Site icon CPI(M)

Jyoti Basu: The Flare, The Legacy

কলতান দাশগুপ্ত

জ্যোতি বসুর নামটা উচ্চারণ করলে আমাদের অবচেতন মনে প্রথমেই ছোটবেলার ব্রিগেড সমাবেশের ছবি ভেসে ওঠে। হাজার হাজার লাল পতাকা উদ্ভাসিত ব্রিগেডে ছাত্র- যুব -মহিলা – শ্রমিক – কৃষকের প্লাবন, মঞ্চে বক্তৃতা করছেন জ্যোতি বাবু। অনেকগুলো কাটা কাটা কথা, স্বাভাবিকভাবে জুড়ে যাচ্ছে পরপর। বাচিক শিল্পী হিসাবে কেমন, তার থেকেও গুরুত্বপূর্ণ হলো তার প্রতিটা শব্দ যেন শ্রোতাদের জীবন যন্ত্রণা থেকে তুলে আনা, সেই যন্ত্রণামুক্তির উপায় যাতে দরিদ্র-প্রান্তিক মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে যায় তার নেতৃত্বের উপর অগাধ আস্থা।

জ্যোতি বসু রাজনীতিতে প্রবেশ করেন ৪০ এর দশকে যা আক্ষরিক অর্থেই উত্তাল সময় ছিল। একদিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগ্রাসী উন্মত্ততা, বাজার দখলের তীব্র লড়াই, ফ্যাসিবাদের চরম আগ্রাসন, অন্যদিকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী আন্দোলন, দুর্ভিক্ষের ভয়াবহতা, ভ্রাতৃঘাতী দাঙ্গা ইত্যাদি মিলিয়ে এক ‘utter chaos’। এর কিছুদিন আগেই প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্র জ্যোতি বসু লন্ডনে গেলেন ব্যারিস্টার হওয়ার জন্য। সেখানে তিনি সহপাঠী ভূপেশ গুপ্ত, স্নেহাংশু আচার্য সহ আরও কয়েকজনের সঙ্গে নিয়ে মেতে ওঠেন লন্ডন মজলিস নিয়ে। তার আগে কৃষ্ণ মেননের নেতৃত্বাধীন ইন্ডিয়া লিগের সভায় গিয়ে দেশের স্বাধীনতার সপক্ষে জনমত গড়ে তোলার প্রয়াসের সূচনা করেন। স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে তাঁরা সাক্ষাৎ করেন ব্রিটিশ কমিউনিস্ট পার্টির নেতাদের সঙ্গে। সংযোগ গড়ে ওঠে পুনর্গঠিত বিটেনের ভারতীয় ছাত্র ফেডারেশনের সঙ্গে। এক নতুন জগতে তিনি প্রবেশ করলেন। সেই সময়ের কথা লিখেছেন “যত দূর মনে পড়ে” তে : ” লন্ডন, কেমব্রিজ, অক্সফোর্ড এই সব বিশ্ববিদ্যালয়ে ভারতীয় ছাত্ররা কমিউনিস্ট গ্রুপ গড়ে তুললেন। ব্রিটিশ পার্টি নেতারা আমাদের বলেন প্রকাশ্য সভা না করতে। কেননা ভারতে ইংরেজ রাজশক্তি তখন কমিউনিস্ট পার্টিকে বেআইনি ঘোষণা করেছে। আমরা মার্কসবাদী পাঠচক্রে যেতে শুরু করলাম। আমাদের পড়াতেন হ্যারি পলিট, রজনী পাম দত্ত,ক্লিমেন্স দত্ত এবং ব্র্যাডলের মতো নেতারা। গোটা বিশ্ব তখন তপ্ত থেকে তপ্ততর। স্পেনে শুরু হয়েছে গৃহযুদ্ধ। ফ্র্যাংকোর স্বেচ্ছাচারের বিরুদ্ধে গণতন্ত্রীদের সংগ্রাম নজর কাড়ছে সমস্ত প্রগতিশীল মানুষের। ফ্যাসিস্টদের বিরুদ্ধে স্বাধীন চিন্তার এই যুদ্ধে শামিল হতে গড়ে উঠেছে আন্তর্জাতিক ব্রিগেড। র‍্যালফ ফকস্, ক্রিস্টোফার কডওয়েলের মতো বিখ্যাত কমিউনিস্ট বুদ্ধিজীবীরা স্পেনে যেতে শুরু করেছেন। আর্নস্ট হেমিংওয়ের উপন্যাস ‘ফর হুম দি বেল টোলস’ এই সংগ্রাম নিয়েই লেখা। আমি ভিতরে ভিতরে প্রবল আলোড়িত। মার্কসবাদী সাহিত্য পাঠ আর সম সাময়িক ঘটনা প্রবাহ আমাকে দ্রুত রাজনীতির মূল প্রবাহে টেনে নিচ্ছে।” এই পরিবেশ-পরিস্থিতি জ্যোতি বসুদের চালিত করে এক দৃঢ় সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে। তাঁরা কয়েকজন স্থির করলেন ভারতে ফিরে গিয়ে সর্বক্ষণের পার্টি কর্মী হিসেবে কাজ করবেন। ব্যারিস্টার জ্যোতি বসু কমিউনিস্ট জ্যোতি বসু হয়ে দেশে ফিরে আসেন। কমিউনিস্ট মতাদর্শ কার্যকর করার দায়বদ্ধতা গ্রহণ করেন। বিপুল স্বাচ্ছন্দের জীবনযাত্রা থেকে প্রতিকূল অনিশ্চিত পরিবেশ মোকাবিলার কল্পনাতীত সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছিলেন আদর্শগত দায়বদ্ধতার কারণে। সর্বক্ষণের কর্মী হিসেবে তাঁর দায়িত্ব ছিল আত্মগোপনকারী পার্টি কর্মী ও নেতাদের আশ্রয়ের স্থান ঠিক করা, পার্টির গোপন বৈঠকের জায়গা ঠিক করা এবং বাইরের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করা ইত্যাদি। তখন গোপন পার্টির নির্দেশে জ্যোতি বসু পার্টি ক্লাস নিয়েছেন এবং বিভিন্ন সভা-সমিতিতে বক্তৃতা দিয়েছেন।

