৃত পুত্রসন্তান এডগার’কে খুঁজে পেয়েছিলেন। আট বছর বয়সে এডগার মারা যায়। প্যারিসে থাকাকালীন মার্কস নিজেকে আরেকবার খুঁজে পেতে চেয়েছিলেন। ইতিপূর্বে জেনি (কন্যা)-কে চার্লস লঙ্গুয়েটের সাথে বিবাহে প্রবল আপত্তি জানিয়েছিলেন। একসময় যার বিরুদ্ধে প্রবল যুদ্ধ করতে হয়েছে সেই পেটি বুর্জোয়া তাত্ত্বিক পিয়ের জোসেফ প্রুধোঁ’রই ভক্ত ছিলেন চার্লস লঙ্গুয়েট ও তৎকালীন ফরাসী সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের আরও প্রমুখ কয়েকজন- সম্ভবত সে কারনেই। অথচ এরাই উঠতে বসতে নিজেদের মার্কসবাদী বলেই চিহ্নিত করতেন। একসময় চার্লস’রা মিশরে সেনা অভিযানের সমর্থনে প্রকাশ্যে বিবৃতি অবধি দিলেন। এমন কাজকর্মে অস্থির হয়েই মার্কস বললেন ‘আর যাই হোক, এটুকু অন্তত নিশ্চিত যে আমি মার্কস- মার্কসবাদী নই’।

এই ছিল সেই প্রেক্ষিত। তৎকালীন ইউরোপের মাটিতে তরুণ মার্কসবাদীরা তত্ত্বের নামে এমন কিছু প্রচার করছিলেন, এমনসব রাজনৈতিক অবস্থান গ্রহণ করছিলেন যা আদৌ মার্কসবাদ সম্মত নয়। ঐতিহাসিক বস্তুবাদের নাম করে যেসকল অপব্যখ্যা প্রচারিত হতে শুরু করেছিল তার বিরুদ্ধেই এঙ্গেলস’কে কলম ধরতে হয়েছিল। ততদিনে মার্কসের মৃত্যু হয়েছে। মার্কসবাদীদের চর্চায় এমন ভ্রান্তির প্রভাব আজকের দুনিয়াতেও যথেষ্ট, তাই এই চিঠির গুরুত্ব অনেকটাই। ঐতিহাসিক বস্তুবাদ ও তার বিস্তৃতি কতদূর এঙ্গেলসের লেখা চিঠিতে তারই সন্ধান মেলে।

এই প্রসঙ্গে রাজ্য ওয়েবসাইটের মতাদর্শ সিরিজে এঙ্গেলসের লেখা তিনটি চিঠিই প্রকাশিত হবে। আজকের প্রতিবেদনে প্রথম চিঠিটির বাংলা অনুবাদ প্রকাশিত হল। এটি প্রথম বঙ্গানুবাদ নয়, সোভিয়েত ইউনিয়নের তরফেই প্রথম বাংলা অনুবাদ প্রকাশিত হয়েছিল। ভাষার সময়োপযোগীতার গুরুত্ব বিবেচনায় সেই অনুবাদটি ব্যবহার করা গেল না।

সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির অধীনস্থ মার্কসবাদ-লেনিনবাদ ইন্সটিটিউট রুশ ভাষায় দু-খণ্ডে যে মার্কস-এঙ্গেলস নির্বাচিত রচনাবলী প্রকাশ করে তাতেই ঐ চিঠিগুলি অন্তর্ভুক্ত হয়। পরে ১৯৬৮ সালে ইংরেজিতে একটি ‘ওয়ান ভল্যুম’ সংস্করণও প্রকাশিত হয়। আমরা অনুবাদের কাজে সেই বইটিকেই ব্যবহার করেছি।

