Neo Liberal Cover

আমেরিকা ফার্স্ট থেকে অনিবার্য পরাজয়ের তত্ত্ব: ঝুটের বেসাতি, দক্ষিণপন্থার রণকৌশল

টমাস কিলকাউয়ের

শেষ এক দশক যাবত দুনিয়াজুড়ে দক্ষিণপন্থা অজস্র মিথ্যা ও ঝুটা জনশ্রুতির প্রচার করেছে। সেইসব ছাইপাঁশের মধ্যে কয়েকটি অবশ্যই আলোচনার যোগ্য। দক্ষিণপন্থার প্রচারকে চিনে নিতে হয় দুভাবে। এক- এদের পেশ করা গপ্পে মাত্রা ছাড়ানো অতিকথন থাকবেই আর দুই; মতাদর্শের বিষয়ে এরা যত বেশি প্রকট, প্রচারিত ভাষ্যের আধারটি ততটাই ঝুটা বয়ানে ভরপুর। এদের মতাদর্শের আগাগোড়াই মূলত বিশ্বাসের উপরে নির্মিত, প্রাপ্ত তথ্যকে বিকৃত ভাষ্যে বয়ান করতে এরা ওস্তাদ।

উদাহরণ হিসাবে চারটি তথ্যে নজর দেওয়া যাক-

১) কর প্রসঙ্গে- ধনীরা বাড়তি হারে অনেক বেশি কর দেয়। তারা অন্যদের চাইতে বেশি ধনী- তাই রাষ্ট্র এভাবে তাদের শাস্তি দেয়। একেবারেই মিথ্যা কথা, ধনীদের থেকে বাড়তি কর আদায়ের বন্দোবস্তকেই প্রোগ্রেসিভ ট্যাক্স সিস্টেম বলে। সেই সম্পর্কে বিখ্যাত ধনকুবের ওয়ারেন বাফেট নিজেই যথেষ্ট লেখালেখি করেছেন।

২) জনকল্যাণ সম্পর্কে- রোনাল্ড রেগ্যান জমানায় এক মহিলার কথা খুব প্রচার করা হত। জনকল্যানের রানী হিসাবেই তার খ্যাতি সুবিদিত ছিল। রেগ্যান বলতেন এই মহিলা নাকি ধনীদের থেকে দেড় লক্ষ ডলার লুট করে জনকল্যানে বিলি করে দিয়েছেন। যদিও বাস্তবে এমন কেউ ছিলেনই না। লিন্ডা টেইলর নামের এক ফেরেব্বাজ মহিলা গ্রেফতার হওয়ার পরে জানা যায় ইনিই সেই প্রখ্যাত লেডি। যদিও দেড় লক্ষ না, লিন্ডা চুরি করেছিলেন মাত্র আট হাজার ডলার। সেই অপরাধে লিন্ডা’র জেলও হয়েছিল।

৩) বাজার প্রসঙ্গে- বাজারকে আবর্ত করেই দক্ষিণপন্থা নিজের সাধের তত্ত্ব ফেরী করে। বাজারকে মুক্ত রাখতেই হবে, কোনও আইন-কানুনের নিগড়ে তার গতিবিধি নিয়ন্ত্রণ করা উচিত না। এরা একথাও বলেন যে বাজারের উপরে রাষ্ট্র নিজের কর্তৃত্ব বজায় রাখে। টাকা পয়সা ছাপা, ওজন ও বিভিন্ন মাপজোক সম্পর্কিত নিয়মাবলী যেহেতু রাষ্ট্রের অধীনে তাই গোটা বাজারই নাকি রাষ্ট্রের দখলে। তারা যা কখনো বলে না তার নাম ব্যক্তিগত সম্পত্তি (প্রপার্টি)। এছাড়াও রয়েছে সত্ত্বাধিকার সংক্রান্ত আইন কিংবা ব্যবসা-বাণিজ্যের বিধিসমূহ- এসবই আসলে পুঁজির স্বার্থে নির্মিত আইনি সুরক্ষার বন্দোবস্ত। এগুলি কার্যকর না হলে পুঁজির শাসন একদিনও চলবে না।

৪) কাজ করতে জনসাধারণের অনিচ্ছা সম্পর্কে- পুঁজিবাদ সামাজিক শ্রেনিবিভাজন’কে কিভাবে ব্যখ্যা করে? তাদের যুক্তি এই শ্রেণীকাঠামোয় যারা একেবারে নিচে রয়েছে তারা আসলে অলস, কাজ করতে চায় না। আর তাই নাকি তাদের এমন দুর্গতি। বাস্তব কি? সামাজিক বিন্যাসেরও অভ্যন্তরীণ গতিপ্রকৃতি রয়েছে, সেদিকে মনোযোগ দিলেই বোঝা যায় ঐ যুক্তি কতটা অসার।

