নতুন ষড়যন্ত্র – ত্রিবেণী কুম্ভ মেলা

দেবব্রত ঘোষ

একটি মিথ্যাকে সত্য হিসাবে প্রতিষ্ঠা করতে সঙ্ঘ পরিবার এবং বিজেপি হিটলার, গোয়েবেলসকে প্রথম থেকে অনুসরণ করে আসছে। যেমন তাদের ফ্যাসিবাদী কার্যকলাপকে প্রকাশ্যে সমর্থন করে এসেছে। বহুদিন ধরে বাবরি মসজিদ রাম মন্দিরের উপর প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে বলে প্রচার করতে করতে একটি পর্যায় এসে রহস্যজনক ভাবে তাকে আইনী বৈধতা দেওয়া হল। যেমন প্রচার করে সমুদ্রগুপ্ত কুতুব মিনার তৈরি করেছিলেন এবং তার আসল নাম বিষ্ণু স্তম্ভ। অথচ সমুদ্র গুপ্তের রাজত্বকাল ছিল ৩২০ থেকে ৩৮০ খ্রিস্টাব্দে। আর কুতুব মিনার তৈরি হয় ১১২০খ্রিস্টাব্দে। এই কাজ শেষ করেন ইলতুতমিস। রাম মন্দির প্রতিষ্ঠার আন্দোলন বিশ্ব হিন্দু পরিষদ ‘অযোধ্যায় রক্তরঞ্জিত ইতিহাস’ নামে একটি বই বিপুল ভাবে প্রচার করে। এতে বলা হয়েছিল ১৫২৮সাল থেকে হিন্দুরা ৭৮বার রাম মন্দির উদ্ধারে সক্ষম হয়েছে। আরেকটি বই ‘সংস্কৃত জ্ঞান প্রশ্নোত্তরী’-তে দেখানো হয়েছে ১৫২৮ থেকে ১৯১৪সাল পর্যন্ত ৩লক্ষ ৫০হাজার রাম ভক্ত রাম মন্দির প্রতিষ্ঠার জন্য প্রাণ দিয়েছেন। যেমন নীরবে প্রচার করছে তাজমহল আসলে শৈব মন্দির।

উদাহরণের সংখ্যা না বাড়িয়ে স্পষ্ট প্রশ্ন হলো এসব প্রচারের ভিত্তি কী ? কোন প্রামাণ্য নথি আছে ? বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, গবেষণার কোন ফলাফল আছে ? না, কোনটার ক্ষেত্রেই এসব নেই। কিছু মানুষ তাদের মনগড়া ধারণা থেকে কিছু বই আকারে লিখে তাকে ঢাক ঢোল পিটিয়ে প্রচার করলেই তা প্রকৃত ইতিহাসের সত্য ঘটনা হয় না।