ফ্রেডরিক এঙ্গেলস

ইতিহাসের গতিপথ উপলব্ধি করতে যা চূড়ান্ত ভূমিকা পালন করে সেই ঐতিহাসিক বস্তুবাদের অর্থ হল বাস্তব জীবনধারণের উৎপাদন ও পুনরুৎপাদন। আমি নিজে কিংবা মার্কস কেউই এর চাইতে বেশি কিছু কখনো বলিনি। যদি দেখা যায় একে ব্যখ্যা করতে গিয়ে কেউ মূল কথাটাই বদলে দিয়েছেন, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকেই ইতিহাস উপলব্ধিতে একমাত্র নির্ধারক ভেবে বসেছেন তবে বুঝতে হবে এমন কাজ প্রকৃত তাত্ত্বিক প্রস্তাবনার এক অসার, বিমূর্ত ও নিরর্থক বোঝাপড়া মাত্র। অর্থনৈতিক পরিপ্রেক্ষিতটি অবশ্যই ভিত্তি, কিন্তু সামাজিক উপরিকাঠামোর বিবিধ উপাদানগুলি সেই ভিতের উপরে কার্যকর হয়। বিদ্যমান সমাজব্যবস্থায় শ্রেণী সংগ্রামের রাজনৈতিক চেহারা থেকে শুরু করে মানুষের কান্ডজ্ঞান অবধি সবকিছুই সেই উপরিকাঠামোর উপাদান। এই সকল উপাদানের উপরে নির্ভর করেই শ্রেণী সংগ্রামের একেকটি পর্বে বিজয়ী শ্রেণী নিজেদের মতো করে আইন ব্যবস্থার বদল ঘটায়। সামাজিক জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্র যেমন রাজনীতি, আইন-কানুন থেকে শুরু করে দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি, ধর্মীয় আচার-আচরণ অবধি- যেকোনো ঐতিহাসিক সংগ্রামের উপরে সমস্ত কিছুরই প্রভাব পড়ে, এমনকি অনেক ক্ষেত্রে এসকল সংগ্রামের পরিণতিও অনেকটাই নির্ধারণ করে দেয়। উপরিকাঠামোর বিভিন্ন উপাদানগুলি একে অন্যের উপরে প্রতিনয়ত প্রভাব বিস্তার করে এগিয়ে চলে। পরস্পরকে প্রভাবিত করার বিষয়টি কার্যত অসংখ্য ছোট বড় সংঘাতের চেহারা নেয়, কখনো সেই সংঘাত এমনই সুক্ষ হয় যে সেগুলিকে আমরা আদৌ উপলব্ধি করতে পারি না। এহেন ছোট বড় সংঘাতগুলির পরিণতিতেই বিদ্যমান সমাজের ভবিষ্যৎ প্রসঙ্গে অর্থনৈতিক পরিস্থিতির গতি-প্রকৃতির প্রকৃত গুরুত্বটুকু স্পষ্ট হয়ে ওঠে। সমাজ বিকাশের সঞ্চারপথ কোন দিকে এগোচ্ছে তা উপলব্ধি করতে এই সকল প্রসঙ্গকে হিসাবের বাইরে রাখা সম্ভব হলে ভবিষ্যৎ জেনে নেওয়ার অংকটি এক মাত্রার সমীকরণ সমাধানের মতোই সহজ হতে পারত, কিন্তু বাস্তবে তেমন কিছু ঘটে না।

নিজেদের ইতিহাস রচয়িতা মানুষই, কিন্তু রচনার কাজটি মস্তিস্ক প্রসূত অভীপ্সা অনুযায়ী আদৌ ঘটে না। সুনির্দিষ্ট ঐতিহাসিক পরিস্থিতি ও শর্তাবলীর উপরেই তাকে সবার আগে নির্ভরশীল হতে হয়। সেই সমস্ত শর্তের মধ্যে অর্থনৈতিক বাস্তবতাই শেষ অবধি নির্ধারকের ভুমিকা নেয়। এর অর্থ এমন না যে অন্যান্য শর্তগুলির কোনও প্রভাবই নেই। রাজনৈতিক বাস্তবতা থেকে শুরু করে যে সকল চিন্তাভাবনা যুগের পর যুগ ধরে মানুষের চেতনায় গেঁথে রয়েছে সেসবেরই প্রভাব থাকে, যদিও তারা সামাজিক বিকাশের পরিণতিকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। আজ প্রুশিয় রাষ্ট্র আমাদের সামনে উদাহরণ হতে পারে, এর বর্তমান চেহারাটি বিবিধ ঐতিহাসিক ও অর্থনৈতিক শর্তাবলীর অধিনেই নির্ধারিত হয়েছে, গড়ে উঠেছে।

