কোভিড সংক্রমণ পদক্ষেপ নিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে লেখা সীতারাম ইয়েচুরির চিঠি

২৬ এপ্রিল,রবিবার,২০২০

সিপিআই(এম) সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি কোভিড-১৯ মহামারির মোকাবিলা ও তাকে পরাস্ত করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রীকে শুক্রবার ২৫ এপ্রিল ২০২০ যে চিঠি লেখেন সেটির পূর্ণাঙ্গ বয়ান প্রকাশ করা হল।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী মহাশয়,

দুর্ভাগ্যবশত আমাকে বাধ্য হয়ে এই লকডাউনের পর্বে আর একবার চিঠি লিখতে হচ্ছে। আমার পূর্ববর্তী বক্তব্যে আমি তালিকাভুক্ত করে বিভিন্ন ব্যবস্থা গ্রহণের কথা বলেছিলাম - যা কেন্দ্রীয় সরকারের গ্রহণ করা উচিত, লকডাউন পর্বে জনগণের বিস্তৃত অংশের দুর্ভোগকে হ্রাস করার জন্য। কিন্তু তা উত্তরহীন হয়ে থেকেছে, এমনকি স্বীকৃতও হয়নি, যা অস্বাভাবিক।

আমি আর একবার আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাইছি সেই মুখ্য বিষয়গুলির দিকে যার সম্মুখীন আমাদের দেশ এবং দেশের অধিকাংশ জনগণ।

আমরা এখন চল্লিশ দিন দেশব্যাপী লকডাউন এর শেষ সপ্তাহে, যা আপনি হঠাৎ এবং আকস্মিকভাবে কেবলমাত্র চার ঘণ্টার বিজ্ঞপ্তিতে জারি করেছিলেন। এটা দেশের জনগণ এবং রাজ্য সরকারগুলিকে সম্পূর্ণ অপ্রস্তুত অবস্থায় ফেলেছিল - এই লকডাউন এর মারাত্মক পরিণতির সম্মুখীন হতে ।

১. পরিযায়ী শ্রমিক: লকডাউন ঘোষণার পর থেকেই পরিযায়ী শ্রমিকদের মধ্যে বাড়ি ফেরার তাগিদ তৈরি হয় যার ফলে ব্যাপক অংশের মানুষের ভিড় তৈরি হয় কারণ সেই সময় তারা তাদের জীবিকা এবং আশ্রয়ের জায়গাগুলি কে হারিয়েছিল। লকডাউন এর যে উদ্দেশ্য ছিল অর্থাৎ অতিমারির গোষ্ঠী সংক্রমণ রুখতে শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখা- তা এতে ব্যাহত হয়। ক্ষুধা, অপুষ্টি, এবং গৃহহীনতা আমাদের দেশে কোটি কোটি মানুষের জীবনকে জর্জরিত করে তুলেছে। লকডাউন ঘোষণার পর থেকেই আমরা প্রস্তাব দিয়েছি অবিলম্বে কেন্দ্রীয় সরকারকে সকল অভাবী মানুষকে বিনামূল্যে খাবার সরবরাহ করতে হবে। আমাদের কেন্দ্রীয় খাদ্য ভাণ্ডারে বিশাল মজুত খাদ্যশস্য পচছে। এগুলি নিখরচায় বিতরণের জন্য রাজ্যগুলিকে প্রেরণ করা উচিত। দাবিগুলির কোনটাই সরকার বিবেচনা করেনি, যে সরকারের প্রধানমন্ত্রী আপনি।

