WB Summit Cover

What’s What About the Business in Bengal? A Report

চন্দন দাস

আগের সম্মেলনগুলিকে ছাপিয়ে গেলো এবারের বিশ্ববঙ্গ সম্মেলন। বুধবার সপ্তমবারের সম্মেলনের শেষ দিনে মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি ঘোষণা করেছেন, এবারের বিনিয়োগের প্রস্তাব এসেছে ৩, ৭৬,২৮৮ কোটি টাকার!

এর আগে, ২০১৫ থেকে ২০২২ — রাজ্যে ছ’টি ‘বিশ্ববঙ্গ শিল্প সম্মেলন’ করেছেন মমতা ব্যানার্জির সরকার।

প্রতিটি শিল্প সম্মেলনের শেষে রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে কত টাকা বিনিয়োগের প্রস্তাব এলো — তা সবিস্তারে, গর্বের সঙ্গে ঘোষণা করা হয়েছে। সরকারের সেই তথ্য জানাচ্ছে, গত ছ’টি সম্মেলনে মোট ১৩, ৭২,৩২৯কোটি ২লক্ষ টাকার বিনিয়োগ প্রস্তাব রাজ্যে এসেছে।

কিন্তু বাস্তব কী? একই রাজ্য সরকারের অন্য রিপোর্ট আছে। যা কেন্দ্রেীয় সরকার প্রকাশ করে। কেন্দ্রীয় সরকারের ডিপার্টমেন্ট অব পলিসি অ্যান্ড প্রমোশন (ডিআইপিপি) তার হিসাব রাখে, প্রকাশ করে। সেই রিপোর্ট জানাচ্ছে, ২০১৫ থেকে ২০২২ — এই সময়ে পশ্চিমবঙ্গে বিনিয়োগের লিখিত প্রস্তাব এসেছে ৫৭,১২৩কোটি টাকার।

অর্থাৎ বিশ্ববঙ্গ শিল্প সম্মেলনগুলিতে মমতা ব্যানার্জির ঘোষিত মোট প্রস্তাবের মাত্র ৪.১৬%।

রাজ্যের শিল্প উন্নয়ন নিগম সূত্রে জানা যাচ্ছে ২০১৫-তে, প্রথম সম্মেলনে বিনিয়োগের প্রস্তাব এসেছিল, ৪০,১৯৭ কোটি ২৫লক্ষ টাকার। আর কেন্দ্রের নথি জানাচ্ছে ওই বছর প্রস্তাব এসেছিল ১৭,৬৬০ কোটি টাকার।

দ্বিতীয় সম্মেলন ২০১৬-তে। সেখানে ২, ৫০,২৫৩ কোটি ৭৪ লক্ষ টাকার প্রস্তাব এসেছিল বলে রাজ্য সরকারের দাবি। ডিআইপিপি জানাচ্ছে, সেই বছর রাজ্যে আসলে প্রস্তাব এসেছিল ৫২০৪ কোটি টাকার।

২০১৭-য় তৃতীয় সম্মেলন, ২০১৭। সেখানে ২, ৩৫,২৯০ কোটি ৩লক্ষ টাকার প্রস্তাব আসে বলে দাবি সরকারের। সরকারি নথি বলছে, সে বছর আসলে ৪০৭৪ কোটি টাকার বিনিয়োগের প্রস্তাব এসেছিল।

৪র্থ সম্মেলন ২০১৮-তে। সেখানে ২, ১৯,৯২৫ কোটি টাকার বিনিয়োগের প্রস্তাব এসেছিল বলে দাবি করা হয়। কিন্তু ডিআইপিপি-র নথি বলছে আসলে প্রস্তাব এসেছিল ৪৭২২ কোটি টাকার।

৫ম সম্মেলন ২০১৯-এ। সেখানে দাবি করা হয় ২, ৮৪,২৮৮ কোটি টাকার প্রস্তাব এসেছে বিনিয়োগের। যদিও সরকারি নথি বলছে এসেছিল ৫৮৪৪ কোটি টাকার প্রস্তাব।

৬ষ্ঠ সম্মেলন হয় গত বছর, ২০২২-এ। সেখানে মমতা ব্যানার্জির দাবি ছিল ৩, ৪২,৩৭৫ কোটি টাকার বিনিয়োগের প্রস্তাব এসেছে। ডিআইপিপি জানাচ্ছে, ওই বছর রাজ্যে মাত্র ৪৫৩২ কোটি টাকার প্রস্তাব এসেছে।

মাঝে করোনার জন্য দু’বছর শিল্প সম্মেলন মমতা ব্যানার্জি করতে পারেননি। ২০২০ এবং ২০২১। সেই দু’ বছর রাজ্যে বিনিয়োগের প্রস্তাব এসেছে যথাক্রমে ৯৫৫২ কোটি টাকা এবং ৫৫৩৫ কোটি টাকার।

লক্ষ লক্ষ কোটি টাকার কোনও চিহ্ন নেই!

