১৯৫১, প্রথম দেখা খড়্গপুরে -পবিত্র সরকার...

৮ জুলাই , ২০২২ (শুক্রবার)

প্রথম পর্ব

এ লেখা মূলত সামান্য ব্যক্তিগত স্মৃতির উপর নির্ভর করবে। কারণ ভারতের সাম্প্রতিক ইতিহাসে জ্যোতিবাবুর রাজনৈতিক ভূমিকা নিয়ে লেখার যোগ্যতা আমার নেই। আমি তাঁকে কাছের থেকে দেখেছি খুব কম উপলক্ষ্যে, বেশির ভাগ সময়ে দূর থেকেই উপমহাদেশের এই এক শ্রেষ্ঠ নেতাকে আমার দেখা। সেই দূর আর কাছের বৃত্তান্ত দিয়েই মূলত মানুষটিকে ধরবার চেষ্টা করি। তাঁকে কিশোরবেলা থেকে দেখেছে এ রকম লোকও তো আস্তে আস্তে কমে আসছে।

প্রথম তাঁকে দেখি খড়্গপুর শহরে। তখন আমি স্কুলের ছাত্র, সম্ভবত ক্লাস এইট-টেইটে পড়ি। সেটা ১৯৫১ সাল হবে। এর মধ্যে খড়্গপুরে কমিউনিস্ট পার্টির (তখন অবিভক্ত) কাজকর্ম শুরু হয়েছে, মূলত রেলওয়ে কারখানার শ্রমিকদের সংগঠিত করার মধ্য দিয়ে। কমরেড নারায়ণ চৌবে তার নেতা, তাঁর সঙ্গে আছেন কমরেড যতীন মিত্র, জনার্দন রাও আরও অনেকে ছিলেন, ছাত্রদের মধ্যে থেকে এলেন প্রশান্ত নাহা, পঞ্চানন সাহা প্রভৃতি। শেষের দুজন স্কুলে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে আমাদের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত করার চেষ্টা করেছিলেন।

খুব একটা চেষ্টা করতে হয়নি, কারণ আমরা উদ্বাস্তু, আর উদ্বাস্তু মানেই তখন শাসক কংগ্রেসের বিরোধী—তাদের অধিকাংশের ধারণা যে গান্ধিজি আর নেহরু আর তাঁদের সাঙ্গোপাঙ্গরা দেশভাগের জন্য দায়ী। আমাদের যে সেই পূর্ববঙ্গের ঢাকা জেলার গ্রাম ছেড়ে চলে আসতে হল নদীর পর নদী আর স্থলপথে এত গ্রামশহর পেরিয়ে, এসে জমিদার না হই, মোটামুটি গ্রামীণ সচ্ছলতা থেকে একটা নদীহীন শহরে ঘিঞ্জি একটা খড়ে-ছাওয়া মাটির ঘরের বাসিন্দা হতে হল, একটা অর্ধসমাপ্ত উদ্বাস্তুদের স্কুলে পড়তে হল, তার সবটাই কংগ্রসের কাজ বা নিষ্ক্রিয়তার পরিণাম, ফলে ঐতিহাসিক বাধ্যবাধকতাতেই আমরা কংগ্রেসবিরোধী হয়ে উঠেছিলাম।  আর তখন বামপন্থা ছাড়া আমাদের কাছে কোনও বিকল্প ছিল না, যদিও পরের বছর, ভারতের প্রথম সাধারণ নির্বাচনে, শ্যামাপ্রসাদের ‘জনসঙ্ঘ’ খাড়া হয়েছিল, আমরা তার দিকে ঝুঁকিনি।

