গত ৩ জানুয়ারি কলকাতার প্রমোদ দাশগুপ্ত ভবনে গনশক্তি পত্রিকার ৫৭তম বার্ষিকী উপলক্ষে বক্তৃতা করেন পার্টির পলিট ব্যুরো সদস্য প্রকাশ কারাত। তার সেই বক্তব্যের সম্পূর্ণ বাংলা অনুবাদ চারটি পর্বে রাজ্য ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হবে। আজ তারই দ্বিতীয় পর্ব।
নয়া উদারবাদ জনিত অর্থনৈতিক সংকট একদিকে মেহন্তি-মধ্যবিত্ত জনজীবনকে ক্রমাগত দুর্বিষহ করে তুলেছে, আরেকদিকে সেই জনরোষকে কাজে লাগিয়েই আধুনিক সাম্রাজ্যবাদ বিভিন্ন দেশে নির্বাচিত সরকারের গণতান্ত্রিক অধিকার কেড়ে নিচ্ছে। এশিয়ার দিকে নজর দিলেই আমরা সেই ঘটনা দেখতে পাচ্ছি। আফগানিস্তানে সেনা হামলা হয়েছে, ইরাকেও একই পরিস্থিতি। সরাসরি আক্রমণের মাধ্যমে দখল করে নেওয়া হচ্ছে। সিরিয়া, লিবিয়া সব জায়গায় একই কায়দায় আক্রমণ নামিয়ে আনা হয়েছে। বিভিন্ন দেশে কার্যত সিভিল ওয়ার চলছে, যার পিছনে রয়েছে সাম্রাজ্যবাদী ইন্ধন। আরব উপমহাদেশের এমন পরিস্থিতির কারনেই বহু উদ্বাস্তু মানুষ দল বেঁধে ইউরোপে চলে যেতে শুরু করেছেন। আমাদের দেশে ইদানিং অবৈধ অনুপ্রবেশকারী শব্দটি চালু হয়েছে, এই শব্দবন্ধটি আসলে ইউরোপের দক্ষিণপন্থী শাসকগোষ্ঠীর থেকেই ধার নেওয়া হয়েছে। আরব দেশগুলি থেকে সবকিছু হারিয়ে অভিবাসী হিসাবে আসা উদ্বাস্তু মানুষজনেদের ইউরোপীয় দক্ষিণপন্থা ঐ নামেই ডাকতে শুরু করেছে। হতভাগ্য মানুষের অনুপ্রবেশের ঘটনাই ইউরোপে উগ্র দক্ষিণপন্থাকে বাড়তি প্রাণশক্তির যোগান দিয়েছে। আরব ও আফ্রিকা থেকে ঘর হারানো মানুষদের দেখিয়ে তারা সংকটের পরিস্থিতির দায় উদ্বাস্তুদের ঘাড়ে চাপিয়ে দিচ্ছে। বলা হচ্ছে এদের জন্যই দেশের মধ্যে কাজের সুযোগ কমছে তাই সংকট দেখা দিয়েছে। উগ্র দক্ষিণপন্থার এহেন কায়দা অবশ্য সবটা নতুন না, কিন্তু নয়া উদারবাদী জমানায় যে সংকট সারা পৃথিবীতেই মানুষকে দিশেহারা করে দিয়েছে সেই পরিস্থিতিকেই সুযোগসন্ধানীর মত নিজেদের স্বার্থে ব্যবহারকারীর ভূমিকায় আমরা এদের মাথাচাড়া দেওয়ার অন্যতম কারণ খুঁজে পাব।
উদ্বাস্তুদের নিশানা করে শুধু যে অর্থনৈতিক দুর্দশার পরিস্থিতির দায় চাপিয়ে হচ্ছে তা নয়, প্রচার করা হচ্ছে এদের জন্যই বিদেশী সংস্কৃতি দেশীয় রুচি-মূল্যবোধকে পাল্টে দিচ্ছে। ফ্রান্স, ইতালি, জার্মানিতে এই প্রচার সবচেয়ে উগ্র চেহারা নিয়েছে। দুনিয়াজুড়ে এভাবেই ইসলামোফবিয়া ( ধর্মীয় পরিচিতি সম্পর্কে ঘৃণা প্রচার ) প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। আমাদের দেশেও সেই পন্থাই