Gandhi's Last Day 3

মহাত্মার শেষ দিন (৩য় পর্ব)

সৌভিক ঘোষ

শেষ দিনটি

নির্দিষ্ট দিনে নির্দিষ্ট সময়ে বিষ্ণু কারকারে বিড়লা মন্দিরের মূল ফটকের সামনে দুজনের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। নাথুরাম গডসে ২৬ শে জানুয়ারির রাতের অর্ধসমাপ্ত আলোচনা শেষ করেন এভাবে -  ‘আপ্তের স্ত্রী, সন্তানসহ পরিবার রয়েছে, তিনি বহু মানুষকে সমবেত করে হিন্দু রাষ্ট্র গঠনের কাজকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবেন। আমার কোনো পরিবার নেই,  আমি একজন বক্তা এবং লেখক - আদালতে নিজের কথা বলে আমি জজকে প্রভাবিত করতে পারবো এবং প্রচার করতে পারবো এই হত্যাকাণ্ডে আমাদের উদ্দেশ্য কত মহান। কারকারে, আপনি আগামী দিনে আমাদের প্রকাশিত খবরের কাগজটি আরো ভালো করে চালানোর কাজে মনোনিবেশ করুন এবং একইসাথে হিন্দু মহাসভার কাজকে এগিয়ে নিয়ে যান’। লম্বা ট্রেন সফরে নাথুরাম খুবই ক্লান্ত ছিলেন, আর তাই সিদ্ধান্ত হয় পরেরদিন গান্ধী হত্যার কাজকে সমাধা করা হবে। সেদিন সন্ধ্যার সময় কারকারে প্রস্তাব দেন আগামীকালের কাজের আগে আজকের সন্ধ্যাটুকু নিজেদের মনের উপরে চাপ কমাতে সিনেমা দেখতে যাওয়া হোক। গডসে এমন প্রস্তাবে বিরক্ত হন, নারায়ণ আপ্তে এবং বিষ্ণু কারকারে দুজনে সিনেমা দেখতে বেরিয়ে গেলে গডসে রেলস্টেশনের রিটায়ারিং রুমে বসে একটি বই পড়ে বাকি সময়টুকু কাটিয়ে দিলেন।

হৃদয়কে চোখ ঠার দিয়ে ঘুমে রেখে

হয়তো দুর্যোগে তৃপ্তি পেতে পারে কান;

এরকম একদিন মনে হয়েছিল -

অনেক নিকটে তবু সেই ঘোর ঘনায়েছে আজ;”

ঘড়িতে ঠিক সাড়ে তিনটে বাজলেই তার ঘুম ভেঙে যেত। এই সময়কে রাত বললে রাত, ভোর বললে ভোর - প্রতিদিন গান্ধীজীর ঘুম ভাঙার সময় ছিল এটাই। পাশেই গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে রয়েছেন মনুবহেন। কোনদিনই গান্ধীর মত সাড়ে তিনটে তার ঘুম ভাঙতো না। গান্ধী ঘুম থেকে উঠে তার কান মলে দিয়ে ঘুম ভাঙ্গিয়ে দিতেন।

সেদিনও এর ব্যাতিক্রম হয়নি।

সবে কিছুদিন হলো গান্ধী অনশন ভঙ্গ করেছেন। শরীর জুড়ে এখনো সেই ছাপ স্পষ্ট। সারা রাত জুড়ে কাশি, রাত গভীর হলে সেই কষ্ট আরো বেশি হয়। চিকিৎসকেরা পেনিসিলিন ব্যবহারের পরামর্শ দিলেও গান্ধীর মনে তখনো ঈশ্বরের ইচ্ছা এবং প্রার্থনা সম্পর্কে গভীর আস্থা। মনুবহেনের কাজ ছিল রাতে গুঁড়ো করা লবঙ্গের লজেন্স বানিয়ে রাখা আর দিনে পেনিসিলিন সেবনে গান্ধীকে অনুরোধ করে যাওয়া। যদিও গান্ধী সেইসব আদৌ পছন্দ করেন না। ততদিনে মনুবহেন মহাত্মার মেয়ে হয়ে উঠেছেন, নিজের থেকেও সামনের মানুষটার স্বাস্থ্যের প্রতি উভয়ই এক গভীর দুশ্চিন্তা ছিল।

