ওয়েবডেস্ক প্রতিবেদন
ভারতীয় টাকার মূল্যে রেকর্ড পতন ঘটেছে। আন্তর্জাতিক ভেহিকল কারেন্সির অন্যতম হল ডলার, আজ সকালে এক ডলার খরিদ করতে ভারতীয় মুদ্রায় ৭৯ টাকা ৯১ পয়সা খরচ করতে হচ্ছে। গতকাল কারেন্সি এক্সচেঞ্জের ওঠানামায় কিছুক্ষণের জন্য সেই দাম ৮০ টাকারও বেশি হয়েছিল।
ভারতে অভ্যন্তরীণ বাজার ভয়াবহ মূল্যবৃদ্ধিতে (জুন মাসের হিসাবে ৭.১%) আক্রান্ত। খাদ্যসামগ্রীর দামই বেড়েছে সর্বাধিক, একইসাথে বেড়ে চলেছে পরিবহন খরচ- পেট্রোল, ডিজেলের দাম। কোভিড মহামারীর দুই বছর কেটে যাওয়ার পরেও ভারতের অর্থনৈতিক অবনমন জারী রয়েছে। মোদী সরকার চাইছে মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন (জিডিপি)’র হার তুলে ধরে প্রকৃত অবস্থা চাপা দিতে।
টাকার দাম কমে কেন সেই বিষয়ে আলোচনার আগে দেখে নেওয়া যাক অর্থনৈতিক অবস্থার নিরিখে আমরা কোথায় রয়েছি।
জিডিপি’র হার দিয়ে দেশের প্রকৃত দুর্দশার কথা জানা যাবে না। ছোটদের অর্থনীতিতেই তার জবাব রয়েছে। দেশীয় বাজারে উৎপাদিত মোট পণ্যসামগ্রীর লম্বা খতিয়ান ব্যখ্যা দিতে পারে না কেন সরকারী খাদ্যভাণ্ডারে বিপুল মজুত থাকলেও রেশনের সুবিধা প্রতি বছর কমিয়ে দেওয়া হয়, কেন গরীব পরিবারের ছেলেমেয়েদের মিড ডে মিলের বরাদ্দ আরও কমে কিংবা কোভিডের মত মহামারীর মোকাবিলায় লকডাউনের ফলে কাজ হারানো পরিবারগুলিকে মাসে ৭৫০০ টাকা দেওয়া যায় না।
ভারতের জিডিপি বৃদ্ধির হার ৮.৭ শতাংশ- ২০২১ সালের সরকারী তথ্য। এই পর্বেই আমাদের দেশে বেকারির হার সর্বোচ্চ- ৮.১০ শতাংশ, গোটা দেশের ৪৫.৭৮% শ্রমিকই স্বনিযুক্তি কিংবা অসংগঠিত ক্ষেত্রে কর্মরত। এদের ন্যুনতম মজুরি নেই, নেই অবসরকালিন পেনশন, এমনকি কাজে যুক্ত থাকাকালীন দুর্ঘটনা সংক্রান্ত নিশ্চয়তাটুকুও নেই। এই সময়েই (জুন- ২০২২’র হিসাব) আমাদের দেশে কাজ হারিয়েছেন এক কোটি তিরিশ লক্ষ মানুষ। দেশের জনগণের টাকায় গড়ে তোলা রাস্ট্রায়ত্ত্ব সম্পদ এলআইসি’র শেয়ার কম দামে বেচে দিয়েছে মোদী সরকার। বিক্রি করতে চাইছে ভারতীয় রেল সহ যাবতীয় সরকারী ব্যংকপরিষেবার পুরোটাই। এমনকি দেশের সেনাবাহিনীতেও ঠিকা সেনা নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি জারী হয়েছে। মোদীর আমলে ঘোষিত নীতি- একচেটিয়া বেসরকারিকরণ। অর্থাৎ যখন দেশের মানুষ বেকারি, মূল্যবৃদ্ধি এবং মহামারীর প্রকোপে বিপর্যস্ত ঠিক তখনই এলোমেলো অবস্থার সুযোগকে কাজে লাগিয়ে (পড়ুন সংসদীয় ব্যবস্থার আদ্যশ্রাদ্ধ করে) যাবতীয় পণ্য এবং পরিষেবা ক্ষেত্রকে জনসাধারণের কল্যানে ব্যবহারের বদলে বেসরকারি কর্পোরেটদের হাতে বিরাট মুনাফার সুযোগ রয়েছে এমন উপহার হিসাবে তুলে দেওয়া হচ্ছে। মহামারী পর্বে আর্থিক সংস্থান না থাকার অজুহাতে লক্ষ লক্ষ গরীব পরিবারগুলিকে কিছুতেই ডিরেক্ট ক্যাশ ট্রান্সফার করতে রাজি হয় নি মোদী সরকার অথচ ঐ একই পর্বে কর্পোরেটদের কর ছাড় দেওয়া হয়েছে ১.৪৫ লক্ষ কোটি টাকা।