এখানেই শেষ নয়। উপরোক্ত উদাহরণগুলি অবশ্যই জনপ্রিয়, কিন্তু এসবের বাইরেও দক্ষিণপন্থী প্রচারের আরও কিছু উপাদান রয়েছে যেগুলি এসবের চাইতে অনেক বেশি শক্তিশালী, দুনিয়াজুড়ে যাদের প্রভাব আরও বিস্তৃত।

‘আমেরিকা ফার্স্ট’ হল দক্ষিণপন্থার এমনই এক অভিনব প্রচার। আজকাল সেই স্লোগানকে সময়োপযোগী করে নেওয়া হয়েছে, এখন বলা হচ্ছে ‘মাগা’ অর্থাৎ ‘মেক অ্যামেরিকা গ্রেট এগেইন’। উনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতিয়ার্ধ থেকেই অনেক আমেরিকান এক কাল্পনিক বৈদেশিক চক্রান্তে (ফরেইন প্লট) বিশ্বাস করতে শুরু করেন, সেই চক্রান্ত নাকি আমেরিকার গণতান্ত্রিক বন্দোবস্তকে অপদস্থ করতে চায়। ফরেইনিজম নামক এক মনগড়া শত্রুশিবিরের বিরুদ্ধে জনমত গঠন করার উদ্দেশ্যেই ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ ধারনাটির সুত্রপাত। অথচ অমন কোনও শত্রু বাস্তবে ছিলই না।

এর পরে যিনি আসরে নামেন র‍্যানডলফ হার্স্ট। আমেরিকান গণমাধ্যমের জগতে এনাকে ‘মিডিয়া মুঘল’ বলে অভিহিত করা হয়। হার্স্টের পরিকল্পনাকে উপযুক্ত মজবুতি যুগিয়েছিলেন অর্সন ওয়েলস। ওয়েলস নির্মিত ছায়াছবি ‘সিটিজেন কেইন’ আমেরিকান নাগরিকদের চেতনায় বৈদেশিক চক্রান্তের ভীতি প্রোথিত করেছিল। ওয়েলস সেই সুযোগ ব্যবহার করেন ষোল আনার উপরে আঠারো আনা। ‘সান ফ্রান্সিসকো এক্সামাইনার’ নামের সংবাদপত্রের মালিক ছিলেন হার্স্ট, নিজের কাগজটিকে তিনি ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ স্লোগান জনপ্রিয় করার কাজে লাগিয়েছিলেন।

হার্স্টের পরিকল্পনার সঙ্গে আরও একটি বিষয় যুক্ত হয়। তৎকালীন আমেরিকার কর্তাব্যক্তিদের অন্যতম দুশ্চিন্তা ছিল লাল ভীতি। আমেরিকার সমাজে ইহুদিবিদ্বেষ ছিলই, প্রচার চলে দুনিয়াজুড়ে বসবাসকারী ইহুদিরা নাকি বলশেভিক বিপ্লবের জন্য পয়সা যোগাচ্ছে। অবশ্য গত শতাব্দীর ৩০-এর দশকে জার্মানিতে হিটলারের উত্থানের পরেও এমন ভয়ের কোনও অর্থই ছিল না, তা স্বত্বেও ৫০-এর দশকের আমেরিকায় ঐ মনোভাবের প্রভাব ছিল যথেষ্টই। পয়সা যুগিয়ে বলশেভিক বিপ্লব ডেকে আনার মতো কোনও পরিকল্পনা কোনোদিনই কোথাও ছিল না- আসলে ঐ প্রচার দক্ষিণপন্থার রাজনৈতিক প্রচারে সহায়ক ষড়যন্ত্রমূলক কর্মসূচিই ছিল।

