Abhas Da 1

রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রে বিনাশ (১ম পর্ব)

আভাস রায়চৌধুরী

ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে শ্রমিক কৃষক সহ আপামর ভারতবাসীর গণঅংশ গ্রহণ ঘটলেও সংগ্রামের নেতৃত্ব দেশীয় উদীয়মান বুর্জোয়া ও সামন্তদের হাতেই থেকে গেছিল। অন্যান্য উপনিবেশের মতো ভারতেও জাতীয় মুক্তি আন্দোলনে রুশ বিপ্লবের পর গুণগত পরিবর্তন ঘটেছিল। ১৯২১ সালে কংগ্রেসের আমেদাবাদ অধিবেশনে কমিউনিস্টরাই প্রথম পূর্ণ স্বাধীনতার প্রস্তাব উত্থাপন করেছিলেন। স্বাধীনতার মানে শুধুমাত্র ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্তি নয় সমাজ থেকে শ্রেণী শোষণ ও সামাজিক-নিপীড়নের অবসানের মধ্য দিয়েই সমগ্র ভারতবাসীর কাছে পূর্ণ স্বাধীনতার স্বাদ পৌঁছানো সম্ভব। অবশ্য সে সময় পূর্ণ স্বাধীনতার এই প্রস্তাব কংগ্রেসের মঞ্চে গৃহীত হয়নি। কংগ্রেসের মঞ্চে আনুষ্ঠানিকভাবে পূর্ণ স্বাধীনতার প্রস্তাব গৃহীত হয় ১৯২৯ সালে লাহোর অধিবেশনে।

তৎকালীন বিশ্ব পরিস্থিতিতে সংগ্রামের শেষ তিন দশকে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের গুণগত পরিবর্তন ঘটে। স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে শ্রমিক কৃষক সহ সাধারণ ভারতবাসী জীবন জীবিকার প্রশ্নটি ক্রমশ সামনে আসতে শুরু করে। মত-পথের ভিন্নতা সত্ত্বেও সকলের সাধারণ লক্ষ্য ছিল স্বাধীনতা। ১৯৪৭'র ১৫ আগষ্টের পর কোন পথে স্বাধীন ভারত নির্মাণ হবে এই প্রশ্নটা সামনে আসে। ব্রিটিশ ভারতের উদীয়মান বুর্জোয়া এবং সামান্তরা মিলিতভাবে স্বাধীন ভারতের শাসক শ্রেণী হিসেবে সামনে আসে। ফলে সামন্ততন্ত্রের অবশেষ কে সঙ্গে নিয়েই স্বাধীন ভারত নির্মাণের পথ পুঁজিবাদী বিকাশের রাস্তা গ্রহণ করেছিল।

ভারত যখন স্বাধীন হচ্ছে তখন পৃথিবী আড়াআড়ি দুটো ভাগে বিভক্ত।  পুঁজিবাদী পৃথিবী ও সমাজতান্ত্রিক পৃথিবী। মাঝখানে উপনিবেশের দেশগুলি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের বিজয়ের পথ ধরে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। এদের একটা বড় অংশ পরবর্তীকালে জোট নিরপেক্ষ শিবির হিসেবে নিজেদেরকে প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছিল। ভারতের ভূমিকা সেক্ষেত্রে ছিল অন্যতম নেতৃত্বকারী। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে দুর্দমনীয় ফ্যাসিবাদকে পরাস্ত করে সারা পৃথিবীতে সমাজতন্ত্র তখন অগ্রসরমান শক্তি। সমাজতন্ত্রের পরিকল্পিত অর্থনীতির প্রভাবে এবং পুঁজিবাদকে রক্ষার স্বার্থে পুজিবাদী দেশগুলিতেও উদারনীতির পরিবর্তে রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত পরিকল্পিত অর্থনীতি গ্রহণ করা হয়েছিল। এই পরিকল্পিত রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদ অবশ্য পরিচিতি লাভ করেছিল জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্রতত্ত্ব ও অর্থনীতি নামে। স্বাধীন ভারতের পুঁজিবাদী পথের বিকাশে এই উভয়ের প্রভাব রয়েছে। অর্থাৎ বিকাশের পথ ছিল পুঁজিবাদী, কিন্তু তা ছিল প্রধানত রাষ্ট্রপরিচালিত।