অনুসরণ করছে আরএসএস-বিজেপি। একইসাথে চলছে জাতিগত ঘৃণাপ্রচার, বর্ণভেদকে নতুন করে হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করা হচ্ছে। সুতরাং উগ্র দক্ষিণপন্থার একটি সাধারণ চরিত্র দেখতে পাওয়া যাচ্ছে, এরা প্রত্যেকেই নিজেদের দেশের ভিতরে এক অংশের মানুষকে নিশানা করছে। বহিরাগত, অবৈধ বসবাসকারী এসবই এদের রাজনীতির প্রাণকেন্দ্র। এমন রাজনীতি সমর্থন আদায় করতে সমর্থ হচ্ছে কি করে? ইতিমধ্যেই দেশে দেশে বেকারির সমস্যা, দারিদ্র্যের সমস্যা যথেষ্ট থাকায় জনসাধারণের মধ্যে অসন্তোষ ছিল, সেই ক্ষোভকেই অন্যদিকে ঘুরিয়ে দেওয়া চলছে। আমাদের দেশেও যেটুকু যা কাজের পরিসর রয়েছে তাকে ‘অনিশ্চিত’ বলতেই হয়, এধরণের কাজকে ‘গিগ’ বলা হচ্ছে। যে নামেই ডাকা হোক, আসল কথা হল নয়া-উদারবাদে যেটুকু কাজের সুযোগ থাকছে তাতে কাজের নিরাপত্তা, আয়ের নিরাপত্তা এমনকি সামাজিক নিরাপত্তা কিছুই নেই। এমন দুঃসহ পরিস্থিতি জনসাধারণকে এক মুহূর্ত অবধি বসতে দিতে চায় না, ফলে বিভিন্ন ক্ষোভের মাঝে ঐক্য নির্মাণে কিছুটা বাধা তৈরি হয়। এখানেই আমাদের চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে হবে। জনসাধারণের অসন্তোষকে সম্মিলিত ক্ষোভে সংগঠিত করার চ্যালেঞ্জ। তাই আমরা নয়া উদারবাদ জনিত অর্থনৈতিক সংকটের বিরুদ্ধে সমস্ত শক্তিকে একজায়াগায় নিয়ে আসার চেষ্টা করছি। উগ্র দক্ষিণপন্থা মানুষকে একে অন্যের থেকে বিচ্ছিন্ন রাখতে চাইছে। এই লক্ষ্যেই ধর্ম, বর্ণ- জাতিগত বিভেদকে প্রচার করা হচ্ছে। আমরা বলছি সমস্ত মানুষের জন্য সাধারণ ন্যায্য অধিকারের ভিত্তিতে সম্মিলিত লড়াই-সংগ্রামের কথা। দুই পথের পার্থক্য মতাদর্শগত, রাজনৈতিক। একদিকে শোষকের ক্ষমতা কায়েম রাখার রাজনীতি, আরেকদিকে নিপীড়িত মানুষের লড়াই। এই লড়াইতে মানুষেরই জেতার ইতিহাস রয়েছে, সেই ইতিহাসের কথা শাসকও জানে। তাই প্রতিদিন নিত্যনতুন কায়দায় জনসাধারণের ঐক্য ভাঙতে চায় তারা। ধর্মীয়, জাতিগত ঘৃণাপ্রচার সেই উদ্দেশ্যেই করা হয়।
দুনিয়াজুড়ে উগ্র দক্ষিণপন্থার রাজনৈতিক ভাষ্যেও মিল রয়েছে। ইতালির ‘ব্রাদার্স’ দল কি বলছে? তারা প্রচার করছে সমস্ত অভিবাসীদের গ্রেফতার করে নিজেদের দেশে চালান করে দেওয়া হবে। এই কথাই তারা নির্বাচনে নিজেদের প্রচারে বলেছে। আমাদের দেশে আরএসএস-বিজেপি যা বলছে তার সাথে এই কথার কার্যত কোনও তফাত নেই। