সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সংগ্রামে কৃষক আন্দোলনের ভূমিকা

মূল প্রবন্ধটি পিজ্যান্টস্‌ স্ট্রাগল পত্রিকার জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি ২০২২ সংখ্যায় দ্য পিজ্যান্টস্‌ ভিক্টরি ওভার ইম্পিরিয়ালিজম শিরোনামে প্রকাশিত হয়। সেই প্রবন্ধেরই বাংলা অনুবাদ রাজ্য ওয়েবডেস্কের তরফে প্রকাশিত হল।

প্রভাত পট্টনায়েক

ইতিহাসে এমন কিছু লড়াই হয় যা নিজের তাৎক্ষনিক প্রেক্ষাপট ছাপিয়ে উঠে ভবিষ্যৎ সমাজ-রাজনীতির গতিপ্রকৃতি নির্মাণে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। এই সকল সংগ্রামে যুদ্ধরত সেনানীরাও হয়ত নিজেদের লড়াইয়ের ঐতিহাসিক গুরুত্ব সম্পর্কে যথাযথরূপে অবহিত থাকেন না। পলাশীর যুদ্ধ ছিল এমনই এক সংগ্রাম। যদিও একে সেই অর্থে সংগ্রাম বলাও চলে না যেখানে এক পক্ষের সেনাধ্যক্ষ আরেক পক্ষের উৎকোচ স্বীকার করে নিজেদের সেনাবাহিনিকে যুদ্ধক্ষেত্রে নিষ্ক্রিয় করে রাখে। পলাশীর প্রান্তরে সেইদিন যা ঘটেছিল তাতেই পৃথিবীর ইতিহাসে এক নতুন পর্যায়ের শুরু হয়।

মোদী সরকারের সাথে কৃষকদের সংগ্রামও এমনই এক যুদ্ধ। এই যুদ্ধে মোদী সরকারকে পরাজয় স্বীকার করতে হয়েছে যেমন, তেমনই গুরুত্বপূর্ণ এই সংগ্রামের মুখোমুখি লড়াইতে নয়া-উদারবাদের পিছু হাঁটার নজির। বিশ্বজূড়ে কৃষিক্ষেত্রকে দখল করাই হল নয়া-উদারবাদী কর্মকাণ্ডের এক গুরুত্বপূর্ণ কর্মসূচি। আমাদের দেশের সংসদে নয়া কৃষি আইন সেই লক্ষ্যেই প্রণীত হয়েছিল।

কৃষকদের সংগ্রাম সম্পর্কে উপরোক্ত দুটি সিদ্ধান্তই সঠিক। কিন্তু এই ঐতিহাসিক সংগ্রাম তৃতীয় আরেকটি শিক্ষাও আমাদের দেয় যা নিয়ে অপেক্ষাকৃত কম আলোচনা হয়েছে। ভারতে কৃষকদের সাম্প্রতিক লড়াই সাম্রাজ্যবাদকে এক বুনিয়াদি লড়াইতে পরাজিত করেছে। পশ্চিমী গণমাধ্যমের ভাষ্যে কৃষি আইন বাতিল প্রসঙ্গে মোদী’কে বিকট সমালোচনার মূল কারণ সেটাই।

প্রকতিজাত সম্পদ হিসাবে খাদ্য এবং যাবতীয় কাঁচামাল সহ জীবাশ্ম জ্বালানীর সবটাই যেমন নিজেদের দখলে রাখতে চায় সাম্রাজ্যবাদ, তেমনই দখল করতে চায় পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তের উর্বরা জমিও। এই লক্ষ্যেই তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিতে সহজলভ্য কৃষিজমির উপরে তার শ্যেন দৃষ্টি নিবদ্ধ, কারণ গ্রীষ্মপ্রধান অঞ্চলগুলি এমনসব ফসল উৎপাদনে সক্ষম যা পুঁজিবাদের সদর দপ্তর রয়েছে এমন দেশগুলিতে ফলে না।