কমিউনিস্ট বিদ্বেষের উদ্দেশ্যে ব্যবহারের পাশাপাশি ‘আমেরিকা ফার্স্ট’-এর পরিকল্পনা অন্যান্য কিছু ক্ষেত্রেও কার্যকরী ভূমিকা পালন করে। লাল ভীতির মতো তাদের মধ্যে ‘পিত বর্ণের প্রতি ঘৃণা’ (দক্ষিণ এশিয়ার অধিবাসী বা নির্দিষ্ট করে বললে জাপান ও চীনের নাগরিকদের প্রতি বিদ্বেষ যা ইয়েলো পেরিল নামে পরিচিত)-ও ছিল ব্যাপক। রীতিমত প্রচার চলেছিল এইসব দেশের নাগরিকরা সব দলে দলে আমেরিকায় ঢুকে পড়ছে এবং ভবিষ্যতে এরাই মার্কিন সভ্যতাকে গ্রাস করে নেবে। আমেরিকার ইতিহাস নিজেই প্রমাণ দিয়েছে এমন কিছু কখনো ঘটেনি। ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ ধারণার ধ্বজাধারীরা এমনও প্রচার করেছিল যে রোজেনফিল্ডের সাথে মিলে আমেরিকার রাষ্ট্রপতি রুজভেল্ট ‘জিউ ডিল’ নামের এক পরিকল্পনা নিয়েছেন যাতে আমেরিকা ধ্বংস হবে- তাই দেশের সুরক্ষায় অমন স্লোগান বিশেষ জরুরী। আমেরিকা অবশ্যই সুরক্ষিত থেকেছে, তবে রুজভেল্ট’ই সেই কৃতিত্বের অধিকারী, ঐ স্লোগান কোনও কাজেই আসেনি।

এসব স্বত্বেও প্রচার হয় রুজভেল্ট প্রশাসনের মাথায় রয়েছে ইহুদিদের আন্তর্জাতিক সংঘ। সেই সংঘ দুনিয়াজুড়ে নিজেদের কর্তৃত্ব কায়েম করতে চায়। ইহুদি কর্তৃত্বের এমন বিপদের মোকাবিলায় আমেরিকানদের জন্য খুনের রাজনীতি গ্রহণ করাই উচিত পথ।

অনেকদিন বাদে ২০১৬ সাল নাগাদ পুনরায় ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ স্লোগানটি শোনা গেল। রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের অন্যতম প্রার্থি ডোনাল্ড ট্রাম্প নিজের প্রচারে সেই স্লোগান তুলে ধরলেন। ডোনাল্ড যাই করুন না কেন, আমেরিকা ফার্স্টের ইতিহাস এই যে শুরুর দিন থেকে ঐ স্লোগান আসলে মার্কিন নাগরিকদের মধ্যে ভীতি প্রচারের উদ্দেশ্যে দক্ষিণপন্থী রাজনীতির অন্যতম হাতিয়ার। এ এক এমন আতংক যার কোনও বাস্তব অস্তিত্বই নেই। ভয়ের কারণ নেই অথচ ভয়ের মোকাবিলায় রাজনৈতিক কর্মসূচিটি যথাবিহিত ব্যবহৃত হচ্ছে!

আমেরিকা ফার্স্ট-এর মতোই আমেরিকানদের উপরে আরেকটি রুপকথার বহুল প্রভাব দেখা যায়। সেই কল্পনাবিলাসের নাম মুক্ত বাজার ব্যবস্থা। আমেরিকার যাবতীয় সমস্যার নিরসনে এই মুক্ত বাজারের ধারণাকে কার্যত সর্বরোগহর দাওয়াই-র মতো তুলে ধরা হয়।

মুক্ত বাজার ব্যবস্থা আমাদের কি দিয়েছে? আজকের পৃথিবীতে শিশুশ্রম নেই? আছে এবং মুক্ত বাজারের জন্যই তা টিকে রয়েছে। কল-কারখানায় কর্মরত অবস্থায় দুর্ঘটনায় প্রাণহানির মতো কিছু আজকের দুনিয়ায় ঘটছে না? অবশ্যই ঘটছে এবং সেটা চলতে পারছে কারণ মুক্ত বাজার ব্যবস্থা তাকে সুরক্ষিত রেখেছে। নির্মম কায়দায় কাজের মজুরি কমিয়ে দেওয়া, চক্রাকার অর্থনৈতিক সংকট, পয়সার অভাবে শ্রমজীবী পরিবারগুলির জন্য উপযুক্ত বাসস্থানের বদলে নোংরা বস্তিতে মাথা গুঁজে দিন গুজরান- কোনটা আজকের পৃথিবীতে নেই? বায়ু দূষণ থেকে শুরু করে ওবেসিটি কিংবা কোভিড-১৯’র সংক্রমনে মৃত্যুর ন্যায় বিপজ্জনক মহামারী অবধি কোনটি মুক্ত বাজারের ফলাফল নয়? আমেরিকায় প্রায়শই বন্দুকবাজের আক্রমণে মৃত্যুর ঘটনা ঘটতে দেখা যায়- এমন ঘটনার দায় মুক্ত বাজারের নয় তো কার?