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে নয়া উদারবাদ ইতিমধ্যেই শ্রমিক-মেহনতি জনতাকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে দিয়েছে। সামগ্রিক বিবেচনায় বামপন্থীদের কিছুটা দুর্বল হতে হয়েছে। দুনিয়াজুড়ে আন্তর্জাতিক লগ্নী পুঁজি নিজের দাপট নির্মাণ করেছে এরই সুবাদে। সেই সুবিধাকেই ষোল আনার উপরে আঠারো আনা কাজে লাগাতে চায় উগ্র দক্ষিণপন্থা। একাজে তারা নিজস্ব ভাষ্য নির্মাণ করেছে, সাবেক দক্ষিণপন্থার সাথে তুলনা করলে দেখা যাবে আজকের উগ্র দক্ষিণপন্থার আদবকায়দা আরও বেশি মৌলবাদী চরিত্রের। এদের রাজনীতি সর্বহারা-মেহনতি মানুষকে আক্রমণেই নিহিত থাকে, আরেকদিকে জনগণের অসন্তোষকে এরা কখনোই আন্তর্জাতিক লগ্নী পুঁজির বন্দোবস্ত কিংবা নয়া উদারবাদী পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে সক্রিয় হতে দেয় না। মেহনতি গরীব জনগণের সেই অংশ যারা কাজের খোঁজে অন্য জায়গা থেকে শহরে এসে উপস্থিত হয় তারাই উগ্র দক্ষিণপন্থী রাজনীতির ‘সফট টার্গেট’।
উগ্র দক্ষিণপন্থীদেরই একটি অংশকে নয়া ফ্যাসিবাদী বলা হচ্ছে। শুধুমাত্র পুরানো ধারণা অনুসারে এদের ফ্যসিস্ত বিবেচনা করা হচ্ছে এমনটা না। বিগত শতাব্দীতে দুটি বিশ্বযুদ্ধের মাঝে যে যে কারনে ফ্যাসিবাদের উদয় ঘটেছিল আজকের পৃথিবীতে ঠিক সেইরকম পরিস্থিতি নেই যা সাবেক ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠার পূর্বশর্ত হিসাবে কাজ করবে। অতীতের ফ্যাসিস্ত পার্টিগুলির মাথায় কোনও মহিলাকে দেখা যায় না, সাবেক ফ্যাসিবাদ মূলত পিতৃতান্ত্রিক আদবকায়দায় সক্রিয় ছিল। আজ আর তেমনটা হচ্ছে না, নয়া ফ্যাসিবাদী দলগুলির মুখ হিসাবে একাধিক মহিলাদের উপস্থিতি লক্ষ্য রাখতে হবে। আসলে ফ্যাসিবাদের শক্তিও উপলব্ধি করেছে বিগত শতাব্দীর তুলনায় আজকের দুনিয়া অনেকটা এগিয়ে গেছে, অতীতের কায়দায় আজকের পৃথিবী চলছে না। জনসাধারণকে প্রভাবিত করতে, তাদের সমর্থন আদায় করতে তাই তারা নতুন ধরণের কৌশল নিয়েছে, এমনকি কিছু ক্ষেত্রে তাদের রাজনীতিতে কতিপয় লিবারাল ধ্যানধারনাও প্রযোজ্য হচ্ছে। নয়া ফ্যাসিবাদী বলা হচ্ছে সেই জন্যই। যদিও মনে রাখতে হবে কৌশল বদলালেও নয়া ফ্যাসিবাদের মূল চরিত্র একই জায়গায় রয়েছে। পুঁজিবাদী ব্যবস্থার সংকটের পরিত্রানে দক্ষিণপন্থার চুড়ান্ত সমাধানই হল নয়া ফ্যাসিবাদের কেন্দ্রীয় রাজনীতি। শুরুতে এমন রাজনীতির প্রতি শাসক শ্রেণির কিছু দুশ্চিন্তা থাকে, তারা একেবারে গোড়া থেকেই এদের সমর্থন করতে পারে না কেননা ফ্যাসিবাদের রাজনীতি মূলত বিভ্রান্তিমূলক, দ্বৈতার্থে ব্যবহার হতে পারে এমন কিছু কথাবার্তা বলে। কিন্তু ক্রমশই শাসকশ্রেণি