বর্তমান কৃষক আন্দোলনঃ এক সুসংহত বিকল্পের লক্ষ্যে আগামী দিনের লড়াই

কিষাণ আন্দোলনঃ সংগ্রামের শ্রেণীচরিত্র অন্বেষণে একটি পর্যালোচনা

Nilotpal Basu

নীলোৎপল বসু

দেশজূড়ে কৃষকদের আন্দোলন স্তিমিত হবার বদলে ক্রমশই জানকবুল লড়াইতে পরিণত হচ্ছে। এই প্রসঙ্গে মোদী সরকারের হতাশা দৃশ্যত স্পষ্ট। ভারতের কৃষকসমাজ বিভিন্ন শ্রেণীতে বিভাজিত। এই কৃষক আন্দোলন সেইসব শ্রেনিগুলিকে একত্র করেছে, শান্তিপূর্ণ প্রতিরোধের সংগ্রামে সবল ঐক্যের মজবুতি প্রতিষ্ঠা করেছে। অভূতপূর্ব সেই ঐক্যই প্রতিরোধ আন্দোলনের গভীরতা এবং ব্যাপ্তির মূলমন্ত্র। প্রতিরোধ আন্দোলনের প্রস্তরপ্রাচীর ভেদ করতে না পারার হতাশা আজ প্রধানমন্ত্রীর চেহারায় ফুটে উঠছে। সম্প্রতি কৃষক আন্দোলন সম্পর্কে নিজের বক্তব্যে মোদী এই প্রাচীরকেই এফডিআই – ফরেন ডেস্ট্রাক্টিভ আইডিওলজি (ধ্বংসাত্মক বিদেশী মতাদর্শ) বলে এক উৎকট ব্যাখ্যা হাজির করেছেন। বক্তৃতায় স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতেই আন্দোলনজীবীদের জন্য কৃষক আন্দোলনের শুদ্ধতা নষ্ট হচ্ছে বলে তিনি অভিযোগ করেছেন। দেশজূড়ে ৫০০টিরও বেশি কৃষক সংগঠনকে একত্রে নিয়ে গঠিত সংযুক্ত কিষাণ মোর্চা এই আন্দোলন চলাকালীন সরকারের সাথে প্রথম পর্বের আলোচনার শেষে স্লোগান তুলেছিল “সরকারকি অসলি মজবুরি, আম্বানি, আদানি অউর জমাখোরি” - কৃষকদের আন্দোলনকে এভাবে অভিশম্পাতের কারন সেটাই।

এই স্লোগানই কৃষকদের বর্তমান আন্দোলনের সারাংশ। এই জন্যেই প্রধানমন্ত্রী নিজের পছন্দের ধান্দাবাজ কর্পোরেটদের নামটুকুও আর উচ্চারণ করছেন না। এই নাছোড়বান্দা আন্দোলন তাকে বলতে বাধ্য করেছে “বেসরকারী ক্ষেত্র সম্পর্কে কোনোরকম সমালোচনা করা উচিত হবে না” !

আন্দোলনের সুত্রপাত

গতবছরের ৯ই জুন কেন্দ্রীয় সরকার কৃষিক্ষেত্র সম্পর্কে যে তিনটি অধ্যাদেশ (অর্ডিন্যান্স) জারি করার অব্যবহিত পরেই কৃষকদের এই আন্দোলন শুরু হয়েছে। দেশের প্রতিটি প্রান্তে নয়া তিন কৃষি আইনের বিরুদ্ধে অসংখ্য প্রতিবাদ সংগঠিত হয়েছে, সেই ধারা বেয়েই আজকের সংগঠিত কৃষক আন্দোলন এক নজিরবিহীন সংগ্রামী ঐক্য স্থাপন করতে সক্ষম হয়েছে। এই তিন কৃষি আইনের বলে কৃষি বাণিজ্যের নামে গোটা দেশের কৃষিক্ষেত্রকে হাতের মুঠোয় আনতে পারবে কর্পোরেট শক্তি।