২. বেকারীত্ব: অনুমান করা হচ্ছেএই বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে এপ্রিলের মধ্যে প্রকৃত বেকারের সংখ্যা ৩৪০ লাখ থেকে ৮৮০ লাখে বেড়ে গেছে। অর্থাৎ অতিরিক্ত ৫৪০ লক্ষ মানুষ তাদের জীবিকা হারিয়েছে। এর বাইরে ৬৮০লাখ শ্রমশক্তি থেকে বিযুক্ত হয়। অতিমারির শুরুর সময়কাল থেকে ১২.২ কোটি মানুষ কাজ , জীবিকা হারিয়েছেন। মার্চ থেকে ২০এপ্রিল - এই লকডাউন সময়কালীন ৬ সপ্তাহে বেকারত্বের হার ৭.৫ অংশ থেকে ২৩.৬ এ বেড়ে গেছে।অবিলম্বে কেন্দ্রীয় সরকারের উচিত পরবর্তী ৩ মাসের জন্য সকল জীবিকাহারা মানুষকে মাসিক৭৫০০ টাকা করে প্রদান করা। অবশ্যই এটি একটি বিস্ময়কর ঘটনা যেখানে ৭.৭৬ লক্ষ কোটি টাকার ঋণ যা গ্রহণ করেছে মহা ধনী এবং করপোরেটরা সেই ঋণ মকুব করেছে আপনার সরকার- গত পাঁচ বছরে। এই পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় সরকারের কোন তহবিলের অভাব ঘটবে না বেশিরভাগ জনগণকে খাওয়াতে এবং তাদের সহায়তা করতে।

৩. কোঅপারেটিভ ফেডারেলিজম : অতিমারি মোকাবিলায় রাজ্যগুলি যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে রয়েছে। তাদের পর্যাপ্ত অর্থ, খাদ্যশস্যের সরবরাহ এবং অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের প্রয়োজন। সেই ধরনের কোনো অর্থবহ সাহায্য কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষ থেকে রাজ্যগুলির কাছে আসেনি। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে হঠাৎ লকডাউন ঘোষণায় সারাদেশে পরিযায়ী শ্রমিকরা সংকটের মধ্যে পড়েছে। কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষ থেকে এখন রাজ্যগুলিকে আশ্রয়, খাদ্য, শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখা এবং অন্যান্য লকডাউন এর শর্তাদি পালনের কথা বলা হচ্ছে। এটা স্পষ্টতই অন্যায়। এমনকি জিএসটি নিয়ে রাজ্য সরকারের বকেয়া এখনো তাদের দেওয়া হয়নি। অবশ্যই দ্রুততার সঙ্গে এই তহবিল রাজ্যকে প্রেরণ করা উচিত।

৪. অর্থ: হাজার হাজার কোটি টাকা আদায় করা হচ্ছে আপনার নাম বহনকারী একটি ব্যক্তিগত ট্রাস্ট দ্বারা। সরকারি ভাবে বলা হয়েছে এই তহবিলটি সিএজি বা অন্য কোন সরকার নির্বাচিত অডিটর দ্বারা পরীক্ষিত হবে না। সরকারি কর্মচারীদের বেতন থেকে কেটে এবং অন্যান্যদের জোর করে এই তহবিলে অর্থ স্থানান্তর করার কথা বলা হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীর দুর্যোগ ত্রাণ তহবিলে সরকারিভাবে দান করলেও তা বলা হচ্ছে। এই তহবিলের অর্থ অবিলম্বে অতিমারীর বিরুদ্ধে লড়াই করবার জন্য যা প্রয়োজন তা মেটাতে ব্যবহার করা হোক।

৫. অপব্যয় বন্ধ করুন : এটা বিস্ময়ের এবং সীমাহীন অপরাধের যে কেন্দ্রীয় সরকার এই সময় অপ্রয়োজনীয় অপব্যয়ের পরিকল্পনা করছে।যেমন কেন্দ্রীয় ভিস্তা প্রোজেক্ট যেখানে প্রধানমন্ত্রীর বাসস্থান এবং অন্যান্য জনসংযোগ মূলক কাজের আবাসন তৈরি হবে। যে সময়ে মানুষ গভীর আর্থিক দুর্দশার মধ্যে জরুরী চিকিৎসা করতে গিয়ে। গত পাঁচ বছরে এই সরকারের উত্তরাধিকার মূর্তি বানাতে খরচ, বুলেট ট্রেন তৈরি করতে খরচ, প্রচারের জন্য খরচ ইত্যাদি। জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থা. শিক্ষা ইত্যাদির খরচ বন্ধ করে। অতিমারির সঙ্গে লড়াইয়ের প্রয়োজনীয়তাকেই অগ্রাধিকার দিতে হবে।

