Fascism and India I

চাই আন্দোলনের সঠিক সূচীমুখ আর দীর্ঘস্থায়ী লড়াইয়ের প্রস্তুতি (১ম পর্ব)

শমীক লাহিড়ী

সুপ্রিম কোর্টের ৪৮তম প্রধান বিচারপতি শ্রী নুথালাপাটি ভেঙ্কট রামন উদ্বেগের সঙ্গে বলেছিলেন –

১) ইচ্ছেমত গ্রেপ্তার, ২) বিচারাধীন বন্দিদের দীর্ঘদিন জামিন না দেওয়া বা বিচার প্রক্রিয়া ইচ্ছাকৃতভাবে দীর্ঘতর করা, ৩) বিনা বিচারে আটক, ৪) রাষ্ট্র কর্তৃক গায়ের জোরে বেআইনী উচ্ছেদ - এগুলি স্বৈরাচারের লক্ষন। (18th All India Legal Service Authority meet, July16, 2022)।

স্বৈরাচার ও ফ্যাসিবাদ

স্বৈরাচার ফ্যাসিবাদের একটা কেন্দ্রীয় বৈশিষ্ট্য, কিন্তু স্বৈরাচার মানেই ফ্যাসিবাদ নয়। ফ্যাসিবাদের আত্মপ্রকাশের কয়েকটি প্রাথমিক শর্ত হল, (১) একচেটিয়া পুঁজির গভীর সঙ্কট, (২) একচেটিয়া পুঁজি এবং ফ্যাসিস্ট দলের মধ্যে সম্পর্ক গঠন, (৩) অসহায় সংখ্যালঘুদের (ধর্মীয়-ভাষাগত-জাতিগত) প্রতি ঘৃণা ও বিদ্বেষ তৈরী, (৪) বিরোধীদের ওপর হামলা ও সন্ত্রাস তৈরীর জন্য রাষ্ট্রশক্তি সমান্তরাল দুষ্কৃতিবাহিনী তৈরী করা।

১৯৩০ আর আজকের ফ্যাসিবাদ

আজকের ফ্যাসিবাদ ১৯৩০ সালের মতই হবে তার কোনও মানে নেই। বরং আজ পৃথিবীর নানা দেশে বা ভারতবর্ষে যা দেখা যাচ্ছে সেটাকে ‘নিও ফ্যাসিবাদ’ বা ‘ছদ্মবেশী ফ্যাসিবাদ’ বলা যেতে পারে। আজকের ফ্যাসিবাদকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে একটি গ্রীক শব্দবন্ধ ব্যবহৃত হচ্ছে - Palengenesis। দুটি গ্রীক শব্দ, Palen যার অর্থ ‘আবার’ অথবা ‘পুনরায়’ এবং Genesis, যার অর্থ ‘জন্ম’। এই দুটো শব্দের সমন্বয় করে Palengenesis অর্থাৎ ‘পুর্নজন্ম’ হয়েছে ফ্যাসিবাদের - এই কথা বলছেন অনেক রাষ্ট্র বিজ্ঞানী। অর্থাৎ ফ্যাসিবাদের তাত্ত্বিক  ভিত্তিকে গ্রহণ করা হচ্ছে কিন্তু পরিবর্তিত পৃথিবীতে এর প্রয়োগের ভিন্ন ভিন্ন রূপ দেখা যাচ্ছে।

১৯৩০-এর ফ্যাসিবাদ যুদ্ধ করে একদিকে যেমন পৃথিবীর বহুদেশকে ধ্বংস করেছিল, তেমনই নিজেরাও শেষ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু ‘নিও ফ্যাসিবাদ’ পৃথিবীব্যাপী সামগ্রিক যুদ্ধের রাস্তায় মোটেই হাঁটছে না। ভারতবর্ষের ফ্যাসিবাদও যুদ্ধের উন্মাদনা তৈরী করলেও যুদ্ধের রাস্তায় হাঁটছে না।

মুসোলিনি'র ইতালি ও রবীন্দ্রনাথের সতর্কবার্তা

কর্পোরেট ও ফ্যাসীবাদ

১৯৩০ এর দশকে তৎকালীন কর্পোরেট সংস্থাগুলির কার্যকলাপ ছিল দেশ ভিত্তিক, আজকের মতো এতটা আন্তর্জাতিক নয়। তাই কর্পোরেটগুলির স্বার্থ রক্ষা করার জন্য তাদের নিজ নিজ দেশের শাসকরা বাজার দখলের উদ্দেশ্যে সর্বগ্রাসী যুদ্ধে লিপ্ত হতে বাধ্য ছিল। কিন্তু আজকের লগ্নি পুঁজি অনেক বেশি আন্তর্জাতিক ও পরিকল্পিতভাবে পরিচালিত হয় সেই সময়ের তুলনায়।

তাই কর্পোরেটের স্বার্থ রক্ষার কায়দা ও চেহারাটাও অনেক পাল্টে গেছে। আজকের লগ্নি পুঁজি গভীর সঙ্কটে থাকলেও তার থেকে মুক্তির রাস্তা খোঁজার জন্য আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে পৃথিবী জুড়ে যুদ্ধ বাঁধিয়ে তার বিশেষ লাভ নেই। অন্য অনেক কায়দা-কানুন ব্যবহার করে আজকের লগ্নি পুঁজি তার মুনাফা বৃদ্ধির হার বজায় রাখে, মূলত ফাটকা পুঁজির অবাধ গতিবিধির রাস্তা উন্মুক্ত করে। যেহেতু আজকের ফ্যাসিবাদ রাষ্ট্রভিত্তিক যুদ্ধে লিপ্ত হচ্ছে না, তাই এর স্থায়িত্ব অতীতের অনেক বেশি হওয়ার সম্ভাবনা থেকেই যাচ্ছে।

