কমরেড সীতারাম ইয়েচুরির সাক্ষাতকারঃ একটি প্রতিবেদন (২য় পর্ব)

গত ৩ এবং ৪ জানুয়ারি,২০২১ সিপিআই(এম) পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটির সভা হয় কলকাতায়। এই সভায় রাজ্য কমিটির সদস্যরা ছাড়াও উপস্থিত ছিলেন পার্টির সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি। সভার শেষে দেশের বর্তমান পরিস্থিতি, অতিমারি পরিস্থিতিতে কেন্দ্রীয় এবং রাজ্য সরকারের ভূমিকা, জাতীয় অর্থনীতির অধোগতি, দিল্লিতে কৃষকদের আন্দোলন নানা প্রাসঙ্গিক এবং গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক বিষয়ে কমরেড সীতারাম ইয়েচুরির একটি সাক্ষাতকার আয়োজন করা হয় CPIM Digital’র পক্ষ থেকে।

ইংরেজি ভাষায় কমরেড সীতারাম ইয়েচুরির সাথে কথা বলেছেন কমরেড শমীক লাহিড়ী। তাদের আলোচনা পার্টি কর্মী, সমর্থক এবং সাধারণ মানুষের জানার প্রয়োজন। সেই কারনে সাক্ষাতকারের ভিডিও পার্টির ডিজিটাল মাধ্যমে ইতিমধ্যেই আপলোড করা হয়েছে। বাংলায় স্বচ্ছন্দ যারা তাদের সুবিধার্থে সেই কথোপকথনের পুর্নাঙ্গ অনুবাদ মোট তিনটি পর্বে রাজ্য পার্টির ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হবে।

দ্বিতীয় পর্ব

১১. বর্তমানে দেশের সংসদ এমনকি বিচারব্যবস্থাও এই আক্রমনের বাইরে থাকছে না…

হ্যাঁ, এটি যদিও একটি ভিন্ন আলোচনার বিষয় তাহলেও একথা মনে রাখতে হবে কোনটাই বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। গোটা দেশের উপরে কর্পোরেটদের দখল নেবার কর্মসূচিরই একটি অংশ হল এই ঘটনা। প্রধানমন্ত্রী মোদী নয়া ভারত (New India) গড়ার স্লোগান দিয়েছেন, তিনি বলছেন ৭০ বছরে যা কেউ করতে পারেনি তিনি তাই করে দেখিয়েছেন। তিনি ঠিকই বলেছেন, তবে বিপরীত অর্থে! প্রধানমন্ত্রীর চেয়ারে বসে তার পূর্বসূরিরা সকলেই কিছু না কিছু গড়তে চেয়েছেন, কিছুটা গড়েও তুলেছেন। আমরা সমালোচনা করে বলেছি যা গড়ে তোলা হয়েছে তা যথেষ্ট নয় – আরও অনেক কাজ বাকি রয়েছে। কিন্তু মোদী শুধুই ধ্বংস করেছেন, এখনও করে চলেছেন। প্রধানমন্ত্রীর পোর্টফলিও ব্যাবহার করে তার নামে ব্যাক্তিগত আমানত ( PM Cares Fund ) গড়ে তোলা হয়েছে যার কোন স্বচ্ছতা নেই, হাজার হাজআর কোটি টাকার কোন হিসাব নেই। ভারতে এমনটা আগে কখনো হয় নি। এটি সম্পূর্ণরুপে একটি রাজনৈতিক দুর্নীতি।

১২. বলা যায় সরকারের কাজকর্মে শুধু ফ্যাসিবাদের চিহ্ন দেখা যাচ্ছে তাই নয়, ফ্যাসিবাদী প্রবনতা এখন সবকিছুকেই গিলে খেতে চাইছে। একদিকে দেশের জনগণের মুখ বন্ধ করতে চাইছে সরকার, আরেকদিকে প্রতিটি সাংবিধানিক কাঠামো সংসদ, প্রশাসন এমনকি বিচারব্যবস্থাকেও নিজেদের নিয়ন্ত্রনাধীন করে তোলা হচ্ছে...

