Abhas Da 2

রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রে বিনাশ (২য় পর্ব)

আভাস রায়চৌধুরী

১৯৫৬ তে অন্ধ্রপ্রদেশের আবাদিতে জাতীয় কংগ্রেসের অধিবেশনে পন্ডিত নেহেরুর সমাজতান্ত্রিক ধাঁচের সমাজ ও অর্থনীতি ঘোষণার সময় থেকে সত্তর দশকের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত সময়কালকে স্বাধীন ভারতের অর্থনীতির বিকাশের সময় বলা যেতে পারে। পঞ্চাশের দশকের শেষ থেকে ষাটের দশক পর্যন্ত ইস্পাত, বিদ্যুৎ, সহ প্রায় প্রতিটি ভারী শিল্প নির্মাণ হয়েছে। এই সময়ের মধ্যেই রেলওয়ের জাতীয়করণ হয়েছে। কয়লা খনিসহ প্রতিটি খনি ও শিল্পের জাতীয়করণ হয়েছে। অর্ডিন্যান্স ফ্যাক্টরি, টেলিকম ফ্যাক্টরি, লোকোমোটিভ ফ্যাক্টরি গড়ে উঠেছে। ব্যাংক, বীমা, পোস্ট জাতীয়করণ হয়েছে। এই সময়ের মধ্যেই ভারতের পেটেন্ট আইন গ্রহণ করা হয়েছে। যে আইনের মূল কথা ছিল আন্তর্জাতিক স্তরের প্রসেস পেটেন্টকে মান্যতা দেওয়া, কিন্তু প্রোডাক্ট পেটেন্টকে মান্যতা না দেওয়া। এই নতুন পেটেন্ট আইনের ফলে ভারতে বিজ্ঞান গবেষণার গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলি গড়ে ওঠে। ইঞ্জিনিয়ারিং, ফার্মাসিউটিক্যাল, কৃষি গবেষণা সহ অসংখ্য ক্ষেত্রে ভারত স্বনির্ভরতা অর্জন করতে পেরেছিল।

social-science

সত্তরের দশকের গোড়াতে বিশ্ব পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে নতুন করে সংকটে শুরু হয়। তার ধাক্কায় এসে লাগে ভারতীয় পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে। এই সময়ে রাষ্ট্রায়ত্ত্ব ক্ষেত্রের সংকট শুরু হয়। ভূমি সংস্কার না হওয়ায় ভারতের শিল্পের বাজারের উচ্চ বিকাশ বাধাপ্রাপ্ত হয়েছে। পুঁজিবাদী পথে বিকাশের অর্থনীতিতে পুঁজির শ্রমের মৌলিক দ্বন্দ্বের প্রতিফলন হিসেবে ভারতের শাসক শ্রেণীর সঙ্গে শ্রমিক শ্রেণী সহ শ্রমজীবী জনগণের দ্বন্দ্ব প্রথম থেকেই স্পষ্ট ছিল। শ্রমিক, কৃষক, ছাত্র-যুব, কর্মচারী সহ সমাজের সমস্ত সাধারণ মানুষের অধিকারের লড়াই স্বাধীন ভারত প্রত্যক্ষ করেছে। তেমনি সময় যত এগিয়েছে ভারতীয় রাষ্ট্রকে শাসক শ্রেণী তাদের নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করেছে। ফলে শ্রমজীবী মানুষের সংগ্রাম বিভিন্ন সময়ে রাষ্ট্রীয় দমনের শিকার হয়েছে। সেই সময় গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের সংগ্রাম ছিল ভারতীয় শ্রমজীবী মানুষের সামনে প্রধান কর্তব্য। পাশাপাশি রাষ্ট্রায়ত্ত্ব প্রতিষ্ঠানের স্বপক্ষে সংগ্রাম জারি থেকেছে। বিশ্ব পুঁজিবাদী অর্থনীতি ও ভারতীয় অর্থনীতির সংকট কমেনি বরং বেড়েছে। আশির দশকে  ইন্দিরা গান্ধী সরকার  দেশবাসীর কাছে শর্ত গোপন রেখে প্রথম আই এম এফ'র ঋণ গ্রহণ করে।

