ওয়েবডেস্ক প্রতিবেদন
সৌভিক ঘোষ
সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত?
ছেলে-মেয়ে একাদশ-দ্বাদশ ক্লাসের পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছে আর আপনি মনে মনে তাদের বিজনেস স্কুলে পড়ানোর বার্ষিক খরচ হিসাব করছেন?
এমনটা করছেন কেননা বিপদে-আপদে আপনাদের পারিবারিক বন্ধু-বান্ধব ও মধ্যবিত্তের সবচাইতে আহ্লাদের বস্তু ‘বুদ্ধিজীবীরা’ আজকাল ‘ঘরে-বাইরে’ বলে চলেছেন ঘটি-বাটি বন্ধক রেখে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়িয়ে লাভ নেই (আসলে ঘুরপথে বোঝাচ্ছেন বাজারে কাজ নেই), ডাক্তারিতে সাফল্যের সুযোগ এখনও যোগ্যতার উপরেই মূলত নির্ভরশীল (পাশ করার আগে এবং পরে আরও বেশি)।
অবস্থা যদি এমন হয় তাহলে সন্তানের ভবিষ্যত সম্পর্কে উচ্চাকাঙ্ক্ষী পরিবারগুলির হাতে যা পড়ে থাকে (মানে সেই বাজার আপনার হাতে যেটুকু পড়ে থাকতে দেয় আর কি!) তাকেই পেন্সিল বা বিজনেস স্কুল বলে। সুতরাং, চালাও হুজ্জত! মানে, লাইনে দাঁড়িয়ে বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন পড়তে ভর্তি হও।
অথচ কেউ আপনার কানে কানে ফিসফিস করে বলে দিচ্ছে না- বাজার যখন সংকটে পড়ে তখন প্রথম আক্রান্ত হয় উৎপাদন। তার প্রভাবে বন্ধ হয় কারখানা, রাষ্ট্রীয় উদ্যোগীরা দলে দলে পণ্যের উৎপাদনটা অন্যের ঘাড় দিয়ে করিয়ে নিতে চায় (হয় নিজেদের গুদামজাত স্টক/ ইনভেন্ট্রি থেকে নাহলে পুঁজি যাদের একটু বেশি তাদের ব্যবসায় বিদেশ থেকে আমদানি করে)। রাতারাতি দেশীয় পুঁজিপতিরা (মানে মোদী যাদের কথা ভেবে গুজরাট মডেল, শাইনিং ইন্ডিয়া এসব গল্প ফেঁদেছিলেন) মুখোশ খুলে রেখে হয়ে যায় বেনিয়া। এতদিন যে সরকারী খয়রাতি ব্যবস্থার (পড়ুন গরীব মানুষের রোজগার, জীবন রক্ষায় বিভিন্ন ব্যয়বরাদ্দ কার্যকরী প্রকল্প যেমন এমএনরেগা) সবচাইতে মর্যাদাসম্পন্ন ও মেধাবী সমালোচক ছিল, তারাই এবার ভিক্ষের ঝুলি হাতে যুক্তির নামে, দেশের নামে, জাতীয় মজবুতির নামে যেন-তেন-প্রকারেণ ‘বেইল ইন’ নীতিকে প্রগতিশীল প্রমাণ করতে নামীদামি কাগজের উত্তরসম্পাদকীয় কলামে হাজির হয়।
কথা হচ্ছে এনপিএ প্রসঙ্গে। এনপিএ- নন পারফরমিং অ্যাসেট। ব্যাংকিং ব্যবস্থার অনাদায়ী ঋণ সম্পর্কে কথাটি ব্যবহৃত হয়। মানে, কেউ ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছে, কিন্তু সেই ঋণ আর শোধ হচ্ছে না। মানে খাতায় কলমে যে পরিমাণ অর্থ ব্যংকের সম্পদ (অ্যাসেট) হিসাবে বিবেচিত হওয়ার কথা (সুদ ও আসল সমেত) তাই এখন হয়ে পড়েছে