এটা বুঝতে হবে যে ফ্যাসিবাদ রাতারাতি গড়ে ওঠেনা। সরকারের বিভিন্ন পদে আসীন কিছু ব্যাক্তির একটি গোষ্ঠী হঠাৎ একদিন নিজেদের ফ্যাসিবাদী বলে ঘোষণা করবে এমন হয় না। একটি পর্যায় ধরে যাবতীয় গণতান্ত্রিক কাঠামোকে ধ্বংস করার মধ্যে দিয়েই ফ্যাসিবাদ নিজেকে প্রতিষ্ঠা করে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার অন্তর্গত কোন একটি অংশের অবৈধ কর্মকাণ্ডকে অন্য অংশগুলি নজরে রাখে, প্রয়োজনে হস্তক্ষেপ করে এবং গণতন্ত্রের ভারসাম্য বজায় রাখে। ভারতের সংবিধানে গণতান্ত্রিক কাঠামোর তিনটি মৌলিক অংশ রয়েছে। এক, গনতন্ত্রের কার্যনির্বাহী (Executives) অংশ হিসাবে সরকার; দুই, আইসভা অর্থাৎ সংসদ (Perliament) এবং তিন, বিচারব্যবস্থা (Judiciary)। এই তিন অংশই একে অন্যের থেকে স্বতন্ত্র আবার তিনটিই একে অন্যের পরিপূরক। এই ব্যবস্থার মধ্যে দিয়েই আমাদের দেশে গণতন্ত্র কাজ করে। এখন যদি সরকার একাই সর্বশক্তিমান হয়ে উঠতে চায় বা হয়ে ওঠে এবং নিজের মর্জিমাফিক সব কিছুকে নিয়ন্ত্রণ করতে থাকে তবে অন্যদুটি অংশের ধ্বংস অবশ্যম্ভাবী। সংসদের উপরে আক্রমনের কারন এটাই। দেশের সরকার সংসদকে এড়িয়ে যেতে চায়, সংসদে কোন প্রশ্ন বা আলোচনার সম্মুখীন হতে চায় না। কৃষক আন্দোলনের দাবী তিনটি নয়া কৃষি আইন বাতিল করতে হবে। এই বাতিল কারা করবে? সংসদে পাশ করা আইন বাতিল করতে পারে কেবল সংসদই – এটাই আইন। আর কারোর আইন বাতিল করার এক্তিয়ারই নেই।

১৩. আমাদের দেশের সংবিধানে এধরণের আইন বাতিল করার অন্য কোন সাংবিধানিক প্রক্রিয়া কিংবা সুযোগ নেই...

একেবারেই নেই, সংসদে কোনোরকম আলোচনা ছাড়াই সরকার এই তিনটি আইন পাশ করিয়েছে। এখন বাতিল করতে হলে পুনরায় সংসদেই আলোচনা করতে হবে। যাতে কোন আলোচনা না করা যায় কিংবা আইন বাতিল করার কোন সুযোগ না থাকে সেই উদ্দেশ্যেই সংসদের শীতকালীন অধিবেশন (Winter Session) খারিজ ঘোষণা করে দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ সরকার দেশের সংসদকেই অগ্রাহ্য করছে, এড়িয়ে যাচ্ছে।

১৪. কোভিড প্রোটোকলের নামে সংসদের অধিবেশন বাতিল করা হচ্ছে অথচ অমিত শাহ কয়েক হাজার মানুষ নিয়ে র‍্যালি করছেন...

