Idology Series 2

মতাদর্শ সিরিজ (পর্ব ২): বস্তুবাদী ও ভাববাদী দৃষ্টিভঙ্গীর বৈপরিত্য

প্রাককথন

মার্কসবাদের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ রচনা হল জার্মান ইডিওলজি। কার্ল মার্কস ও ফ্রেডরিক এঙ্গেলস- দুজনেই এ লেখার রচয়িতা। ১৮৪৫ থেকে ১৮৪৭- এই হল রচনাকাল। ১৮৪৫’র ফেব্রুয়ারিতে গিজো সরকারের ফরমানে মার্কস ফ্রান্স থেকে বিতাড়িত হয়ে ব্রাসেলস-এ থাকতে শুরু করেন। এঙ্গেলস এলেন বারমেন থেকে, ঐ একই জায়গায় অর্থাৎ ব্রাসেলস-এ। একে অন্যের সাথে আলোচনা করেই সিদ্ধান্ত হয় বিপ্লবী সর্বহারা শ্রেণীর নিজস্ব দর্শন প্রসঙ্গে স্পষ্ট কথা বলার সময় হয়েছে।

সেই পরিকল্পনারই ফলাফল দ্য জার্মান ইডিওলজি যার মুখবন্ধে লেখা হল ক্রিটিক অফ মডার্ন জার্মান ফিলোজফি। মনে হতে পারে হঠাৎ জার্মান কেন, বাদবাকি দর্শনশাস্ত্রকে কি ক্ষমা করে দেওয়া হল? আসলে সেই যুগে জার্মান দর্শন এক অভূতপূর্ব উচ্চতায় পৌঁছেছিল। একদিকে হেগেল- যিনি ছিলেন জ্ঞানচর্চার আদর্শবাদী ঐতিহ্যের শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্ব আবার দর্শনের ‘ইতিবাচক’ (পজিটিভিস্ট) ব্যখায় অনন্যকীর্তি। আরেকদিকে ফয়েরবাখ, বস্তুবাদী ধারণাকে ভিত্তি করে চিন্তালব্ধ দর্শনচর্চাকে এক বিরাট চ্যালেঞ্জের সামনে টেনে এনেছিলেন। এছাড়াও ব্রুনো বাউয়ের, ম্যাক্স স্টার্নার এদেরও নিজস্ব মতামত ছিল। কিন্তু মোটের উপরে ঐ দুটি ধারণাকে দুপ্রান্তে রেখেই জার্মান দর্শন হয়ে উঠেছিল দুনিয়াজোড়া দর্শনচর্চার ভরকেন্দ্র। কিন্তু বাস্তবজগতের ব্যাখ্যায় এহেন দর্শনের কোথাও কিছুই ছিল না। বিশুদ্ধ জ্ঞানচর্চার অজুহাতে দর্শনচর্চাকে বাস্তব দুনিয়া থেকে একেবারেই বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয়েছিল। সমাজতন্ত্র সম্পর্কে যে সকল দার্শনিকেরা নানারকম কথাবার্তা বলতেন তারা মূলত একে ইউটোপিয়া হিসাবেই তুলে ধরতেন। এইসব যাবতীয় অকেজো, বুকনিসর্বস্ব ও ভ্রান্ত দার্শনিক অবস্থানের বিরুদ্ধেই কলম ধরলেন কার্ল মার্কস ও ফ্রেডেরিক এঙ্গেলস। এই বইয়েরই শেষদিকে থিসিস অন ফয়েরবাখ শিরোনামের প্রবন্ধে সেই বিখ্যাত উক্তিটির দেখা মেলে যার ১১নং পয়েন্টে মার্কস লিখেছেন – এযাবৎকাল অবধি দার্শনিকেরা দুনিয়াটাকে শুধু ব্যখ্যাই করে গেলেন, আসল কাজ তো একে বদলানোর।

জার্মান দর্শনকে সমালোচনার মধ্যে দিয়ে তারা দুনিয়ার সার্বিক দর্শনচর্চার অন্তঃসারশুন্যতাকে তুলে ধরতে চেয়েছিলেন, আর তাই বইটির প্রথম অনুচ্ছেদের শিরোনাম ‘ইডিওলজি ইন জেনারেল, জার্মান ইডিওলজি ইন পার্টিকুলার’।