জনসাধারণের সমস্যাগুলির মোকাবিলার নামে মুক্ত বাজার ব্যবস্থা আসলে যা করেছে তাতে প্রায় ১০০ মিলিয়ন মানুষের প্রাণ চলে গেছে (বন্দুক, ফাস্টফূড, সিগারেট ও বিপজ্জনক কেমিক্যাল উৎপাদনে নিয়ন্ত্রণের আইন জারী করা স্বত্বেও)। এমন অভিনব নিয়ন্ত্রনই মুক্ত বাজারের বিবেচনায় সমস্যার সমাধান!

বিশ্বব্যাপী প্রচারের আরেক উদাহরণ পবিত্র ব্যক্তিস্বাধীনতার মর্যাদা অক্ষুণ্ণ রেখেই নাকি আমেরিকা গড়ে উঠেছে। আর ব্যক্তিস্বাধীনতা সুরক্ষিত থাকে কি করে? যখন নাকি মুক্ত বাজার ব্যবস্থা কায়েম হয়, যখন শিল্পমালিকানার উপরে কোনও নিয়ন্ত্রণ থাকে না। অথচ এইসকল বন্দোবস্ত থাকার পরেও কয়েক শতাব্দী জুড়ে আমেরিকার ইতিহাসে দাসব্যবস্থা ভালমতোই কায়েম ছিল।

আমেরিকায় দাসব্যবস্থা ছিল- আজও আছে। আজকের আমেরিকায় ৫০ মিলিয়ন মানুষ দাসের মতোই জীবনযাপন করছেন। এ হল সেই অর্থনৈতিক ব্যবস্থা যা একদিকে মিষ্টির দোকান সাজিয়ে রাখে আরেকদিকে এমনসব দোকানের কর্মচারীরা জানে না পরেরদিন তাদের কাজ থাকবে কি না। মুক্ত বাজারের ধারণাকে ভিত্তি করেই আজকের আমেরিকা নির্মিত হয়েছে বলে সুদিনের গপ্পোবলিয়েরা যতই কায়দা করুক, আমরা জানি এই সুবিশাল নির্মাণ ঘটেছে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে টিকে থাকা দাসব্যবস্থার জোরেই।

মুক্ত বাজারের পক্ষে সবচেয়ে বেশি জোরে গলা ফাটানো দুজনের নাম ল্যুদউইগ ভন মাইজেস ও ফ্রেডরিখ ভন হায়েক। এদের মধ্যে মাইজেস’র কথা বিশেষ উল্লেখযোগ্য। কেন? মুক্ত বাজারের পক্ষে চরমপন্থী প্রচারক ছাড়াও ভন মাইজেস অস্ট্রিয়ান ফ্যাসিবাদেরও অন্যতম সমর্থক ছিলেন।

অস্ট্রিয়ান চেম্বার অফ কমার্শের চিফ ইকনমিস্ট হিসাবে কর্মরত থাকার সময় ভন মাইজেস সেদেশের ফ্যাসিস্ত চ্যান্সেলর এঙ্গেলবার্ট ডলফাসের অর্থনৈতিক উপদেষ্টার পদেও আসীন ছিলেন। এমন ভূমিকায় থাকা একজন ব্যক্তি কি করে নিজের দেশে শিশুশ্রম নিবারনী আইন প্রণয়ন মেনে নেবেন! মাইজেস এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হন, একইসাথে তিনি জনশিক্ষার প্রভাব সম্পর্কে প্রবল সমালোচনাও করেন। অবশ্য ভন হায়েক’ও কম যান না। তিনি একদিকে ছিলেন নয়া উদারনীতির অন্যতম পরিকল্পনাকার, আরেকদিকে পিনোচেত শাসনের সমর্থক। হায়েক ছিলেন মাইজেসের অন্যতম এক ছাত্র যিনি গুরুর সুনাম অক্ষুণ্ণ রেখেছিলেন।