‘হাসি’... ঠিকই, এই কারনেই আমরা শীতকালীন অধিবেশনে আলোচনার দাবী জানিয়েছিলাম। আমরা চাইছি অন্যান্য দল্গুলিও এই একই দাবী তুলুক। প্রায় এক বছর হতে চলেছে সংসদে কোন আলোচনা করার সুযোগ দেওয়া হচ্ছে না। সংবিধানের ৩৭০ নম্বর ধারা বাতিল সংক্রান্ত আপিল, সি এ এ সংক্রান্ত বিতর্ক, ইলেক্টোরাল বন্ড কোনোকিছু নিয়েই কথা বলার সুযোগ নেই। দেশের বিচারব্যবস্থা সবটাই দেখছে। তাদের তরফেও কোনো নড়াচড়া নেই। অথচ এই সময়েই কোন বিশিষ্ট সাংবাদিক কিংবা কোন অভিনেতার জামিনের আবেদনে কোর্ট তৎপরতা দেখিয়েছে। যেন এরাই বর্তমানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ – জনগণ নয়। সরকারের বিরুদ্ধে কোনোরকম আপিলই শোনা হচ্ছে না। উত্তরপ্রদেশের বিধানসভায় ‘লাভ জিহাদ’ সংক্রান্ত যে অধ্যাদেশ (Ordinance) পাশ হয়েছে তা সরাসরি দেশের সংবিধানের পরিপন্থী। দুইজন প্রাপ্তবয়স্ক ভারতীয় যদি একে অন্যকে বিবাহ করতে চান তবে ভারতে এমন কোন ব্যবস্থা নেই যা তাদের বাধা দিতে পারে। উত্তরপ্রদেশ বিধানসভার ‘লাভ জিহাদ’ সংক্রান্ত অধ্যাদেশ (Ordinance) সেই সাংবিধানিক অধিকারের বিরুদ্ধে কাজ করছে। সাধারণ অবস্থায় এমনকি আমি নিজে যখন সাংসদ ছিলাম তখনও কোথাও সংবিধানের পরিপন্থী কোন সিদ্ধান্ত নেওয়া হলে সুপ্রিম কোর্ট সেই ব্যাপারে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে (Suo Moto) হস্তক্ষেপ করত এবং সংশ্লিষ্ট ভ্রান্তি নিরসন করা হত, ভুল আইন প্রনয়ন বাতিল হত। এখন সেরকম কিছুই নেই। এমনকি জনগণের মনেও কোর্টে গিয়ে সমস্যা সমাধানে কোন উৎসাহ নেই, তারা অনুভব করেছেন কোর্টে গিয়ে কোন লাভ নেই। নির্বাচন কমিশনের ক্ষেত্রেও একই কথা বলা চলে। স্বাধীন ভারতের ইতিহাসে এই প্রথম দেশের নির্বাচন কমিশন রাজনৈতিক দলগুলির সাথে কোন আলোচনা ছাড়াই নতুন নির্বাচনী আইন প্রণয়ন করছে। এমনটা আগে কখনো হয় নি। গণতান্ত্রিক কাঠামো এবং প্রশাসনের সমস্ত প্রতিষ্ঠানগুলিই নড়বড় করছে। ইডি (Enforcement Directorate), সি বি আই ( Central Bureau of Inevstigation ) সবাইকেই এমনভাবে কাজে লাগানো হচ্ছে যেন এরা ক্ষমতাসীন দলের নিজস্ব সংস্থা। এদের সাহায্যে বিরোধীদের ভয় দেখানো হচ্ছে – ‘হয় আমাদের দলে এসো নাহলে জেলে যাও’ এই হল বার্তা। ঠিক এভাবেই ফ্যাসিবাদ নিজেকে প্রতিষ্ঠা করে।

ন্যুরেমবার্গে ‘ফ্যাসিবাদ” ঘোষণা করার আগে হিটলার এভাবেই নিজের শাসন কায়েম করেছিল। একেবারে একই কায়দায় সেখানেও নানা নয়া আইন প্রণয়নের নামে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছিল। আমাদের দেশেও এখন তাই হচ্ছে। জার্মানিতে ইহুদিদের নিশানা করা হয়েছিল, ভারতে মুসলমানেদের নিশান করা হচ্ছে। গনতন্ত্রের প্রতি শ্রদ্ধাশীল, ভারত সম্পর্কে ভালবাসা রয়েছে যাদের এবং ‘বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্যের’ যে ঐতিহ্য ভারতের চিরায়ত তার প্রতি আস্থা রয়েছে এমন সবাইকেই আজকের এই অবস্থার বিরুদ্ধে লড়াই করতে হবে।

১৫. গনতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা এবং ‘বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্য’ এগুলিই তো ভারতের বৈশিষ্ট, আমাদের ভিত্তি ...