একই কায়দায় প্রচার হচ্ছে, হুগলী জেলার তথাকথিত ত্রিবেণীর কুম্ভ মেলা। ২০২৩ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি দেখা গেল হঠাৎ করেই বহু বহিরাগত সাধু, সন্ন্যাসীদের নিয়ে মেলার আয়োজন করতে। পরিকল্পনা বিজেপি, কেন্দ্রীয় সরকার, সঙ্ঘ পরিবারের, আর কার্যকর করার সমস্ত দায়িত্ব নিল তৃণমূলের প্রশাসন। এমনকি প্রধানমন্ত্রীও তাঁর ২৬ ফেব্রুয়ারির ‘মন কী বাত’-এ ত্রিবেণীর কুম্ভ মেলার উল্লেখ করে বললেন, এখানে আবার কুম্ভমেলা হচ্ছে, এ খুব গর্বের। এখানেও প্রচার করা হচ্ছে, গবেষণা করে নাকি দেখা গেছে, ৭০০বছর আগে এখানে কুম্ভ মেলা হত। আর একটা অপপ্রচার চলছে যে, জাফর খান গাজীর দরগাটি ‘দেবতা বিশ্বকর্মার সৃষ্টি এবং মুসলমানেরা সেটি ধ্বংস করছে’। গত ২৫-৩০ বছর ধরেই আরএসএস এমন প্রচার করছে। এর সপক্ষে কিছু ব্যক্তি বহুদিন ধরেই নানান যুক্তিকে খাড়া করছেন। তার মধ্যে একটি হল জাফর খান গাজীর দরগায় সংস্কৃত শিলালিপি দেখা গেছে। অথচ যিনি এই কথা উল্লেখ করছেন, তিনি আবার উল্লেখ করছেন, ‘জাফর খানের গঙ্গার প্রতি বিশেষ শ্রদ্ধা ছিল এবং গঙ্গার স্তবমালার মধ্যে সংস্কৃত ভাষায় সুললিত ছন্দে যে স্তবটি আছে তা জাফর খান (ওরফে দরাফ খান) রচিত বলিয়া প্রসিদ্ধ। জাফর খানের গঙ্গা ভক্তির কারণ তাহার তৃতীয় পুত্র বরখান খান গাজী হুগলীর রাজকন্যাকে বিবাহ করেন। উক্ত রাজকন্যার গঙ্গা ভক্তির জন্যই জাফর খান এবং তাহার পুত্রগণ গঙ্গাদেবীর প্রতি শ্রদ্ধা সম্পন্ন হইয়া ছিলেন। হুগলীর রাজকন্যা গঙ্গার আরাধনা করিয়া বহু অলৌকিক কাজ করে তাহা দেখিয়া জাফর খানও গঙ্গাদেবীর পূজা করিতেন।’ (সুধীর কুমার মিত্র, হুগলী জেলার ইতিহাস ও বঙ্গ সমাজ)। উল্লিখিত বইটি ভালো করে বিশ্লেষণ করলে বহু স্ববিরোধী বিবরণ দেখা যায়। এসবের কোন প্রমাণ ছাড়াই আরএসএস এবং সঙ্ঘ পরিবারের মাইক্রলেভেল সোশ্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং-এর কাজ চলছে। সম্প্রতি তথাকথিত ত্রিবেণী কুম্ভ মেলাকে কেন্দ্র করে আর একটি আজগুবি বিষয়ও আনা হল, তা হচ্ছে, মেলার সময় একটি জেটি তৈরি হল এবং সেই জেটির নাম দেওয়া হল সপ্তঋষি। মুখে মুখে ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে সাতজন ঋষি এখানে স্নান করেছিলেন। এই জেলায় আগে এই অঞ্চলের একজন মানুষও এই কথা কোনোদিন শোনেননি।

যাই হোক সত্য প্রতিষ্ঠা করতে হলে কিছু ব্যক্তির বই বা তথাকথিত কল্পিত ইতিহাসের ভিত্তিতে কখনও প্রমাণ হয় না। বিজ্ঞান, প্রযুক্তি এবং যে গবেষণার বা প্রামাণ্য দলিল আন্তর্জাতিক স্তরে স্বীকৃতি আদায় করেছে তেমন কোন বিষয় এখনও আমাদের জানা নেই। কাঞ্চন ব্যানার্জির মতন কিছু ব্যক্তি  যাঁর স্ত্রী আবার সক্রিয় ভাবে সঙ্ঘ পরিবার এবং বিজেপির সংগঠক, ২০২১সালের নির্বাচনের আগে সক্রিয় ভাবে পশ্চিমবাংলার প্রচারে অংশ নিয়েছেন, তাঁর গবেষণা যে নির্দিষ্ট স্বার্থেই হয়েছে, তা বুঝতে অসুবিধা হয় না।