অকার্যকরী, বোঝা। তাই নন পারফর্মিং। ধ্রুপদী ঘরানায় (আমাদের দেশে এমন জমানা দুটি- এক স্বাধীনতার পরের কুড়ি বছর, আর দ্বিতীয়বার উদারঅর্থনীতিকে স্বাগত জানানোর পরের দশ বছর) এমন ঋণখেলাপি কে বা কারা সেসব জানা যেত, ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপের শাস্তির বিধানও ছিল। মোদী শাসনে ইতিহাস ও তার শিক্ষাকে অস্বীকার করাই দস্তুর, তাই কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সিতারামনের কর্তব্য তালিকায় শুধু তিনটি কাজ রয়েছে।
আর সেই তিনটি পয়েন্টেই বুঝে নেওয়া যায় ভারতে কর্পোরেট ব্যাপারটা আসলে কীরকম।
ঋণখেলাপিদের পরিচয় গোপন
কেন্দ্রীয় সরকার ঋণখেলাপিদের সামাজিক মর্যাদা প্রসঙ্গে খুবই স্পর্শকাতর। সাদা মনে কাদা নেই যাদের (অর্থাৎ অর্থনীতি জানেন না যারা), তারা প্রশ্ন করতে পারেন- এমনই তো স্বাভাবিক, গরীব মানুষ দুটো টাকা ধার নিয়ে ছোট দোকান বা ব্যবসা গোছের কিছু একটা করতে গিয়ে ডুবেছে, তাদের নাম-ধাম জানিয়ে দেওয়া কি উচিত? সমস্যা হল কেন্দ্রীয় সরকারের তথ্য বলেও একটা বিষয় থাকে, চাইলেই সেসবের সবটা গোপন রাখা যায় না (অন্তত যতদিন সংসদ ও আদালত বলে একটা কিছু আছে)। সেই তথ্যের জোরেই ঝুলি থেকে বেড়াল বেরিয়ে এসেছে। দেখা যাচ্ছে অনাদায়ী ঋণ যাদের নামে রয়েছে সেই তালিকায় কর্পোরেটরাই বেশি। ইংরেজিতে লায়ন’স শেয়ার বলে একটা কথা আছে, মানে হল গায়ের জোরে নিজের দিকে বেশিটা ধরে রাখা। সম্পদ, অধিকার, ক্ষমতার পাশাপাশি ভারতের কর্পোরেটগোষ্ঠী আজ ঋণের ব্যাপারেও লায়ন’স শেয়ার হোল্ডার! ভারতে ব্যাংক ব্যবস্থার জাতীয়করণের সবচাইতে বড় সুবিধা ছিল এর প্রভাবে জনসাধারণের কর্মক্ষম কিন্তু মধ্যবিত্ত ও গরীব অংশ নিজেদের রোজগারের উপায় নিশ্চিত করতে সুবিধাজনক শর্তে ঋণ পাবে। যত দিন এগিয়েছে রাষ্ট্র ও ব্যাংক উভয়েই সেই ভাবনাকে দূরে সরিয়েছে। ক্রমশ বিরাট বিরাট অর্থমূল্যের কর্পোরেট ঋণ দিতে বেশি মনোযোগী হয়েছে ব্যংকগুলি। তারা রাজী না হলে সরকারী দপ্তর থেকে চাপ দেওয়া হয়েছে (নীরব মোদীর ঘটনাই এর উদাহরণ)। একদিনেই সবকটা সোনার ডিম বের করে নেওয়ার বুদ্ধি আর কি! এমনটা হওয়ার ফলে একদিকে চাপা পড়েছে মধ্যবিত্ত, গরীব মানুষের স্বার্থ- তারা আপদকালেও ঋণ পাচ্ছেন না, কেননা ব্যাংক অনাদায়ী ঋণের অজুহাত তুলে কঠিন শর্ত (পড়ুন গ্যারেন্টি) চাপিয়ে দিচ্ছে। আরেকদিকে অনাদায়ী ঋণের চাপে ক্রমাগত ধুঁকতে থাকা ব্যাংকগুলিকে ‘গ্রেট মার্জার’ প্রকল্পের অধীনে অন্য কোনও ব্যাংকের সাথে জুড়ে দেওয়া শুরু হয়েছে। এতে যেমন ব্যাংকিং সেক্টরে কাজের (চাকরি) সুযোগ কমছে, তেমনই গোটা ব্যবস্থাটা পুনরায় বেসরকারি হাতে তুলে দেবার যুক্তি হাজির করা গেছে।