ভারতীয় সভ্যতার ভিতই হল বিভিন্নের একত্রে মিলন। বহু ভাষা, বহু সংস্কৃতি এবং বহু দার্শনিক চিন্তার প্রয়াগক্ষেত্রই হল আমাদের ভারত। এইকারনেই ভারত সমৃদ্ধশালী। সেই মিলনের ঐতিহ্যকেই ধ্বংস করে দেওয়া চলছে। এই কথায় বিবেকানন্দের প্রসঙ্গ চলে আসবে। তিনি ব্যাখ্যা করেছিলেন যেভাবে বিভিন্ন নদী নানা পথে এগোয় কিন্তু একই সমুদ্রে এসে মিলে যায় সেভাবেই ভারতের হৃদয় একীভূত রয়েছে। হিন্দু, মুসলমান, শিখ, পার্শি, বৌদ্ধ, জৈন সবাই এমনকি নাস্তিক্যবাদীরাও (ভারতে নাস্তিকতার চর্চা সেই প্রাচীন যুগ থেকেই ছিল, আমাদের প্রাচীন সাহিত্যেই সেই প্রমান পাওয়া যায়) সবশেষে মানবিকতার সমুদ্রে এসে মিলিত হয়েছে – এটাই আমাদের ঐতিহ্য। উদাহরণ হিসাবে মনে করা যেতে পারে অমৃত নিষ্কাশনের উদ্দেশ্যে দেবতাদের পক্ষ থেকে গুরু বৃহস্পতি (যিনি নিজেই নাস্তিক)-কে দূত হিসাবে রাক্ষসদের কাছে পাঠানো হল। এর অর্থ কি? অমৃত মন্থনের কাজে সকলকেই প্রয়োজন হয়। হিন্দুত্বের নামে একটি এককেন্দ্রিক রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থ করতে গিয়ে আর এস এস সেই অনুভবকে, সেই শিক্ষাকেই ধ্বংস করতে চাইছে। আর এসএস’র হিন্দুরাষ্ট্র কোনো ধার্মিক পরিচয়ের সাথেই মেলে না। ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রী ভারতের ধারনার বিপরীতে আর এস এস’র হিন্দুরাষ্ট্র আসলে একটি চরম অসসহিষ্ণু, ফ্যাসিবাদী, ধর্মীয় অনুশাসন ভিত্তিক একটি পশ্চাদপদ দেশ।

১৬. এই অবস্থায় একটি বৃহত্তর লড়াইয়ের মঞ্চে সারা দেশের ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক শক্তিগুলির সমাবেশ ঘটানো যাবে কিভাবে?

34 years Of LeftFront 1

আমরা সেই লক্ষ্যেই কাজ করছি। দীর্ঘ নয় মাস কোভিড পরিস্থিতিতে লকডাউন চলাকালীন আমাদের সেই কাজ করতে বাধা দেওয়া হয়েছে। যদিও এই সময়েই সরকার নিজেদের যাবতীয় অগনতান্ত্রিক কাজকর্ম জারী রেখেছে। বামপন্থী দলগুলি নিজেদের মধ্যে ঐক্যমত স্থাপন করেছে। কৃষক আন্দোলনে সমর্থনে ইতিমধ্যেই এগারটি রাজনৈতিক দল সমর্থন জানিয়েছে। কিছুদিনের মধ্যেই এই লড়াইতে অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলিো নিজেদের সমর্থন জানাবে। আমাদের বার্তা স্পষ্ট – সবাইকে একজোট হয়ে ভারতকে রক্ষা করতে হবে, আজ যদি আমরা ভারতকে রক্ষা করতে না পারি তবে ভবিষ্যতে উন্নত ভারত গড়ে তোলা যাবে না।

ওয়েবডেস্কের পক্ষে সাক্ষাৎকারের অনুবাদ – সৌভিক ঘোষ

প্রথম পর্ব পড়তে লিংকে ক্লিক করুনঃ সাধারণ সম্পাদকের সাক্ষাতকার (প্রথম পর্ব)


শেয়ার করুন

উত্তর দিন