মার্কস-এঙ্গেলস যৌথ রচনার প্রথম গ্রন্থ দ্য হোলি ফ্যামিলি। জার্মান ইডিওলজি দ্বিতীয়। ঐতিহাসিক বস্তুবাদ বলতে যা কিছু বোঝানো হয় তার প্রথম ব্যাখ্যা ও প্রয়োগ দেখা যায় এই লেখাতেই। পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থার সমালোচনায় ক্যাপিটাল-এ যেসকল যুক্তি, ব্যখ্যাকে পরিপূর্ণ চেহারায় পাওয়া যায় সেই দার্শনিক যুক্তিনিষ্ঠ দৃষ্টিভঙ্গির প্রাথমিক রূপটিও এই বইতেই পাওয়া যায়। যদিও বইটি মার্কস ও এঙ্গেলসের জীবদ্দশায় প্রকাশিত হয়নি। ফ্রেডরিক এঙ্গেলসের মৃত্যুর পরে বইটির পাণ্ডুলিপি জার্মানির সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টির দপ্তরেই রয়ে যায়। বিচ্ছিন্নভাবে এই বইয়ের কিছু অংশ নানা সময়ে প্রবন্ধের আকারে প্রকাশ পেয়েছিল। ১৯৬৪ সালে মস্কো’র প্রগ্রেস পাবলিশার্স বইটির প্রথম পুর্নাঙ্গ ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশ করে।

আজকের প্রতিবেদনে জার্মান ইডিওলজি’র ভল্যুম ওয়ান থেকে দুটি অনুচ্ছেদ অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। প্রথমটির শিরোনাম ‘প্রিমাইসেস অফ দ্য মেটিরিয়ালিস্ট কনসেপশন অফ হিষ্ট্রি’, দ্বিতীয়টির- ‘দ্য এসেন্স অফ দ্য মেটিরিয়ালিস্ট কনসেপশন অফ হিষ্ট্রি, সোশ্যাল বিইং অ্যান্ড সোশ্যাল কনশাসনেস’।

কার্ল মার্কস ও ফ্রেডরিক এঙ্গেলস

মতাদর্শ প্রসঙ্গে সমালোচনার কাজ শুরু করতে গিয়ে আমরা নিজেদের পছন্দসই কোনও একটি প্রেক্ষিত কিংবা বিষয়কে বাছাই করে নিইনি। নিজেদের মতামতকে প্রতিষ্ঠা করতে সুবিধামত কোনও এক বা একাধিক দার্শনিক বক্তব্যকে আমরা নিশানা করিনি, জার্মান দর্শনের যাবতীয় মতাদর্শগত ঘরানাকেই আলোচনার ভরকেন্দ্রে বিবেচনা করে এগিয়েছি। প্রথম কথা হল মতাদর্শ বলতে অনড়, অটল কোনও দার্শনিক অবস্থানকে (ডগমা) বোঝানো হচ্ছে না। বস্তুগত পরিপ্রেক্ষিত বা বলা ভালো বাস্তব পরিস্থিতির পর্যালোচনা করতে গিয়ে যে সাধারণ সত্য সামনে চলে আসে তাকেই মতাদর্শ হিসাবে বিবেচনা করছি আমরা। ঐ বাস্তব পরিস্থিতিই ব্যক্তির চেতনায় স্বাতন্ত্র্যের উপলব্ধির জন্ম দেয়। সেই পথেই কোনও ব্যক্তির আত্মগত চিন্তা-ভাবনা ক্রমশ জীবনদর্শনের রূপ পরিগ্রহ করে। এমন অবস্থায় ব্যক্তির চিন্তা-চেতনা ও বহির্জগতকে পৃথকরূপে বিচার করে চলে না, এরা উভয়েই একে অন্যের কারণ এবং ফলাফল। সঠিক বিবেচনায় এই সত্যই সামনে আসে যে বাস্তব পরিস্থিতির প্রতিফলনেই যেমন ব্যক্তির চিন্তা-চেতনা গড়ে ওঠে তেমনই ঐ চেতনার সুবাদেই মানুষ তার চারপাশের বস্তুগত বাধ্যবাধকতার বদল ঘটায়। এদুটিই বাস্তব সত্য। এহেন পর্যালোচনার জন্য সামাজিক জীবন থেকে উৎসারিত অভিজ্ঞতাই আমাদের সহায়তা যোগায়।

