Satyaki Roy

সংকটকালে একচেটিয়া পুঁজির শাসন নিরাপদ রাখার উদ্দেশ্যই ফ্যাসিবাদের আবির্ভাব

সাত্যকি রায়

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে রাশিয়ার  কাছে ফ্যাসিবাদী শক্তি  পরাস্ত হওয়ার পর বিশেষত ষাট লক্ষেরও বেশি ইহুদি নিধন  যজ্ঞের পর ইউরোপেও সাধারণভাবে পৃথিবীতে ফ্যাসিবাদ সম্পর্কে যথেষ্ট ঘৃণা তৈরি হলেও ফ্যাসিবাদ মতাদর্শ হিসেবে বিলীন হয়ে  যায়নি। একথা  ঠিক  যে ফ্যাসিবাদের কোনো সুনির্দিষ্ট মতাদর্শ নেই এবং বিভিন্ন  দেশে তার রূপ বিভিন্ন  ছিল কিন্তু এতদসত্ত্বেও ফ্যাসিবাদের আবির্ভাব ও শক্তিশালী হয়ে  ওঠার কতগুলি  মৌলিক  চরিত্র চিহ্নিত করা সম্ভব। কিছু  দেশে এই ধরণের  আন্দোলন শক্তিশালী হয়ে  ওঠে পরাজয়ের  গ্লানি থেকে পরিত্রাণের রাস্তা হিসেবে আবার কোনো শক্তিশালী উন্নত  দেশেও ফ্যাসিবাদের আবির্ভাব ঘটে। কিন্তু উন্নত অংশেও যেসব  দেশে  ফ্যাসিবাদ মাথাচাড়া দেয় তারা অপেক্ষাকৃত  পিছিয়ে পড়া  দেশ  ছিল। তিরিশের  দশকে জার্মানি ও ইতালি রাশিয়ার  পরেই ইউরোপের তুলনামূলক পিছিয়ে  পড়া  দেশ ছিল। এই অবস্থা জনিত হতাশা আবার অন্যদিকে এর থেকে  পরিত্রাণের একটা সামগ্রিক আকাঙ্ক্ষা জনমনে প্রবল  ছিল। অনেকে ফ্যাসিবাদের একটি গণ মনস্তুত্বের কথাও  বলেছেন যা নিম্নবিত্ত মানুষের হতাশা থেকে  উদ্ভূত। কিন্তু সাধারণ ভাবে বলা  যেতে পারে যে ফ্যাসিবাদ শক্তিশালী হয় পুঁজিবাদের সংকট কালে এবং একই সাথে উল্লেখযোগ্য ভাবে পুঁজিবাদের দোষগুলির থেকে পরিত্রাণের আহ্বান নিয়ে।

Capitalism is the crisis

এক্ষেত্রে লক্ষণীয় যে ফ্যাসিবাদ একটি আন্দোলন হিসেবে গড়ে  ওঠে যা পুঁজিবাদের সংকটের কথা  বললেও কখনো পুঁজির শাসন কে চ্যালেঞ্জ করে  না। এবং শুধু  তাই নয় ,গরিব  মানুষের প্রতিনিধি হিসেবে নিজেদের উপস্থিত  করলেও  কখনো  শ্রেণী সংহতিকে সহ্য  করতে  পারে না। একারণেই তা সংঘটিত শ্রমিক শ্রেণীর সমস্ত সংঘ  ও প্রতিষ্ঠানকে ভাঙতে উদ্যত হয়ে  ওঠে। এলিট সুবিধাভোগীদের বিরুদ্ধে নিপীড়িত জনতার আন্দোলন হিসেবে গড়ে  উঠলেও ক্ষমতায়  আসার  পর  তা একচেটিয়া পুঁজির সবচেয়ে  বড়  পাহারাদারে পরিণত  হয়। পৃথিবীতে পঞ্চাশ ও ষাট এর দশকে ফ্যাসিবাদী পার্টিগুলি ও সংগঠন কিছুটা ঘুমন্ত  ছিল। পুরোনো বা ধ্রুপদী ফ্যাসিবাদের পতনের  পর আবার আমরা তাঁদের উত্থান দেখতে  পেলাম সত্তরের দশকের শেষে বা আশির  দশকের সূচনায়। এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য বিন্দুটি হলো ১৯৭৩ সালে চিলিতে  জেনারেল পিনোচেতের ক্ষমতা  দখল। খেয়াল  করলে  দেখা  যাবে এই সময়টাও যুদ্ধোত্তর কালে পুঁজিবাদের নব পর্যায়ের সংকটের সূচনা। এবং তারপর  থেকেই ইউরোপের দেশে দেশে এবং উন্নয়নশীল  দেশেও  দক্ষিণপন্থার  উত্থান ঘটতে  থাকে।