ভন হায়েক একটি ছোট পুস্তিকাও লিখেছিলেন। তার নাম দ্য রোড টু সার্ফডম, বাংলা করলে ‘দাসত্বের পথে’ গোছের একটা কিছু দাঁড়ায়। বই না বলে একে রাজনৈতিক-মতাদর্শগত প্রচারপত্র বলাই ভালো। এমন গণ্য করার অন্যতম কারণ হল হায়েক নিজের লেখায় এতটুকু ভনিতা করেননি, বুঝতে কষ্ট হয় এমন একটিও অর্থনৈতিক তত্ত্বও এতে নেই। রচনাটি নয়া উদারবাদি দুনিয়ার সমর্থকদের জন্য কার্যত এক আদর্শ হ্যান্ডবুক। আসল কথাটি হায়েক সবচেয়ে সোজাসুজি লিখেছেন- আমরা যাকে নয়া উদারবাদ বলছি তা আসলে বাজার ব্যবস্থার পক্ষে এক মৌলবাদী বন্দোবস্ত।

মিল্টন ফ্রিডম্যান ছিলেন হায়েকেরই সুযোগ্য উত্তরসূরি। নয়া-উদারবাদের পক্ষে তার মতো করে আর কেউ যুক্তি সাজাতে পারেনি। নয়া উদারবাদ ব্যাপারটি কেমন সেকথা বুঝতে গেলে আমাদের চিলির ইতিহাসে নজর দিতে হবে। সেদেশেই সবার প্রথম নয়া-উদারবাদ প্রয়োগ করা হয়, দায়িত্বে ছিলেন অগাস্ট পিনোচেত। ১৯৭৩ থেকে ১৯৯০ অবধি তার শাসনে পিনোচেত সেদেশের গনতান্রিক ব্যবস্থাকে কবরে পাঠিয়ে ছিলেন, বলা ভালো নির্মম অত্যাচার মারফত খুন করেছিলেন। অবশ্য কেতাবি ভাষায় একে বলা হবে মুক্ত বাজার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার কর্মসূচি। পিনোচেতের উপদেষ্টা কে ছিলেন? ঐ ফ্রিডম্যান। তার পরামর্শ এবং শিকাগো বয়েজের সহায়তায় পিনোচেত নিজের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষদের রীতিমত নিখুঁত কায়দায় অপহরণ করাতেন, অত্যাচার চালাতেন এবং শেষে খুন করে ফেলতেন।

পুঁজিবাদের সুসন্তানেরা মুক্ত বাজারের ধ্বজা লাগানো ভেলা চেপেই হাজির হয়। সেইসব সুসন্তানদের কর্তব্য কি? পুঁজিবাদ বিরোধী যেকোনো প্রতিপক্ষকে সরাসরি নিকেশ করে দেওয়া, ট্রেড ইউনিয়ন ধ্বংস করা ইত্যাদি। মুক্ত বাজার চিলিতে ট্রেড ইয়নিয়ন কর্মীদের হত্যা করেনি ঠিকই, পিনোচেতের বুলেটই ঐ কাজ শেষ করেছিল। ইউনাইটেড কিংডমে ট্রেড ইউনিয়ন বিরোধী আইন প্রণয়ন করে মার্গারেট থ্যাচার প্রায় একই ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন।

Neoliberalism

আজ অবধি মুক্ত বাজার তত্ত্বকে অর্থনীতির নামেই চালিয়ে দেওয়া হয়েছে। এও এক বিরাট মিথ্যা বৈ আর কিছু নয়। এমন অসত্য প্রচারের উদ্দেশ্য একটাই, যাতে কেউ না বুঝতে পারে মুক্ত বাজার টাজার বলে আসলে পুঁজিবাদকেই চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে। ঐ মুক্তির যূপকাষ্ঠে সবার আগে যার গলা কাটা যায় তারই নাম গণতন্ত্র।

দক্ষিণপন্থী মেধাজীবীদের তরফে আরও এক বিরাট মিথ্যাকে এখনও ঢাক পিটিয়ে প্রচার করা হচ্ছে। সেই যে ইহুদি ষড়যন্ত্রের কথা বলা হয়েছিল, তারা আজও শুনিয়ে যাচ্ছেন ঐ ‘নিউ ডিল’ কোনমতে আটকে দেওয়া গেছে। আসলে কি ঘটেছিল? রুজভেল্ট শাসনের প্রথম ১০০দিনেই শেয়ার বাজারে ৬৬% বিনিয়োগ বাড়িয়ে দেওয়া হয়, সমস্ত জিনিসপত্রের দাম রাতারাতি আকাশ ছোঁয়। ১৯৩৩ সাল নাগাদ শেয়ারে বিনিয়োগের পরিমাণ বেড়ে প্রায় দ্বিগুণ হয়।