যে যে প্রেক্ষিতের উপর নির্ভর করে ব্যক্তি মানুষের চেতনা নির্মিত হয় তাদের মধ্যে মানবসমাজের গুরুত্বই সর্বাগ্রে বিবেচনা করতে হবে। মানুষের সমাজ নিজেই নিজের সদস্যদের ধারণাগত বুনিয়াদ গড়ে তোলার ভিত। মানবসমাজের সাথে প্রকৃতিজগতের যে আন্তঃসম্পর্ক তাকেই সেই বুনিয়াদ বলে উপলব্ধি করতে হয়। ইতিহাসের একেকটি পর্যায়ে সেই আন্তঃসম্পর্কের একেক মাত্রা উন্মোচিত হয়, সেই অনুযায়ী নির্ধারিত হয় সামাজিক মানুষের চেতনার স্তর। উভয়ের আন্তঃসম্পর্ক প্রসঙ্গে এই আলোচনার সময় মনে রাখতে হবে ব্যক্তি মানুষ বলতে তার শারীরিক বৈশিষ্ট, তার উপরে নির্দিষ্ট ভুপ্রকৃতির প্রভাব, জলবায়ুর বৈচিত্র ইত্যাদিকে বিবেচনার অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে না। প্রকৃতিজগত ও তারই অন্তর্ভুক্ত ক্রমবিকাশমান মানবসমাজের যাবতীয় সক্রিয় কর্মকাণ্ডই ইতিহাস রচনার একমাত্র ভিত্তি।

চেতনার নিরিখে পশুদের সাথে মানুষের পার্থক্যকে চিহ্নিত করার পাশাপাশি ধর্মীয় বিশ্বাস ইত্যাদিকেও বিচারের মাপকাঠি হিসাবে ব্যবহার করা চলে। প্রাণীজগতের অন্যান্য সদস্যদের থেকে মানুষ কিভাবে নিজেদের আলাদা করতে পারল? যখন থেকে নিজেকে টিকিয়ে রাখার জন্য জরুরী সামগ্রীগুলিকে (মিনস অফ সাবসিস্টেন্স) তারা আর শুধু প্রকৃতি থেকে সংগ্রহের কাজেই সীমাবদ্ধ রইল না, সেইসকল সামগ্রীর উৎপাদন ও পুনরুৎপাদন করতে শুরু করল সেই থেকেই বাদবাকি প্রাণীদের তুলনায় মানুষের অস্তিত্ব স্বতন্ত্র্য হয়ে উঠল। এভাবেই শ্রম-বিভাজন শুরু হল এবং তারই সুবাদে মানব সমাজের কাঠামো নির্মিত হল। জীবনসংগ্রামে টিকে থাকতে জরুরী উপকরণসমূহের উৎপাদনের সাথেই তারা আরও একটি কাজ শুরু করে- নিজেদের চারপাশের বস্তুগত পরিবেশের বদল ঘটানো। সেই কারণেই ইতিহাসের একেক পর্বে মানবসমাজের চারপাশের বস্তুগত পরিবেশেরও বদল ঘটেছে। নিজেকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার সাথেই মানবসমাজ তার চারপাশের বাস্তবতারও পরিবর্তন সাধন করেছে।

জীবনোপকরণ উৎপাদনের কাজে প্রাথমিক ধাপটি ছিল প্রকৃতি থেকে আহরিত যাবতীয় কিছুর পুনরুৎপাদন করা। উৎপাদন প্রক্রিয়ার ইতিহাসে এই পর্বকে পর্যালোচনা করার সময় একে সন্তান জন্ম দেওয়ার (অর্থাৎ পরবর্তী প্রজন্ম হিসাবে নিজেদেরই পুনরুৎপাদন করা) সাথে গুলিয়ে ফেললে চলবে না। দুটি প্রক্রিয়া একই সময় থেকে কার্যকরী হয়নি। জন্ম দেওয়ার কাজটি প্রথম থেকেই চলে এসেছে, কিন্তু সমাজ বিকাশের এক বিশেষ পর্বে, ইতিহাসের একটি নির্দিষ্ট পর্যায়ে পৌঁছানর আগে অবধি প্রকৃতিজাত উপকরণসমূহের উৎপাদন ও পুনরুৎপাদন ঘটেনি।

মানব সমাজের অভ্যন্তরে যে কায়দায় কোন একক ব্যক্তি নিজের পরিচিতিকে সামনে নিয়ে আসে ইতিহাসের সেই পর্বে প্রাণীজগতের মধ্যে মানুষ নিজেদেরকে ঠিক সেভাবেই তুলে ধরেছিল। তখন থেকেই মানুষের সামাজিক অস্তিত্ব ও সামাজিক উৎপাদন প্রক্রিয়া কার্যত একাকার হয়ে যায়। সামাজিক উৎপাদন বলতে কি উৎপাদন হচ্ছে এবং কিভাবে উৎপাদন হচ্ছে দুটিকেই যুগপৎ উপলব্ধি করতে হবে। এই কারণে ব্যক্তি মানুষের সামাজিক চেতনা কার্যত সমসাময়িক ঐতিহাসিক পর্বে সামাজিক উৎপাদন প্রক্রিয়ার বস্তুগত শর্তসমূহের উপরে নির্ভর করেই গড়ে ওঠে, বিকশিত হয়।