একথা উপলব্ধি করে নেয় পুঁজিবাদ যখন সংকটে পড়েছে, জনগণের অসন্তোষ ক্রমশ বাড়ছে সেই পরিস্থিতিতে ফ্যাসিবাদ বা নয়া ফ্যাসিবাদই হল সেই পথ যারা শাসকের স্বার্থ অক্ষুণ্ণ রাখবে। তখনই ফ্যাসিবাদ অথবা নয়া ফ্যাসিবাদের পক্ষে শাসক শ্রেণির সমর্থন মেলে, তারা বিভিন্ন প্রদেশের রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল করতে সক্ষম হয়। কেউ বলতে পারেন, আমেরিকায় তো ডোনাল্ড ট্রাম্প নির্বাচনে পরাজিত হয়েছেন, তাহলে সেই দেশে কি আধিপত্যবাদী রাজনীতির পরাজয় ঘটল না? মনে রাখতে হবে, ট্রাম্প হেরে গেছেন ঠিকই, কিন্তু তার পছন্দসই রাজনীতি এখনও আমেরিকায় যথেষ্ট সক্রিয়। আমেরিকার রিপাবলিকান পার্টি যারা চিরকালই দক্ষিণপন্থী থেকেছে তারাও এখন বদলাচ্ছে। সেই বদল ঘটছে উগ্র দক্ষিণপন্থার দিকেই। উন্নত ধনতান্ত্রিক দেশগুলির বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে সাধারণ পর্যালোচনা এটাই।
অপেক্ষাকৃত পিছিয়ে থাকা দেশগুলিতে কি অবস্থা অন্যরকম? না। অপেক্ষাকৃত দুর্বল ধনতান্ত্রিক দেশগুলিতেও সামগ্রিক বিচারে একই প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। উদাহরণ হিসাবে আমরা তিনটি দেশের কথা ভাবতে পারি। প্রথমে লাতিন আমেরিকার দেশসমুহের দিকে নজর দেওয়া যাক। দক্ষিণ আমেরিকার বৃহত্তম অর্থনীতি ব্রাজিলের। সেখানে রাষ্ট্রপতি ছিলেন জাইর বোলসেনারো। এর সম্পর্কে পরিহাস করে তাকে ডোনাল্ড ট্রাম্পেরই মদমত্ত অবতার বিশেষ বলা হয়। তার হাবভাব, নির্দেশ, রাজনীতি সবেতেই ফ্যাসিবাদের সমস্ত লক্ষণ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তিনি আমাজনের পরিবেশ রক্ষার দাবীকে কমিউনিস্টদের ষড়যন্ত্রমূলক কর্মসূচি বলে চিহ্নিত করেন। নির্বাচনে লুলা জিতেছেন ঠিকই, কিন্তু বোলসেনারো প্রায় তার সমান ভোট পেয়েছেন। অর্থাৎ বোলসেনারোর প্রতিও এক বিরাট অংশের সমর্থন রয়েছে। এমনটা ঘটছে কেন? ব্রাজিলে খৃষ্টান ধর্মের প্রভাবই সবচাইতে বেশি। খৃষ্টানদের মধ্যেই একটি অংশ আছে যারা নিজেদের ইভাঞ্জেলিক্যাল চার্চ বলে অভিহিত করে। রক্ষণশীল ক্যাথলিক চার্চের থেকেও এরা অনেক বেশি গোঁড়া ধরণের। ব্রাজিলে এদেরই প্রভাব সর্বাধিক। এই ইভাঞ্জেলিক্যাল চার্চের নিজস্ব প্রচারমাধ্যম রয়েছে, তাদের রেডিও স্টেশন আছে, নিউজ এজেন্সি আছে, টিভিতে নিজেদের চ্যানেল আছে। এরা সবাই বোলসেনারোর সমর্থক। নির্বাচনে এরা বোলসেনারোর সাথে জোটেও ছিল। বোলসেনারো বরাবরই জাতিবিদ্বেষী হিসাবে সুপরিচিত, ব্রাজিলের আদিবাসীদের যেকোনো অধিকার