Site icon CPI(M)

Stagflation In Current India: A Report

ওয়েবডেস্ক প্রতিবেদন

দেশের প্রতিটি রাজ্যই ভয়াবহ মূল্যবৃদ্ধিতে আক্রান্ত। জাতীয় পরিসংখ্যান সংস্থার অসহায় আর্তনাদ। মূল্যবৃদ্ধির হারের এই তালিকার শীর্ষে পশ্চিমবঙ্গ। দু’নম্বরে মধ্যপ্রদেশ। তিনে তেলেঙ্গানা। আর এই তিন রাজ্যে মূল্যবৃদ্ধির হার ৯ শতাংশেরও বেশি! সবচেয়ে কম কেরালায়, ৫.০৮ শতাংশ।

জাতীয় পরিসংখ্যান সংস্থার এই প্রতিবেদন প্রকাশের আগেই ক্রমবর্ধমান মূল্যবৃদ্ধিকে মানুষের জন্য ‘শ্বাসরোধকারী’বলে চিহ্নিত করেছে সিপিআই(এম)। বামদলগুলি ইতিমধ্যেই দেশব্যাপী আন্দোলনের ডাক দিয়েছে।

করোনা মহামারী’র কারনে দেশের অর্থনীতি কার্যত ধ্বসে পড়েছে। কাজ হারানো, রোজগার কমে যাওয়া এবং লকডাউন চলাকালীন বেঁচে থাকতে সঞ্চয়টুকু নিঃশেষ করতে বাধ্য মানুষের হাতে কেনার জন্য পয়সাই যদি না থাকে তাহলে বাজারে জিনিস বিকোবে কিভাবে এই সমস্যার সমাধান এখনও করতে পারেনি যোগান নির্ভর আধুনিক অর্থনীতি। উৎপাদনের বিরাট সমাহার দেখিয়ে উন্নয়নের কালোয়াতি সাজিয়ে বসে পুঁজিবাদ। সেই জয়ঢাক ফেঁসে যাওয়ায় আওয়াজ যেটুকু বেরোচ্ছে তার চোটে আর চোখ বন্ধ করেও থাকা যাচ্ছে না। মাসকাবারি দোকান-বাজারের চাপে হাঁসফাঁস করতে থাকা জনগণের প্রশ্নের সামনে পড়ে অর্থনীতিবিদেরা ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে যোগানে ঘাটতির দোহাই দিচ্ছেন। মনে রাখতে হবে এই অবস্থাতেও ভারত সরকার দেশে উৎপাদিত গম কিনে সরকারী মজুত বাড়ায় নি, অথচ দেশের বেশিরভাগ মানুষের প্রধান খাদ্যই গমজাত। সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদনটি পড়লে দেখা যাবে, এই সময়ে (এপ্রিল-২০২২) ভারতের গ্রামীণ অর্থনীতিতে পাইকারি বাজারে মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব সর্বাধিক – প্রায় ৮.৪ শতাংশ, শহরাঞ্চলে সেই হার ৭.১ শতাংশ। পশ্চিমবঙ্গের চিত্রটি আরও করুণ – এই বছরই মার্চ-এপ্রিল নাগাদ আমাদের রাজ্যের গ্রামাঞ্চলে মূল্যবৃদ্ধির হার ১০ শতাংশ ছুঁয়েছে।

বাজার খরচের চাপ নির্ধারণে কনজিউমার্স প্রাইস ইনডেক্স (CPIt ) প্রচলিত সূচক হিসাবে কাজ করে। ২০১১-১২’কে ভিত (বেস ইয়ার) হিসাবে ব্যবহার করে বর্তমানে গড় বাজার খরচকে (C0) ঐ সময়ের গড় বাজার খরচ (Ct) দিয়ে ভাগ করে শতাংশের হিসাবে আমাদের দেশে ২০২২ সালের কনজিউমার্স প্রাইস ইনডেক্স (CPIt ) নির্ধারণ করা হয়। কনজিউমার্স ফুড প্রাইস ইনডেক্স (CFPI) হল খাদ্যসামগ্রীর ক্ষেত্রে খরচ বৃদ্ধির অনুরূপ সূচক। খাদ্যসামগ্রীর বর্ধিত দাম মূল্যবৃদ্ধির প্রধান সমস্যা। 