এই সময়ে ১৯৪১ সালের জুন মাসে হিটলারের নাৎসি বাহিনী সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমণ করে। এই আক্রমণের ফলে আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিতে এক গুণগত পরিবর্তন আসে। যুদ্ধের চরিত্রে পরিবর্তন আসে, সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে জনযুদ্ধে পরিণত হয়। এর কিছুদিনের মধ্যেই ১৯৪১ সালের ৭ ডিসেম্বর আমেরিকার পার্লহারবারে বোমা ফেলে জাপান। ১৯৪২ সালে শুরু হয় ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলন। সেই সময় কমিউনিস্ট পার্টির সামনে এক ভয়ঙ্কর প্রতিকূল পরিস্থিতি। পার্টির উপর নেমে এসেছে মিথ্যা প্রচার, দমন-পীড়ন। তীব্র আক্রমণের মুখে পার্টি কর্মীরা। এই প্রতিকূলতার মধ্যেও পার্টি কর্মীরা গ্রামে, গঞ্জে শহরে বাড়ি বাড়ি গিয়ে পার্টির নীতি-আদর্শের কথা মানুষকে বোঝানোর চেষ্টা করেছেন। এর পরই ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের কবলে পড়ে বাংলা। ১৯৪৩ সালের এই ভয়ঙ্কর প্রাণঘাতী মন্বন্তরের মোকাবিলায় পার্টির উদ্যোগে রিলিফ কমিটি গড়ে তোলা হয় এবং ত্রাণের কাজ সংগঠিত হয়। এ ছাড়াও পার্টির উদ্যোগেই তৈরি হয়েছিল ‘বেঙ্গল রিলিফ কো-অর্ডিনেশন কমিটি’। রিলিফ দেওয়ার কাজকে কৌশল হিসাবে ব্যবহার করে, সেই কাজকে রাজনৈতিক স্তরে উত্তরণের ডাক দিয়েছিল পার্টি। প্রায় একই সময়ে ঢাকায় ফ্যাসিস্ট শক্তির সমর্থকদের দ্বারা নৃশংসভাবে খুন হন উদীয়মান লেখক ও কমিউনিস্ট কর্মী সোমেন চন্দ। ১৯৪২ সালের ৮ মার্চ সোভিয়েত সুহৃদ সমিতি’র আহ্বানে ঢাকায় ফ্যাসিষ্ট বিরোধী সম্মেলনের আয়োজন করা হয়েছিল। মিছিলে নেতৃত্ব দিয়ে সেই সম্মেলনে আসার পথে ফ্যাসিবাদের সমর্থকদের আক্রমণে খুন হন তরুণ লেখক সোমেন চন্দ। এই মিছিলেই অন্যান্যদের সঙ্গে ছিলেন জ্যোতি বসু।