সামাজিক উৎপাদন প্রক্রিয়া, প্রথম থেকেই মানবসমাজের কলেবর বৃদ্ধির সাথে সমানুপাতে শক্তিবৃদ্ধি করেছে। সমাজবদ্ধ মানুষ একে অন্যের সাথে ক্রমাগত বিভিন্ন মাত্রায় সংসর্গ স্থাপন করেছে, মিলন ইত্যাদি ঘটিয়েছে, অর্থাৎ শারীরিক ও মানসিক যাবতীয় সম্পর্কেরই ক্রমবিকাশ ঘটেছে। বিকশিত হওয়ার জন্য পরবর্তী যুগের উৎপাদন প্রক্রিয়াটিও যেন এমন অবস্থারই অপেক্ষায় থেকেছে। মানবিক সম্পর্কের বিকাশকেও তাই উৎপাদন প্রক্রিয়ার ক্রমবিকাশের দ্বারাই বারংবার পুনঃনির্ধারিত হতে হয়েছে। সুতরাং এ কথা বলা চলে যে একেকটি নির্দিষ্ট সামাজিক উৎপাদন প্রক্রিয়ায় সক্রিয় রূপে যুক্ত মানুষই একে অন্যের সাথে বিভিন্ন নির্দিষ্ট সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে। সেই সব যাবতীয় সম্পর্কের সম্মিলিত কাঠামোটিই বিদ্যমান সমাজ ব্যবস্থার রাজনৈতিক ও সামাজিক গঠনকে নির্ধারণ করে। বিভিন্ন সমাজ ব্যবস্থায় বিদ্যমান রাজনৈতিক ও সামাজিক কাঠামোকে উপলব্ধি করতে কোন প্রকার অলৌকিক কিংবা মনগড়া ধারণার বশবর্তী না হলেও চলে, ওই প্রসঙ্গে এতদিনকার অভিজ্ঞতালব্ধ সামাজিক চেতনাই সে কাজে যথেষ্ট ভূমিকা পালন করে। নিজেদের সমসাময়িক যুগের সামাজিক বিন্যাস ও রাজনৈতিক কাঠামোর পিছনে সক্রিয় উৎপাদন প্রক্রিয়ায় যে আসল একথা আমরা নিজেদের অভিজ্ঞতা থেকেই শিখতে পারি। নিজেদের সময়কার সমাজব্যবস্থা ও রাষ্ট্রযন্ত্রের ক্রমবিকাশকে উপলব্ধি করলেই বোঝা যায় ও দুটির সঞ্চারপথ আদৌ কোনও স্বতন্ত্র ব্যক্তিসত্ত্বার মর্জিমাফিক এগিয়ে চলে না। ব্যক্তি মানুষের ইচ্ছা কিংবা অনিচ্ছা যেমনটাই হোক না কেন, সমাজ ব্যবস্থা ও রাষ্ট্রযন্ত্রের বিকশিত হওয়ার নিজস্ব ও বস্তুগত শর্তসমূহ রয়েছেই এবং সেই সকল শর্তাবলী কার্যত ব্যক্তি মানুষের ইচ্ছানিরপেক্ষ।

