প্রভাত পট্টনায়েক
বৈষম্যের দ্বিতীয় কারণটিও একই ধরণের। একেই মার্কস ‘পুঁজির কেন্দ্রীভবন’ বলে চিহ্নিত করেছিলেন। উৎপাদনের প্রযুক্তিগত ও কাঠামোগত উন্নতিসাধন ঘটলে ব্যবসা ক্রমশ ছোট পুঁজির ধান্দা ছেড়ে বড় পুঁজির দিকে এগিয়ে চলে। এমনটা হয় কেন? কারণ নতুন প্রযুক্তিতে উৎপাদনের ন্যুনতম খরচ জুটিয়ে কাজ চালু রাখতে পুরাতন ছোট পুঁজি আর যথেষ্ট হয় না। নতুন প্রযুক্তি উৎপাদনে বৃদ্ধির পাশাপাশি যোগান হিসাবে জরুরী পুঁজির পরিমাণও বাড়িয়ে দেয়। নতুন প্রযুক্তির জোরে উদ্বৃত্ত উৎপাদন বেড়ে গেলে সামগ্রিক উৎপাদন ব্যবস্থায় যে প্রভাব পড়ে বলে ইতিপূর্বে আমরা আলোচনা করেছি, এক্ষেত্রেও তেমনই হয়। এই সময় বর্ধিত উদ্বৃত্তের (পড়ুন মুনাফার) মালিকানা ছোট পুঁজির হাতছাড়া হয়, সেই মালিকানা দখলে আনে বড় পুঁজি। অবশ্য এমন পরিস্থিতিতেও উৎপাদন ব্যবস্থায় ছোট পুঁজি কিছু কিছু সক্রিয়তা ধরে রাখে; তাহলেও মুনাফার এক বিরাট অংশই (এমনকি যে মুনাফার উৎস ছোট ছোট পুঁজির বিনিয়োগে) বৃহৎ পুঁজির দখলে চলে যায়। মুনাফার ভাগাভাগিতে বড় পুঁজির হাতে বেশিরভাগটাই চলে যায়, আর তাই সামগ্রিক মালিক গোষ্ঠীর অন্যান্য অংশের চাইতে বড় পুঁজির সঞ্চয়ের পরিমাণেও বৃদ্ধির হার হয় বেশি। সুতরাং কেন একটি দেশের মোট সম্পদের মালিকানায় ক্রমশ বড় পুঁজির অংশিদারিত্বের অনুপাত বৃদ্ধি পায় সেকথা বুঝতে আর অসুবিধা নেই। পুঁজির কেন্দ্রীভবন সরাসরি সম্পদের মালিকানার ক্ষেত্রেও একইরকমের কেন্দ্রীভবন ঘটায়।
সঞ্চিত সম্পদের বণ্টনের কায়দায় পরিবর্তন এলে সম্পদের কেন্দ্রীভবনে যে প্রান্তিক (মার্জিনাল) পরিবর্তন ঘটে সেই প্রসঙ্গেই এতক্ষণ আমরা আলোচনার পরিসরকে সীমাবদ্ধ রেখেছি। কেউ প্রশ্ন তুলতে পারেন- বিনিয়োগের বাজারে তেজি থাকা সত্বেও প্রাপ্য আদায়ে (সুদ ও আসল মিলিয়ে) সমস্যা তৈরি হলে তখন কি হবে? অর্থাৎ, পণ্য বাজারে এসে হাজির হলেও বিকিকিনির হাটে সাধারণ চাহিদার ঘাটতি থাকলে পরিস্থিতি কি হবে? তখন লাভের হিসাব কষে যতটা সঞ্চয়ের পরিকল্পনা করা হয়েছিল প্রকৃত সঞ্চয়ের পরিমাণ তার চাইতে কম হবে। বড় পুঁজিই সর্বোচ্চ বিনিয়োগ করেছে, কিন্তু প্রত্যাশামতো লাভের হার বজায় রেখে পণ্য বিক্রি না হওয়ায় মোট সঞ্চয় কমে যাওয়ার এমন ঘটনা মালিকগোষ্ঠীর বিভিন্ন অংশের (বড়, মাঝারি ও ছোটখাটো পুঁজি) সবার উপরেই সমান প্রভাব ফেলবে। অর্থাৎ পুঁজি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বড় পুঁজি যে বাড়তি সুযোগ পায়, ঝুঁকির মুখোমুখি হওয়ার ক্ষেত্রে ব্যপারটা তেমন হয় না, তখন কিন্তু ঝুঁকির প্রভাব পড়ে সর্বস্তরে। সুতরাং উৎপাদিত পণ্য বাজারে প্রত্যাশামতো লাভ সহ বিক্রি হোক (চাহিদা যখন উপযুক্ত অবস্থায় লাভ যোগানোর অবস্থায় আছে) বা না হোক (যখন চাহিদা কম অথবা আদৌ নেই) সম্পদের কেন্দ্রীভবন ঘটেই, এবং বড় পুঁজির দিকেই তা ঘটে।