এই অবধি পড়লেই বোঝা যায় এতে কার লাভ, কাদের সুবিধা? সরকারী ব্যাংকে পরিষেবার মান খারাপ বলে খবরের কাগজের পাতা থেকে শুরু করে বিরাট ইন্সটিটিউট হলে বিদগ্ধজনের সেমিনারে মুখে ফেনা তুলে (পড়ুন ফিন্যান্স ম্যানেজমেন্ট) যারা প্রমাণ করলেন ‘বেসরকারি হলে পরিষেবা ভালো হবে’- দেখা যাচ্ছে ঋণখেলাপিদের তালিকাতেও তারাই রয়েছেন!
এরাই মোদীর প্রচারে নির্বাচনী বন্ডের মাধ্যমে সবচাইতে বেশি টাকা ঢেলেছেন। এরাই সরকারী ব্যাংক থেকে সবচাইতে বেশি অংকের ঋণ নিয়ে আটকে রেখেছেন। এই দুয়ের মাঝে যোগাযোগকে অর্থনৈতিকও বলা চলে, আবার রাজনৈতিক বললে বাহুল্যের দোষও খুব একটা হয় না।
আর তাই নির্বাচনী বন্ডের মাধ্যমে কারা বিজেপিকে টাকার যোগান দিচ্ছে তাদের নাম প্রকাশিত হোক- সেটা যেমন কেন্দ্রীয় সরকার চাইছে না, ঠিক তেমনই অর্থমন্ত্রী নির্মলার প্রথম সাফল্যই হল ঋণখেলাপিদের নাম গোপন রাখা।
ঋণমুকুব সংক্রান্ত সরকারী নীতি
কোভিডের সময় জীবনদায়ী ভেন্টিলেটরের দামে জিএসটি চাপিয়েছিল মোদী সরকার। পিপিই কিট, যাবতীয় ওষুধপত্র এমনকি সাধারণ ঘরোয়া সামগ্রী (যেমন শ্যাম্পু, সাবান থেকে শুরু করে উৎপাদনের মেশিনারিতে কাজে লাগে এমন সবকিছু)-তেও ১৮% জিএসটি রয়েছে। অথচ ডিজিটাল লার্নিং’কে মজবুত ও সহজলভ্য করতে কম্পিউটার সহ ইলেকট্রনিক সামগ্রীতে করের সেই হার ১২%! প্রসেসড ফুডেও তাই। এর অর্থ বুঝতে ‘দাস ক্যাপিটাল’ পড়তে হয় না, সহজেই উপলব্ধি হয় মোদীর সরকার আসলে কাদের কথা ভেবে পরিচালিত হয়। নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রীর দাম বাজারে প্রতিদিন বেড়ে যাচ্ছে, পেট্রোল-ডিজেলে লোকদেখানো করছাড় দিয়ে সরকার দেশোদ্ধার করে ফেলছে – অথচ সবকিছুর দাম বাড়ার কারনে যে শ্রমজীবী মানুষের দৈনিক ন্যুনতম মজুরিও বাড়াতে হয় সেকথা কেউ মনে রাখেনা। বাজার দর বেশি বলেই ‘ঘরে-বাইরে’ নানা প্রয়োজনে যারা ঠিকে হিসাবে কাজ করেন (ঘরবাড়ি বানানো, রংয়ের কাজ, রান্নার কাজ কিংবা নিছক ঘরদোর পরিস্কারের কাজ) তাদের বর্তমান মজুরি শুনে মাথায় হাত পড়ছে আপনার-আমার সবারই। সেইটুকু বাড়তি টাকা গুনতে মধ্যবিত্তের বেজায় বিরক্তি, অথচ সেই টাকাটুকু বাড়তি রোজগার না করলে ‘যারা কাজ করে’ তাদের কিছুতেই চলে না। ফলে বাজার বলতে যা বোঝায় তার সার্বিক অবনমন। পণ্যের চলাচল, পূঁজির ঘোরাফেরা ছাড়াও আরও একটি বিষয় থাকে যাকে বাদ দিয়ে বাজার চলে না- তাকেই শ্রমশক্তি বলে। ফিন্যান্স শাস্ত্রে ব্যাপারটা নিছক একটা প্যারামিটার হয়ে পড়ে থাকলেও, আসলে ওটাই সব- কারণ ওতেই মানুষের কথা যুক্ত থাকে।