মানুষের মগজে অদ্ভুত বিভিন্ন পরিকল্পনা, ধারণা, চিন্তাভাবনা সবার প্রথমে যার দ্বারা নির্ধারিত হয় তা হল বিদ্যমান সমাজব্যবস্থার মূল হিসাবে কার্যকরী উৎপাদন প্রক্রিয়ার কাঠামোটি ঠিক কোন অবস্থায় রয়েছে। এক্ষেত্রে উৎপাদন প্রক্রিয়া বলতে প্রকৃতির সাথে মানুষের যাবতীয় সম্পর্ককে বুঝতে হবে। অর্থাৎ ঐ নির্দিষ্ট পর্বে বস্তুনিষ্ঠ মানবজীবন প্রকৃতিজগতের মধ্যে নিজেকে ঠিক যতদূর মেলে ধরতে পেরেছে বা বিস্তৃত করতে পেরেছে সেটাই সামাজিক চেতনার সীমানা। চেতনাগত অবস্থার গভীরতা, চিন্তাভাবনার ব্যক্তি সহ যাবতীয় মানবিক সম্পর্কই সমসাময়িক বস্তুগত সমাজ কাঠামোকে যতদূর জানা গেছে ঠিক ততদূর অবধিই এগিয়ে নিয়ে যায়। এই উপলব্ধি যে কেবলমাত্র বস্তুগত উৎপাদনের বেলাতেই খাটে এমন না, মনোবৃত্তিজনিত কর্মকাণ্ডেও তা প্রযোজ্য হয়। যেকোনো একটি ঐতিহাসিক পর্বে বিদ্যমান সমাজের রাজনীতি, আইন-কানুন, ন্যায় অন্যায় সম্পর্কিত সামাজিক ধারনা, ধর্মীয় রীতিনীতি এমনকি যাবতীয় আধিবিদ্যক চর্চাও কার্যত তৎকালীন সমাজব্যবস্থায় বিদ্যমান বস্তুগত উৎপাদন কাঠামোরই প্রতিফলন। মনগত চেতনার জন্মদাতা মানুষ নিজেই - এ কথায় খুব একটা ভুল নেই ঠিকই, কিন্তু একথাও মনে রাখতে হবে যে সেই সৃষ্টিকার্যটি ব্যক্তি মানুষের ইচ্ছাধীন নয়। ওই কাজ সদা সর্বদা বিদ্যমান যুগের উৎপাদিকা শক্তির বিকাশের মাত্রা অনুযায়ী শর্তাধীন থাকে। মানুষকে যতদূর অব্দি সক্রিয় করে তোলে ( শারীরিক ও মানসিক উভয় দিক থেকেই) ঠিক ততদূরই মানবিক চেতনার বিস্তৃতি ঘটে। চেতনা আসলে সচেতন অস্তিত্বের সীমাবদ্ধতা। সেই অনুসারী মানুষ নিজেদের সামাজিক জীবনের বিন্যাসকে বদলাতে থাকে, তাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে থাকে। এমন এগিয়ে চলার মধ্যে দিয়েই মানুষ প্রকৃত অর্থে নিজেদের জীবনের অন্তর্নিহিত গতিময় অস্তিত্বকে মূর্ত করে তোলে। যাবতীয় দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গিতেই মানুষের চেতনা ও বস্তুগত পারিপার্শ্বিকতার মধ্যেকার সম্পর্কটি এমনভাবে প্রতিভাত হয় যেন চেতনাই হল প্রাথমিক, বস্তুজগৎ হল তারই প্রতিফলন। বাস্তবে এর ঠিক বিপরীতটিই সত্য। এ প্রসঙ্গে চোখের সাজির বৃত্তীয় গঠনের কথা উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরা যেতে পারে। প্রকৃতিকে উপলব্ধি করার সময় আমাদের চোখ একটি ক্যামেরার মতোই আচরণ করে। সামনের যেকোনও বস্তু ক্যামেরার ভিতরে থাকা পর্দায় নিজের উল্টানো প্রতিবিম্ব সৃষ্টি করে। জাগতিক সত্য সম্পর্কে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে মহত্তম দার্শনিক ভাষ্যসমূহ কার্যত সেভাবেই বস্তুজগতের উল্টানো প্রতিচ্ছবিকেই সত্য বলে তুলে ধরে।