ফ্যাসিবাদ শোষিত  জনতার  মধ্যে একচেটিয়া পুঁজির আধিপত্য প্রতিষ্ঠার আন্দোলন হিসেবে  দেশে  দেশে  গড়ে  ওঠে। এই আন্দোলন এক জাতীয়তাবাদের রূপরেখা গড়ে তোলে যা জাত্যাভিমান নির্ভর যা বর্ণ বা ধর্মীয় পরিচয়ের ভিত্তিতে গড়ে  ওঠে। সাধারণ  ভাবে বিভিন্ন  দেশেই ফ্যাসিবাদী আন্দোলন সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে, পরিযায়ীদের প্রতি অসহিষ্ণু এবং মহিলাদের স্বাধিকারের বিরুদ্ধে। হৃত  গৌরব  পুনরুদ্ধারের  জন্য ইতিহাসের  পুনর্নির্মাণ এই আন্দোলনের অন্যতম  প্রতিপাদ্য অথচ একই সাথে প্রযুক্তি ও বিজ্ঞানের জগতে নেতৃত্ব দেওয়ার লক্ষ্যও প্রকাশ  করে  থাকে। এই পরস্পর বিরোধী অবস্থান ও সতত পরিবর্তনশীল রাজনৈতিক  লক্ষ্যের প্রবচন গরিব নিম্নবিত্ত মানুষকে ধন্দের মধ্যে  ফেলে দেয়। খেয়াল  করলে  দেখা  যাবে যে নিম্নবিত্ত অসংগঠিত মানুষ অথবা সরকারি আমলা বা স্বনিযুক্ত মানুষ মূলত দেশে দেশে ফ্যাসিবাদের প্রধান সমর্থক হয়ে উঠেছে । সংগঠিত শ্রমিক শ্রেণী এই রাজনীতিকে বিশেষ  সমর্থন জানায়নি। জার্মানির নাৎসি পার্টির প্রায় দশ লক্ষ  সদস্যর পাঁচ শতাংশর ও কম  ছিল  শ্রমিক। অনেকের মতে নিম্নবিত্তের যে অংশটি তাঁদের আয়ে কমে  গিয়ে শ্রমিকে  পরিণত  হওয়ার আশঙ্কায় ভুগছে  তারাই এক হতাশাগ্রস্ত মনস্তত্ব থেকে  শক্তিশালী নেতার আহ্বানের অপেক্ষায়  থাকে। তারা পুঁজিবাদের শোষনের দ্বারা জর্জরিত  অথচ  শ্রমিক শ্রেণীর আধিপত্যকে পছন্দ  করেনা এই অংশের বিপুল সংখ্যক মানুষই দেশে  দেশে  ফ্যাসিবাদের সমর্থক হয়ে  উঠেছে।

মনে  রাখা  দরকার যে সত্তরের দশকের  শেষের থেকে  বিশ্ব ধণতন্ত্র  যে সংকটে নিমজ্জিত হয়েছিল তা থেকে পরিত্রান তো দূরের কথা এই সংকট প্রলম্বিত চেহারা নিয়েছে যা পুঁজিবাদের কাঠামোগত সংকট কে প্রকট  করে তুলেছে। সঙ্গে সঙ্গে প্রচলিত উদারবাদী গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক কাঠামো সম্পর্কে আস্থাও ক্রমান্বয়ে শিথিল হয়ে এসেছে কারণ  গণতান্ত্রিক কাঠামোর মধ্য দিয়ে একটি ধনী ও এলিট অংশ  লাভবান হয়েছে অথচ গরিব মানুষের  সমস্যার বিশেষ  সুরাহা হয়নি। এই পরিপ্রেক্ষিতে দেশে দেশে দক্ষিণপন্থী  রাজনীতির উত্থান ঘটে যা অদ্ভুতভাবে বৃহত্তর  শোষিত  জনতাকে শোষকের  নীতিরই সমর্থকে পরিণত করতে  পারে। ফ্যাসিবাদ শোষিত  মানুষের হতাশা ও আস্থাহীনতার বাতাবরণে শক্তিশালী  নেতৃত্বের অঙ্গীকার নিয়ে হাজির হয়।