দেওয়ার বিরুদ্ধেও তিনি সোচ্চার ছিলেন, কালো চামড়ার মানুষের প্রতিও প্রকাশ্যে বিদ্বেষ প্রচার করেন। নির্বাচনের মধ্যেই তিনি ঘোষণা করেছিলেন ভোটে পরাজিত হলে তিনি সেনাবাহিনীর সাহায্যে ক্যু’র আহ্বান জানিয়ে ক্ষমতা দখল করবেন। তাহলে কি দেখা গেল? একদিকে একটি বিশেষ ধর্মীয় গোষ্ঠী যারা জাতিবিভাজনের নীতিতে চলে, তাদের সাথে যুক্ত হচ্ছে চূড়ান্ত প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি এবং পিছন থেকে সমর্থন জানাচ্ছে, আর্থিক ও সামরিক মদত দিতে আন্তর্জাতিক লগ্নী পুঁজির সম্মতি। এটাই আজকের উগ্র দক্ষিণপন্থা। এবার তুরস্কের প্রসঙ্গে আসা যাক। সেদেশে এরদোগান দীর্ঘদিন রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব সামলেছেন। এরা নির্বাচন জেতার মাধ্যমেই ক্ষমতায় থেকেছেন। কিন্তু সেই নির্বাচনের চেহারা কেমন? ইদানিং সেইরকম নির্বাচন আমাদের দেশেও দেখা যাচ্ছে। তুরস্কে এরদোগান বারে বারে নির্বাচনে জয়ী হন কি কায়দায়? সেই রাজনীতির নাম ইসলামিক জাতীয়তাবাদ। তুরস্ক একসময় মূলত মধ্যপ্রাচ্যের অন্যতম ধর্মনিরপেক্ষ দেশ হিসাবেই পরিচিত ছিল। কামাল আতার্তুকের নেতৃত্বে তুরস্ক নিজেকে তুলে ধরেছিল। সেদেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসে হিজাব পরে যাওয়ায় নিষেধাজ্ঞা অবধি ছিল, আজ সেসব কিছুই আর নেই। এখন তুরস্কের রাষ্ট্রপতির স্ত্রী অবধি হিজাব পরেই চলাফেরা করেন। কামাল আতার্তুকের তুরস্কের ক্রমাগত ইসলামীকরণ ঘটেছে, ধর্মনিরপেক্ষতা হারিয়েছে সেই দেশ। এরদোগানের রাজনীতি ইসলামিক জাতীয়তাবাদ। এই জাতীয়তাবাদ একদিকে ধর্মনিরপেক্ষতার বিরোধী আরেকদিকে সংখ্যালঘু কুর্দদের প্রতি ঘৃণাপ্রচার চালায়, তাদেরকেই দেশের যাবতীয় সমস্যার জন্য দায়ী করে। তুরস্কে কার্যত অভ্যন্তরীণ যুদ্ধপরিস্থিতি চলছে। এর পুরোটাই হচ্ছে সংখ্যালঘুদের নিপীড়নের প্রসঙ্গে। হাজার হাজার অধ্যাপকদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে, শেষ রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে যিনি এরদোগানের প্রতিপক্ষ ছিলেন, পাঁচ বছর হয়ে গেল তিনি জেলবন্দী হয়ে রয়েছেন। কারণ তিনি সংখ্যালঘু কুর্দদের অধিকারের পক্ষে ছিলেন। এভাবেই নির্বাচনের অধিকারকে কার্যত হরণ করে নেওয়া হয়েছে। নির্বাচন হচ্ছে এমন একটা ব্যাপার থাকছে ঠিকই কিন্তু এক বিরাট অংশের নাগরিদের ন্যায্য অধিকারটুকুই না থাকলে সেই অবস্থায় নির্বাচন কার্যত শাসকের আধিপত্যকেই পুনঃপ্রতিষ্ঠা করে। তুরস্কে ধর্মনিরপেক্ষ ব্যাক্তিবর্গকেও গ্রেপ্তার করে জেলে বন্দী রাখা হয়েছে। মজার বিষয় এখানেও শাসক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন পেয়েই নিজেকে টিকিয়ে রেখেছে। নিজেদের যুদ্ধ পরিকল্পনার সমর্থক যেকোনো দেশে এমন অগণতান্ত্রিক অবস্থা সম্পর্কে আমেরিকার কোনও উচ্চবাচ্য আগেও ছিল না, আজও নেই।