কেন্দ্রীয় পরিসংখ্যান ও পরিকল্পনা রূপায়ন মন্ত্রক (Ministry of Statistics & Programme Implementation) নিজেরাই টুইট করে জানিয়েছে চলতি বছরে এই দুইটি সূচকেই বৃদ্ধি ঘটছে। ১২ মে, ২০২২-র সেই ট্যুইটে রিটেইলইনফ্লেশন (পাইকারি মূল্যবৃদ্ধি)-র হ্যাসট্যাগ জ্বলজ্বল করছে।

নিচের ছবিতে সেই তালিকা দেওয়া হল –

সহজ যুক্তিতে এই সমস্যার সমাধান কি?

প্রথম পর্ব

সমাধানের পূর্বে আমাদের সমস্যার মূল কোথায় তাকে চিহ্নিত করতে হয়।

পাইকারি বাজারে মূল্যবৃদ্ধির কারন একাধিক। ভারতের ক্ষেত্রে একটি সম্ভাবনা উৎপাদনে ঘাটতি– অর্থাৎ উচ্চ হারে চাহিদার অবস্থায় যোগানের ঘাটতি পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেয়, তখন পরিকাঠামো খাতসমুহে সরকারী ব্যয়বরাদ্দ বাড়িয়ে চাহিদা-যোগানের ফারাক মেটাতে হয়। এমন না হলে বাড়তি মুনাফার আশায় বেআইনি মজুতদারির সুযোগ তৈরি হবে। দ্বিতীয় সম্ভাব্য কারন নিয়ন্ত্রণহীন আমদানি-রপ্তানি, বিশেষ করে যখন অভ্যন্তরীণ বাজারে মূল্যবৃদ্ধি ক্রমশ চেপে বসছে সেই অবস্থাতেও জরুরী সামগ্রীকে নিয়ন্ত্রণের অধীনে নিয়ে না আসা।

প্রথম সম্ভাবনার আলোচনার সময় মনে রাখতে হবে সরকারের কাছে বাজারের ওঠানামার যাবতীয় তথ্য সংগ্রহে রাখার উপায় থাকায় প্রতিষেধ হিসাবে অনেকটা আগে থাকতেই গণবণ্টন ব্যবস্থা (পিডিএস)-কে আরও মজবুত করা উচিত ছিল। প্রাথমিক প্রয়োজন ছিল উপযুক্ত পরিকল্পনা মাফিক সরকারী খাদ্যপ্রক্রিয়াকরণকে খাদ্যশস্যের মজুত ও বন্টনে ব্যবহার করা। এইসবই অর্থনীতির বুনিয়াদি ধারণা, যদিও আজকের ভারতে সবকিছুকেই নতুন করে শুরু করতে চাওয়া মোদী সরকার ইকোনমিক্স’কে ‘মোদিনমিক্স’ নামক প্রহেলিকায় পরিণত করেছে। বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রীর দাম বাড়লে শুধু বড়লোকেরাই নাকি তার ফলে ক্ষতিগ্রস্থ হবেন, এটাই কেন্দ্রীয় সরকারের যুক্তি। আসলে পরিকল্পিত অর্থনীতি নয়া-উদারনীতির স্বার্থক্ষুণ্ণ করে, সবকিছুকেই খোলা বাজারের ভরসায় ছেড়ে দিয়ে সরকার নিজের দায়-দায়িত্ব এড়িয়ে যেতে চায় – একথা আর তত্ত্ব নয়, ভারতের জনসাধারণ নিজেদের প্রতিদিনকার অভিজ্ঞতায় বুঝে নিচ্ছেন। তাই দাম বাড়লেও সরকারের কিছুই করার নেই এমনটা প্রচার করে দেশের মানুষকে ভুখা পেটে দিন গুজরানে বাধ্য করতে চাইছে মোদী সরকার।