নব্বইয়ের দশকের গোড়াতে সংকট দীর্ণ বিশ্ব পুঁজিবাদী ব্যবস্থা নয়া উদারবাদী পথে যাত্রা শুরু করার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ভারতেও নয়া উদারবাদ প্রয়োগ শুরু হয়ে যায়। আশির দশকের গোড়ায় আই এম এফ র শর্তগুলি জানা না গেলেও ক্রমশ তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ১৯ ৯১ এর আগেই বিশ্ব পুঁজিবাদী ব্যবস্থাতে নয়া উদারবাদের আনুষ্ঠানিক প্রয়োগের পরিবেশ গড়ে উঠেছে। ১৯৮৬ সাল থেকে গ্যাটের অষ্টম রাউন্ডের বৈঠক থেকে ১৯৯৪ এ বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার গঠন আন্তর্জাতিক লগ্নিপুজির নিয়ন্ত্রণকে নয়া উদারনীতির নাম করে আরও দৃঢ় ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠা করেছে। যদিও এরও দেড় দশক আগে লাতিন আমেরিকায় নয়া উদারবাদের পরীক্ষা ও প্রয়োগ শুরু হয়ে গেছিল। যার মূল কথা ছিল রাষ্ট্রায়ত্ত্ব ক্ষেত্রকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করে কর্পোরেটের হাতে জাতীয় সম্পত্তি তুলে দেওয়া। আর এর জন্যই প্রয়োজন ছিল গণতন্ত্রের জায়গায় স্বৈরাচারী শাসন।

আজ স্বাধীনতার ৭৫ এ আমরা যখন পৌছালাম তখন দেশ দুনিয়ায় আন্তর্জাতিক লগ্নিপুজীর নিয়ন্ত্রণ আরও শক্তিশালী হয়েছে। আন্তর্জাতিক লগ্নী পুঁজিতে উৎপাদনের ক্ষেত্রকে কার্যত বিসর্জন দিয়ে আর্থিক লেনদেনের মধ্য দিয়ে পুঁজির সর্বোচ্চ কেন্দ্রীভবন ঘটছে। ফলে সাধারণ মানুষের উপর সংকট ও বঞ্চনার বোঝা আরও নির্মম হচ্ছে। ভুক্তভোগী মানুষদের যেকোনো ধরনের প্রতিবাদ প্রতিরোধ কিংবা নয়া উদারবাদী লুটের বিকল্প কোনো নীতি যাতে না আসতে পারে তার জন্য বিশ্বব্যাপী অতি দক্ষিণপন্থী রাজনীতি প্রবল ভাবেই ক্রিয়াশীল। যার মূল লক্ষ্য ও বৈশিষ্ট্য হলো শ্রমজীবী মানুষের সব ধরনের অধিকার কেড়ে নেওয়া এবং গণতন্ত্রের পরিবর্তে বহুমাত্রিক স্বৈরতান্ত্রিক শাসন কে প্রতিষ্ঠা করা। এই পরিপ্রেক্ষিতে পুঁজিবাদী অর্থনীতির জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্রের ধারণা বলা ভালো রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদের পরিবর্তে বাজারের হাতে সবকিছু কে ছেড়ে দেওয়ার নীতি সারা পৃথিবীতে বেপরোয়াভাবে প্রয়োগ করা হয়েছে। পুঁজিবাদী দুনিয়ার অন্য দেশগুলির মত ভারতের রাষ্ট্রায়ত্ত্ব ক্ষেত্র আজ বেশি-বিদেশি কর্পোরেটের জন্য বলি প্রদত্ত।  আরএসএস/বিজেপির নিরঙ্কুশ স্বৈরশাসনে আজ দেশের রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্র কার্যত ধ্বংসের কিনারায় এসে উপস্থিত হয়েছে।