দেশের জিডিপিতে কৃষিক্ষেত্রের অবদান ১৪ শতাংশ হলেও ভারতের জনগণের ৬০ শতাংশই আয়ের জন্য কৃষিকাজে নির্ভরশীল। এই পরিস্থিতিতে নয়া কৃষি আইন সমুহ কার্যত ভারতের কৃষকদের বিরুদ্ধে এক যুদ্ধ ঘোষনা। এই আইন পাশ করা হয়েছে দেশের সংসদীয় রীতিনীতিকে এড়িয়ে গিয়ে, দেশের জনসাধারণের এক বিরাট অংশ এর বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। এধরনের আইন বলবৎ করার পূর্বে সংশ্লিষ্ট সমস্ত প্রতিষ্ঠান (যেমন এক্ষেত্রে রাজ্য সরকার) এবং ব্যক্তিবর্গ (যেমন এক্ষেত্রে দেশের সাংসদেরা)-দের সাথে কোনরকম আলোচনাই হয়নি, সরাসরি কেন্দ্রীয় সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রকের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করে দেওয়া হয়েছে। রাজ্যসভায় এই আইন পাশ করানোর জন্য অত্যন্ত জঘন্য কৌশলে সাংসদদের এসম্পর্কে নিজেদের আপত্তি জানানোর আইনি সুযোগটুকুও দেওয়া হয় নি।

তথ্যের অধিকার আইনের প্রয়োগে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে জানতে চাইলেও সরকারের জবাব দেবার মতো ফুরসত হয়নি। কৃষিক্ষেত্র রাজ্য সরকারের অধীনস্ত বিষয় – কেন্দ্রীয় সরকার নয়া আইনের বলে সংবিধানের সেই ধারাকেই অগ্রাহ্য করছে। সংবিধান অবমাননা সত্বেও সুপ্রিম কোর্টের পর্যবেক্ষণ ও নির্দেশ ভারতে আইনব্যবস্থার  ইতিহাসে অবনমনের এক বেনজির গভীরতায় নিয়ে গেছে। এধরণের আইন প্রণয়নে সংসদীয় ব্যবস্থার যে মানের আইনি দক্ষতার প্রয়োজন হয় তাকে এড়িয়ে যাওয়াই সাংবিধানিক সংকট তৈরি হবার মূল কারন।   

এই আইনের বিষয়ে নিজেদের আপত্তি জানানোয় সমর্থ এমন সমস্ত সংস্থাকেই অকেজো করে দেওয়ার ফলে দেশের জনগণকে রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ দেখাতে বাধ্য হতে হয়েছে। বর্তমান আন্দোলনের প্রানকেন্দ্র দিল্লী সীমান্তবর্তি হলেও দেশের সকল প্রান্তেই প্রতিবাদ আন্দোলন বিস্তৃত হতে শুরু করেছে। প্রথমে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল নয়া কৃষি আইনের বিরোধীরা সকলেই পাঞ্জাবে সীমাবদ্ধ, যত দিন গেছে দেশজুড়ে প্রসারিত আন্দোলনের চেহারা সরকারের সেই দাবিকে মিথ্যা প্রমান করেছে।     

এই আন্দোলন যত এগিয়েছে ততই স্পষ্ট হয়েছে সারা দেশে কৃষকদের জীবন সংগ্রামের বিভিন্নতা – এই আইন সম্পর্কে তাদের বোঝাপড়া সম্পন্ন হতে সেই কারনেই কিছুটা সময় ব্যয় হয়েছে, বিভিন্ন সময়ে দেশের এক একটি প্রান্ত এই লড়াইয়ের সাথে যুক্ত হয়েছে। আমাদের দেশে ছয় প্রকারের কৃষি সহায়ক মরশুমের কারনে এমনটা হওয়া স্বাভাবিক। এই বৈচিত্র্যকে মাথায় রেখেই সংবিধান প্রণেতারা কৃষিক্ষেত্রকে রাজ্য সরকারের অধীনে রেখেছিলেন।  

সরকারের তরফে আন্দোলনকারীদের খালিস্তানি, মাওবাদী এবং পাকিস্তান ও চীনের দালাল ইত্যাদী বলে আন্দোলনকে কালিমালিপ্ত করতে চেয়েছে। মোদী সরকার এইসব বস্তাপচা বুলি আউড়ে আসলে আন্দোলনকে দেশবিরোধী তকমা দিতে চাইছে।

