জ্যোতি বসু রবে অনির্বাণ অন্তরে

জন্মঃ ৮ জুলাই ১৯১৪                                                                                   মৃত্যুঃ ১৭ জানুয়ারি ২০১০ আমরা সবাই জানি প্রকৃতির নিয়মে জন্ম হলে একদিন মৃত্যু আসবেই। কিন্তু কিছু ক্ষেত্রে এই অনিবার্য ঘটনাকে মেনে নেওয়াটা সবার পক্ষেই অত্যন্ত কষ্টদায়ক হয়ে ওঠে, যখন সেই মানুষটির নাম সর্বজন শ্রদ্ধেয় কমরেড জ্যোতি বসু। বিশেষ করে বর্তমান পরিস্থিতিতে প্রতিটি বাঁকে ও মোড়ে কমরেড জ্যোতি বসুর অনুপস্থিতি আমরা অনুভব করছি। আমৃত্যু তিনি নিজ গুনে গোটা ভারতবর্ষে কমিউনিস্ট আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া এবং গরীব খেটে খাওয়া মধ্যবিত্ত মানুষকে সংগঠিত করার কাজে নিজেকে নিয়োজিত করেছিলেন। ভারতবর্ষের সংসদীয় রাজনীতির ইতিহাসে এক উজ্জ্বলতম নক্ষত্র হিসাবে তিনি সারা জীবন কাজ করে গেছেন। গোটা ভারতবর্ষের অন্যান্য রাজনৈতিক দলের কাছেও অভিভাবক সম ব্যক্তিত্ব হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছিলেন। দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে এই উপমহাদেশেও একজন কমিউনিস্ট নেতা হিসেবে নিজেকে উপস্থিত করেছিলেন। প্রকৃতপক্ষে শুধুমাত্র কমিউনিস্ট আন্দোলনের নয়, তিনি আধুনিক ভারতবর্ষের একজন অন্যতম প্রবাদপ্রতিম ব্যক্তিত্ব। ইংল্যান্ডে গিয়ে ব্যারিস্টার হওয়ার সময় তিনি কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকতাবাদের প্রতি আকৃষ্ট হন ও মতাদর্শকে বরণ করে নেন। ১৯৪০ সালে ভারতবর্ষে ফিরে আইনজীবীর কালো কোর্ট না পরে, কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগদান করে সরাসরি ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন। কার্ল মার্কস এক সময় বলেছিলেন, 'যে যখন একটি ভাবনা জনগণের মনকে আলোড়িত করে, তখন তা এক বাস্তব শক্তি হয়ে ওঠে।' ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীনতার ইচ্ছা যখন ভারতবর্ষের মানুষকে আলোড়িত করছে তখন কমরেড জ্যোতি বসু কমিউনিস্ট আন্দোলনে যোগদান করেছিলেন। যদিও স্বাধীন ভারতের রাষ্ট্র চরিত্র এবং তার উপাদান কি হবে, তা নিয়ে তাঁর চিন্তা আরো অগ্রসর ছিল। এমন একটি সমাজতান্ত্রিক সমাজ তৈরি করা, যেখানে মানুষের উপর মানুষের শোষণ বিলুপ্ত হবে। আমাদের দেশের সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলি সর্বদাই আধুনিক ভারতের বিবর্তনের বিরোধী শক্তির প্রতিভূ হয়ে থেকেছে। কমরেড জ্যোতি বসু এই সাম্প্রদায়িক শক্তিকে বিচ্ছিন্ন এবং পরাস্ত করা ও ধর্মনিরপেক্ষতার নীতিকে শক্তিশালী করার জন্য কাজ করে গেছেন। পাশাপাশি, ভারতের রাজনৈতিক স্বাধীনতাকে জনগণের অর্থনৈতিক স্বাধীনতায় রূপান্তরিত করার জন্য, সমাজতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম কে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে তিনি সম্পূর্ণভাবে মনোনিবেশ করেছিলেন। কিভাবে তা অর্জিত হবে এই বিষয়ে ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলনের ভেতরে এক তীব্র মতাদর্শগত লড়াই শুরু হয়। বাম ও দক্ষিণপন্থী এই দুই বিচ্যুতির বিরুদ্ধে সরাসরি লড়াই করে অন্যান্য কমরেডদের সাথে কমরেড জ্যোতি বসু সি পি আই(এম) গঠন করেন ১৯৬৪ সালে। সংসদীয় গণতন্ত্র, তার প্রতিষ্ঠান এবং মঞ্চগুলিকে ব্যবহার করে আন্দোলন এবং একইসাথে জনগণের কাছে আরো বেশি সুবিধা পৌঁছে দেওয়ার সংগ্রামে কমরেড জ্যোতি বসু ছিলেন অনবদ্য। একটানা মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন আধুনিক ভারতের সংহতির লক্ষে ভুমিসংস্কার রূপায়ণ, পঞ্চায়েতীরাজ প্রতিষ্ঠান গুলির উন্নতিসাধন করে গণতন্ত্রকে শিকড়ের গভীরে পৌঁছে দেওয়া, ভারতের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোকে শক্তিশালী করার জন্য কেন্দ্র-রাজ্য পুনর্বিন্যাসের প্রয়োজনীয়তা ইত্যাদি বিষয় গুলি কমরেড জ্যোতি বসুর বিশেষ অবদান হিসেবে স্বীকৃত। এই সমস্ত বিষয়গুলি ছাড়া জ্যোতি বসুর ব্যক্তিত্বের প্রধান দিক যা জনগণ কে আকৃষ্ট করতো তা হলো মানুষের প্রতি অবিচল আস্থা। শ্রমিক-কৃষক, সাধারণ মানুষের জন্য আধুনিক বাংলার প্রকৃত রূপকার ছিলেন কমরেড জ্যোতি বসু। তথাকথিত ‘বাংলার রূপকার’, পশ্চিমবঙ্গের প্রথম মুখ্যমন্ত্রী ড. বিধান চন্দ্র রায়, কিংবা রাজ্যের গণতন্ত্রের ‘কালাপাহাড়’ সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায় বাংলাকে শুধুই ‘হতদরিদ্র’ রেখে গিয়েছে।হ্যাঁ, গ্রামীন দারিদ্রে দেশের রাজ্যগুলির মধ্যে সবচেয়ে গরীব, সার্বিক দারিদ্রের হারে দ্বিতীয় ছিল পশ্চিমবঙ্গ।যোজনা কমিশনের একাদশ পরিকল্পনায় (ভলিউম-৩, পৃষ্ঠা ১০০-১০১) তার স্বীকারোক্তি: ১৯৭৩-৭৪, গ্রামীন দারিদ্রের হার ছিল ৭৩.২ শতাংশ (সমস্ত রাজ্যের মধ্যে শীর্ষে, এমনকি ওড়িশারও পিছনে), যেখানে জাতীয় গড় ছিল ৫৬.৪ শতাংশ।