জ্যোতি বসু পার্টির নির্দেশে শ্রমিক সংগঠনে কাজ শুরু করেন। প্রথমে বন্দর ও ডক শ্রমিকদের সংগঠিত করার কাজ শুরু করলেও পরে পার্টির সিদ্ধান্তে তাকে যুক্ত করা হয় রেল শ্রমিক ইউনিয়নে। রেল শ্রমিকদের সংগঠন গড়ায় যথেষ্ট অসুবিধা ছিল কারণ অত্যন্ত শক্তিশালী প্রতিপক্ষ ছিলেন হুমায়ুন কবীর। সে অবস্থাতেই সংগঠনের অগ্রগতি ঘটাতে থাকে। রেল শ্রমিকদের যুক্ত সংগঠনের সভাপতি এবং সম্পাদক হন যথাক্রমে মহম্মদ ইসমাইল এবং জ্যোতি বসু। তিনি অসম ও উত্তর পূর্বাঞ্চলসহ সমগ্র পূর্ব ভারতে রেল শ্রমিকদের সংগঠিত করার কাজে নিজেকে উজার করে দিয়েছিলেন। রেল কর্তৃপক্ষও প্রথমদিকে এই ইউনিয়নকে স্বীকৃতি দেয়নি। ফলে যথেষ্ট অসুবিধাজনক অবস্থায় কাজ করতে হয়েছে। লাগাতার শ্রমিকদের লড়াই পরিচালনার মাধ্যমেই কর্তৃপক্ষের স্বীকৃতি পাওয়া গেছিল।১৯৪৬ সালে প্রাদেশিক আইনসভার নির্বাচন হয়। সীমাবদ্ধ ভোটদাতাদের নিয়েই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। রেল শ্রমিক নির্বাচন কেন্দ্রে প্রার্থী করা হয় জ্যোতি বসুকে। শ্রমিকদের ভোটে তিনি জয়ী হলেন। আইনসভার সদস্য হিসাবে যেমন দায়িত্ব পালন করতে পেরেছেন, তেমনই শ্রমিক, কৃষকসহ সমস্ত শ্রমজীবী মানুষের সংগ্রামের পাশে থেকে গণ আন্দোলনের সার্বিক নেতৃত্বের ভূমিকাই ক্রমশ তার মধ্যে প্রকাশিত হয়েছে। শ্রমিক ছাড়াও কৃষক, শিক্ষক, ছাত্র–যুব সহ সমস্ত অংশের সংগ্রামের সামনে দাঁড়িছেন জ্যোতি বসু।