১৯৩৩ থেকে ১৯৩৭ অবধি সময়কাল আমেরিকার ইতিহাসে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। যুদ্ধের সময়কার পরিস্থিতি বাদ দিলে  চার বছরের শাসনে আর কখনো আউটপুট বৃদ্ধির হার ৩৯% হয়নি। যে ‘নিউ ডিল’ সম্পর্কে আমেরিকার কর্তাব্যাক্তিরা লোকজনকে ভূত দেখান সেই তথাকথিত বিতর্কিত শাসনকালের কিছু উল্লেখযোগ্য পরিসংখ্যান নিচে দেওয়া হল। দেখে নেওয়া যাক নিউ ডিল আমেরিকাকে কি কি সুবিধা দিয়েছেঃ

১) কাজ হারানো, গণঅসন্তোষ কিংবা জনগণের পেটে ভাতের বন্দোবস্ত হয়েছিল ঐ সময়েই। ২) ব্যাংকগুলিকে সুরক্ষা যোগানোর পাশপাশি আমেরিকায় মুদ্রাস্ফীতি আটকে দেওয়া গেছিল। ৩) আমেরিকার সেইসব পরিবারের কাছেও বিদ্যুতের আলো পোঁছে দেওয়া গেছিল যারা অন্ধকারেই অভ্যস্ত ছিলেন।

৪) দেশজোড়া সড়ক যোজনার কার্যকরী রুপায়ন ঘটেছিল। ৫) নদীর জল থেকে সৃষ্ট বন্যা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়েছিল।

৬) একাধিক রোগব্যাধিকে সারা দেশ থেকেই চিরতরে বিদায় দেওয়ার বন্দোবস্ত হয়।

৭) শ্রমিকদের ইউনিয়ন করার অধিকার আইনি স্বীকৃত পেয়েছিল।

৮) বয়স্কদের জন্য বার্ধক্যকালীন পেনশন, বেকার বিরোধী বীমা প্রকল্প, ন্যুনতম মজুরির বন্দোবস্ত হয়।

৯) গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও সরকারের উপরে জনসাধারণের মনে আস্থা আরও মজবুত হয়।

উপরের সবকটি ঘটনাই দক্ষিণপন্থী রাজনীতি ও মতাদর্শ দুয়ের জন্যই রীতিমত ঘৃণার বিষয়, মুক্ত বাজারের সমর্থকেরা এসব স্বপ্নেও ভাবতে পারে না। তাই তারা এসব কিছুকেই বাতিল ভাবনাচিন্তা বলে প্রচার করে, এমনকি কোনও আমেরিকান সিইও অবধি নিউ ডিল’র বিরুদ্ধে এবং এসবের পক্ষে কথা বললে তাকেও ধর্তব্যের বাইরেই রাখা হয়।

যেমন ঐতিহাসিক স্টাডস টার্কেলের সাথে কথা বলতে গিয়ে স্যয়ার্স কর্পোরেশনের ভূতপূর্ব প্রেসিডেন্ট রবার্ট উড উল্লেখ করেছিলেনঃ

‘১৯৩৪ এবং ৩৫ নাগাদ ঐসকল বন্দোবস্ত খেল দেখাতে শুরু করেছিল।

৩৬ সালে পৌঁছালে বোঝা গেল এসমস্ত ব্যবস্থার জোর যথেষ্ট।

৩৩ সালেই মহামন্দা শেষ হয়ে গেছিল।

কিন্তু সবকিছু পুনরায় ঠিকঠাক হতে হতে ৩৬ সাল অবধি সময় লেগে যায়’।

তিনি আরও বলেনঃ ‘১৯৩২ সালে বেকারির হার ছিল ২৫ শতাংশ। রুজভেল্টের শাসনকালে তা কমে ১৪ শতাংশে পরিণত হয়’। অবশ্য দক্ষিণপন্থীরা এসব কথাবার্তা অস্বীকার করেন। গোঁড়া দক্ষিনপন্থী, রক্ষণশীলরা (কনজারভেটিভ) এবং মুক্ত বাজারের সমর্থকেরা একটাই কথা মন্ত্রের ন্যায় জপে চলেন- ‘যে কোনও তথ্যকে ততদুরই এগোতে দাও যতক্ষণ না সেসব জনগণের জন্য উৎসাহব্যঞ্জক রূপকথায় পরিণত হয়’। অর্থাৎ যা কিছু জনসাধারণকে বিকল্প জীবনধারা সম্পর্কে আশাবাদী করে তুলতে পারে সেসবকিছুকেই এরা অস্বীকার করবেন।