ভারতে মোদী শাসন এমনই একটা বন্দোবস্ত করতে চাইছে, কিছুটা সফলও হয়েছে।
এমন রাজনীতির তিনটি সাধারণ বৈশিষ্ট থাকে। প্রথমটি এক বিশেষ ধরণের জাতীয়তাবাদ। যারা এক দেশে বাস করেন তাদের সবাইকে অন্তর্ভুক্ত করে নয়, নির্দিষ্ট একটি জাতিসত্ত্বার পরিচিতিমূলক এক সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদ। ইংরেজিতে একেই ‘এথনো ন্যাশনালিজম’ বলা হয়। এথনো বলতে কোনও একটি নির্দিষ্ট জাতি, ধর্মীয় কিংবা সাংস্কৃতিক পরিচিতিকে নির্দেশ করা হয়। দেশের ভূগোল, ইতিহাস কিংবা জনসাধারণের সামগ্রিক পরিচিতিকে এই মতবাদে গুরুত্বহীন বিবেচনা করা হয়। এই কায়দাতেই ইতালিতে ‘ব্রাদার্স’রা বলছে ইতালীয়রা ব্যতীত আর কেউই ইতালির নাগরিক নয়। জার্মানিতে হিটলারও একই ধরণের কথাবার্তা বলেছিলেন। স্যুইডেন ও তুরস্কেও একই যুক্তিতে শাসক দেশ পরিচালনা করতে চাইছে। তুরস্কের ন্যাশনালিজমে কুর্দদের জন্য কোনও জায়গা নেই, তারা বহিরাগত, দেশবিরোধী। ভারতে সেই ন্যাশনালিজমকেই হিন্দুত্বের জাতীয়তাবাদ বলা হচ্ছে। আরএসএস-বিজেপি সেই কারনেই মুসলমান, খৃষ্টানসহ অন্যান্য সংখায়লঘুদের নাগরিক অধিকার কেড়ে নিতে চাইছে। এই মতবাদে হিন্দুরাই একমাত্র ভারতের নাগরিক হওয়ার অধিকারী, তাই তারা দেশ বলতে হিন্দুরাষ্ট্রের কথা বলে। একইসাথে তারা অন্যান্য ধর্মীয় পরিচিতির মানুষজনকে আক্রমণের লক্ষ্য হিসাবেও তুলে ধরে। এহেন জাতীয়তাবাদী তত্ত্বে ইউরোপের সাথে ভারতের রাজনীতিতে একটাই ফারাক রয়েছে। ইউরোপে বহিরাগত অভিবাসীরা বাইরে থেকেই আসতে বাধ্য হয়েছেন। ভারতে মুসলমান মানেই বহিরাগত এমনটা একেবারেই নয়। ইউরোপে কোনও দেশের মোট জনসংখ্যার খুবই অল্প একটি অংশ হিসাবে সংখ্যালঘুরা রয়েছেন। ভারতে সংখ্যালঘু মুসলমান জনসাধারণ শেষ আদমসুমারি অনুযায়ী মোট জনসংখ্যার প্রায় ১৪ শতাংশ। এই কারনেই তারা আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু।
আরএসএস-বিজেপি নিজেদের সাম্প্রদায়িক বলে না, তারা নিজেদের জাতীয়তাবাদী বলেই তুলে ধরে। হিন্দু জাতীয়তাবাদ আসলে এমন এক উৎকট ও উগ্র জাতীয়তাবাদী ধারণা যা স্বাধীনতা পরবর্তী ভারত নির্মাণের যাবতীয় বুনিয়াদী ধারণাকেই ধ্বংস করতে চায়।