১৯৯১ সালে প্রথম প্রজন্মের কাঠামোগত সংস্কারের মধ্য দিয়ে ভারতে নয়া উদারবাদী অর্থনীতি চালু হয়েছে। এই  সংস্কারের মূল লক্ষ্য ছিল অর্থনীতি থেকে ভারত সরকারের ভূমিকা কে সরিয়ে ফেলা এবং রাষ্ট্রায়ত্ত্ব প্রতিষ্ঠানগুলি বিলগ্নীকরণের দিকে ঠেলে দেওয়া। বর্তমান প্রজন্মের আর্থিক সংস্কার পর্বে  ২০১৪ পরবর্তী, বিশেষত ২০১৯'র পর রাষ্ট্রায়ত্ব ক্ষেত্র একদমই ধ্বংসের কিনারায় এসে উপস্থিত হয়েছে। স্বাধীনতা আন্দোলনের সময়ে গড়ে ওঠা পরিকল্পনা কমিশনের ধারণা স্বাধীন ভারতের অর্থনৈতিক পরিকল্পনার সঙ্গে ওতপ্রতভাবে যুক্ত ছিল। পরিকল্পনা কমিশনের ভূমিকা বাদ দিয়ে রাষ্ট্রপরিচালিত অর্থনীতি ভাবাই যেত না। আজকের আরএসএস/বিজেপি পরিচালিত কেন্দ্রীয় সরকার কর্পোরেটের স্বার্থে নয়া উদারবাদের বেপরোয়া প্রয়োগ করতে গিয়ে ভারতীয় পরিকল্পনা কমিশনকেই বাতিল করে দিয়েছে। ২০১৪ সাল থেকে বেপরোয়া গতিতে প্রায় প্রতিটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠানকে বিক্রি করে দেওয়া অথবা তুলে দেওয়ার পরিকল্পনা চলছে।

রাষ্ট্রায়ত্ত্ব প্রতিষ্ঠানগুলোতে শ্রমিক কর্মচারীদের লাগাতার আন্দোলন শ্রমিক শ্রেণীর দেশব্যাপী সাধারণ ধর্মঘটের প্রভাবে যে ভাবে যে গতিতে রাষ্ট্রায়ত্ত্ব প্রতিষ্ঠানকে তুলে দিতে চায় কেন্দ্রীয় সরকার, সেভাবে তা সম্ভব হয়নি। কোভিড পরিস্থিতিতে সারা পৃথিবীর পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে বিকাশ  নিম্নগামী। ভারতীয় অর্থনীতিতেও বিকাশ নিম্নগামী।  ২২ কোটি মানুষের কাজ চলে গেছে। ৩৫ শতাংশ ক্ষুদ্র মাঝারি বেসরকারি ক্ষেত্র উঠে গেছে। ৩৭ শতাংশ স্ব-নিযুক্ত মানুষ চিরকালের জন্য বরবাদ হয়ে গেছে। সেই সময় আত্মনির্ভর ভারতের নামে আর এক দফা রাষ্ট্রায়াত্ত্ব প্রতিষ্ঠান ও রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি বিক্রি করে দেবার ঘোষণা করেছে কেন্দ্রীয় সরকার।

রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্র ধ্বংসের সর্বশেষ পদ্ধতিটি হল ন্যাশনাল মনিটাইজেশন পাইপ লাইন বা এন এম পি। এই এন এম পি'র মাধ্যমে এখনও চালু ও লাভজনক রাষ্ট্রায়ত্ত্ব শিল্প, ব্যাংক, বীমা, পোস্ট, টেলিকম, রেল প্রভৃতি প্রতিষ্ঠানগুলির কার্যত বিলগ্নীকরণ ঘটাতে বেপরোয়া উদ্যোগ নিয়েছে এই সরকার। কোভিড পর্বে সারা পৃথিবীর মতোই ভারতীয় ফার্মাসিউটিক্যালস প্রতিষ্ঠানগুলি, প্রভূত মুনাফা করতে সক্ষম হয়েছে। সারা পৃথিবীর মতোই ভারতেও এই মুনাফার গেছে বড় বড় ফার্মাসিউটিক্যালস কর্পোরেট গুলির ঘরে। ভারত সরকারের অধীনে রাষ্ট্রায়ত্ত্ব ফার্মাসিউটিক্যাল প্রতিষ্ঠানগুলিকে দূরে সরিয়ে রেখে দুটি বেসরকারি কর্পোরেটকে বিপুল পরিমাণ মুনাফার সুযোগ করে দিয়েছে মোদি সরকার। ঠিক যেমন বি এস এন এল কে ৪জি থেকে বঞ্চিত করে রিলায়েন্স সহ বেসরকারি কর্পোরেটের মুনাফার সুযোগ করে দিয়েছে মোদি সরকার।


শেয়ার করুন

উত্তর দিন