বোধ হয় তখন রেলের কী একটা ধর্মঘটের আয়োজন হচ্ছিল, সেই উপলক্ষ্যেই সম্ভবত জ্যোতিবাবুর খড়্গপুর যাওয়া। খড়্গপুরে রেলের এলাকা আর সাধারণ নাগরিক এলাকার (সিভিল টাউন) মধ্যে একটা লম্বা আর মানুষের মাথা-ছাড়ানো পাঁচিল খাড়া করা আছে, জানি না কবে থেকে। সুভাষপল্লি ময়দানে তিনি বক্তৃতা দেবেন, কিন্তু রেল তাঁকে ময়দানে ঢুকতে দেবে না। তখন পার্টির তরফে এই ব্যবস্থা হল যে, ওই পাঁচিলের পেছনে, নাগরিক এলাকায় পাঁচিল সমান মঞ্চ হবে, জ্যোতিবাবু তার ওপর দাঁড়াবেন, আর আমরা জনতা, তাঁর শ্রোতারা বসব ওই রেলওয়ের এলাকাভুক্ত মাঠে, রেল কিচ্ছু বলতে পারবে না। কারণ জ্যোতিবাবু তো মাঠে ঢুকছেন না। আমি আর আমার পালিকা ছোটমা (আমার ছোটপিসিমা) দুজনেই গেলাম জ্যোতিবাবুর বক্তৃতা শোনবার জন্য, মূলত ওই বিখ্যাত নেতাকে দেখার জন্য।  

তাঁর বক্তৃতার কথা সবাই জানেন— কাটা-কাটা বাক্যে, কখনও একটু ব্যঙ্গ মিশিয়ে তিনি পরিষ্কার কথা বলতেন, তাতে আবেগ উচ্ছ্বাস খুব বেশি থাকত না, ভাষার অলংকরণও না। আমাদের ভালোই লেগেছিল সে বক্তৃতা, কিন্তু তা শেষ হতে না হতে তুমুল বৃষ্টি এল। আমরা দেখলাম জ্যোতিবাবু এক মুহূর্তের জন্য থামলেন না, যেন এটাই খুব স্বাভাবিক, এতে তিনি অভ্যস্ত। বৃষ্টি থেকে তাঁকে বাঁচাতে একজন তাঁর মাথায় ছাতা ধরল, কিন্তু প্রবল জলহাওয়ার তোড়ে সে ছাতা খুব কাজে এল না, তাঁর ধবধবে পাঞ্জাবি ভিজে শরীরে সঙ্গে লেপটে গেল। কিন্তু তার জন্যে বক্তৃতা তিনি সংক্ষেপ করলেন এমন মনে হল না।  
ওই মাঠের শ্রোতারা ছুটে ইতস্তত পাশের রাস্তায় উঠে গাছের জলায় জড়াজড়ি করে দাঁড়িয়েছিল। আমি আর ছোটমা একটা ছাতার নীচে দাঁড়িয়ে শুনেছিলাম বক্তৃতা, তারপর এই মানুষটির কথা ভাবতে ভাবতে ফিরে এসেছিলাম।

ভাবছিলাম সবাই তাঁকে নিয়ে যা ভাবত।  লন্ডন ফেরত ব্যারিস্টার, যুক্ত হলেন কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে। সাদা ধুতি আর পাঞ্জাবি ছাড়া অন্য পোশাকে দেশে তাঁকে দেখিনি বললেই হয়। একেবারে প্রতিনিধিসুলভ বাঙালি। পরে আমার প্রতিবেশী ‘গণশক্তি’র প্রয়াত চিফ রিপোর্টার কবি সুধীর চৌধুরী জ্যোতিবাবু সম্বন্ধে আরও অনেক খবর আমাকে দিয়েছে। সে প্রায় আঠারো ঘণ্টা পার্টি অফিসে থাকত, জ্যোতিবাবুর সঙ্গে তার কথাবার্তা হত। সে জানিযেছিল, বাড়িতে জ্যোতিবাবু খুব স্বাবলম্বী ছিলেন, নিজের লুঙ্গি গেঞ্জি সব নিজে সাবান দিয়ে নিজের হাতে কাচতেন, অন্যদের হাত লাগাতে দিতেন না। পার্টি কনফারেন্সে কোথাও গেলেও তাই করতেন। খেতেন খুবই কম, সেটা আমি নিজের চোখেই দেখেছি। যখন তাঁর বড় নাতনির বিয়েতে গেলাম, তাঁর বউমা, অসাধারণ অভিনেত্রী আর নাট্যপরিচালক শ্রীমতী ডলি বসুর আমন্ত্রণে, তাঁকে আর আমাকে এক ঘরে খেতে দেওয়া হল। আমি দেখলাম একটা বড় প্লেটে অতি সামান্য দু-এক টুকরো কী নিয়েছেন তিনি, আর কিছু না। নাতনি বিয়ের সাজ পরেই এসেছিল দাদুকে আপ্যায়ন করতে, তিনি পরম স্নেহে তাকেই জিজ্ঞেস করলেন, তুমিই ঠিক করে দাও কী খাব আমি।