তবে এই সবই প্রস্তাব। বাস্তবায়নের হিসাব দেখলে এর পরিমাণ আরও অনেকই কম হবে। যদি শিল্পের প্রস্তাবকেই হিসাবে ধরা হয় তাহলে দেখা যাবে শুধু ২০০৮সালেই রাজ্যে বিনিয়োগের প্রস্তাব ছিল ৯৫,০০০ কোটি টাকার। সেই সময়েই রাজ্যে শিল্প আটকাতে সিঙ্গুর সহ নানা জায়গায় হাঙ্গামা তৈরি করেছিল তৃণমূল এবং তার সহযোগীরা।

উল্লেখ্য, মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার আগে মমতা ব্যানার্জি বিধানসভা নির্বাচনের ইশ্‌তেহারে শিল্প সংক্রান্ত প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন অনেকগুলি। সেই ঘোষণাগুলির রিপোর্ট কার্ড নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ এখন।

তৃণমূলের প্রতিশ্রুতির মধ্যে ছিল —

১) ২০১১-তে তৃণমূল কংগ্রেসের নির্বাচনী ইশ্‌তেহারে ছিল, ‘পাঁচ বছরের মধ্যে প্রতিটি মহকুমায় অন্তত দশটি করে বড়, মাঝারি শিল্প গড়ার উদ্যোগ নেওয়া হবে। বেকারদের মুখে হাসি ফোটাতে তৃণমূল কংগ্রেস অঙ্গীকারবদ্ধ।’

বেকারদের মুখে হাসি নেই। শিল্প হয়নি কোথাও।

২) ২০১১-র সেই ইশ্‌তেহারে ছিল, ‘গ্রামের আধাবেকারসহ এখন বেকারের সংখ্যা ১কোটি। এদের চাকরির ব্যবস্থা করতে হবে। কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা আমাদের প্রাথমিক লক্ষ্য। এর জন্য বিশেষ ভূমিকা নেবে এমপ্লয়মেন্ট ব্যাঙ্ক।’

চাকরি হয়নি। লক্ষ লক্ষ শূণ্য পদ। এমপ্লয়মেন্ট ব্যাঙ্ক থেকে কত চাকরি হয়েছে সরকারই বলতে চাইছে না। ইদানিং সেই ব্যাঙ্ক নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী বলা বন্ধ করেছেন।

স্বভাবতই নতুন শিল্প কিংবা বিনিয়োগ নিয়ে মমতা ব্যানার্জির ঘোষণার সময়েই বন্ধ কারখানার হিসাব নেওয়াও দরকার। তৃণমূলের ২০১১-র বিধানসভা নির্বাচনের ইশ্‌তেহারের ২৫নং পাতায় লেখা হয়েছিল, ‘‘পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্ট সরকারের সময়ে ৫৬ হাজার কারখানা বন্ধ। তার জমির পরিমাণ ৪৪হাজার একর।’’ এখন দেখা যাচ্ছে পুরোটাই ছিল বামফ্রন্টের বিরুদ্ধে অপপ্রচার। ৫৬হাজার বন্ধ কারখানা নয়। কখনও ছিল না। অন্তত বামফ্রন্ট সরকারের সময়কালে তো নয়ই। যদি ধরে নেওয়া হয় যে, ১৯৭৭-র আগে রাজ্যে একটি কারখানাও বন্ধ ছিল না, তাহলে বামফ্রন্ট সরকারের ৩৪ বছরে ৮৩টি কারখানা বন্ধ হয়েছে। এই তথ্য গত নভেম্বরে রাজ্য বিধানসভায় এক বিধায়কের প্রশ্নের জবাবে জানিয়েছিল রাজ্য সরকার। গত ২৯ নভেম্বর এই সংক্রান্ত একটি প্রশ্নের জবাবে রাজ্যের শ্রমমন্ত্রী জানিয়েছিলেন যে, রাজ্যে বন্ধ কারখানার সংখ্যা ১৭৭। তার জন্য ২৯,০৮৪জন শ্রমিক কাজ হারিয়েছেন। তবে যে কারখানার শ্রমিকরা ফাউলাই প্রকল্পের আওতায় আছেন এবং ভাতা পান, তার ভিত্তিতেই সরকার বন্ধ কারখানার সংখ্যা নির্দ্ধারণ করেছে। সেই হিসাবেই রাজ্যে বড় ও মাঝারি ১৭৭টি কারখানা বন্ধ।

অর্থাৎ বামফ্রন্ট সরকারের সময়ে ছিল ৮৩। মমতা-শাসনে হয়ে গেছে ১৭৭। মমতা ব্যানার্জির শাসনে রাজ্যে বড় ও মাঝারি কারখানা বন্ধ হয়েছে ৯৪টি।

২০১১-১২-তে কত ছিল? তারও জবাব তৃণমূলের সরকার দিয়েছিল বিধানসভায়। তখন সবে মমতা ব্যানার্জি মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন, সেই সময়কালে, ২০১১-র ২৩ ডিসেম্বর বিধানসভায় এক বিধায়ক জানতে চেয়েছিলেন যে, রাজ্যে বন্ধ বড় ও মাঝারি কারখানা কত? সেদিন মমতা ব্যানার্জির সরকারের শ্রম মন্ত্রী জানিয়েছিলেন যে, ২০১১-র ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত রাজ্যে বন্ধ কারখানার সংখ্যা ৮৩। তার মধ্যে ২৫টি বড় কারখানা।

মমতা ব্যানার্জির শাসনে রাজ্যে অনেক কারখানা বন্ধ হয়েছে। লকআউট ঘোষণা করে মালিক পক্ষ বসে আছে — এমন উদাহরণ প্রতিটি শিল্পনগরীতেই আছে। আবার তৃণমূলের তোলবাজির জন্যও কারখানা বন্ধ হয়েছে অনেক। ৫০০ কিংবা তার বেশি শ্রমিক কাজ করেন, এমন কারখানাকে বড় ধরা হয়। আর ১০০ থেকে ৪৯৯ পর্যন্ত শ্রমিক থাকলে তাকে মাঝারি কারখানা ধরা হয়।

Spread the word

Leave a Reply