আজকের প্রুশিয়া আদৌ গড়ে উঠতে পারত না যদি না  অর্থনৈতিক দিক থেকে শক্তিশালী হয়ে ওঠার জন্য উত্তর জার্মানির অন্তর্গত ক্ষুদ্র রাজ্যগুলির বাধ্যবাধকতা না থাকত। এই সকল ক্ষুদ্র রাজ্যের মধ্যে সবচাইতে সম্ভাবনাময় হয়ে উঠেছিল ব্র্যান্ডেনবার্গ। শক্তিশালী অর্থনীতির প্রদেশ হয়ে উঠতে নিজেদের আর্থিক ও ভাষাগত ঐতিহ্য বিশেষ ভূমিকা পালন করেছিল। জার্মানির সীমানা পুনর্গঠিত হওয়ার পরে আরও কিছু প্রভাব বিদ্যমান ছিল। দেশের উত্তর ও দক্ষিণ অংশে ধর্মীয় বিশ্বাসের পার্থক্য ছিল। এর সাথে যুক্ত হয়েছিল পোল্যান্ডের সাথে নানা সময় বিবিধ সংঘাতের প্রভাব। প্রুশিয়া পোল্যান্ডের দখলে চলে গেলে ব্র্যান্ডেনবার্গের সাথে পোল্যান্ডের পরিস্থিতি আরও জটিল আকার নেয়। তৎকালীন আন্তর্জাতিক রাজনীতির পরিস্থিতিই অস্ট্রিয়ায় রাজববংশের শাসনকে প্রতিষ্ঠিত করতে চুড়ান্ত ভূমিকা পালন করেছিল। এ সকল পরিপ্রেক্ষিত এড়িয়ে গেলে অতীত ও আজকের পরিস্থিতির মধ্যে যোগসূত্র খুঁজে পাওয়া যাবে না। সুদেতান অঞ্চল থেকে তাউনাস অবধি পর্বতসংকুল এলাকাটি জার্মানির একাংশকে আরেকাংশের থেকে যতটা দূরত্বে রাখে ক্ষুদ্র রাজ্যগুলির বিবিধ ঐতিহাসিক সংকট সেই ব্যবধান আরও বাড়িয়ে দিয়েছিল। এমন পরিস্থতির ব্যখায় কেবলমাত্র অর্থনীতিকে ভরসা করা খুবই হাস্যকর অবস্থান।

ইতিহাসের সঞ্চারপথ নির্ধারণে এর পরেই আসে বিকাশের একেকটি পর্বে ঐতিহাসিক পরিস্থিতির প্রসঙ্গ। একেকটি সন্ধিক্ষণে পরিস্থিতি এমন চেহারায় সামনে আসে যাতে মনে হয় সমাজ বিকাশের পরিণতি শেষ পর্যন্ত বিভিন্ন ব্যক্তিগত ইচ্ছার সংঘাতের ফলাফল। ঐ সকল ইচ্ছা আসলে তৎকালীন সমাজে বিদ্যমান বিভিন্ন বাস্তব পরিস্থিতির নির্দিষ্ট প্রতিফলন। কোনও এক নির্দিষ্ট পর্বে বিদ্যমান সমাজে একাধিক সমান্তরাল বাস্তবতা একে অন্যের উপর প্রভাব বিস্তার করে। একাধিক আয়তঘনক যেমন একে অন্যের সাথে মিলে একটি কাঠামো গড়ে তোলে সমাজ বিকাশের একেকটি ঐতিহাসিক পর্বের পরিস্থিতি অনেকটা তেমনই আকার নেয়। এমন অবস্থায় যা ঘটে তাকেই আমরা ঐতিহাসিক ঘটনা বলে চিহ্নিত করি। কখনো কখনো এমন পরিস্থিতিও তৈরি হয় যাকে কোনও অংশের সচেতন ইচ্ছার প্রতীক হিসাবেই প্রতিপন্ন করা চলে না। প্রত্যেকটি ব্যক্তিগত অভিপ্সারই বিপরীত মত থাকে, তাই ঐতিহাসিক পরিণতি এমনও হতে পারে যা কারোরই মনোমত হল না। আর তাই বলা যায় এখনও অবধি ইতিহাস প্রকৃতিতে কার্যকর গতির নিয়ম অনুসারেই এগিয়েছে। অবশ্য একথাও মনে রাখতে হবে ব্যক্তির ইচ্ছা বলে আমরা যা উপলব্ধি করি তা হল বস্তুত মানুষের শারীরিক বৈশিষ্ট ও পারিপার্শিকতার প্রভাবে সম্মিলতি মানসিক উদ্দীপনা অর্থাৎ শেষ বিচারে বিদ্যমান অর্থনৈতিক বাস্তবতা। একক ব্যক্তি কিংবা সামাজিক অভীপ্সা যাই বিবেচিত হোক না কেন বিষয়টি একই প্রসঙ্গেই নির্ধারিত হয়। একক ব্যক্তির অপূর্ণ সাধগুলি সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলনে এসে মিলে যায় ঠিকই, কিন্তু এর অর্থ এমন না যে তারা মিলিয়ে যায়। ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ায় লব্ধ সামাজিক ফলাফলে প্রত্যেকটি একক ইচ্ছাই অন্তর্ভুক্ত থাকে, অবদানও থাকে।