কেন্দ্রীয় কৃষিমন্ত্রী ভুয়ো কৃষক সংগঠনের সাথে বৈঠকের আয়োজন করেছিলেন, বলা হল কৃষকেরা এই আইনকে সমর্থন করছে – আসলে কৃষকদের সংগ্রামী ঐক্যকে ভেঙ্গে দেবার উদ্দেশ্য নিয়েই এইসব করা হয়েছে। নিপীড়িত মানুষের শ্রেণী ঐক্যকে ভাঙতে সংগ্রামরত কৃষকদের ধর্মীয় পরিচয়কে সামনে এনে আন্দোলন ভাঙবার চেষ্টা চলে।   

সাধারণতন্ত্র দিবসের দিন ঐতিহাসিক ট্র্যাক্টর র‍্যালিতে নিজেদের লোক ঢুকিয়ে দিয়ে লাল কেল্লায় বিক্ষোভের নামে অহেতুক হাঙ্গামা তৈরি করে সরকার নিজেদের স্বার্থ চরিতার্থ করতে চেয়েছিল। স্বাধীন গণমাধ্যম এবং বর্ষীয়ান সাংবাদিকদের উপরে আক্রমন চালিয়ে দিল্লী পুলিশও সেই একই লক্ষ্যে সহায়কের কাজ করেছে। এই আন্দোলন প্রমান করে দিয়েছে গনতন্ত্র এবং আইনকানুনকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে মোদী সরকার ভারতে কর্তৃত্বকারী শ্রেণীগুলির স্বার্থ চরিতার্থ করতে কতটা বদ্ধপরিকর।  

সরকার এখনও উপলব্ধি করেনি যে এই আন্দোলন আসলে কৃষকদের শ্রেণী সংগ্রাম যার সাথে ধনী কৃষকদের এক বড় অংশই সরাসরি যুক্ত রয়েছে।

বর্তমান পরিস্থিতির পূর্ববর্তী ঘটনাক্রম

স্বাধীনতার পরে জনস্বার্থে ব্যয়বরাদ্দের সাহায্যে ভারতে কৃষিক্ষেত্র প্রসারিত হয়, ফসল উৎপাদন বেড়ে আমাদের দেশ খাদ্যে স্বনির্ভর হয়ে ওঠে। যদিও ভূমিসংস্কারের কাজ অসম্পূর্ণ রেখেই সবুজ বিপ্লবের কাজ সমধা করার প্রচেষ্টা চলে। এর ফলে গরীব এবং জমির মালিকানাহীন বহু কৃষক পরিবার প্রসারিত, লাভজনক কৃষিকাজের আওতার বাইরে পড়ে থাকে।  ৯০’এর দশক থেকে আন্তর্জাতিক বিনিয়োগের উপরে নির্ভরশীল নয়া উদারবাদী নীতিসমূহের কারনে ভারতের কৃষকসমাজ গভীর দুর্দশার শিকার হয়েছে। মুক্ত কৃষিবাণিজ্যের বিস্তৃতির সাথেই সেচ, চাষের কাজে ব্যাবহার হওয়া সার, বীজ এবং কীটনাশক ইত্যাদীর মূল্যবৃদ্ধি হওয়ায় চাষের খরচ ক্রমশ অনেকটাই বেড়ে যায়। অন্যদিকে খাদ্য প্রক্রিয়াকরণের কাজে সরকার উৎসাহ না দেখানোয় এই ক্ষেত্রে কর্পোরেটদের নজর পড়ে। এর সাথে যুক্ত হয় বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার প্রস্তাবিত কৃষি সম্পর্কিত চুক্তি। সেই চুক্তির প্রস্তাবে প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া হিসাবে ভারত সরকারের বক্তব্য ছিল অন্যান্য লাভজনক ক্ষেত্রের সাথে কৃষিক্ষেত্রকে মুনাফা নির্ভর যুক্তির নিরিখে বিচার করা চলে না কারন কৃষিক্ষেত্র কর্পোরেটরা চালায় না, এর সাথে দেশের কোটি কোটি মানুষের জীবন জীবিকার প্রশ্ন জড়িয়ে রয়েছে। যদিও সারা পৃথিবীর অন্যান্য দেশের সাথে তুলনা করলে দেখা যাবে ভারতে কৃষিক্ষেত্রে ভর্তুকির সুযোগ ক্রমশ হ্রাস করে কৃষকদের উপরে বিপুল খরচের বোঝা চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে -  নিচের তালিকাটি সেই চিত্রই স্পষ্ট করে।  