ঘুম ভাঙার পর দাঁতন তাঁর রোজকার অভ্যাস, গান্ধী নিজের রোজকার কর্মকাণ্ডে এতটুকু নড়চড় বরদাস্ত করতে পারেন না, বিরক্ত হন - ক্ষুব্ধ হন ভীষন। প্রার্থনাসভায় অবহেলার কারণে কারোর অনুপস্থিতি তাকে ভয়ানক বিরক্ত করত। তার কাছে প্রার্থনা ছিল আত্মশুদ্ধির একমাত্র উপায়, শুধুমাত্র ঘুম ভাঙছে না বলে কেউ এ কাজে অনুপস্থিত হবে একথা তিনি সহ্য করতে পারতেন না। বিড়লা হাউজে রোজ সকালে প্রার্থনা সভা বসত, গান্ধী খেয়াল করছিলেন প্রায়ই একটি মেয়ে সেখানে বসে বসে ঢুলত। এই এ ঘটনা তার অসহ্য ছিল - সেই দিন সকালে দাঁত মাজার সময় তিনি মনুবহেনকে বলেন মেয়েটি বিড়লা হাউজ থেকে চলে যাক, তাতে উভয়পক্ষেরই মঙ্গল।

৩০শে জানুয়ারির সকালে পেয়ারেলাল এবং সেই মে দুজনকেই অনুপস্থিত দেখলেন গান্ধী - অত্যন্ত আক্ষেপের সুরে মনুবহেনকে বললেন ‘এইসব আর সহ্য হয় না। এমন আচরণ আরো সহ্য করার আগেই আশা করি ঈশ্বর আমাকে মুক্তি দেবেন।’

সামনে তখনো একটা কর্মব্যস্ত দিন। কংগ্রেসের সংবিধান রচনার কাজ শেষ করবেন ঠিক করেছেন, বিকালের দিকে বল্লভ ভাই প্যাটেলের সঙ্গে একটি গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা রয়েছে, এছাড়াও সারাদিন অবন্তী সাক্ষাৎকারের আরজি মেটাতে হবে তাকে - গান্ধী ক্লান্ত হয়ে উঠেছিলেন, সেই ক্লান্তি তার শরীর এবং মন দুইই বুঝিয়ে দিচ্ছিল।

কিছুদিন আগে অবধি তিনি বিশ্বাস করতেন জহরলাল এবং প্যাটেল দু'জনের একজনকে ভারতের রাজনীতি থেকে অবসর নেওয়া উচিত, না হলে এদের দুজনার মতান্তর, মনান্তর দেশের ভবিষ্যতের জন্য ক্ষতিকর সাব্যস্ত হবে এই ছিল তার মত। সম্প্রতি সেই ধারণা তিনি পাল্টে ফেলেছেন, এখন তার লক্ষ্য নেহরু এবং প্যাটেলের দ্বন্দ্বের সমাধান। বিকালে বল্লভভাই প্যাটেলকে তিনি সেই উদ্দেশ্যেই ডেকে পাঠিয়েছেন। এসব ভাবতে ভাবতেই আরেকবার তার কাশির দমক শুরু হল - মনুবহেন গুঁড়ো করে রাখা লবঙ্গের লজেন্সের কথা তুলতে গান্ধী তাকে থামিয়ে দিলেন ‘যদি আজ রাত অবধি বেঁচে থাকি তবে তখন এসবের বন্দোবস্ত করা যাবে নাহয়’।

নোয়াখালী থেকে ফেরার পর গান্ধী বাংলা শিখতে শুরু করেছিলেন। সকালে খবরের কাগজ পড়া এবং বাংলা ভাষা শিক্ষা এই ছিল তার রুটিন। সেদিনও এর ব্যতিক্রম হয় নি। এরপর স্নানের পালা। শরীর অত্যন্ত দুর্বল ছিল বলে শেষ কয়েক দিন তিনি একা চলাফেরা করতে পারতেন না। সেদিন স্নান সেরে তিনি নিজেই হাঁটতে হাঁটতে বাইরে এলেন, মনুবহেন উচ্ছসিত হয়ে উঠে জানালেন গান্ধীর ওজন ১০৯ পাউন্ড, তিনি অনেকটাই সেরে উঠেছেন।