ভারত সরকার গমের রপ্তানি আপাতত বন্ধ করার ঘোষণা করেছে। খাদ্যসামগ্রীর ক্ষেত্রে এমন সিদ্ধান্ত আরও আগেই নেওয়া উচিত ছিল, বাড়তি মুনাফার বদলে প্রয়োজন ভিত্তিক ন্যুনতম বণ্টনের দায় সরকারেরই– এটুকু সত্য এড়িয়ে চলার মাশুল দিতে হচ্ছে তাদের, দাম বাড়লে নিজেদের প্রয়োজন কমিয়ে রাখতে যারা বাধ্য হন, যাদের আমরা গরীব, নিম্নবিত্ত এবং মধ্যবিত্ত বলে চিহ্নিত করি। রপ্তানি বন্ধ করলেই শুধু চলবে না, রেশন ব্যবস্থাকে আরও মজবুত করে আয়কর সীমার বাইরে থাকা প্রতিটি পরিবারের জন্য বিনামূল্যে খাদ্যসামগ্রীর আয়োজনকে সম্পূর্ণ করতে হবে।

খাদ্যসামগ্রীর দামে বিকট বৃদ্ধির প্রেক্ষাপট আলোচনায় মাথায় রাখতে হবে করোনা মহামারীর সময়ে ফুড কর্পোরেশন অফ ইন্ডিয়ার গুদামে পচতে থাকা খাদ্যশস্য কিছুতেই বণ্টন করতে রাজী হয়নি মোদী সরকার। বাজারে মন্দা জারী থাকা স্বত্বেও নিম্নবিত্ত, গরীব পরিবারগুলিকে ন্যূনতম ৭৫০০ টাকা করে মাসিক ক্যাশ ট্রান্সফারেও তারা রাজি নয়। বাজারে দাম বেড়েছে কারন মুনাফায় ঘাটতি মেটাতে দাম বাড়ানো ছাড়া অন্যকিছু পুঁজিবাদের ক্ষমতায় কুলোয় না। দেশীয় বাজারে চাহিদার ঘাটতিকে একদিকে দাম বাড়িয়ে দিয়ে আরেকদিকে বিদেশের বাজারে রপ্তানি করে পুষিয়ে নিতে চাওয়া নতুন কিছু না। এই প্রেক্ষিতেই সরকারের দায়, দায়িত্ব এবং ভূমিকা পালনের প্রসঙ্গ বিবেচনা করতে হয়। এই পর্বেই কেন্দ্রীয় সরকার পেট্রোলিয়ামজাত পণ্যের উপরে ক্রমাগত সেস, সারচার্জ ইত্যাদি চাপিয়েছে– পণ্য পরিবহন খরচ বাড়লে যে খাদ্যসামগ্রীর দামও বাড়বে এটুকু বোধহয় মোদী সরকারের অর্থনৈতিক উপদেষ্টামণ্ডলী বুঝতে পারেন নি, এখনও। অর্থমন্ত্রী নির্মলা সিতারামন বলেছিলেন পেঁয়াজের দাম বাড়লেও তার কিছু এসে যায় না কারন তিনি পেঁয়াজ খান না। প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক রান্নার গ্যাসের সিলিন্ডার, ভোজ্য তেল, আলু সহ যাবতীয় খাদ্যসামগ্রীর দাম যখন আকাশ ছুঁইছুঁই সেই অবস্থায় দেশের গরীব মানুষ কি খাবেন আর কিই বা বাদ দেবেন!

আত্মনির্ভরতার কথা ইদানিং আর খুব একটা শোনা যাচ্ছে না, আসলে মোদীর দূরদৃষ্টি অনুযায়ী আত্মনির্ভরতা অর্জন করতে গিয়েই শেষ আট বছরে কেন্দ্রীয় বাজেটে জনকল্যান খাতের যাবতীয় বরাদ্দে কাটছাঁট করা হয়েছে। এই কারনেই গ্রামীণ ভারতে কর্মসংস্থানের প্রধান ক্ষেত্র কৃষিকাজে উৎপাদন ব্যাহত হয়েছে। সেই উৎপাদন ঘাটতিই মুল্যবৃদ্ধির প্রধান কারন, একইসাথে রোজগারের সুযোগ কমে যাওয়ায় গ্রাম ভারতের এক বিশাল অংশের মানুষেরই ক্রয়ক্ষমতা কমে গেছে। পরিসংখ্যান মন্ত্রকের প্রকাশিত প্রতিবেদন এই সত্যকেই সমর্থন করছে।