জার্মান দর্শন বা জার্মান মতাদর্শের বেলায় এমন উপলব্ধি বিশেষভাবে প্রযোজ্য। এই দর্শনের ভাষ্যের মানব সমাজের বিকাশকে আগাগোড়া বর্ণনা করা হয়েছে স্বর্গচ্যুত হওয়ার ফলে মর্তলোকে মানুষের চলাফেরা করতে বাধ্য হওয়ার ধারণাকে ভিত্তি করে। বাস্তবে কিন্তু এর উল্টোটাই ঘটেছে। আদিম যুগ থেকে আজকের মানুষ অবধি রূপান্তরিত হওয়ার পথে মানবসমাজের সঞ্চারপথটি কার্যত পৃথিবী থেকে স্বর্গের অভিমুখে একনিষ্ঠ রয়েছে। রক্ত-মাংসের শরীরে মানুষ বলতে আজ ঠিক যেমনটা বোঝায় সেসব কারোর ইচ্ছা-অনিচ্ছা, চিন্তাভাবনা কিংবা কল্পনাশক্তির জোরে ঘটেনি। গুহা জীবন থেকে আধুনিক অবস্থা অবধি এসে পৌঁছাতে সামাজিক মানুষের সক্রিয়তাই প্রধান ভূমিকা পালন করেছে। নিজেদের চারপাশের বস্তুগত প্রেক্ষিতকে বদলের জন্য প্রয়োজনীয় সংগ্রামকে বিবেচনায় রেখেই ঐ সক্রিয়তাকে উপলব্ধি করতে হয়। অর্থাৎ ওইসব দর্শনের কেতাবে যেমনটা বলা হয়েছে কার্যক্ষেত্রে তার উল্টোটাই ঘটেছে। আধুনিকমনষ্ক চেতনার সুবাদে আদৌ আধুনিক মানুষ গড়ে ওঠেনি। আধুনিক মানুষ আসলে এক বিরামহীন, বিকাশমান সামাজিক সক্রিয়তার ফলাফল। সেই সক্রিয়তার অর্থ উন্নত জীবনযাত্রা অর্থাৎ জীবনোপকরণের নিরবিচ্ছিন্ন বিকাশ সাধনের জন্য নিরন্তর সংগ্রাম। আমাদের দর্শন বা মতাদর্শকেও সেই বিকাশমান জীবনের প্রতিবিম্ব হয়ে উঠতে হবে। মানুষের চেতনায় যে সকল অলৌকিক ঘটনাবলী কিংবা চরিত্রের উদ্ভাস হয় তারও বুনিয়াদ পারিপার্শ্বিক বস্তুগত বাধ্যবাধকতার আড়ালেই লুকিয়ে থাকে। অবাস্তব বা পরাগস্তব ব্যাখ্যা সমূহ আসলে বাস্তব পরিস্থিতি থেকে আহরিত অভিজ্ঞতাসমূহেরই প্রতিফলন। তবে অবাস্তব ভাবনার উদ্ভাবন কিভাবে ঘটে? বাস্তব অভিজ্ঞতাকে উপলব্ধি করতে গিয়ে যদি যুক্তির বদলে মনোগত ধারণাকেই ব্যখ্যার ভিত্তি করা হয় ঠিক তখনই চিন্তাভাবনার ফলাফল এমন উৎকট চেহারায় পর্যবসিত হয়। ন্যায় সম্পর্কে ধারণা, ধর্মীয় বিশ্বাস ও ওইরকম যা কিছু মানসিক কর্মকাণ্ড রয়েছে কোনোকিছুরই বস্তুনিরপেক্ষ স্বাধীন অস্তিত্ব নেই। একটু তলিয়ে ভাবলেই বোঝা যাবে ঐ ধরনের যাবতীয় আধিবিদ্যক ধ্যানধারণার পিছনে থাকা মূল ভাবনাটির নিজস্ব কোন ইতিহাস নেই। কারণ অযুক্তির শিকড় আগেও যেখানে ছিল আজও ঠিক সেভাবেই রয়েছে। অবাস্তব অস্তিত্বের শিকড় আসলে বস্তুনিরপেক্ষ চৈতন্য সম্পর্কে ভাববাদী দৃষ্টিভঙ্গি। এখানেই বস্তুবাদের সাথে ভাববাদের প্রধান পার্থক্য। বস্তুবাদ সামাজিক চৈতন্যকে বিকাশমান মানবসমাজের গতিময় অস্তিত্বের সাথে বস্তুগতরূপে সম্পৃক্ত হিসাবেই বিবেচনা করে। এর অর্থ মানবসমাজের অস্তিত্ব মানুষের নিজস্ব চৈতন্যের উপরে নির্ভর করে টিকে থাকে না বরং সামাজিক চৈতন্য ঐ সময়কালে বস্তুগত পারিপার্শ্বিক বাস্তবতার দ্বারাই শর্তাধীন থাকে। চিন্তা বনাম বস্তুর দ্বন্দ্বে বস্তুবাদ পার্থিব জগতকেই প্রাথমিক হিসাবে স্বীকৃতি দেয়, মানুষের মগজে বস্তুজগতের প্রতিফলনকেই চেতনা হিসাবে বিবেচনা করে। মানবজীবনকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ভাববাদ চেতনাগত অবস্থানকে তার বস্তুগত অস্তিত্বের বুনিয়াদ হিসাবে বিবেচনা করে, এবং এমনটা করতে গিয়েই ব্যক্তি মানুষকে সামাজিক জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন সত্ত্বারূপে বিচার করে বসে। বস্তুবাদী দর্শনে বাস্তব জগতটিই প্রধান। আলাদা আলাদা ব্যক্তির চেতনায় বিভিন্ন মাত্রায় সেই বাস্তব জগতের প্রতিফলন ঘটে। ভাববাদে একক ব্যক্তির চেতনাই মূল, বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গী সমাজবদ্ধ মানুষের যাবতীয় চেতনার সম্মিলিত রূপকেই সামাজিক চৈতন্য হিসাবে বিবেচনা করে।