ততক্ষণে কংগ্রেসের সংবিধান মুসাবিদা করার কাজ তিনি মিটিয়ে নিয়েছেন - সেই কাগজের তাড়াটি পেয়ারেলালের হাতে তুলে দিয়ে বলেছেন ‘কোথাও কোনো ফাঁক থেকে গেলে তার সংশোধন করে নাও, এই কাজে আমার যথেষ্ট শক্তিক্ষয় হয়েছে।’

দুপুরের দিকে মহাদেব দেশাই এলেন, তার সাথে দেশের পরিস্থিতি নিয়ে এক দীর্ঘ আলোচনা হল। গান্ধী আলোচনার শেষ করলেন এই বলে ‘ ... নিজেদের মধ্যে এই অশান্তি যাদবকুলের মতই ধ্বংস ডেকে আনবে একথা কেউ বুঝছেনা। আর কেউ না, আমিই এর জন্য দায়ী।... এই অশান্তি যদি আমি না মেটাতে পারি তবে চাইবো ঈশ্বর আমায় এই পৃথিবীতে আর বেশিদিন দুঃখ ভোগ করার জন্য বাঁচিয়ে রাখবেন না।’

বিকাল চারটে বেজে গেছে... সকাল থেকে যে আলোচনার জন্য তিনি উদ্বিগ্ন ছিলেন তার সময় হল। প্যাটেল নিজের মেয়েকে সাথে নিয়ে বিড়লা হাউজে এসেছেন। গান্ধী তাকে নিজের দায়িত্ব সম্পর্কে আরও সচেতন হতে বললেন। ততদিনে প্যাটেল গান্ধীর নিরাপত্তার ব্যাপারে নেওয়া সিদ্ধান্তে খুবই নিশ্চিন্ত। আলোচনার শেষে গান্ধী তাকে জানালেন তিনি এবার নেহরুর সাথে কথা বলতে চান। বিকাল পাঁচটা বেজে দশ মিনিটে প্যাটেল বিড়লা হাউজ ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন। এরপরেই তার সান্ধ্য প্রার্থনার সময় - তিনি সেই কাজে বেরোতে যাবেন এমন সময় কথিয়াওয়ার থেকে দুজন কংগ্রেস কর্মী তার সাক্ষাতের জন্য আর্জি পাঠালেন। গান্ধী উত্তরে জানালেন ‘বেঁচে থাকলে সন্ধ্যাকালীন প্রার্থনার পরে তিনি এদের সাথে দেখা করবেন।’ কেউই খেয়াল করলোনা সারাদিনে গান্ধী এই নিয়ে চারবার নিজের মৃত্যু সম্পর্কে প্রায় ভবিষ্যৎবানী করলেন। আসলে বোমা বিস্ফোরণের পরেই তিনি উপলব্ধি করেছিলেন এই পৃথিবীতে তার সময় আর বেশি নেই।

৩০ শে জানুয়ারি সকাল সকাল তিনজনে তৈরি হন, নতুন রিভলবারটা পরখ করে দেখা বাকি ছিল। মূল শহর এলাকা থেকে কিছুটা দূরে গিয়ে তিন চারটি রাউন্ড ফায়ার করে গডসে নিশ্চিন্ত হন - এই হাতিয়ার কাজের উপযুক্ত। কিছুটা আনমনা হয়েই কারকারের উদ্দেশ্যে নাথুরাম বলে ওঠেন ‘এর পরে নানা গুরুত্বপূর্ণ কাজে তোমরা আমার অনুপস্থিতি অনুভব করবে’ ; এই পরের কাজ সম্পর্কে কারকারের মনে প্রশ্ন এলেও তিনি সেকথা বলার সুযোগ পান নি, তিনজনেই চুপ করে থাকেন কিছুক্ষন। গান্ধীর শরীরে তিনি একাই গুলি চালাবেন, তবু আপ্তে এবং কারকারে’কে তিনি সেখানে উপস্থিত হতে অনুরোধ করেন, যদিও কড়া নির্দেশ দেন গুলি চালানো কিংবা অন্য কোনো কিছুই তাদের দুজনের কেউ করবেন না, মহাত্মার মৃত্যুর জন্য যাকিছু প্রয়োজন তা তিনি নিজেই করবেন।