কিছুদিন হল প্রধানমন্ত্রী মোদী নয়া কৃষি আইন বাতিল ঘোষণা করেছেন। সেই আইনের জোরে দেশের কৃষিব্যবস্থায় খাদ্যশস্যের বদলে অর্থকরী ফসল উৎপাদনের সুযোগ তৈরি হত, অর্থাৎ উৎপাদিত ফসলের ঘাটতি হত আরও বেশি। অর্থকরী ফসল চাষের চরিত্র অনুযায়ী কৃষিকাজে কর্মসংস্থান হত আরও কম। সুতরাং যত অপপ্রচারই চালানো হক না কেন অন্তত আগামী কয়েক দশক ভারত কৃষকদের আন্দোলনের প্রতি শুধু এই কারনেই কৃতজ্ঞতা জানাতে পারে যে সেই আন্দোলন আমাদের দেশকে এক বিরাট সংকট হতে সুরক্ষিত রেখেছে। 

এই পরিস্থিতিতে সংকট মোকাবিলায় দ্বিবিধ পদক্ষেপ প্রয়োজন, প্রথমটি নিকটতম সমস্যার সমাধানে প্রতিষেধমূলক– অর্থাৎ সংকট আরও গভীরে যাওয়ার আগেই আপৎকালীন সমাধান হিসাবে যাবতীয় নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রীকেই গণবণ্টনের আওতায় নিয়ে আসা, অন্তত পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত। বিত্তবানেদের সম্পত্তি কর বাড়িয়ে এবং কর্পোরেটদের করছাড় বন্ধ করে দিয়েই একাজে প্রয়োজনীয় বাড়তি অর্থের সংস্থান করা যায়।

দ্বিতীয়টি দীর্ঘমেয়াদী সমাধান, অভ্যন্তরীণ পরিকাঠামো খাতে ক্রমশ সরকারী ব্যয়বরাদ্দ বাড়াতে হবে। দেশীয় উৎপাদন, মানুষের ক্রয়ক্ষমতা এবং বাজারে চাহিদা বাড়াতে এর বিকল্প হয় না। যতদিন না দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা রূপায়িত হচ্ছে ততদিন অবধি সংকটে পড়া দুঃস্থ পরিবারগুলির জন্য ক্যাশ ট্রান্সফার জারী রাখতে হবে।

অর্থনীতি বিষয়ক এই সকল আলোচনা তখনই প্রাসঙ্গিক হবে যদি পরিস্থিতির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে সমস্যা সমাধানের রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকে তবেই। সংকট মোচনে আগ্রহী যে কোন সরকারকেই আজকের পরিস্থিতি অবিলম্বে নয়া-উদারবাদের নীতিসমূহ পরিত্যাগ করে বিকল্প পরিকল্পনায় মনোযোগ দিতে বাধ্য করে। ভারতে মোদী সরকারের এমন কোন সদিচ্ছা নেই। একথাও মনে রাখতে হবে যে নয়া উদারবাদের ধ্বজাধারীরা খুব সহজে ভারত সরকারকে কোনরকম উপযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করতেও দেবে না, কারন তাহলে একটা বিরাট ভূখণ্ডে তাদের ইচ্ছামতো মুনাফা লোটার বন্দোবস্ত ঘুচে যাবে। তাই আজকের ভারতে পরিস্থিতির মোকাবিলায় জনসাধারণের ভূমিকা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। নয়া-উদারবাদের জাল কেটে বেরোতে না পারলে এহেন সংকট থেকে মুক্তির কোন সুযোগই নেই, সুতরাং প্রাথমিক কর্তব্য হল এদেশে নয়া-উদারবাদের কোলের সন্তান বিজেপি’কে রাজনৈতিক ক্ষমতা থেকে উৎখাত করা। আজকের ভারতে বাঁচার জন্য জনগণের অন্য কোন পথ অবশিষ্ট নেই।

ওয়েবডেস্কের পক্ষেঃ সৌভিক ঘোষ

শেয়ার করুন