মনে হতে পারে এমন পদ্ধতিতে অর্থাৎ বস্তুবাদী পর্যালোচনার ক্ষেত্রে পূর্বানুমান বা বুনিয়াদ বলতে কিছু থাকে না। বস্তু জগতের ধারাবাহিক বদল যেহেতু স্পষ্ট তাই তাকে অনিত্য বলে অনেকেই ভেবে নেয়। ব্যাপারটা আদৌ তেমন না। বস্তুবাদের বুনিয়াদ হল বাস্তবজগত এবং এই দর্শন কখনোই সেই বুনিয়াদকে পিছনে ফেলে রেখে সামনে এগোয় না। একইভাবে বলা যায় বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গির কেন্দ্রে মানুষও রয়েছে তবে সেই মানুষ বলতে সমষ্টি হতে বিচ্ছিন্ন কোনো সত্তা না - যেমনটা ভাববাদীরা বলে থাকে। বস্তুবাদ মানুষকে পর্যালোচনার সময় তাকে সমকালীন প্রকৃতিগত বাস্তবতার শর্তাধীন রেখেই আলোচনা করে, প্রকৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন করে নয়। বস্তুবাদ মানুষের সত্তাকে অনড়, অটল কোনও চিরায়ত চেতনাপিণ্ড হিসাবেও বিবেচনা করে না যা প্রথম থেকে আজ অবধি একই রকম অবস্থায় রয়েছে।  বিকাশমান, নিরন্তর পরিবর্তনশীল বস্তুজগতের সাথেই মানব চেতনারও ক্রমোত্তরণ ঘটে চলেছে। বস্তুবাদ সেই সত্যকে স্বীকৃতি দেয়। সেই বিকাশের ধারাকে বস্তুজগত দ্বারা শর্তাধীন হিসাবে বিবেচনা করে বলেই বস্তুবাদ প্রতিনিয়ত সজীব, এক প্রাণবন্ত মতাদর্শ হিসাবে সামনে আসে। এই বিবেচনাকে বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গি হিসেবে উপলব্ধি করা মাত্রই ইতিহাসের প্রকৃত স্বরূপটি একেবারে আমূল বদলে যায়। প্রত্যক্ষবাদীরা ( ইম্পিরিসিস্ট) ইতিহাসকে কেবলমাত্র অতীতের বিচ্ছিন্ন ঘটনাসমূহের পরম্পরা হিসাবে তুলে ধরে। ইতিবাচক আদর্শবাদের ( আইডিয়ালিষ্ট) পণ্ডিতরাও তার চাইতে বেশি কিছু বলতে ব্যর্থ হয়েছে।