ঔপনিবেশিক জমানায় মুনাফা লুটে নিতে সেইসব সদর দপ্তরগুলির হাতে একটি অমোঘ অস্ত্র ছিল। আমাদের দেশেই নির্লজ্জের ন্যায় সেই অস্ত্রের প্রয়োগ করা হয়েছে সর্বাধিক। ঔপনিবেশিক সরকারগুলির অন্যতম প্রয়োজন ছিল কর আদায় করা, সেই আদায় পুষিয়ে নেওয়া হত নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ( সেই সময় পেরিয়ে গেলে কৃষক তার জমির উপরে ন্যুনতম অধিকারটুকুও হারাত) কৃষকদের দেয় খাজনার মাধ্যমে। দেয় খাজনা মেটাতে বেনিয়াদের থেকে ঋণ নিতে কৃষকরা বাধ্য হত, সেইসব বেনিয়ারা ঋণের শর্ত হিসাবে উৎপাদিত ফসলের দাম বেঁধে দিত। ফসল উৎপাদনের পরে পূর্ব-নির্ধারিত দামেই ফসল বেচতে হত বেনিয়াদের কাছেই, কোন ফসলের চাষ করা হবে তাও তারাই নির্ধারণ করত। ফসল নির্ধারণে বিবেচিত হত বাজার-দর এবং প্রধান প্রধান লুঠেরা দেশের চাহিদা। ঠিক যেমন আফিম ব্যবসায়ীরা কৃষকদের ঋণ দেওয়ার মাধ্যমে আফিম চাষে বাধ্য করেছিল।

এই পদ্ধতিতেই দেশের ভূমিব্যবস্থাকে নিজেদের দখলে এনেছিল পুঁজিবাদ। আগে কখনো খাদ্যশস্য ব্যাতিত অন্য কিছু ফলন হয় নি এমনসব জমিতেও জবরদস্তি নীল, আফিম এবং তুলার চাষ শুরু করা হয়। এ এক চক্রাকার শোষণরীতি, একদিকে ঔপনিবেশিক শাসক জমির উপরে বিবিধ খাজনা চাপায়, তারপরে সেই খাজনা মেটাতে তাদেরই বেনিয়াদের থেকে নেওয়া ঋণের বোঝা চেপে বসে, সেই ঋণের শর্তে পূর্ব-নির্দিষ্ট কম দামে উৎপাদিত ফসল কিনে মুনাফা, আবার সেই ফসল অন্য দেশে বিক্রি করেও মুনাফা, কার্যত জমিকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা একচ্ছত্র লুটেরা কর্তৃত্ব। এভাবেই উপনিবেশগুলি থেকে লুটে নেওয়া সম্পদের একাংশ নিজেদের ব্যবহারের জন্য সঞ্চয় করে বাড়তি অংশকে ত্রিমুখী বাণিজ্যের আওতায় নিয়ে যাওয়া হয়। ত্রিমুখী বাণিজ্যকে বুঝতে আফিম যুদ্ধের বিষয়টি মনে করা যেতে পারে, একদিকে জবরদস্তি ভারতের মাটিতে আফিমের ব্যপক উৎপাদন, পরে উৎপাদিত আফিম কেনার জন্য চীনের উপরে বীভৎস চাপ দেওয়া, শেষে যুদ্ধ যার উদ্দেশ্যে চীনের সাথে ব্রিটেনের বাণিজ্য ঘাটতিকে পুষিয়ে নেওয়া। এই প্রক্রিয়ায় কৃষকেরা নির্দয় শোষণের শিকার হতেন। দীনবন্ধু মিত্রের নীলদর্পণ নাটকে সেই সময়কার শোষণ-নির্দয়তার এক অবিস্মরণীয় চিত্র ফুটিয়ে তোলা হয়েছিল, দর্শকাসনে বসে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর অবধি রাগে-ঘৃণায় নীলকর সাহেবের ভুমিকায় অভিনেতার দিকে নিজের পায়ের চটি ছুঁড়ে দিয়েছিলেন।

ভয়াবহ শোষণের এহেন নির্দিষ্ট কৌশল তৎকালীন সাম্রাজ্যবাদ আবিষ্কার করেছিল। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে খাজনা না দিলে জমির অধিকার হারানোর ভয়, খাজনা দিতে শাসকের থেকেই ঋণ, সেই ঋণের জাঁতাকলে পড়ে শাসক নির্ধারিত ফসল উৎপাদন করে তাকেই কম দামে বিক্রির বাধ্যবাধকতা – ঔপনিবেশিক শাসন শেষ হয়ে যাওয়ার পরে পুঁজিবাদ এই লুণ্ঠন প্রক্রিয়া থামাতে বাধ্য হয়। স্বাধীন সরকারগুলি নিজেদের দেশে কৃষকদের উৎপাদিত ফসলের দামে সহায়ক মূল্যের বন্দোবস্ত করে, এই রক্ষাকবচের জোরেই কৃষকেরা পুঁজিবাদী শোষণের জাঁতাকল থেকে নিজেদের সরিয়ে রাখতে সক্ষম হয়।