এই দরগায় গিয়ে দেখা যাবে ভারত সরকারের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের যে বিজ্ঞপ্তি আছে সেখানে উল্লেখ আছে- এই সৌধটি দুটি মসজিদ নিয়ে গঠিত। দরগাটি হল ছাদবিহীন দু-প্রকোষ্ঠযুক্ত কক্ষ যেটি ইট ও পাথরের তৈরি। এই দরগাটি ১২৯৮ সালে দিল্লির সুলতানের সেনা প্রধান জাফর খান গাজী নির্মাণ করেন যা মসজিদের কেন্দ্রীয় মিহরাবের উপর আরবি লিপি থেকে স্পষ্ট। প্রার্থনা হলঘরটি পাঁচটি পাথরের তল যুক্ত ধনুকাকৃতি খিলানের মধ্য দিয়ে প্রবেশ করেছে এবং সারিবদ্ধ অলংকৃত স্তম্ভদ্বারা দুটি কুলুঙ্গিতে বিভক্ত হয়েছে। দশ গম্বুজযুক্ত প্রাচীন মসজিদটি মাদ্রাসা হিসেবেও ব্যবহৃত হতো, যার বেশিরভাগ গম্বুজ এখন ধ্বংসপ্রাপ্ত। এই সমাধিটি পূর্ব ভারতের বর্তমান সবচেয়ে প্রাচীন সুন্দর/ জমকালো সমাধি, যা ১৩১৫খ্রীঃ হয়েছিল। এর পশ্চিমে একটিতে উলুগ-ই-আজম হুমায়ুন জাফর খান গাজী, তাঁর দুই পুত্র আইন খান গাজী এবং খাইন খান গাজীর এবং ছোট ছেলে বারখান গাজীর স্ত্রীর সমাধি আছে। পূর্বদিকে বারখান ও তার দুই পুত্র রহিম খান এবং করিম খানের সমাধি আছে। এই সৌধটিও সম্ভবত মাদ্রাসা হিসেবে ব্যবহৃত হতো। দেওয়ালগুলির বেশিরভাগ বড় বড় ব্যাসল্ট ফলক যুক্ত। মসজিদ ও সমাধি দুটিতেই আগের কোনো কাঠামোর স্থাপত্যশিল্প ও ভাস্কর্যযুক্ত প্রস্তর ব্যবহৃত হয়েছে। দরগাটি ২৭/০৭/১৯০৮ তারিখে (ভাইড বি.জি. ৬৩৮৮) জাতীয় ও গুরুত্বপূর্ণ সৌধ হিসাবে ঘোষিত হয়েছে।

বাংলার দ্বিতীয় মাদ্রাসাটি এখানেই স্থাপিত হয়েছিল। প্রথমটি হয়েছিল ঢাকার অদূরে সোনারগাঁতে।

আসল লক্ষ্য হল যুগ যুগ ধরে জাফর খান গাজীর দরগাকে কেন্দ্র করে গঙ্গার দুই পারের সব ধর্মের বিশেষ করে হিন্দু ও মুসলমান সম্প্রদায়ের সহাবস্থান এবং যে ঐক্য ও সম্প্রীতি বজায় আছে তাকে রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থ করতে ফাটল ধরানো। দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে অবিশ্বাসের বাতাবরণ তৈরি করা। তৃণমূলের যা কাজ তাই করছে। অর্থাৎ সঙ্ঘ পরিবার ও বিজেপির উদ্দেশ্য এবং কর্মসূচিকে বাস্তবায়িত করতে সবরকম ভাবে সাহায্য করা যা স্থানীয় পৌরসভা, বিধায়কদের ভুমিকা ইতিমধ্যে দেখা গেছে। পশ্চিমবাংলার হিন্দুত্ববাদী শক্তিকে সবরকম ভাবে জায়গা করে দেওয়াই ওদের কমিটমেন্ট। বিগত ২০১১সাল থেকে ধারাবাহিক ভাবে করে যাচ্ছে।

মূল কথা হলো যত বড় ব্যক্তি হোন না কেন, তিনি যাই ব্যাখ্যা করুন, লিখে থাকুন কোন প্রমাণ নথি ছাড়া সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয় না। এভাবেই বিজেপি দেশের বিকৃত, মিথ্যা ইতিহাস দেশবাসীর সামনে আনার প্রক্রিয়া জারি রেখেছে। বিজেপি ইতিহাস পুনর্লিখন করতে চাইছে কেন ? এর উত্তরে বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ অধ্যাপক ইরফান হাবিব সম্প্রতি বলেছেন, তাদের একটি উদ্দেশ্য মুসলমানদের শত্রু বলে খাড়া করা।

বিজেপি-সঙ্ঘ পরিবার কীভাবে ইতিহাসকে বিকৃত করছে তার দু’একটি উদাহরণ দেওয়া যাক। বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ রামশরণ শর্মার এনসিয়েন্ট ইন্ডিয়া বইয়ের ২০-২১পৃষ্ঠার একটি অনুচ্ছেদে লেখা আছে, পৌরাণিক সাহিত্যের সূত্র ধরে অযোধ্যায় রামের থাকার সময় ২৩০০খ্রিস্টপূর্ব নির্ণয় করা যেতেই পারে, কিন্তু অযোধ্যায় ওই সময়ে মানুষ বসবাসের কোন চিহ্ন পুরাতাত্ত্বিক খননের মাধ্যমে পাওয়া যায়নি। যে কৃষ্ণ মহাভারতের গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র এবং যার লীলাক্ষেত্র হিসাবে মথুরাকে চিত্রিত করা হয়, সেই মথুরাতে ২০০০খ্রিস্টপূর্বাব্দের আগে মনুষ্য বসবাসের প্রমাণ পাওয়া যায় না- একথাও লেখা হয়েছে অনুচ্ছেদে। এই অনুচ্ছেদকে বাদ দেওয়া হয়েছে। ইতিহাস তো যুক্তি প্রমাণের উপর দাঁড়িয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়। ভারতবর্ষে সঙ্ঘ পরিবারের দর্শন ও বীক্ষণ কার্যকর করতে হলে সেই ইতিহাসকে আগে বর্জন করার অভিযান করে চলেছে এরা। এই পরিকল্পনা সফল করার জন্য এনসিইআরটি-র বিভিন্ন কমিটি বদলে দেওয়া হয়। প্রথিতযশা ঐতিহাসিকদের সরিয়ে দেওয়া হয়।