স্বাধীন ভারত নির্মাণের এই পুঁজিবাদী পথের আরও কিছুটা পরিপ্রেক্ষিত রয়েছে। ১৯৩০ এর দশক থেকেই বিভিন্ন সময়ে জাতীয় কংগ্রেস কমিটির অধিবেশনে কৃষি উন্নয়ন ও স্বাধীন ভারতের অর্থনীতি সম্পর্কে চিন্তাভাবনা শুরু হয়। অবশ্য এই সমস্ত চিন্তা ভাবনা গুলি ছিল গান্ধীবাদী ধারায় স্বয়ংসম্পূর্ণ গ্রাম ভারত নির্মাণের আধারে। ১৯৩৮ এ হরিপুরা কংগ্রেসে সুভাষচন্দ্র বসু জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি হবার পরে স্বাধীন ভারতের জন্য পরিকল্পনা কমিশন গঠন করেন। জাতীয় কংগ্রেসের ঐ পরিকল্পনা কমিশনের সভাপতি ছিলেন পন্ডিত জহরলাল নেহেরু এবং সচিব ছিলেন টি কে শাহ। এই একই সময়ে ১৯৪৪ এ যখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের গতিপ্রকৃতি অনেকটাই স্পষ্ট হচ্ছে, পুরনো কায়দায় আর ভারতকে সাম্রাজ্যবাদী অধীনতায় বেঁধে রাখা অসম্ভব সম্ভব এই ধারণা স্পষ্ট হচ্ছে সেই সময় টাটা বিড়লা সহ তৎকালীন উদীয়মান ভারতীয় বুর্জয়াদের নেতৃত্বে ১৯৪৪ এ বোম্বাই প্ল্যান ঘোষণা করা হয়। স্বাধীনতার পরে পন্ডিত নেহেরু আনুষ্ঠানিকভাবে কখনোই বোম্বাই প্ল্যান কে গ্রহণ করেননি। কিন্তু জাতীয় কংগ্রেসের পরিকল্পনা কমিশনের ভিত্তিতে স্বাধীন ভারতের রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে বোম্বাই প্ল্যানের প্রভাব ছিল।

constituent-assembly-of-india

সোভিয়েত ইউনিয়নের পাঁচশালা পরিকল্পনার ধাঁচে ভারতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছিল। প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় জোর পড়েছিল কৃষি বিকাশের পথে অর্থনৈতিক উন্নয়নে। দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় গুরুত্বের দিক থেকে সামনে চলে আসে রাষ্ট্র নির্মিত ভারী শিল্প। যদিও ভারতের এই নতুন শাসক শ্রেণী সামন্ততন্ত্রের অবসানের জন্য শেষ পর্যন্ত লড়াই করেনি। ভূমি সংস্কার করা হয়নি। অর্থাৎ বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবকে অসম্পূর্ণ রেখেই পুজিবাদী পথে স্বাধীন ভারত নির্মাণ শুরু হয়েছিল। দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে শিল্প গড়ে তোলা ও রাষ্ট্র পরিচালিত অর্থনীতি কে পন্ডিত নেহেরু সমাজতান্ত্রিক ধাঁচের অর্থনীতি বলে উল্লেখ করেছিলেন। অর্থ সামাজিক ও রাজনৈতিক বিচারে যা কখনোই সমাজতন্ত্র ছিল না বরং বলা ভালো যা পরের দিকে জনপ্রিয় হয়েছিল মিশ্র অর্থনীতি বলে। তার মূল বৈশিষ্ট্য ছিল রাষ্ট্র শিল্পের মৌলিক ক্ষেত্রগুলি গড়ে তুলবে এবং বেসরকারি ক্ষেত্রে গড়ে তুলবে উপভোক্তামূলক শিল্প গুলি।

শতাব্দী প্রাচীন ঐতিহ্যশালী গণ সংগ্রামের পরিপ্রেক্ষিত নিয়েও শেষ পর্যন্ত ভারতের স্বাধীনতা এসেছিল আপোষের পথে, দেশভাগের পথে। শাসক শ্রেণীর সীমাবদ্ধতার ফলে ভারতে রাষ্ট্র পরিচালিত পুঁজিবাদের সীমাবদ্ধতা থাকলেও স্বাধীন ভারত অর্থনৈতিকভাবে স্বনির্ভরতার পথে এগোতে পেরেছিল। আজ স্বাধীনতার ৭৫ বছরে এসে সেই স্বনির্ভরতা ভয়ংকর বিপদের মুখে। রাষ্ট্র ক্ষমতায় প্রতিষ্ঠিত আরএসএস/বিজেপি বেপরোয়া ভাবে ভারতের অর্থনৈতিক সার্বভৌমত্বের মূল ক্ষেত্র রাষ্ট্রায়ত্ত্ব প্রতিষ্ঠান ও অর্থনীতি পরিচালনায় রাষ্ট্রের ও সরকারের ভূমিকা কে বাতিল করতে বেপরোয়াভাবে তৎপর।


শেয়ার করুন

উত্তর দিন