এই অবস্থায় ভারতীয় টাকার দাম কমতে থাকলে তার প্রভাবে মূল্যবৃদ্ধি আরও বাড়বে, আরও তীব্র হবে বেকারি। আসলে মূল সমস্যা কারেন্সি এক্সচেঞ্জ নয়, আসল কথা হল অভ্যন্তরীণ বাজারে চাহিদার বিরাট ঘাটতি রয়েছে। এই ঘাটতির কারণ জনসাধারণের ক্রয়ক্ষমতা কমেছে। এমন অবস্থায় দাম বাড়িয়ে মুনাফার হার এক রাখতে চাওয়া পুঁজিবাদী বন্দোবস্ত রপ্তানির যোগান বাড়িয়ে দিয়েছে। সোজা কথায় দেশের বাজারে মুনাফা লুটতে না পেরে বিদেশের বাজারে দেশীয় পণ্যের যোগান বেড়েছে। বাজারে আচমকা যোগান বাড়লে কি হয় সকলেই জানে। রপ্তানির যোগান বাড়ানোর ফলেই ভারতের বাজার থেকে পুঁজি সরে যাচ্ছে। ক্যাপিটাল মার্কেটে বিনিয়োগের এমন নড়াচড়াতেই টাকার দাম কমছে।
দেখে নেওয়া যাক মোদী সরকার আসীন হওয়ার আগে অবধি টাকার দামের অবস্থা কেমন ছিলঃ
শক্তিশালী ধনতান্ত্রিক দেশগুলি এমন পরিস্থিতির মোকাবিলায় আগাম পরিকল্পনা হিসাবে নিজেদের রিজার্ভ ফান্ডে একাধিক (ন্যুনতম দুইটি) কারেন্সির বন্দোবস্ত করে রাখে। একে বলে হেজিং এগেন্সট ফরেন এক্সচেঞ্জ রেট ফ্লাকচ্যুয়েশন। ২০০৪ সালে আমেরিকান ডলারের সাথে মোকাবিলা করতে ইউরো কারেন্সি সেই পথেই হেঁটেছিল। সেই কারনেই একমুখী বাণিজ্যনীতি আজকের অর্থনীতিতে আর চলে না। স্বাধীনতার পরে ভারত সরকারের বৈদেশিক নীতি ছিল জোট নিরপেক্ষ, সেই পথেরও সীমাবদ্ধতা থাকলেও সংকটের সময় যখন ‘বড় ভাই’র মতো বন্ধু নিংড়ে নেওয়ার নীতিতে লুটে নিতে চায় তখন বাজারে নতুন বন্ধুর সাথে হাতে মেলানোর সুযোগটুকু ছিল। ডলার অন্যতম শক্তিশালী কারেন্সি, কিন্তু ইউরোপে এখন যুদ্ধের আবহাওয়া। সেই যুদ্ধ যেমন রাশিয়ার সাথে ন্যাট’র, তেমনই ডলারের সাথে অন্যদেরও। এই সুযোগে আমরা ‘অধস্তন মিত্র’র অবস্থা কাটিয়ে উঠতে পারতাম, কিন্তু মোদী সরকার মার্কিন প্রশাসনের স্বার্থরক্ষায় (কোয়াড জোট) নিবেদিত প্রাণ।
ক্যালকুলাসের হিসাব কষে, গ্রাফ এঁকে ভারতীয় মুদ্রার অবনমন ব্যখ্যায় অসামান্য গবেষণা করা যেতেই পারে। বানিজ্য ঘাটতি, রেট অফ এক্সচেঞ্জ, রিজার্ভ হেজ ফান্ড ইত্যাদির প্রসঙ্গ কেউ তুলতেই পারেন। কিন্তু কাজের কথা আগেও যা ছিল আজও তাই আছে- ‘দ্য পয়েন্ট, হাউএভার, ইজ টু চেঞ্জ ইট’! এই চেঞ্জ করতে লাগে অর্থনৈতিক পরিকল্পনা। সেই পরিকল্পনা হতে হবে একচেটিয়া ক্ষমতার বিরুদ্ধে, ডলারের মালিকানার বিরুদ্ধে, ডলারের রাজনীতির বিরুদ্ধে। তাই মোদী সরকার যতই এহেন সমস্যার ব্যখ্যায় অর্থনীতির তত্ত্বকথা আওড়াক না কেন হ্যামলেটের দুঃস্বপ্নের মতোই বারে বারে যার প্রসঙ্গ ফিরে আসবে তাকে বলে রাজনৈতিক-অর্থনীতি। অবশ্য এই বিষয়ে মোদী সরকারের অবস্থান স্পষ্ট- তারা নিজেদের নাক কেটেও ডলারের প্রমোদ ভ্রমণ আটকাতে চান না।
আজকের পরিস্থতিতে লাভ কার? এই একটি কথাতেই সবটা পরিস্কার হয়ে যায়। আন্তর্জাতিক বাজারে আমাদের কেনা-বেচা সবচাইতে বেশি হয় মার্কিন ডলারে। টাকার দাম কমলে আমরা বাইরে থেকে যাকিছু কিনব তাতে খরচ হবে বেশি, আবার যা বিক্রি করব তাতে লাভ হবে কম। মুদ্রাদোষের এমন অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে আন্তরিক যেকোনো পরিকল্পনাই শেষ অবধি ভারতকে নয়া-উদারবাদী বন্দোবস্তের বিরুদ্ধে নিয়ে যাবে।
সেই পরীক্ষায় মোদী সরকারের অবস্থান মেধা তালিকার বাইরেই।
ঐ পরীক্ষায় বসতেই চান নি বলেই তারা ভারতের ক্ষমতায় বসেছেন।
ওয়েবডেস্কের পক্ষেঃ সৌভিক ঘোষ
ছবিঃ সোশ্যাল মিডিয়া