এসবের চাইতেও যা নিয়ে আমেরিকার দক্ষিণপন্থী রাজনীতি সর্বাধিক মিথ্যাচার করে তা হল আমেরিকার গৃহযুদ্ধে মিত্রপক্ষের হার। তারা ঐ ঘটনাকে এক অনিবার্য পরাজয় (লস্ট কজ) বলে চিহ্নিত করেন। এ সম্পর্কে যাবতীয় মিথ্যাচারের মুখোশ খুলে দিতে বস্তুনিষ্ঠ ইতিহাসের পুনর্পাঠে মনযোগী হতে আমরা বাধ্য হই।

আসলে লস্ট কজ টজ ইত্যাদি বলে তারা যা লুকিয়ে রাখতে চান তাকে ইতিহাসে সাদা চামড়ার কর্তৃত্ব (হোয়াইট সুপ্রিমেসি) বলে। ইতিহাস নিজেই প্রমাণ দেয় লস্ট কজ আসলে অন্ধবিশ্বাস ছাড়া আর কিছুই নয়। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য নিজেদের মূল্যবোধ (পড়ুন দাসত্বের নিয়ম বজায় রাখার অধিকার) সুরক্ষিত রাখার ইচ্ছাতেই এসব কষ্টকল্পনাকে নির্মাণ করা হয়েছে।

ঐ মিথের ভাষ্যে রবার্ট ই লি ও থমাস জ্যাকসনদের জনসাধারণের চোখে রুপকথার নায়কে পরিণত করা হয়েছে। অতীত দিনের দক্ষিনাঞ্চল সম্পর্কে বাড়তি মোহের বাতাবরণ সৃষ্টি করে পুনর্গঠনের পর্যায়কে এক অন্ধকারময় যুগ বলে চিহ্নিত করাই আসল উদ্দেশ্য।

লি’এর নামে মনুমেন্ট ইত্যাদির নির্মাণ অবধি করা হয়। শান্তি প্রস্তাবের বিরুদ্ধে বিদ্রোহীদের বিভিন্ন জয়লাভের ঘটনাকে উতসবের মেজাজে পালন করা শুরু হয়। সাবেক যুগের অস্ত্রশস্ত্র (যা আজকের দিনে অচল) জড় করে এনে জাদুঘর সাজিয়ে ফেলে, যাবতীয় ঘৃণ্য কাজের দিনলিপির ভিড়ে ঠাসা পাঠাগার নির্মাণ করিয়ে দলে দলে স্কুলের ছেলেমেয়েদের সেখানে বেড়াতে নিয়ে যাওয়া চলতে থাকে। এসবেরই উদ্দেশ্যে ছিল যাতে একটা সময় পরে জনসাধারণের বিরাট অংশই লস্ট কজ’কে ইতিহাস বলে বিশ্বাস করতে শুরু করে। আমেরিকার দক্ষিণপন্থী রাজনীতির জন্য ঐ মিথ জিগিয়ে রাখা কার্যত নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্যই গুরুত্বপূর্ণ। ২০২১ সালের ৬ই জানুয়ারি সেই মিথকেই আরেকবার সামনে তুলে ধরা হল। ঐ দিন আমেরিকায় নতুন মিথ জন্মানোর মতো ঘটনা ঘটেছিল।

ঐ দিন কি ঘটে? ট্রাম্পের সমর্থকেরা, উগ্রদক্ষিণপন্থী মিলিশিয়ার সদস্যেরা এবং বিবিধ মিথ বিশ্বাসকারী গোষ্ঠীর সদস্যরা একযোগে আমেরিকার গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে ধ্বংস করতে উদ্যত হয়ে ওঠে। এই খুনে বাহিনীর হাতে পাঁচজন প্রাণ হারায়, এদের মধ্যে একজন পুলিশ অফিসারও ছিল।