অথচ একচেটিয়া লগ্নি পুঁজির স্বার্থে পরিচালিত অর্থনীতি মানুষের জীবনমানের কোনো উন্নতি ঘটাতে পারেনি বরং  বৈষম্য বেড়েছে পৃথিবীর জুড়ে এবং মানুষের  জীবনে কর্মহীনতা ও অনিশ্চয়তা ক্রমাগত বেড়ে চলেছে। আবার একই সাথে এই পর্যায়ে কর্পোরেটদের মুনাফা দ্রুত গতিতে বেড়েছে। এই অবস্থায়  প্রচলিত গণতান্ত্রিক কাঠামোর মাধ্যমে  বিভিন্ন অংশের মানুষের স্বার্থের সংঘাত নিরসন  ক্রমাগত কঠিন  হয়ে পড়ছে। এর আরেকটা বড় কারণ হলো দেশের সরকার আন্তর্জাতিক লগ্নি পুঁজির স্বার্থ দেশের নীতি প্রণয়নে  প্রাধান্য দিলেও তাদেরকে ক্ষমতায় আসতে হয় মানুষের ভোটে নির্বাচিত হয়ে। ফলে গণতন্ত্রের ব্যবস্থাপনা আর নয়াউদারবাদের আর্থিক নীতির টানাপোড়েন ক্রমশ  গভীর  হতে থাকে। এমতাবস্থায় গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠানগুলিকে পঙ্গু করে দেওয়া শাসক শ্রেণীর কাছে অত্যন্ত প্রয়োজনীয় হয়ে  ওঠে। একারণেই পুঁজিবাদের সংকটের সঙ্গে ফ্যাসিবাদী শক্তির উত্থানের গভীর  যোগাযোগ লক্ষ্য  করা যায় । ফ্যাসিবাদী পার্টি ও মতাদর্শের অস্তিত্ব ও প্রবণতা পুঁজিবাদী সমাজে সবসময় বিরাজমান থাকলেও শাসকশ্রেণীর প্রয়োজনীয়তা ভিত্তিক মদত না পেলে ফ্যাসিবাদী পার্টিগুলি বড়  শক্তি হিসেবে উঠে  আসতে  পারে না। প্রয়োজনীয়তা  অনুযায়ী এই শক্তিকে ব্যবহার করা হয় গণতান্ত্রিক কাঠামোকে ক্রমাগত অকেজো করে দিতে। সবসময় তা ইতালি, জার্মানি বা স্পেনের ফ্যাসিবাদের চেহারায়ে দেখা  দেবে এরকম  কোনো কথা নেই। কিন্তু মর্মবস্তুর দিক থেকে এদের লক্ষণগুলি এরকম: গণতন্ত্রকে অকেজো করে দেওয়া, রাজনৈতিক বিরোধী স্বরের কন্ঠরোধ  করা ও শত্রুতে পরিণত করা, শ্রমিক শ্রেণীর সংহতি কে খতম করা ও খোলাখুলি ভাবে বৃহৎ পুঁজির স্বার্থকে দেশ ও জাতির স্বার্থ হিসেবে উপস্থিত করা। এর জন্য কখনো পার্লামেন্ট ও অন্যান্য আইন সভাকে বাতিল করা  হয়েছে । কখনো বা এই ব্যবস্থাকে সম্পূর্ণ বন্ধ না করে অকেজো বা অপ্রাসঙ্গিক বানানোর চেষ্টা করা হতে  পারে। প্রচার  মাধ্যমকে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে এনে বিরোধী স্বর বা ভিন্নমত কে অদৃশ্য করার চেষ্টা হতে পারে। ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার ও অন্যান্য শ্রমিক সংঘ ও পার্টি গুলিকে আক্রমণ করা হতে পারে। এরই অংশ  হিসেবে বিভিন্ন দেশে কমিউনিস্টদের খুন করার ভুরি ভুরি উদাহরণ পাওয়া যাবে। এছাড়াও গণতন্ত্রে মতপ্রকাশের ভিত্তিকেই বদলে দেওয়ার প্রক্রিয়া চলতে  পারে।

কোনো একটি দেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় মানুষ অংশগ্রহণ করে এই প্রাথমিক সার্বিক বিবেচনার থেকে যে আমরা সবাই নাগরিক এবং প্রত্যেকে সমানভাবে মত প্রকাশের অধিকারী। যদি এই সম অধিকারের প্রাথমিক অঙ্গীকার থেকে সরে গিয়ে আমরা এটা মনে করতে শুরু  করি  যে এই দেশে কেবলমাত্র একটি ধর্মের মানুষের বা কোনো গোষ্ঠীর অধিকার বেশি হওয়া উচিত অথবা সংখ্যালঘুদের অধিকার কম  হওয়া উচিত তা হলে গণতন্ত্রের ভিত্তিকেই টলিয়ে দেওয়া যায়। এই সমস্ত প্রক্রিয়াকে কাজে লাগানো হয় একটাই কারণে এবং তা হলো সংকটকালে দেশি বিদেশী একচেটিয়া পুঁজির নিরাপত্তা রক্ষা করা। শ্রমজীবী মানুষের কোনো কার্যকরী প্রতিবাদ যেন  গড়ে উঠতে না পারে। আমাদের দেশে বিভিন্ন মাত্রায় এই সব প্রক্রিয়াগুলির সক্রিয়তা আমরা দেখতে  পাচ্ছি। এগুলির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ শুধুমাত্র একটি রাজনৈতিক দলকে পরাস্ত করার লক্ষ্যে সীমিত থাকলে চলবে না, আসলে এর মাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও মতাদর্শের ভিত্তিকে পরাস্ত করা দেশের গণতন্ত্র, স্বাধীনতা ও সর্বোপরি শ্রমজীবী জনতার অধিকার রক্ষার জন্য অত্যন্ত জরুরি।


শেয়ার করুন

উত্তর দিন