বিকাল সাড়ে চারটে নাগাদ নাথুরাম গডসে একাই একটি ঘোড়ার গাড়ি চেপে বিড়লা হাউজে পৌঁছান। এর কিছুক্ষণ পরে একইভাবে সেখানে আসেন আপ্তে এবং কারকারে। বিকাল পাঁচটা বেজে তেরো মিনিটে গান্ধী নিজের ঘর থেকে বাইরে আসেন। অন্যান্য দিন গান্ধীর চলার পথে ভিড় সরানোর কাজ করতেন গুরু বচন সিং, যদিও সেদিনই তার সেই কাজে পৌঁছাতে কিছুটা দেরি হয়ে যায়।

ঘিরে থাকা ভিড়ের মধ্যে থেকে নাথুরাম গডসে আচমকাই গান্ধীর সামনে চলে আসেন। অত্যন্ত জোরের সাথে হাত দিয়ে ঠেলে সরিয়ে দেন এক পাশে থাকা মনুবেহেন কে, মনুবেহেন সেই ধাক্কায় মাটিতে পড়েই যাচ্ছিলেন - পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জ থেকে পরপর তিনটি গুলি ফায়ার হল। মহাত্মা মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন। এক বিশাল বৃক্ষ যেভাবে কুঠারের শেষ কোপের আঘাতে পড়ে যায়, ঠিক সেভাবেই।

আচমকা এহেন আক্রমনে চারপাশের ভিড় কিছুটা সন্ত্রস্থ হয়ে পড়ে, পরক্ষনেই কয়েকজন রক্ষী নাথুরামের উপরে ঝাঁপিয়ে পড়েন, তাকে গ্রেফতার করা হয়।

রিভলবারের মধ্যে সাতটি বুলেট ছিল, কিন্তু নাথুরাম আর একটিও বুলেট ফায়ার করেন নি।

তিনি সংকল্প করেছিলেন মহাত্মা শূন্য পৃথিবীই তার চাই। তার লক্ষ্য পূর্ণ হয়েছিল।

গোটা পৃথিবীর সকলের সাথে সেইদিন নাথুরামেরও একসময়কার একান্ত শ্রদ্ধার মানুষটি আর রইলেন না... মহাত্মা বিশ্বাস করতেন তাকে হিন্দুরাই খুন করতে চায়, যেটা তিনি কখনও জানতে পারেন নি তা হল তাঁর হত্যাকারীর নামেও ‘রাম’ রয়ে গেল।

বিড়লা হাউজের উঠোনের মাটিতে কিছুটা রক্ত, দুটি বুলেট আর মহাত্মার নিথর, রক্তাক্ত শরীরটাই পড়ে রইল ... নাথুরাম গডসে আর একটিও বুলেট ফায়ার করেন নি।

তথ্যসুত্রঃ ১) দ্য অ্যাসাসিনেশন অফ মহাত্মা গান্ধী, ট্রায়াল অ্যান্ড ভার্ডিক্ট ১৯৪৮-৪৯

দ্য হিন্দু, হিস্টোরি সিরিজ

২) দ্য লাইফ অ্যান্ড ডেথ অফ মহাত্মা গান্ধী, রুপা পাবলিকেশন্স ইন্ডিয়া প্রাইভেট লিমিঃ

রবার্ট পেইন

৩) গান্ধীজ প্যাশন, দ্য লাইফ অ্যান্ড লিগ্যাসি অফ মহাত্মা গান্ধী

স্ট্যানলি উলপার্ট


শেয়ার করুন

উত্তর দিন