মাথায় সাদা ফেট্টি বেঁধে এবং রকমারি পোশাক পরিচ্ছদ সমেত এরা রাস্তায় নেমে এসেছিল। অবশ্য নিজেদের আসল পরিচয় চেপে রাখতে তারা বিবিধ বিচিত্র দাবিসনদ পেশ করে। অভিবাসন সমস্যা, নারিমুক্তি আন্দোলন, ভিন্ন জাতির মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্কের আইনি বৈধতা এবং অন্যান্য সামাজিক বিষয়গুলিকে তারা সাদা চামড়ার মানুষদের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ে পরিণত করার চক্রান্ত হিসাবে চিহ্নিত করে এবং সেইমতো স্লোগান ইত্যাদি দিতে শুরু করে। ঐ প্রতিবাদ সংগঠনের সময়ই লোন উলফ (এক নেকড়ে)-এর মিথকে ব্যাপক প্রচারে আনা হয়। ঐ মিথটি কারা বারংবার ব্যবহার করে? হোয়াইট পাওয়ার গোষ্ঠীর সন্ত্রাসবাদীরা, উগ্র দক্ষিণপন্থী দলসমুহের পান্ডারা এবং নিও নাৎসিরা। আসলে নিজেদের প্রকৃত রাজনৈতিক পরিচয়কে আড়ালে রাখতেই এমন মিথের প্রচার চলে। উগ্র দক্ষিণপন্থীদের মদ্যে গাইডবুক হিসাবে কুখ্যাত টার্নার ডায়েরিতেও এই লোন উলফ- মিথের কথা উল্লিখিত রয়েছে। বিভিন্ন সময়ে নানা ব্যক্তি যেমন কুখ্যাত গনহত্যাকারি টিমোথি ম্যাকভেই’কে (১৯৯০ সালে এই ব্যক্তি ১৬৮জন কে হত্যা করেছিল) লোন উলফ হিসাবে চিহ্নিত করা হলেও একথা সর্বজনবিদিত এরা সকলেই অপরাধী নিশ্চিত কিন্তু লোন উলফ আসলে উগ্র দক্ষিনপন্থী রাজনৈতিক কর্মসূচির গোপন হাতিয়ার। ২০১৭ সালে শার্লটভিলের ঘটনা কিংবা ২০২১ সালের ৬ই জানুয়ারি ডোনাল্ড ট্রাম্পের সমর্থনে যারা আমেরিকার রাস্তায় তাণ্ডব চালিয়েছিল তারা আসলে কারা? প্রাউড বয়েজ, ওথ কিপার্স, থ্রি পার্সেন্টার্স, দ্য বেস, বুগালু বয়েজ এবং অ্যাটমঅয়াফেন ডিভিশন এইসব গোষ্ঠীর লোকজনেরাই ছিল প্রধান। অথচ পরে এদের আড়াল করতে লোন উলফের উল্লেখ করা শুরু হল। এটুকু বুঝতে কোনও অসুবিধা নেই এহেন লুকোচুরিতে কার লাভ, কাদের সুবিধা?

আমেরিকা ফার্স্ট’কে কেবল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমস্যা বলে ভাবলে বিরাট ভুল হবে। মুক্ত বাজার, নিউ ডিল, লস্ট কজ এবং সবশেষে ঐ লোন উলফ এসব কিছুর প্রকৃত উদ্দেশ্য তিনটি-

১) উগ্র দক্ষিণপন্থী গোষ্ঠীগুলিতে নতুন (কমবয়সী) সদস্যের অন্তর্ভুক্তি করা।

২) যারা ইতিমধ্যে এই সব গোষ্ঠীর পাল্লায় পড়েছে তাদের সন্ত্রাসমূলক কর্মকাণ্ডে যুক্ত করে উপযুক্ত ট্রেনিংয়ের বন্দোবস্ত করা।

এবং

৩) যুক্তিগ্রাহ্য যে কোনকিছুকেই সরাসরি অগ্রাহ্য, অস্বীকার করার অভ্যাস গড়ে তোলা।

অনেক সময়েই দক্ষিনপন্থী রাজনীতি যেসকল মিথ’কে তুলে ধরে তার থেকে উগ্র দক্ষিনপন্থী সন্ত্রাসমূলক কর্মসূচীকে আলাদা করে বিবেচনা করা হয়। এমনটা প্রতিষ্ঠা করাই আসলে ওদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য। ঠিক যেমন আমাদের শেখানো হয় ফ্রেডরিখ ভন হায়েক, মুক্ত বাজার ব্যবস্থা, নয়া উদারবাদ এবং নিজের খুনে বাহিনী সমেত অগাস্ট পিনোচেত নাকি সব আলাদা আলাদা বিষয়। আসলে কিন্তু ঠিক উল্টোটাই সত্যি।

সুত্রঃ কাউন্টারপাঞ্চ, পিপলস ডেমোক্র্যাসি

ভাষান্তরঃ সৌভিক ঘোষ


শেয়ার করুন

উত্তর দিন