এর পর সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী আন্দোলন, তেভাগা সহ কৃষক আন্দোলন, শ্রমিক-কর্মচারী আন্দোলন, উদ্বাস্তুদের আন্দোলন, খাদ্য আন্দোলন, গণতান্ত্রিক আন্দোলনের বহুমুখী গতিধারার সঙ্গে জ্যোতি বসুর জীবনের রাস্তা আলাদা করা যায়নি। সত্তরের নৈরাজ্য-সন্ত্রাসের অন্ধকারাচ্ছন্ন দিন থেকে আলোয় উত্তরণের সংগ্রামে তিনি ছিলেন অন্যতম দিশারি। বাংলার এই দীর্ঘকালীন সামগ্রিক লড়াই-আন্দোলনই জ্যোতি বসুকে স্বাভাবিক জননেতা রূপে নির্মাণ করেছে। এই দীর্ঘ লড়াই-আন্দোলনের পথ বেয়েই পশ্চিমবঙ্গে অন্ধকারের শাসনকাল পেরিয়ে ১৯৭৭ সালে জ্যোতি বসুর নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠা হয় বামফ্রন্ট সরকার। তারপর ক্রমান্বয়ে ২০০০ সাল পর্যন্ত তিনিই ছিলেন মুখ্যমন্ত্রী, দেশের সংসদীয় গণতন্ত্রে যে নজির আজও নেই। জ্যোতি বসুর নেতৃত্বে বামফ্রন্ট সরকার জনমুখী কর্মকাণ্ডে অভূতপূর্ব সাফল্য এসেছে রাজ্যে। গণতান্ত্রিক অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা, দলমত নির্বিশেষে বন্দিদের মুক্তি, সরকারি কর্মচারিদের ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার প্রদান, ছাঁটাই কর্মীদের পুনর্বহাল, শিক্ষার প্রসার ও শিক্ষায় গণতন্ত্রীকরণ, শিক্ষকদের উপযুক্ত মর্যাদাদান ইত্যাদি সিদ্ধান্ত উজ্জ্বল হয়ে রয়েছে। এছাড়া ভূমি সংস্কার ও ত্রিস্তরীয় পঞ্চায়েত ব্যবস্থার মাধ্যমে ভূমিহীনদের জমি বণ্টন, বর্গাদারদের অধিকার সুরক্ষা, মহিলাদের জন্য যৌথ পাট্টা, গ্রামীণ মানুষের আর্থিক উন্নয়ন, পঞ্চায়েতের মাধ্যমে মানুষের রাজনৈতিক-সামাজিক ক্ষমতায়ন, ১৮ বছরের ভোটাধিকার, পঞ্চায়েত-পৌরসভায় নির্দিষ্ট সময়ে নির্বাচন এবং যাবতীয় উন্নয়নমূলক কাজে মানুষকে যুক্ত করা, বিরোধীদের মতমতকে মর্যাদা দেওয়া ইত্যাদির মধ্যদিয়ে গণতন্ত্রের প্রসার, পঞ্চায়েত-পৌরসভায় মহিলাদের আসন সংরক্ষণ, তপশিলি – আদিবাসী – সংখ্যালঘু সহ অনগ্রসর শ্রেণির কল্যাণে প্রভূত উদ্যোগ গোটা দেশে নজির সৃষ্টি করেছে। জ্যোতি বসুর নেতৃত্বে বামফ্রন্ট সরকারের সময়ে পঞ্চায়েতের সাফল্য শুধু দেশে নয় আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও প্রশংসিত হয়েছে। এই সময়েই কৃষিতে অভাবনীয় সাফল্য এসেছে রাজ্যে, খাদ্যশস্য উৎপাদনে উদ্বৃত্ত রাজ্যে পরিণত, ক্ষুদ্র শিল্পে, মৎস্য উৎপাদনে, বন সৃজনে দেশের শীর্ষ স্থান অধিকার করেছে পশ্চিমবঙ্গ। এরই পাশাপাশি হলদিয়া, বক্রেশ্বর, তথ্য প্রযুক্তি শিল্প সহ অসংখ্য শিল্প গড়ে উঠেছে রাজ্যে। কৃষির সাফল্যকে অটুট রেখেই শিল্প সম্ভাবনার নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয় রাজ্যে। এই সমস্ত কিছুর মূল অভিমুখ ছিল বিকল্প পথে কর্মসংস্থান ও রাজ্যের সার্বিক উন্নয়ন। তবে এর জন্য সরকারি সমস্ত কর্মসূচিতে জ্যোতি বসুর বড় বড় ছবি দেওয়ার প্রয়োজন হয়নি, বা তার ছবি দিয়ে জনগণের পয়সায় ‘উন্নয়নের প্রতীক’ লেখা ব্যানার, ফ্লেক্স রাজ্যবাসীকে দেখানো হয়নি। তার বক্তৃতায় ও লেখায়  ‘আমি’ নয়, সবসময়ই প্রাধান্য পেয়েছে ‘আমরা’। তিনি লিখেছেন: “এ রাজ্যে যখন বামফ্রন্ট সরকার প্রতিষ্ঠা হয় তখনই আমরা ঘোষণা করেছিলাম, আমাদের সরকার শুধু মহাকরণ থেকে চলবে না, প্রতিটি গ্রামে, প্রতিটি শহরে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ করা হবে। সেই মতো আমরা পঞ্চায়েত রাজ প্রতিষ্ঠা করেছি, অসংখ্য পৌরসভা গঠন করেছি এবং এগুলির হাতে আর্থিক ও প্রশাসনিক ক্ষমতা দিয়েছি।…রাজ্যের সীমাবদ্ধ ক্ষমতার মধ্যে থেকেও আমরা মানুষকে যা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম তা সব সময়ই বাস্তবায়নের চেষ্টা করেছি। আমরা মানুষকে কখনো মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিইনি।”