আর সেই মানুষ যখন দুবেলা খাওয়ার মতো কিছু জোটাতে পারছে না তখন সরকারী ব্যয়বরাদ্দ থেকে মাসিক সাড়ে সাত হাজার টাকা দিতেও অস্বীকার করেছে মোদী সরকার। অজুহাত ছিল সরকারে তহবিলে নাকি যথেষ্ট অর্থ নেই। অথচ সেই একই সরকার গত দশ বছরে কত টাকার কর্পোরেটদের ছাড় দিয়েছে জানেন? ১৩.২২ লক্ষ কোটি টাকা।
এই ছাড় সবটাই দেওয়া হয়েছে অনাদায়ী ঋণমুকুবের খাতে। অথচ দেশে যখন আর্থিক সংকট ক্রমশ বাড়ছে, অতিমারির সময় কাজ হারিয়ে মানুষ মরছে তখন মাসে সাড়ে সাত হাজার টাকা সহায়তা দেবার মুরোদটুকুও ছিল না এদের।
হাফ-পন্ডিতবৃন্দ (যেমনটা সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যানে আজকাল চলছে আর কি) বলতে পারেন কর্পোরেটদের কর ছাড় না দিলে চলবে কেন? তারাই তো কলকারখানা চালু রাখবেন, সেইসব জায়গায় সকলে কাজ করবে, আরও লোকজন কাজ পাবে- বাজার পুনরায় তেজি হবে! মজার বিষয় হল আজ অবধি ‘বেইল আউট’ (যাতে সরাসরি কর্পোরেটদের হাতে সরকারী অর্থ তুলে দেওয়া হয়) কিংবা ‘বেইল ইন’ (যাতে বেসরকারি ঋণকে সরকারী বাজেটে অন্তর্ভুক্ত করে নেওয়া হয়) প্যাকেজের সুবিধায় একটাও বন্ধ কলকারখানা খোলেনি, একটাও কোম্পানি (উৎপাদনমুখী কিংবা পরিষেবাকেন্দ্রিক) চালু হয়নি, যদিও দানের অর্থে শেয়ার হোল্ডারদের ডিভিডেন্ড দেওয়া হয়েছে (মেরিল লিঞ্চ, ল্যেমান ব্রাদার্স দ্রষ্টব্য- ঐ পন্ডিতদের জন্যই)। বাজারে যখন মন্দা প্রায় স্থায়ীরূপ নিচ্ছে তখন সরকারী দানে পাওয়া টাকা নিয়ে কোনও পুঁজিপতিই উৎপাদনে বিনিয়োগ করবেন না- পুঁজিবাদী অর্থশাস্ত্র অতটাও শিশুসুলভ নয়। সুতরাং সেই টাকা গুটিকয়েকের পকেটেই ঢুকবে কারণ সেটাই দস্তুর।
আমাদের দেশে পুঁজিপতিরা বড় বেশি ধান্দাবাজ, তারা সুযোগ খোঁজে কিভাবে নিজেদের যাবতীয় দায় সরকাররের ঘাড়ে চাপিয়ে টুক করে কেটে পড়া যায়- স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর নিতান্ত আক্ষেপ ছিল। মোদী যতই নেহরুর বিরোধী সাজুন না কেন, আসলে তিনিও তাকেই অনুসরণ করেছেন, কিছুটা অতিক্রমও করেছেন। ঐ একই আক্ষেপ বুকে চেপে তিনি প্রমাণ করতে চাইছেন কর্পোরেটরা দেশের জন্য অনেক কিছু করছেন- আর তাই সরকারী আর্থিক নীতিতে কর্পোরেটদেরই সর্বাধিক করছাড় দেওয়া চলছে। আন্তর্জাতিক ফিন্যান্স পূঁজির শব্দকোষে গায়ের চামড়া বলে কোনও শব্দ নেই যে!