আপনার কাছে আমার অনুরোধ ঐতিহাসিক বস্তুবাদের মূল তাত্ত্বিক প্রস্তাবনাটি যেভাবে রচিত হয়েছে তাকে সেই ভাষ্যেই চর্চা করুন। অন্য কারোর ভাষ্যে একে উপলব্ধির প্রচেষ্টা অহেতুক বেশ কিছু বাড়তি জটিলতার সৃষ্টি করে। প্রকৃত তত্ত্বটি সেই তুলনায় অনেক সহজ। নিজের যাবতীয় লেখাতেই মার্কস ঐতিহাসিক বস্তুবাদের তত্ত্বকে ব্যবহার করেছেন। ‘ল্যুই বোনাপার্টের অষ্টাদশ ব্রুমেয়ার’ রচনাটি ইতিহাস উপলব্ধিতে বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গি প্রয়োগের সবচেয়ে উৎকৃষ্ট উদাহরণ বলা চলে। ‘ক্যাপিটাল’ রচনার সময়েও মার্কস তাকে ব্যবহার করেছেন, পড়লেই বোঝা যাবে। এই প্রসঙ্গে আমার নিজেরও দুটি লেখা রয়েছে, ‘ড্যুরিং মহাশয়ের তরফে বিজ্ঞানে বিপ্লব’ এবং ‘ল্যুদভিগ ফয়েরবাখ ও চিরায়ত জার্মান দর্শনের অবসান’- এগুলিও পড়ুন। ঐতিহাসিক বস্তুবাদ সম্পর্কে আমি এখনও অবধি যতদূর জানতে পেরেছি এদুটি বইতে সেসবের সবচেয়ে বিশদ বিবরণ উল্লেখ রয়েছে।

বর্তমানে অনেকেই, বিশেষত তরুণ বয়সীরা ঐতিহাসিক বস্তুবাদের ব্যখ্যা করতে গিয়ে অর্থনৈতিক পরিস্থিতির উপরে অনেকটা বাড়তি গুরুত্ব আরোপ করে চলেছেন, এর দায় মার্কস ও আমার, উভয়েরই। আগেকার অবস্থায় আমাদের প্রতিপক্ষের তাত্ত্বিকেরা ইতিহাসের বিবেচনায় অর্থনৈতিক পরিপ্রেক্ষিতকে এমনই তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যে এড়িয়ে যেতেন যে তাকে প্রতিহত করতেই অর্থনীতি প্রসঙ্গে আমাদের বেশ কিছুটা জোর দিতে হয়েছিল। সমাজ বিকাশের সঞ্চারপথে সক্রিয় বিভিন্ন ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াগুলিকে বস্তুবাদী তত্ত্বের সাধারণ বয়ানে যতটা গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনায় নিয়ে আসা উচিত ছিল তখনকার পরিস্থিতি আমাদের সেই সুযোগ দেয়নি। তবে যখনই ইতিহাসের কোনও একটি নির্দিষ্ট পর্বকে বিশ্লেষণের প্রয়োজন হয়েছে সেই কাজে আমরা ঐ নির্দিষ্ট পর্বের যাবতীয় ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াকেই বস্তুবাদী পর্যালোচনায় কার্যকরীরূপে অন্তর্ভুক্ত করতে পেরেছি। অবশ্য যে কোনও নতুন তত্ত্বের ক্ষেত্রেই একটি সমস্যা তৈরি হয়। প্রাথমিক ও মৌলিক সুত্রগুলিকে আয়ত্ত করা মাত্রই অনেকে ভেবে বসে তারা যেকোনও সাম্প্রতিক সমস্যার সমাধানে সেই তত্ত্বের সফল প্রয়োগের জন্য সক্ষম। হাল আমলে যারা নিজেদের মার্কসবাদী বলে পরিচয় দিচ্ছেন তাদের মধ্যেও এমন ঝোঁক যে রয়েছেই- আমি অস্বীকার করিনা। এদের অনেকেই যা সব করতে শুরু করেছেন তাকে মার্কসবাদের নামে আবর্জনা ছাড়া আর কিছুই বলা যায় না।

প্রাককথন ও অনুবাদ- সৌভিক ঘোষ

শেয়ার করুন

উত্তর দিন