দেশহিতৈষী, শারদ সংখ্যা, ২০০৯

সাম্প্রদায়িকতা, বিচ্ছিন্নতাবাদের বিরুদ্ধে জ্যোতি বসুকে চিরকাল দৃঢ় পদক্ষেপ করতে দেখেছেন রাজ্য ও দেশের মানুষ। তাই উগ্র, সাম্প্রদায়িক, হিন্দুত্ববাদীদের হাতে বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পর দিল্লি সহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে হিংসার আগুন জ্বললেও পশ্চিমবঙ্গে তার কোনো চিহ্নমাত্র ছিলনা। বরং ভিন রাজ্যের আতঙ্কিত মানুষ অনেকেই তখন পরিত্রাণ পেতে ‘জ্যোতি বসুর বাংলায়’ আশ্রয় খুঁজেছিলেন। বাবরি মসজিদের ঘটনার পর জ্যোতিবাবু সোচ্চারে বলেছিলেন এই জঘন্য কাজ ঘটাতে পারে একমাত্র ‘অসভ্য ও বর্বররাই’। আমাদের দেশে হিন্দু, মুসলমান, খৃস্টান, বৌদ্ধ, জৈন, শিখ প্রভৃতি বিভিন্ন ধর্মের মানুষ বাস করেন। ধর্ম মানুষের ব্যক্তিগত বিশ্বাস। আবার এই ধর্মবিশ্বাসী মানুষের মধ্যে অগ্রসর ও পশ্চাৎপদ অংশের মানুষও রয়েছেন। জ্যোতিবাবু মনে করতেন প্রকৃত  ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শই পারে সাম্প্রদায়িক ঐক্য ও সংহতির মেলবন্ধন তৈরি করতে। তাকে কখনোই কোন ধর্মীয় উৎসবে হাজির হতে হয়নি নিজেকে প্রমাণ করার জন্য। প্রশাসকের নমনীয়তা ও দৃঢ়তা, দুটোই তার মধ্যে দেখেছিল বাংলার মানুষ। একটা টিভি ইন্টারভিউতে জাভেদ আখতার তাঁকে প্রশ্ন করেছিলেন, আপনার রাজ্যে দাঙ্গা হয় না কেন?‌ এক কথায় উত্তর দিয়েছিলেন, ‘‌কিঁউ কি হুকুমত নেহি চাহতি।’‌

সময়োপযোগী সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করার সহজাত ক্ষমতা ছিল তার। এর মধ্যে দিয়েই বামফ্রন্ট তৈরি হয়েছে। প্রথমে ৬ দলকে নিয়ে বামফ্রন্ট ১৯৭৭ সালের ২১ জুন সরকার গঠন করে। পরে সিপিআই সহ আরো কিছু দল  যুক্ত হয়। গোটা জীবনজুড়ে কুৎসা , কারাবাস, মিথ্যা মামলা, অপপ্রচারের জালকে যেমন ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন করেছেন, তেমনি উদ্দীপ্ত করেছেন শ্রমিক-কৃষক, কর্মচারী, শিক্ষক, শিল্পী, সাহিত্যিক, বিজ্ঞানী, ছাত্র-যুব-মহিলা আন্দোলনকে। আমাদের দেশের ও আমাদের রাজ্যের নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে বাস্তবানুগ প্রয়োগের মধ্য দিয়ে মার্কসবাদ-লেনিনবাদের চর্চাকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন। পুঁজিবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থার মধ্যে একটি অঙ্গরাজ্যে সীমিত আর্থিক ও প্রশাসনিক ক্ষমতা সত্ত্বেও সাধারণ মানুষের স্বার্থে বিকল্প কী কী কর্মসূচি নেওয়া সম্ভব হতে পারে তা জ্যোতি বসুর নেতৃত্বে বামফ্রন্ট সরকার গোটা দেশের সামনে হাতেকলমে সাফল্যের সঙ্গে করে দেখিয়েছিল। দেশে জোট রাজনীতির যুগে পশ্চিমবঙ্গে তাঁর নেতৃত্বে এবং পরবর্তী সময়ে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে একটানা ৩৪ বছর ধরে চলা একটি দৃঢ় জোট হিসাবে বামফ্রন্ট সরকার উল্লেখযোগ্য উদাহরণ তুলে ধরেছিল। জোট সরকার মানেই যখন অস্থিতিশীল, স্বার্থপর, সুযোগসন্ধানী বলে প্রমাণ হচ্ছিলো, তখন এরাজ্যে এই জোট স্থিতিশীলতা এবং ব্যাপক উন্নয়নের নজির তৈরি করে ছিল। সকলেরই জানেন যে, এরাজ্যের ত্রিস্তর পঞ্চায়েতী ব্যবস্থাকে অনুকরণ করেই গোটা দেশে তা রূপায়ণের জন্য আইন তৈরি করা হয়েছে। কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্ক পুনর্বিন্যাসের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টিকেও সামনে তুলে এনেছিল জ্যোতি বসুর নেতৃত্বে বামফ্রন্ট সরকারই।