কৃষিক্ষেত্রে সরকারি ব্যয়বরাদ্দ (২০১৯)

দেশীয় অর্থনীতি ভর্তুকির পরিমাণ (মার্কিন ডলারের হিসাবে)
চীন ১৮৫.৯ বিলিয়ন
ইউরোপীয় ইউনিয়ন ১০১.৩ বিলিয়ন
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ৪৮.৯ বিলিয়ন
জাপান ৩৭.৬ বিলিয়ন
 ইন্দোনেশিয়া ২৯.৪ বিলিয়ন
কোরিয়া ২০.৮ বিলিয়ন
ভারত ১১.০ বিলিয়ন

তথ্যসুত্রঃ ট্রেডভিস্টাস

বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার দেওয়া প্রস্তাবের পরবর্তী সময়কালে ভারতসহ পৃথিবীর উন্নয়নশীল দেশসমূহে কৃষিজাত পণ্যসহ অন্যান্য আবশ্যিক পণ্যের দাম এভাবেই অর্থনীতির দোহাই দিয়ে বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। একদিকে চাষের খরচ বেড়ে যাওয়া, অন্যদিকে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি কৃষকদের জীবনকে এক গভীর সংকটের দিকে ঠেলে দিয়েছে। ৯০’এর দশক থেকে শুরু করে কৃষকদের আত্মহত্যা বেড়ে যাবার পিছনেও এই কারনই মুখ্য, এমনকি এই সংকটের শিকার হয়েছে ধনী কৃষকদের একটি বড় অংশ। ন্যুনতম সহায়ক মূল্যের দাবীতে আন্দোলনের শুরু এই কারনেই। উৎপাদিত ফসলের খরিদ সম্পর্কে সরকারের দায়বদ্ধ থাকার দাবি উঠে আসছে একই পরিস্থিতির চাপে। উৎপাদিত খাদ্যশস্যের একাংশকে সরকারী গনবন্টন ব্যবস্থা প্রসারিত করে তার মাধ্যমেই বিলি করতে হবে বলে কৃষকেরা দাবী জানিয়েছেন। কৃষিকাজ সম্পর্কে চাষিদের উৎসাহ বজায় রাখতে C2+50% হারে ফসল কেনার দাম নির্ধারণের সুপারিশ করেছিল স্বামিনাথন কমিশন। যদিও সেই সুপারিশ মানা হয়নি, সরকারী খাদ্য প্রক্রিয়াকরণের অবস্থাও তথৈবচ রয়ে গেছে, ক্রমশ আরও খারাপ হয়েছে।    

সরকারী কৃষকমান্ডি ব্যবস্থার বিস্তৃতি না হবার কারন কৃষিবানিজ্যে বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার শ্বাসরোধকারী চাপ। এতে উৎপাদিত ফসল বিক্রির প্রক্রিয়া এমন জটিলতায় পৌঁছে যায় যে বাধ্য হয়েই কৃষকরা ন্যায্য মূল্যের চেয়ে অনেক কম দামে ফসল বিক্রি করে দেয়। মোদী সরকারের আমলে নয়া উদারবাদী নীতিসমূহ এমন প্রখরতায় প্রযোজ্য হয়েছে যে খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ, মজুত এবং বণ্টনের পরিকাঠামো সর্বত্রই কয়েকটি বড় কর্পোরেট ধান্দাবাজ সংস্থা নিজেদের প্রতিষ্ঠা করে নিয়েছে।  

নয়া কৃষি আইনের প্রকৃত উদ্দেশ্য

কেন্দ্রীয় সরকার চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করতে চায় কেবলমাত্র বিনিয়োগের মাধ্যমেই সার্বিক আর্থিক উন্নয়ন হবে, যদিও বর্তমান পরিস্থিতি অন্য কথা বলে। বিনিয়োগে ভাঁটা পড়েছে কারন গোটা দেশেই চাহিদার সার্বিক ঘাটতি তৈরি হয়েছে। বেড়ে চলা অসাম্য এবং বেকারি চাহিদায় ঘাটতির প্রধান কারন। “অসাম্যের জীবাণু” শিরোনামে অক্সফ্যামের সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে সেই চিত্রই স্পষ্ট হয়েছে। মহামারী চলাকালীন লকডাউনের পর্বে ভারতে সেই দুর্দশা আরও বেড়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। মহামারী পরবর্তী ভারতের আর্থিক অবস্থা অন্যান্য উন্নত দেশের তুলনায় স্বাভাবিকভাবেই আরও ভয়ানক।