ভারতে পুঁজিবাদের নির্দিষ্ট চেহারা
‘না ঘরকা, না ঘাটকা’ বিষয়টি শুধু জনপ্রিয় হিন্দি প্রবচন এমনটা না, আমাদের দেশের অর্থনৈতিক বিকাশের ধারা আলোচনায় একথা প্রায় সারসংক্ষেপের সমান। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ অতীত ভারতের আর্থিক কাঠামো চুরমার করে দিয়েছিল, কিন্তু নতুন কোনও কাঠামো নির্মাণ করেনি। এর কারণ তারা চিহ্নিত করেছিল এদেশ থেকে দেদার সম্পদ লুটের ব্যবস্থাটা পাকা করতে গেলে নিজেদের দেশে তারা যেমন বন্দোবস্ত গড়ে তুলেছে তা করা চলবে না। কারণ পুঁজিবাদ যেমন লুটেরা ব্যবস্থা, তেমনই তার প্রভাবে জনগণের চেতনায় আধুনিকতার অভিঘাতও খুব প্রবল। সামন্ত শাসনে শোষিতদের মতো করে আধুনিক যুগে শ্রমিক শ্রেণি শুধুই ফ্যালফ্যালে চোখে তাকিয়ে থাকে না, উন্নত পুঁজিবাদী দেশে চাকরি হারিয়ে ঘরে ফেরা শ্রমিক মার্কসের লেখা বই কিনে উত্তর খোঁজে কেন এমনটা হল। সময় এলে উপযুক্ত কায়দায় বিক্ষোভ প্রদর্শন করে, কাজের জায়গায় ইউনিয়ন গড়ে (যেমনটা ইদানিং আমেরিকায় হচ্ছে) অধিকার আদায় করে নেয়। উনবিংশ শতাব্দীর ভারতে এসব হলে আর ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদকে করে খেতে হত না। তাই আমাদের দেশ স্বাধীনতা অর্জন করেছিল কিছুটা ভ্যবাচ্যাকা অবস্থা সমেত। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বাধ্যবাধকতার কারনেই জোট-নিরপেক্ষ নীতি ছিল আমাদের দেশের জন্য যথাযথ। স্বাধীন ভারতের গর্ব হিসাবে প্রমানিত বহুকিছুর ন্যায় মোদী সেই ঐতিহ্যটুকুও বিসর্জন দিয়েছেন। লাভের হার কমতে থাকায় একবিংশ শতাব্দীর পুঁজিবাদ যখন পুনরায় নিজের লুটেরা (পড়ুন আদিম) চেহারা সামনে আনছে তখন শুধু শিকারি হলে তো চলবে না, উপযুক্ত মৃগয়াক্ষেত্রও তো চাই! আজকের ভারত হল সেই শিকার খেলার মাঠ। বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, শিল্পোৎপাদন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনা, সংস্কৃতি- সবকিছুতে উন্নত দেশগুলিতে যা কিছু বাতিল হচ্ছে তাই আমাদের দেশে নতুন যুগ বলে চালিয়ে দেওয়া শুরু হয়েছে। তাই ফ্লিপকার্ট, অ্যামাজন সহ পরিষেবাক্ষেত্রের জায়ান্টরা যখন খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেই শ্রমিকদের ন্যায্য অধিকার দিতে বাধ্য