আজকে পশ্চিমবাংলায় বিভাজনের রাজনীতিতে কিছুটা সাফল্য হিন্দুত্ববাদী শক্তি পেয়েছে তা বলা যায়, কিন্তু বিভাজনের রাজনীতি বাংলায় কার্যকর করার বিষয়টি নতুন নয়। স্বাধীনতা ও দেশভাগের পরবর্তী সময়ে বিভাজনের রাজনীতিকে এ রাজ্যে শক্তিশালী করতে হিন্দু মহাসভা, আরএসএস যথেষ্ট সক্রিয় ছিল কিন্তু তখন এরা সফল হতে পারেনি। তার কারণ হলো রাষ্ট্র ক্ষমতায় বিজেপি ছিল না, এরাজ্যে তাদের কর্মসূচিকে বাস্তবায়িত করার জন্য তৃণমূল কংগ্রেস ছিল না এবং দেশ ভাগের পর ছিন্নমূল মানুষদের জন্য বামপন্থী আন্দোলন এবং পরবর্তী ৬০-৭০দশকে জমির লড়াই, শিক্ষা, খাদ্যের লড়াইয়ে বিভাজনের রাজনীতি কোন জায়গা পায়নি। পরবর্তী সময় দীর্ঘ সময় বাম সরকার থাকার কারণে ওরা এই কাজ করতে পারেনি এমনকি ১৯৯২সালে বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পরেও বিভাজনের রাজনীতিকে রুখে দিয়েছিল পশ্চিমবাংলা। ২০১১ সালে পশ্চিমবাংলায় তৃণমূল সরকার আসার পর থেকেই এই কাজকে পুরোদমে কার্যকর করতে শুরু করেছে রাজ্য সরকার ও আরএসএস, বিজেপি যৌথভাবে। ধুলাগড়, বসিরহাট সম্প্রতি শিবপুর, রিষড়ার ঘটনাবলী সবই ওদের যৌথ প্রজেক্ট। বিভাজনের লক্ষ্যে বর্তমানে তথাকথিত ত্রিবেণী কুম্ভ মেলার ষড়যন্ত্র বিজেপি তৃণমূলের যৌথ পরিকল্পনা।

আজ শুধু হুগলী জেলা নয়, পশ্চিমবাংলাকে টার্গেট করে কল্পিত কাহিনী সামনে এনে শুধু ত্রিবেণীর কুম্ভ মেলা নয়, আরও অনেক কিছুকেই সামনে এনে মানুষের মধ্যে ঐক্য ও সম্প্রীতি বিনষ্ট করে বিভাজনের রাজনীতি, উগ্র ধর্মান্ধতার রাজনীতি সৃষ্টি করে বাংলায় আরএসএস, সংঘ পরিবার এবং তৃণমূলের মাধ্যমে বিজেপির শক্তিকে বৃদ্ধি করাই লক্ষ্য। এত সহজে এসব বাংলায় হবে না, যখন মানুষের বেঁচে থাকার জন্য প্রতিটা ক্ষেত্র কাজ, শিক্ষা, খাদ্য প্রভৃতি তীব্র সংকটের মধ্যে নিমজ্জিত, দুর্নীতি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ ধারণ করেছে, তখন মন্দির-মসজিদ ইস্যু পশ্চিমবাংলার মানুষকে বিপথে পরিচালিত করতে পারবে না। এই ষড়যন্ত্রকে হুগলী জেলা সহ সমগ্র পশ্চিমবাংলার বাম গণতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ সহ সমস্ত সত্যসন্ধানী মানুষকে ঐক্যবদ্ধভাবে রুখে দিতে হবে।


শেয়ার করুন

উত্তর দিন