রাজ্যের এই অনন্য সাফল্য এবং অর্জিত সম্মান আজ অন্ধকারের শাসনে নস্যাৎ হতে বসেছে। আজ রাজ্যে ও গোটা দেশে গণতন্ত্র, অর্জিত অধিকার, ধর্মনিরপেক্ষতা, সংহতি, সম্প্রীতি, সংবিধান, আইন, ইতিহাস ও সংস্কৃতির ভূলুণ্ঠিত পতাকাকে তুলে ধরতে এবং দুর্নীতিমুক্ত সমাজ তৈরী করতে মানুষের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক গড়ে তুলে লড়াইয়ের নামা ছাড়া বিকল্প নেই। বর্তমানে এরাজ্যে গণতন্ত্র ও ব্যক্তি স্বাধীনতার ওপর তীব্র আক্রমণ নামিয়ে এনেছে তৃণমূল সরকার। গোটা দেশ জুড়ে বিজেপি ও একই কাজ করছে। বিজেপি’র সঙ্গে পাল্লা দিয়ে তৃণমূল এই রাজ্যে প্রতিযোগিতামূলক সাম্প্রদায়িকতায় নেমেছে। যার জেরে এরাজ্যে আরএসএস ক্রমশ ডালপালা বিস্তার করে চলেছে। জ্যোতি বসু বারবার সতর্ক করে বলতেন, “তৃণমূলের সবচেয়ে বড় অপরাধ, ওরা বিজেপি’র মতো সাম্প্রদায়িক শক্তিকে এরাজ্যে ডেকে এনেছে।” তাঁর এই সতর্কবাণী মনে রেখেই আমাদের আগামীদিনে যুক্তরাষ্ট্রীয় গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষ কাঠামো রক্ষার শপথ গ্রহণ করতে হবে।

দীর্ঘ সংগ্রামী জীবনে জ্যোতি বসু বারংবার আমাদের মনে করাতেন ‘সভ্যতার সংকট’-এর সেই অমোঘ বাণী, “মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ।” ২০১০ সালের জানুয়ারী মাসে লাল পতাকায় ছেয়ে যাওয়া রেড রোডে জ্যোতি বাবুর মরদেহ যখন জাতীয় পতাকায় আচ্ছাদিত করে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় গান স্যালুট দেওয়া হচ্ছিল, তখন উপস্থিত লাখো মানুষের দৃঢ় কণ্ঠে বারে বারেই উচ্চারিত হয়েছে তারই শেখানো কথা, “মানুষের স্বার্থ ছাড়া কমিউনিস্টদের আর কোনো স্বার্থ নেই। মানুষ যেমন ভুল করে, আবার মানুষই ইতিহাস রচনা করে। তাই মানুষের কাছেই আমাদের বারে বারে যেতে হবে।”

শহরের রাজপথে যোগ্য চাকরিপ্রার্থীদের প্রতিবাদ-প্রতিরোধ, গ্রামের খেতের আলপথ ধরে লালপতাকা উঁচিয়ে কৃষকের ফসলের ন্যায্য দাবী, মহিলাদের মাথা উঁচু করে বাঁচার দাবী, সুদূর রাজ্যে কাজ খুঁজতে যাওয়া পরিযায়ী শ্রমিকদের জানকবুল লড়াই যতদিন থাকবে, ততদিন আমাদের লড়াইয়ের অনির্বাণ শিখা হিসাবে থেকে যাবেন কমরেড জ্যোতি বসু।

শেয়ার করুন