আজকের দুনিয়ায় খাদ্যশস্য দখল করতে পুঁজিবাদের প্রয়োজন ফুরিয়েছে, কিন্তু খাদ্যশস্য ব্যাতিত অন্যান্য অর্থকরী ফসল চাষ করতে কৃষকদের সে কিছুতেই বাধ্য করতে পারছে না। সরকার নির্ধারিত ন্যুনতম সহায়ক মূল্যের ব্যবস্থার কারনেই কৃষকেরা অর্থকরী ফসল চাষের ঝুঁকি নিতে রাজি নয়। নয়া-উদারবাদের চাপে ক্রমাগত শ্রমজীবী মানুষের প্রকৃত আয় কমছে, বাজারে চাহিদার ঘাটতি দেখা দিচ্ছে, তাতে সংকট আরও বাড়ছে। সরকারী ভাণ্ডারে খাদ্যশস্যের পাহাড় জমা হচ্ছে। এই অবস্থায় খাদ্যশস্যের বিক্রয়মূল্যে সহায়তার আইনি বন্দোবস্তটুকু ঘুচিয়ে না দেওয়া অবধি কৃষিজমিকে অন্য কাজে ব্যবহারের সুযোগ নেই। তাই সাম্রাজ্যবাদের প্রয়োজন এমন একটি বিকল্প ব্যবস্থার যাতে অর্থকরী ফসল উৎপাদনে কৃষকদের বাধ্য করা যায়।

উগ্র-জাতিয়তাবাদী মোড়কের আড়ালে মোদী সরকার প্রণীত নয়া তিন কৃষি আইন আসলে সাম্রাজ্যবাদের সেই স্বার্থকেই রক্ষা করতে চেয়েছিল। এই আইনের জোরে আমাদের দেশের কৃষিজমি এবং কৃষিব্যবস্থার উপরে কর্পোরেটদের দখলরাজ কায়েম হত। খাদ্যশস্য উৎপাদন বাতিল করে কর্পোরেটরা নিজেদের মুনাফার জন্য বিদেশের বাজারে ভালো দর পাওয়া যায় এমনসব অর্থকরী ফসল চাষে কৃষকদের বাধ্য করত, অর্থাৎ পুনরায় তৃতীয় বিশ্বের জমিকে নিজেদের মুনাফার স্বার্থে ব্যবহার করার সুযোগ পেত। সেই লক্ষ্যপূরণে সাম্রাজ্যবাদ কোন কসুর করতে বাকি রাখেনি, ন্যুনতম সহায়ক মূল্য বাতিল করে নয়া কৃষি আইনের সমর্থনে পোষা দালাল মিডিয়া থেকে শুরু করে একাধিক মেধাবৃত্তিকারদের মাঠে নামিয়েছে। এত কিছু করেও তারা ব্যর্থ হয়েছে।

Farmers of India

কৃষকদের দুর্নিবার লড়াইয়ের সামনে শেষ অবধি মোদী সরকার আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়েছে। যদিও শুধু আইন রদ করিয়ে নিশ্চয়তার স্থিতাবস্থা বজায় রাখা যাবে না বুঝেই কৃষকরা সমস্ত রকম ফসলে সারা দেশে ন্যুনতম সহায়ক মূল্যের আইনি বন্দোবস্তটি পাকাপোক্ত করার দাবী তুলেছেন। এখনও সরকারী খাদ্য প্রক্রিয়াকরণের কাজ সারা দেশের কিছু প্রান্তেই সীমাবদ্ধ রয়েছে, ন্যুনতম সহায়ক মূল্যকে উপযুক্তরূপে আইনানুগ না করা হলে দেশের কৃষকদের সর্বনাশের সম্ভাবনা রদ করা যাবে না।

মান্ডি ছাড়া অন্যত্র (ফসল কেনাবেচার বেসরকারি বাজার) ফসল বিক্রির ক্ষেত্রে সরকারী দর ব্যবস্থাকে কার্যকরী না কর হলে অবস্থা আগের মতোই রয়ে যাবে, যথাযথ নজরদারি এড়িয়ে কম দামে কৃষকদের ফসল বিক্রি করতে বাধ্য হতে হবে। তাই কৃষকদের দাবী সর্বত্রই সরকারী নজরদারি থাকতে হবে, নয়া-কৃষি আইন বাতিল না হলে সেই কাজ অসম্ভব হয়ে উঠত। ভবিষ্যতে কোন সরকার চাইলেও যাতে কৃষকদের জীবন-জীবিকার সুরক্ষাটুকু বাতিল করতে না পারে সেই আশংকা থেকেই এমএসপি (মিনিমাম সাপোর্ট প্রাইস) ব্যবস্থাকে আইনানুগ করা প্রয়োজন।