1977 Satgachia


তাঁর সঙ্গে মুখোমুখি বা কাছাকাছি বসব, এ রকম পর্যায়ে আসতে অবশ্য বহু বছর লেগেছে। ছাত্র আন্দোলনের কর্মী হিসেবে ছাত্রজীবন পার হলাম, তখন বিপিএসএফের কর্মী, সব স্তরেই চুটিযে ইউনিয়ন করেছি, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় স্তরে ইউনিয়নে আমার বাঁধা ছিল পত্রিকা সম্পাদকের কাজ। কোনও ছাত্র-সম্মেলনে জ্যোতিবাবুকে বক্তা হিসেবে পেয়েছি বলে মনে হয় না। ভুবনেশ্বরে একটি সর্বভারতীয় সম্মেলনে এসেছিলেন পি সি যোশী। ব্রিগেডে ও অন্যত্র জ্যোতিবাবুকে দূর থেকে সভাসমিতিতে দেখেছি, বক্তৃতা শুনেছি। আগেই বলেছি, জ্যোতিবাবুর বক্তৃতা জনমোহিনী ছিল না, কিন্তু তবু লক্ষ করতাম, তাঁর কথার জন্য সবাই বসে আছে, তাঁর বক্তৃতা হয়ে গেল তো মাঠ খালি হতে শুরু করল। দূর দূর থেকে আসা কমরেডরা পতাকা গুটিয়ে তাঁদের লোকজনকে নিয়ে বাস বা ট্রেনের উদ্দেশ্য যাত্রা করলেন। ১৯৫৮ নাগাদ বঙ্গবাসীতে ইউনিয়ন করার সময়ে অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে যুক্ত হলাম। ওই সময় এখন যেটা কলকাতা জেলা অফিস সেখানে পার্টি ক্লাস আয়োজিত হয়েছিল, তাতে আমি শমীক বন্দ্যোপাধ্যায়, পল্লব সেনগুপ্ত এরা ক্লাস করছিলাম ঐতিহাসিক ও দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ সম্বন্ধে। ক্লাস নিয়েছিলেন সুরেন্দ্রনাথ কলেজের অধ্যাপক সুবাসসিঞ্চন সরকার আর যাদবপুরের শিপ্রাদি, শিপ্রা সরকার। ওই অফিসে একদিন জ্যোতিবাবু এলেন শ্রীপাদ অমৃত ডাঙ্গেকে নিয়ে, আমাদের সঙ্গে মুখোমুখি প্রথম সাক্ষাৎ হল তাঁর। আর পার্টি যখন ভাগ হল ১৯৬৪তে তখন আমি ছাত্রজীবন পেরিয়ে যাদবপুরে অধ্যাপনায় ঢুকেছি। ভারত-চিন সীমান্ত সংঘর্ষ হয়ে গেছে দু-বছর আগে, তখন মনে হল রবীন্দ্রনাথের এ জন্মের তীর্থ রুশদেশের দৃষ্টিভঙ্গি একটু নড়বড় করছে। কাজেই একটা সিদ্ধান্ত নিতে হল। কিন্তু পুরোনো বন্ধুদের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হয়নি।

লেখাটি দুটি পর্বে প্রকাশিত......


শেয়ার করুন

উত্তর দিন