বস্তুবাদ ইতিহাসকে নতুন আলোয় পর্যালোচনা করতে সক্ষম হয় তার কারণ এই দর্শন ইতিহাসকে বাস্তব জীবনের মাটিতে টেনে নামায়। যাবতীয় অনুমান কৌশল ও জল্পনা-কল্পনার জাল ছিঁড়ে ফেলে তাকে সমাজবিকাশের ধারার সাথে মিলিয়ে দেখতে পারে। পর্যালোচনার এই দৃষ্টিভঙ্গি বিজ্ঞানসম্মত উপলব্ধির ইতিবাচক প্রগতিকে সামনে নিয়ে আসে। অনুমানকে পিছনে ফেলে বাস্তবসম্মত ও বস্তুনিষ্ঠ যুক্তির বিবেচনায় সামাজিক মানুষের কর্মকান্ডকে বিচার-বিশ্লেষণ করে। এতেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে আদিম যুগ থেকে আধুনিক হয়ে ওঠা অভিধিক মানব সমাজ বিকাশের কোন কোন পর্যায় কিভাবে পেরিয়ে এসেছে। এতদিন সেই বিকাশকে বস্তু নিরপেক্ষ চেতনার ফলাফল হিসাবে কার্যত এক শিকড়হীন সত্ত্বা হিসাবেই বিবেচনা করা হত, এইবার বস্তুবাদের আলোকে সেই চেতনাই হয়ে ওঠে প্রকৃত জ্ঞানের ভান্ডার বিশেষ। এযাবৎকাল অবধি দর্শনের বিষয় হিসাবে বিদ্যমান বস্তুজগতের যাবতীয় প্রসঙ্গকেই তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। তাই বাস্তব দুনিয়ার প্রসঙ্গ এলেই জ্ঞানের এক বিশেষ শাখা নামে পরিচিত দর্শনশাস্ত্র নিছক ফাঁপা বুলির ন্যায় একটা কিছুতে পর্যবসিত হত। ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতাসমূহ থেকে সাধারণ জ্ঞান হিসাবে মানুষ যেটুকু যা জানতে পেরেছে সেসবই একজায়গায় নিয়ে এলে যেমনটা ঘটে দর্শনশাস্ত্র ছিল অনেকটা সেরকম খেরোর খাতা। এতে মানুষের ঐতিহাসিক বিকাশের কথা ছিল না এমন নয়, কিন্তু সেই বিকাশকে বিবেচনা করা হয়েছিল বস্তুজাপুর থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করে- চৈতন্য নামক অন্তঃসারশূন্য এক ধারনার উপরে ভিত্তি করে। সেই জন্যেই দর্শনশাস্ত্র হতে প্রাপ্ত জ্ঞান সমূহকে ইতিহাস থেকে আলাদা করে বিচার বিশ্লেষণ করতে বসলেই তা কার্যত একগোছা অকেজো বুলির সমাহার হিসাবে প্রতিভাত হত। বিদ্যমান জগৎ সম্পর্কে দর্শনশাস্ত্রের কার্যত কিছুই বলার মত ছিল না। ইতিহাসকে পরস্পর বিচ্ছিন্ন কয়েকটি ঘটনার সম্মিলিত রূপ হিসাবে তুলে ধরা ব্যতীত দর্শনের অন্য কোনও উপযোগীতা খুঁজে পাওয়া যেত না। এটাই জ্ঞানচর্চার অন্যতম ধারা হিসাবে স্বনামধন্য দর্শনশাস্ত্রের সবচেয়ে বড় সংকট ছিল ইতিহাসের একেকটি পর্যায়কে কিভাবে আরেকটির সাথে তুলনায় ভিন্ন হিসাবে বিচার করা হবে এর কোনওরকম উত্তর দিতে তা কার্যত ব্যর্থ হত। আমরা যদি জানতে চাই যে সময়কালে আমরা জীবিত রয়েছি সেই পর্বকে কি আমাদের ইতিহাস বলা যাবে নাকি পিছনে ফেলে আসা আগেকার সামাজিক অবস্থাটিকেই আমাদের ইতিহাস হিসাবে মেনে নিতে হবে? কিভাবে ইতিহাস ও বর্তমান এই দুয়ের পার্থক্য নিরূপিত হবে এ সমস্যার কোনও সমাধান করা যেত না।

মতাদর্শ বা দর্শনশাস্ত্রের সমালোচনা করতে গিয়ে কি উপায়ে আমরা সেই বাধা অতিক্রম করলাম এই মুহূর্তে তাকে সংজ্ঞায়িত করা কিছুটা দুস্কর। যদিও মূল বিষয়টির কিছুটা উল্লেখ করাই যায়। মানবসমাজের ক্রমবিকাশমান ইতিহাসের একেকটি পর্বকে আরেকটির থেকে আলাদা হিসাবে চিহ্নিতকরণের কাজে আমরা সেইদিন সফল হলাম যখন চৈতন্যের বদলে সামাজিক মানুষের বাস্তব জীবন সংগ্রামের চিত্রটি স্পষ্ট উপলব্ধি করা গেল। তখন থেকেই বিভিন্ন ঐতিহাসিক রূপান্তরের রহস্যকে বুঝতে নিছক অনুমানের বদলে মানুষের প্রকৃত অর্থাৎ বাস্তব জীবনই হয়ে উঠল ইতিহাসের মূল প্রসঙ্গ। ইতিহাসের বস্তুবাদী ব্যাখ্যার সুবাদে এক একটি ঐতিহাসিক পর্ব নিজস্ব বৈশিষ্ট্যের আলোয় ভাস্বর হয়ে উঠল, ফলে তাদের আলাদা করে চিনে নিতে আর কোনও বাধা রইল না।

   
প্রাককথন ও অনুবাদ – সৌভিক ঘোষ

শেয়ার করুন

উত্তর দিন