৬. পি পি ই এর গভীর সংকট: ইতিমধ্যেই এটি সর্বজনবিদিত যে লকডাউনকে ব্যবহার করা হয় মানুষের সংক্রমণ পরীক্ষার কাজে এবং সেইজন্যে ডাক্তার ও স্বাস্থ্যকর্মীদের পি পি ই এর ব্যবস্থা অত্যন্ত জরুরী এই অতিমারিকে পরাস্ত করার কাজে। দুর্ভাগ্যবশত দীর্ঘসময় অতিক্রান্ত হওয়ার পরও প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি আমাদের দেশে অন্যান্য দেশের মতো গ্রহণ করা হয়নি। লকডাউন এর এক মাস অতিক্রান্ত হওয়ার পরও সংক্রমণ পরীক্ষার হারে আমাদের দেশ পৃথিবীর নিম্নতম দেশগুলির মধ্যে একটি। লজ্জাজনকভাবে পাকিস্তানেরও নিচে। স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রয়োজনীয় পিপিই নেই এবং দুঃখজনকভাবে তাদের কেউ কেউ এই ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হয়েছেন। এই সময়ে এটা অত্যন্ত প্রয়োজনীয় যে টেস্ট কিট এবং পি পি ই যুদ্ধকালীন তৎপরতায় সরবরাহ করতে হবে।

৭. সার্বজনীন স্বাস্থ্য পরিষেবা: আমাদের কেন্দ্রীয় বিষয় কোভিড অতিমারির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা। কিন্তু এর জন্য চিকিৎসার অবহেলায় এক ব্যাপক অংশের অসংক্রামক নন কোভিড রোগী মৃত্যুর ঘটনা ঘটা উচিত নয়। রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে লকডাউন পর্বে ৩ লাখ শিশু এবং কয়েক লক্ষ গর্ভবতী মা প্রয়োজনীয় জীবনদায়ী ভ্যাকসিন থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। এক লাখেরও বেশি ক্যান্সার রোগী এবং সাড়ে তিন লাখ ডায়াবেটিক রোগী প্রয়োজনীয় চিকিৎসা পাননি। এমনকি ম্যালেরিয়া দূরীকরণ এবং টিবির চিকিৎসাও গত ৫ সপ্তাহে মারাত্মকভাবে নিম্নগামী। ব্লাড ব্যাঙ্কগুলিতে রক্তের সরবরাহ অত্যন্ত কম। থ্যালাসেমিয়া, হিমোফিলিয়া ইত্যাদির মত রোগীরা রক্তের অভাবে রয়েছে। অবশ্যই এই ধরনের পরিস্থিতি গ্রহণীয় নয় এবং তা সংশোধন দরকার।

৮. প্রশাসনের অগ্রাধিকার: মধ্যপ্রদেশে সংক্রমনের পজিটিভ কেসের গতি বৃদ্ধির হার এবং প্রচুর মৃত্যুজনিত গভীর পরিস্থিতির সঙ্গে প্রত্যক্ষ যোগাযোগ রয়েছে বিজেপির রাজনৈতিক ক্ষমতা কুক্ষিগত করার জন্য নগ্ন লালসার। এক গুরুত্বপূর্ণ সময়ে তারা রাজ্যের জরুরী জনস্বাস্থ্য সতর্কতা ভঙ্গ করেছে। একটি নির্বাচিত সরকারকে পদচ্যুত করা এবং বিজেপি সরকারের শপথ গ্রহণ করা রাজ্যকে রাজনৈতিক নেতৃত্বহীনতায় ফেলেছে। রাজ্যের সাধারণ মানুষকে এর মাশুল গুনতে হচ্ছে যখন অতিমারি ভয়ঙ্কর হারে বিস্তৃত হচ্ছে।

৯. হতাশ জনক শাসনব্যবস্থা: কেন্দ্র সরকারের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে এমন এমন নির্দেশিকা জারি করা যা বোধগম্যতার বাইরে। যার একাধিক ব্যাখ্যা করা যায় এবং তার অর্থ উদ্ধার করা যায় না। এই হতাশ জনক শাসনব্যবস্থা আমরা প্রত্যক্ষ করেছি যখন নোট বন্দির সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছিল। স্পষ্টতই দেশের রাজনৈতিক পদাধিকারীরা তাদের অপদার্থতা প্রমাণ করছে ক্রোধান্বিত প্রতিক্রিয়ার মধ্য দিয়ে।