২০০৮ পরবর্তী আর্থিক মন্দাবস্থার আগে বেসরকারি কর্পোরেট বিনিয়োগ ভারতের জিডিপিতে ৬.২ শতাংশ থেকে অনেকটা বেড়ে ১৬.৮ শতাংশে পৌঁছেছিল, এখন স্পষ্ট হয়ে গেছে বিনিয়োগের সেই ক্ষমতা আর নেই। মন্দার ধাক্কায় ম্যানুফ্যাকচারিং শিল্প, পরিকাঠামো এবং আবাসন নির্মাণ প্রকল্পসমূহে বিনিয়োগ থেমে গেছে। আজকের মুদ্রাস্ফিতির ভিত্তিতে দেশের জিডিপিতে ২০১৫-১৬ সাল নাগাদ বেসরকারি কর্পোরেট বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল ১১.৬ শতাংশ, ২০১৮-১৯ সালে তা কমে এসে দাঁড়ায় ১০.৩ শতাংশে। কোভিড মহামারীর আগেও সেই অবনমন কমার কোন লক্ষণ ছিল না, এখন সেই সম্ভাবনা আরও ক্ষীণ। মোদী সরকার যতই বেসরকারি কর্পোরেট বিনিয়োগের নামে ঢাক পেটাক না কেন, আসলে বিনিয়োগের ভাঁড়ার খালি। মহামারী মোকাবিলায় জনসাধারনের জীবন জীবিকাকে সুরক্ষিত রাখতে সরকারের তরফে যথাযথ তহবিল গড়ে না তোলার সিদ্ধান্তে আর্থিক সংকটের চেহারা আরও তীব্র হয়েছে।

গত বছর কর্পোরেট কর আদায়ে বিপুল ছাড় দেওয়ায় সরকারের রাজস্ব আয় ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। জনগণের বদলে কর্পোরেটদের পাশে থাকতে মোদী সরকার করছাড় দেবার পাশাপাশি সকল লাভজনক সরকারী সংস্থাগুলিকে জলের দরে বিক্রি করে দিতে শুরু করেছে, বিক্রি করে দেওয়া হচ্ছে দেশের সম্পদ – জনসাধারনকে আরও বড় বিপদের দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে।   

মহামারীর সময় দেশের আর্থিক অবস্থা, জনগণের স্বাস্থ্য এবং জীবন জীবিকার সুরক্ষার ব্যবস্থা না করে নির্লজ্জের ন্যায় সরকার ব্যাস্ত রয়েছে কর্পোরেটদের স্বার্থরক্ষায়, যাবতীয় শ্রম আইন এবং মানবাধিকার আইনকে বদলে দেওয়া হচ্ছে।

সেই লক্ষ্যেই কৃষি বাণিজ্যে আরও বেশি মুনাফা লুটে নিতে লালায়িত কর্পোরেট সংস্থাগুলির হাতে গোটা কৃষিক্ষেত্রটিকেই তুলে দিতে চাইছে সরকার। অন্যান্য ক্ষেত্রে চাহিদার ঘাটতি দেখা দিলেও খাদ্যের বাজারে চাহিদার ঘাটতি হওয়া অসম্ভব বলেই এমন সিদ্ধান্ত।  

ন্যুনতম সহায়ক মূল্য, গনবন্টন ব্যবস্থা এবং খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ সম্পর্কে সরকারী বন্দোবস্তের প্রতি অনীহা এবং নয়া কৃষি আইন এই সরকারের শ্রেণীচরিত্র চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। আঁচ করতে অসুবিধা হয় না এই সমস্ত আইনের ফলে ভবিষ্যতে প্রচলিত সরকারী ব্যবস্থাগুলি শুকিয়ে যাবে এবং তখন কর্পোরেট সংস্থাগুলির সাথে ফসলের কিংবা মজুরির দরদস্তুর সংক্রান্ত কোনো লড়াইতেই কৃষকরা টিকতে পারবেনা।  