কাজেই এখন ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র খোলামেলা সন্ত্রাসের পরিবর্তে ‘ছদ্মবেশী ফ্যাসিস্ট’ চেহারা নিয়েই থাকছে। একটা নির্দিষ্ট ধরণের আক্রমণ বা নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য নিয়ে এরা বিরাজ করছে না। বরং পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করে ছদ্মবেশেই ফ্যাসিস্ট কার্যকলাপ বা আক্রমণ পরিচালনা করছে।

ছদ্মবেশী ফ্যাসিবাদ

বর্তমান ভারত সরকার একটা আপাত গণতান্ত্রিক মুখোশের আড়াল থেকেই ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র পরিচালনা ও নির্মান করতে চাইছে। যেমন বিভিন্ন গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলিকে এরা সরাসরি ভেঙে-গুঁড়িয়ে দিচ্ছে না, যেভাবে স্পেন-ইতালি-জার্মানি-জাপান ইত্যাদি দেশে ফ্যাসিস্টরা এই কাজ করেছিল। বরং আপাতভাবে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান বা নির্বাচনী ব্যবস্থাকে এরা বজায় রাখছে। কিন্তু গণতন্ত্রের মূল ভিত্তিগুলিকেই তারা নড়বড়ে করে দিচ্ছে। যেমন জনপ্রতিনিধি কেনাবেচা করে মানুষের প্রকৃত রায়কেই এরা সম্পূর্ণ পাল্টে দিচ্ছে। আগে এরা অর্থ খরচ করে ভোট কিনত, কিন্তু এখন লজ্জা শরমের মাথা খেয়ে সমগ্র মন্ত্রীসভাই নেমে পড়ছে বিধায়ক কেনাবেচা ক’রে সরকার গঠন করতে। সংসদকে কার্যত অকেজো করে দিচ্ছে। একইভাবে স্বাধীন বিচার ব্যবস্থাকেও ক্রমশ পঙ্গু করে ফেলা হচ্ছে। এইভাবে ফ্যাসিস্ট শক্তির উদ্যোগে অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার গলায় ফাঁসির দড়ি ক্রমশ চেপে বসছে।

Neoliberalism

উদারনীতিবাদ ও গণতন্ত্র

এই প্রক্রিয়া অবশ্যই অনেক আগে থেকেই শুরু হয়েছিল। নয়া উদারবাদী অর্থনীতি যখন থেকে শুরু হয়েছিল, তখন থেকেই গণতান্ত্রিক বাতাবরনকে অস্বীকার করার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল। নয়া উদারবাদী অর্থনীতির সবচেয়ে বড় ক্ষতিকর দিক হলো, যেহেতু বিশ্ব লগ্নি পুঁজি অত্যন্ত দ্রুত স্থান পরিবর্তন করতে পারে, তাই এদের নির্দেশ মত, লগ্নি পুঁজির স্বার্থ রক্ষার্থে কোনো দেশ তার অর্থনীতি পরিচালনা করতে অস্বীকার করলে তারা দ্রুত পুঁজি স্থানান্তর করে ফেলে। ফলে আজকের লগ্নি পুঁজি রাতারাতি যে কোনো দেশের অর্থনৈতিক বাজারকে এলামেলো করে দিতে পারে, পুঁজির স্থানান্তর ঘটিয়ে।

তাই যে রাজনৈতিক দলই ক্ষমতায় আসুক না কেন, তারা লগ্নি পুঁজির নির্দেশ অনুযায়ী তাদের স্বার্থ রক্ষার্থে অর্থনৈতিক নীতি পরিচালনা করতে বাধ্য হয়। ফলস্বরূপ নির্বাচনের মাধ্যমে সরকারী রাজনৈতিক দলের পরিবর্তে অন্য রাজনৈতিক দল আনলেও দেশের জনসাধারণ জনবিরোধী অর্থনৈতিক নীতি পাল্টাতে পারে না।

একটি সার্বভৌম দেশের গণতন্ত্রে মানুষের প্রাথমিক অধিকার থাকে যে তারা নির্বাচনের মাধ্যমে ভিন্ন ভিন্ন নীতি নিয়ে চলা রাজনৈতিক দলের মধ্যে তাদের পছন্দ অনুযায়ী যে কাউকে বেছে নিতে পারে। অর্থাৎ একটি রাজনৈতিক দলের নির্দিষ্ট অর্থনৈতিক বা রাজনৈতিক নীতি যদি জনগণের অপছন্দ হয়, তাহলে অন্য অর্থনৈতিক নীতি নিয়ে চলা রাজনৈতিক দলকে জনগণ বেছে নিতে পারে ভোটদানের ক্ষেত্রে। কিন্তু আর্ন্তজাতিক লগ্নিপুঁজির চাপে রাজনৈতিক দলগুলি ভিন্ন অর্থনৈতিক নীতি নিয়ে চলতেই পারছে না নয়া উদারনীতিবাদের যুগে। ফলে নির্বাচন প্রায় প্রহসনে পরিণত হয়েছে আর্ন্তজাতিক লগ্নিপুঁজির দাপটে।


শেয়ার করুন

উত্তর দিন