হচ্ছে সেই একই সময়ে ভারতের সংসদে আলোচনার বিষয় ‘নয়া শ্রমকোড’- অর্জিত সমস্ত অধিকার খারিজ করে দেওয়াই যার উদ্দেশ্য। ইউরোপে যখন কোভিড প্যাকেজের প্রসারণ চলছে তখন আমাদের দেশে জাতির মেরুদণ্ড সোজা রাখতে নয়া কৃষিআইনের অজুহাতে গরীব জনতার কোমর ভেঙ্গে দেওয়া হচ্ছে, রেশন ব্যবস্থা সংকুচিত হচ্ছে, জনস্বাস্থ্য, জনশিক্ষা সবকিছুই বাতিল করে দেওয়া হচ্ছে। কেউ প্রশ্ন করছে না এমনটা না, প্রশ্ন করলে দেশদ্রোহী তকমা জুটছে, তার জোরে কারাবাসও ভোগ করতে হচ্ছে- এমনকি সেই অবস্থায় মৃত্যুও ঘটছে (ফাদার স্ট্যান স্বামীর ঘটনা)।
সুতরাং আন্তর্জাতিক ফিন্যান্স ক্যাপিটাল নির্ভর আধুনিক পুঁজিবাদ যদি একটা কামান হয় তবে সেই কামানের গোলা হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছেন দুনিয়ার শ্রমজীবী মানুষ, আবার সেই গোলার আঘাতে ছিন্নভিন্ন হচ্ছেন তারাই। এর কামান চুরমার না করে দেওয়া অবধি মুক্তি নেই- এটুকুই সত্যি। বাকি যা কিছু উন্নয়নের গল্প শোনাতে চাইছে সবই আসলে মিথ্যাচার কিংবা খুব বেশি হলে, মাথায় সাপের কামড়ে মৃত্যুমুখে পতিত মানুষের পায়ে ব্যাথার মলম লাগানোর মতোই কার্যকরী।
তাই ভারতে কর্পোরেট চিনবেন কিভাবে?
এক – যারা সরকারী টাকায় জনগণের সমস্যা সমাধানের বিরোধিতা করেন, কিন্তু সেই একই টাকায় নিজেদের জন্য ঋণ নেন এবং শোধ দেন না। এরা দেশের সরকারে নিজেদের লোক ঢুকিয়ে দেন, তারা নিয়মিত সেইসব ঋণ ‘রাইট অফ’ করেন।
দুই – যারা লাভের সময় লুটে নেওয়া সম্পদের উপরে ব্যাক্তিগত মালিকানার পবিত্র কর্তব্য প্রচার করেন অথচ বাজার খারাপ গেলে বেসরকারি ক্ষতির পরিমাণকে সরকার অর্থাৎ জনগণের ঘাড়ে চাপিয়ে দেবার অর্থশাস্ত্র লেখেন।
তিন – যারা প্রতিদিন আপনাকে, আমাকে সবাইকে বোঝাতে ব্যস্ত থাকেন- মোদী হ্যায় তো মুমকিন হ্যায়।
রইল পড়ে বিজনেস স্কুলের প্রসঙ্গ!
তারা নিজেরাই ওয়েবসাইট খুলে জানিয়ে দিয়েছেন- পাঠ্যক্রমের মাধ্যমে তারা শিক্ষার্থীদের মগজে যে বিষ পুরে চলেছেন তাকে ইংরেজিতে লিখলে এমন দেখায়
Don’t sit down and wait for opportunities to come. Get up and make them!
মোদীর শাসনে ভারতের কর্পোরেটরা আর কিছু না হোক ভালো শিক্ষার্থী নিশ্চিত, একথাটুকু স্বীকার করতেই হয়।
ছবির সুত্রঃ সোশ্যাল মিডিয়া