একইভাবে চুক্তিচাষের ক্ষেত্রে জমির মালিকানাসহ উৎপাদিত ফসলের গুনমান এবং পরিমাণ সম্পর্কে যেকোনো সিদ্ধান্ত নেবার একচ্ছত্র ক্ষমতা চলে যাবে কর্পোরেটদের হাতে। অত্যাবশ্যকীয় পণ্য আইনে যেভাবে পরিবর্তন করা হয়েছে সেই ধারাতেই আগামিদিনে মজুত, ফাটকা এবং কালোবাজারি বৈধতা পেয়ে যাবে – খোলাবাজারে মুনাফার লক্ষ্যে খাদ্যের বেচাকেনা চলবে। এই কারনেই বলা চলে কৃষকদের আন্দোলন শুধু তাদের নিজেদের অস্তিত্বরক্ষার সংগ্রাম নয়, বরং গোটা দেশের মানুষের খাদ্য সুরক্ষারও লড়াই।

ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের উত্থান

কৃষকদের লড়াই এই আন্দোলনের শ্রেণীচরিত্রে স্পষ্ট – এমনকি ধনী কৃষকদের এক বড় অংশ আন্দোলনের সাথে যুক্ত থাকা সত্বেও। সংগ্রামরত মানুষের এই বিস্তৃত জোটকেই মোদী সরকার অস্বীকার করতে চাইছে, বিভিন্ন গনমাধ্যমে কর্মরত সরকারের ধামাধরাদের মুখ দিয়ে এই আন্দোলনকে ধনী কৃষকদের লড়াই হিসাবে চিহ্নিত করতে চেষ্টা করছে। প্রথমে সেই লক্ষ্যেই এই আন্দোলনকে পাঞ্জাবের লড়াই বলে দেখানো হচ্ছিল। ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে যায় আইন বাতিল না হওয়া অবধি কৃষকরা পিছু হঠবেন না।

বিভিন্ন শ্রেণীতে অবস্থান করা ভারতের কৃষক সমাজের মধ্যেকার এই অভূতপূর্ব ঐক্যের আসল কারন কৃষিকাজে আয় কমে যাওয়া, ঋণের ফাঁসে জর্জরিত হওয়া এবং জমি থেকে উচ্ছেদের ধারাবাহিক ঘটনা যা আজকের ভারতে রোজ ঘটে চলেছে। ২০১৬ সাল থেকে মোদী সরকার ভূমি অধিকার আন্দোলন শুরু করলে এইসব ঘটনা আরও বেড়েছে। ঐ বছরেই নভেম্বর মাসে নোট বাতিলের সরকারী ঘোষণা হবার পরে ফসলের দাম না পেয়ে দেশজূড়ে কৃষকেরা একজোট হয়, ২০১৭ সালে জন্ম হয় সারা ভারত কিষাণ সংঘর্ষ কোঅর্ডিনেশন কমিটির (AIKSCC)।     

সেই থেকে AIKSCC অনেক ছোট বড় সংগ্রাম আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছে, ক্রমশ ২০০তি বিভিন্ন কৃষক সংগঠন তার সাথে যুক্ত হয়েছে। একইসাথে পাঞ্জাবে এমজিএনআরইজিএ (MNREGA) প্রকল্পে কাজের সুযোগ কমে যাওয়া, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার প্রস্তাবিত কৃষি চুক্তির ফলে ফসলের দাম পড়ে যাওয়ার বিরুদ্ধে বহু আন্দোলন সংগঠিত হয়েছে।

এভাবেই ক্রমশ আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে AIKSCC – এর সাথে ৫০০টি কৃষক সংগঠন যুক্ত হয়েছে, এরা সকলেই বর্তমান আন্দোলনের সাথী। দেশের সামাজিক, রাজনৈতিক এবং মতাদর্শগত বৈচিত্র্যকে মাথায় রেখে সংযুক্ত কিষাণ মোর্চায় যেভাবে বিভিন্ন সংগঠনের মধ্যে আলাপ আলোচনার ক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক পদ্ধতি মেনে চলা হয়,  তারই ফলস্রুতি হল আজকের আন্দোলনে কৃষকদের সংগ্রামী ঐক্য। কৃষিক্ষেত্রে সংস্কারের নামে কেন্দ্রীয় সরকার যেভাবে নিজেদের শ্রেণীচরিত্র প্রকাশ করেছে তার বিরুদ্ধে আন্দোলনে এই ঐক্যই জয়ী হবার লড়াইতে অন্যতম সহায়ক শর্ত।  