এমন আশংকার কারণ জনসাধারণের সাথে প্রতারণায় বিজেপি সরকারের বিশেষ সুনাম রয়েছে। নয়া-কৃষি আইন রদ সম্পর্কিত ঘোষণা স্বত্বেও ঘুরপথে আরও একবার ঐসকল আইনকে লাগু করতে চাইলে সেই সুযোগ রয়েছেই।

সেই বিপদের সম্ভাবনা নিয়েই এক কঠিন যুদ্ধে জয়ী হয়েছে ভারতের কৃষকেরা। এই জয়ের ফলে আমাদের দেশের গ্রীষ্মপ্রধান উর্বরা কৃষিজমি এলাকাগুলি সাম্রাজ্যবাদের হাত থেকে রক্ষা করা গেছে। এই জয়ের দুটি নির্দিষ্ট তাৎপর্য রয়েছে।

নয়া-উদারবাদের জমানায় জনসাধারণকে বিবিধ পরিচিতি এবং বিভিন্ন সংকীর্ণ দাবীর ভিত্তিতে একজোট হতে দেওয়া হয় না, জনগণের যেকোনোরকম ঐক্যই সুকৌশলে বিনষ্ট করে দেওয়া হয়। সেই উদ্দেশ্য সাধনেই মিডিয়া ও বুদ্ধিজীবীদের নিয়োগ করে রাখা হয়। কৃষকদের আন্দোলনের গোটা পর্ব জূড়ে বিভাজনের সেইসব কৌশল বারে বারে ব্যর্থ হতে দেখা গেছে। সারা দেশেই কৃষকদের লড়াইতে ব্যপক জনগণের সমর্থন গড়ে উঠেছে, নয়া-উদারনীতির বিরোধিতায় সাধারনত জনগণ পরোক্ষ প্রতিবাদে সক্রিয় হয় – এক্ষেত্রে ঘেরাও, অবস্থান, বিক্ষোভ, মিটিং – মিছিল পেরিয়ে ধর্মঘট অবধি জনগণের প্রতিরোধ আন্দোলন ক্রমশ সক্রিয় হয়েছে। বিকল্প নীতির প্রচার ও তার সমর্থনে ব্যপক জনগণকে সমবেত করে ক্ষমতা দখলের পরোক্ষ রাজনীতিতেই কৃষক আন্দোলনের অভিমুখ নিবিষ্ট থেকেছে। এহেন রণকৌশল লাতিন আমেরিকার দেশগুলিতে দেখা যায়। সেইসব দেশে গণতান্ত্রিক অধিকার সুরক্ষিত রাখতে অঙ্গীকারবদ্ধ নতুন সরকার গঠিত হলেও তারা নয়া-উদারবাদের ব্যাপক ঘেরাও’এর মুখোমুখি হয়, একাধিকবার এমন সরকাগুলিকে আন্তর্জাতিক চক্রের (কখনো ঋণ, কখনো রাজকোষীয় ঘটতি অথবা বিচ্ছিনতাবাদী আন্দোলনকে অর্থ যুগিয়ে) ফাঁদে পড়ে ক্ষমতা থেকে সরে যেতে হয়েছে।

আমাদের দেশের প্রেক্ষিতে কৃষকদের আন্দোলন-সংগ্রাম এক নতুন নজির রেখেছে। এই আন্দোলন সরাসরি বিজেপি সরকারের নীতির বিরোধিতার পাশাপাশি সরকার বদলে দিতে প্রত্যক্ষ সংগ্রামের আহ্বানও জানিয়েছে। নয়া-উদারবাদ বিরোধী আন্দোলনে এমন রণকৌশল অভূতপূর্ব।

দ্বিতীয় তাৎপর্য হল সেই প্রত্যক্ষ সংগ্রামের স্থায়িত্ব। দিল্লি শহরের প্রান্তে একটি গোটা বছর বসে থেকেছেন আন্দোলনকারী কৃষকরা। বিজয়ের লক্ষ্যে এমন বিস্ময়কর রণকুশলতা তারা কিভাবে অর্জন করলেন সেই সম্পর্কে ভবিষ্যতের গবেষকরা নিশ্চিত উৎসাহিত হবে। আপাতত সেই বিজয়ই জনগণের ভরসা।

ওয়েবডেস্কের পক্ষে অনুবাদ – সৌভিক ঘোষ


শেয়ার করুন

উত্তর দিন