তৃতীয় যে দিকটিতে আমরা নজর দেব, তার প্রভাবে সম্পদের বন্টনে বৈষম্য আরও প্রকট চেহারা নেয়। ইতিমধ্যে আমরা বৈষম্যের অন্যতম দুটি কারণ প্রসঙ্গে কিছু আলোচনা করেছি। এবারে আমরা যে বিষয়ে কথা বলব একেই মার্কস ‘পুঁজি সঞ্চয়ের আদিম পন্থা’ বলে চিহ্নিত করেছিলেন। সেই পন্থা হল লুট। এই কায়দায় যে শুধু কৃষক পরিবারগুলির থেকে জমি কেড়ে নেওয়া হয় বা পণ্যের দাম নির্ধারণে বড় পুঁজির যথেচ্ছাচারই চলে তাই নয়, কম পয়সায় জমি কেড়ে নিয়ে সেই জমিকে নগরায়ন কিংবা শিল্পস্থাপনের জন্য ব্যবহারের সময় জমির বাজারমূল্য অনেকগুণ বাড়িয়ে নেওয়াই হল দস্তুর। জমির চরিত্র পাল্টে দিয়ে তাকে দ্বিতীয়বার বিক্রির সময় দাম বাড়িয়ে নেওয়ার ঘটনাটি অনেকটা শেয়ার বাজারে স্টক কেনাবেচার সময় কম পয়সায় কিনে বেশি দামে বেচার মতোই সরল বলে বিবেচনার ভ্রান্তি তৈরি হতে পারে। তবুও এই দুয়ের মধ্যে একটি মূলগত তফাত আছেই। স্টক মার্কেটে যেকোনো সময় ধ্বস নেমে আসতে পারে, যার ফলে সম্পদ লুটে নেওয়া (শাস্ত্রীয় বচনে যাকে ক্যাপিটাল গেইন বলে) ক্ষতিগ্রস্থ হতে পারে। জমির দামের ক্ষেত্রে সাধারনভাবে এমনটা হয় না, জমির হাতবদলের ক্ষেত্রে দামের পরিবর্তন সাধারণত একমুখী, তা শুধু বেড়েই চলে। সুতরাং আজকের পৃথিবীতেও জমি কেড়ে নেওয়ার ঘটনাকে (পড়ুন কৃষিজমিতে চাষের অধিকার উচ্ছেদ করা) পুঁজি সঞ্চয়ের আদিম পন্থা হিসাবেই বিবেচনা করতে হয়। আজ যা হয় তার সারাংশ, বাজার মূল্যের চাইতে কম দামে জমির অধিকার ছেড়ে দিতে কৃষকদের বাধ্য করা হয়, কম পয়সায় সেই জমি দখলে আনার মানেই হল বৃহৎ পুঁজির মালিকানায় সম্পদের কেন্দ্রীভবন।
বর্তমানে আরও একটি কায়দায় লুট চলছে। এতে যেন-তেন-প্রকারেণ সরকারী সম্পদকে (রাষ্ট্রায়ত্ত্ব ক্ষেত্রসমূহ) জলের দরে কিংবা সম্ভব হলে মুফতে বেসরকারিকরণ করে ফেলা হয়। আরও মজার বিষয় হল, এসবই করা হয় উন্নয়নে গতি যোগানের অজুহাতে। কেউই আসল কথাটি বলে না, উন্নয়ন মানে তো সবার সমৃদ্ধি, সর্বার্থে প্রগতি! আজকের পৃথিবীতে সম্পদের বৈষম্য নির্মাণের অন্যতম স্থপতিই হল বেসরকারিকরণ। এহেন উন্নয়নমূলক কর্মসূচিটি নিস্কন্টক রাখতেই পুঁজিকে বিবিধ পরিকল্পনা করতে হয়, এমনকি দাঙ্গা অবধি সংগঠিত করতে হয়। এমন দাঙ্গার আসল উদ্দেশ্য কি? জমি থেকে এক ধাক্কায় বিরাট সংখ্যার মানুষের উচ্ছেদ নিশ্চিত করা। এই কায়দায় উদ্ধার হওয়া জমিটুকু নামমাত্র মূল্যে দখলটাও তখন ন্যায্য! সরাসরি না হলেও, ঐ অবস্থায় জমির দাম অনেকটাই নির্ধারিত হয় পুঁজির ইচ্ছামতোই।
এই সমস্ত পথেই সম্পদের উৎকট বৈষম্য নির্মিত হয়, হয়েছে, হচ্ছে। নয়া উদারবাদী জমানায় সেই গতি আরও দ্রুত হয়েছে। মুনাফার লুট, সম্পদের লুটের পথে যেকোনো বাধাকেই এই জমানায় ব্যাক্তিমালিকানার পবিত্র মাপকাঠিতে পাপ বলে চিহ্নিত করে দূরে সরিয়ে রাখা হয়। যেন ব্যাক্তিমালিকানার অধিকারটুকু সুরক্ষিত থাকলেই সকলের কল্যাণ হবে! সকলের সম্পদ, মূলধন, অধিকার কেড়ে নিয়ে মুষ্টিমেয়র আকাশছোঁয়া উন্নতিই এই ব্যবস্থার মূল কথা।
অনুবাদঃ সৌভিক ঘোষ