এক সুসংহত বিকল্পের লক্ষ্যে আগামী দিনের লড়াই

একথা নিশ্চিত যে আগামিদিনে এই আন্দোলনকে শুধুই ন্যুনতম সহায়ক মূল্যের অধিকার এবং কৃষি আইন বাতিলের দাবীতে আটকে রাখা যাবে না। দেশের সরকার যে যুক্তিতে কৃষিতে বেসরকারি আন্তর্জাতিক বিনিয়োগের সামনে মাথা পেতে দিচ্ছে সেই প্রেক্ষিতেই মনে রাখতে হবে বিশ্ব ব্যাংক এবং আইএমএফ বিশ্বজোড়া কৃষিবাজারের দোহাই দিয়ে যাই দাবী করুক না কেন, ভারতের পরিস্থিতি একেবারেই আলাদা। আমেরিকায় কৃষিজমির গড় পরিমাণ ৪৫০ একর - সেখানে আমাদের দেশে গড় কৃষিজমির পরিমাণ ১.৫ একরের কাছাকাছি, এছাড়াও দুই দেশে সরকারী ভর্তুকির বিরাট ফারাক ভারতের পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে।    যাবতীয় সমস্যায় একই সমাধানের পদ্ধতি মেনে চলার নীতিতে ভারতের কৃষিক্ষেত্রে সুরাহা হবে না। এদেশে কৃষিক্ষেত্রের উপরে নির্ভরশীল জনগণের ৬০ শতাংশেরও বেশি মানুষ, তাদের জীবন জীবিকা ধ্বংস হবার অর্থ দেশের বেশিরভাগ মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা ধংস হওয়া এবং খাদ্য উৎপাদনে দেশের স্বনির্ভরতা সংকটের কবলে চলে যাওয়া। সম্ভবত নয়া কৃষি আইনসমূহের পিছনে আইএমএফ (আন্তর্জাতিক অর্থভাণ্ডার) –এর সমর্থন রয়েছে।

সেকারনেই কৃষি আইন বাতিল করার অভিন্ন সাধারণ দাবীতে সকলেই সহমত। কিন্তু এর সাথেই চিন্তাভাবনা শুরু করতে হবে কৃষিক্ষেত্রে আয়-ব্যয়ের সঠিক হিসাব সম্পর্কে, ন্যুনতম সহায়ক মূল্যকে সঠিকভাবে প্রযোজনা সম্পর্কে। একজোট হয়ে ভাবতে হবে কৃষিজাত পণ্যের বাজার, খাদ্যশস্যের মজুত এবং প্রক্রিয়াকরণের জন্য প্রয়োজনীয় আধুনিক পরিকাঠামো নির্মাণ, NREGA প্রকল্পে সুস্থিত কর্মসংস্থান, কৃষিঋণ সম্পর্কে সঠিক নীতি, কৃষিবাণিজ্যে বিভিন্ন চুক্তির সারবত্তা সম্পর্কেও। ভারত এক বিরাট দেশ, এর বিভিন্ন প্রান্তের বৈচিত্র্যময় বাস্তবতাকে আলোচনায় গুরুত্ব না দিয়ে আন্দোলন সামনের দিকে এগোতে পারবে না। নিজেদের অস্তিত্বরক্ষার আন্দোলনে অগ্রাধিকার দিয়ে উক্ত সমস্যাবলী সম্পর্কে সমাধানের লক্ষ্যে এক সুস্থিত কৃষি অর্থনীতি গড়ে তুলতে হবে যা ভারতের সাধারণ অর্থনীতির মেরুদন্ড হিসাবে কাজ করবে। সেই লক্ষ্যে এগিয়ে যাবার পথে জনগণের অন্যান্য অংশকেও এই লড়াইয়ের সাথী করে নিতে হবে, তবেই এই লড়াই এক সার্বিক গণআন্দোলন হিসাবে সার্থক হয়ে উঠবে। আজকের কৃষক আন্দোলন সেই প্রকৃত বিকল্পের দিশা সম্পর্কে ইতিমধ্যেই অনেককে স্বপ্ন দেখাতে সমর্থ হয়েছে।    


শেয়ার করুন

উত্তর দিন