১০. সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ: অতিমারীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ কেবলমাত্র সফল হতে পারে যখন সারাদেশ এবং সকল ভারতীয় এর বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়। তব্লিগি জামাত সংগঠকদের দায়িত্বজ্ঞানহীনতা শুধুমাত্র সমগ্র সংখ্যালঘু মুসলিম সম্প্রদায়কে নিশানা করবার অজুহাত হতে পারে না। এটা সামাজিক বিভাজন এবং সাম্প্রদায়িক মেরুকরণকে গভীরতা প্রদান করে। সাম্প্রদায়িক ঘৃণা ছড়ানোর মধ্য দিয়ে এটা ভারতের শক্তিকে দুর্বল করার চেষ্টা করে। এই সাম্প্রদায়িক প্রচারের প্রতিক্রিয়া এখন পৃথিবীর অন্য দেশে অনুভূত হচ্ছে যেখানে ভারতীয় বংশোদ্ভূতরা কাজ করে এবং বসবাস করে। এটা রাজনৈতিক নেতৃত্বে কাজ অর্থাৎ সরকারের কাজ এটিকে এখন থেকে বন্ধ করা। অন্যথায় এটি একটি বৃহত্তর অহিতকর ব্যবস্থা হবে অতিমারীর বিরুদ্ধে সংগ্রামে।

১১. পরিযায়ী শ্রমিকদের ঘরে ফেরাও : কেন্দ্রীয় সরকার যথার্থভাবে অতিমারি শুরুর সময় বিদেশে আটকে পড়া এক বৃহৎ অংশের ভারতীয়কে সঠিকভাবে সরিয়ে নিয়েছেন। বিশেষ বিমানে তাদের ভারতে নিয়ে আসা হয়েছিল। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকার বিমানের নয় লকডাউন এর সতর্কতা মেনে অন্তত বিশেষ ট্রেনের এবং বাসের ব্যবস্থা করার অনুমতি দিচ্ছে না দেশের মধ্যে থাকা পরিযায়ী শ্রমিকদের ঘরে ফিরিয়ে আনার জন্য। অন্ততপক্ষে এখনই এই ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। এছাড়া অনেক ভারতীয় এখন বিদেশে থাকেন কেন্দ্রীয় সরকারের অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া দরকার তাদের দেশে ফিরিয়ে আনার যেমন পৃথিবীর অন্যান্য দেশ করছে। এর মধ্যে রয়েছে এয়ার লিফটিং এর ব্যবস্থা।

১২. মাননীয় প্রধানমন্ত্রী মহাশয়, অবশেষে আপনি দেখিয়েছেন এককভাবে কিভাবে মিডিয়ার সম্মুখীন হওয়াকে অবজ্ঞা করা যায়। ভারতীয় জনগণের উদ্বেগের উত্তর না দেওয়া যায়। আপনার মত অন্য দেশের রাষ্ট্রপ্রধানরা কিন্তু তা করেননি। বেশিরভাগ দেশের সরকারের প্রধানেরা নিয়মিত সাংবাদিক সম্মেলন করেছেন এবং প্রশ্নোত্তর পর্ব করেছেন। এর মাধ্যমেই জনগণের কাছে দায়বদ্ধ থাকা যায়, জনগণের মধ্যে প্রত্যয় তৈরি করা যায় যে সরকার পারে পরিস্থিতি মোকাবিলার নেতৃত্ব দিতে। প্রকৃতপক্ষে দেশের অনেক রাজ্যও এটা করছে।কেরালার বাম গণতান্ত্রিক মোর্চার সরকারের মুখ্যমন্ত্রী দৈনিক সাংবাদিকদের প্রেস ব্রিফ এবং গৃহীত ব্যবস্থার রূপরেখা সম্বন্ধে বিবৃত করেন যাতে জনগণের এই চ্যালেঞ্জকে মোকাবেলা করার আত্মবিশ্বাস তৈরি হয়। গণতান্ত্রিক জবাবদিহিতা আপনার প্রশাসনের শৈলীতে গুরুতরভাবে অনুপস্থিত।

আপনার জ্ঞাতার্থে

সীতারাম ইয়েচুরি


শেয়ার করুন

উত্তর দিন