জ্যোতি বসুর নেতৃত্বে বামফ্রন্ট সরকার। ভূমি সংস্কার, ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ, ত্রিস্তর পঞ্চায়েত।২০০৪-০৫, দারিদ্রের হার নেমে আসে ২৮.৬ শতাংশে।সার্বিক দারিদ্রের হার এই সময়ে ৬৩.৪ শতাংশ থেকে কমে হয় ২৪.৭ শতাংশ।যেখানে জাতীয় গড় ৫৪.৯ শতাংশ থেকে কমে হয় ২৭.৫ শতাংশ।জাতীয় নমুনা সমীক্ষা (এনএসএসও)-র ৬৯ দফার প্রতিবেদন জানায়: ২০১০-১১, রাজ্যে গ্রামীন বাজারের আয়তন বেড়ে হয়েছে ২৯,০০০ কোটি টাকা।

এই দুরন্ত বাস্তবকে, বামফ্রন্ট সরকারের এই বেনজির সাফল্যকে কেউ মুছে ফেলতে পারবে না ইতিহাসের পাতা থেকে। ২০০৩ সালের ৪ঠা এপ্রিল চিকিৎসা বিজ্ঞানের জন্য তার মরণোত্তর দেহ দানের অঙ্গীকার পত্রে সই করতে গিয়ে কমরেড জ্যোতি বসু লিখেছিলেন, "একজন কমিউনিস্ট হিসাবে ,জীবনের শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত মানবজাতির সেবায় নিয়োজিত থাকার জন্য আমি অঙ্গীকারবদ্ধ। আমি খুশি যে এখন এমনকি মৃত্যুর পরেও আমি এই সেবা করতে পারবো।" সারা জীবন লড়াই করার অদম্য ক্ষমতা  ধরে রেখে দেখিয়েছেন কমরেড জ্যোতি বসু। অসুস্থ অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি করার পরে টানা ১৭ দিন লড়াই চালিয়ে ১৭ই জানুয়ারি ২০১০, সকাল ১১ টা ৪৭ মিনিটে কমরেড জ্যোতি বসুর জীবনাবসান হয়। ১৯ শে জানুয়ারি পুর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় গান স্যালুট দিয়ে শেষ বিদায় জানানো হয় কমরেড জ্যোতি বসু কে। কমরেড বসু পলিট ব্যুরোর ৯ জন সদস্যের অন্যতম এবং ঐ ঝোড়ো দিনগুলিতে সি পি আই (এম) প্রতিষ্ঠার সময় নবরত্নের শেষ ব্যক্তি হিসাবে তিনি বিদায় নিয়েছেন। মানুষের মুক্তির লক্ষ্যে আমাদের সংগ্রামকে আরো শক্তিশালী করার মাধ্যমে আমরা কমরেড জ্যোতি বসুর প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে পারবো।


শেয়ার করুন

উত্তর দিন