গণপতি উৎসবে তিলককৃত সংস্কারের ভিতরে সবথেকে উল্লেখযোগ্য দিক হল; গণেশের বিরাট বিরাট মূর্তি স্থাপন করা।দক্ষিণ ভারতের রাজনীতির ক্ষেত্রে দীর্ঘদিন ধরে যে কাটআউট সংস্কৃতি দেখতে পাওয়া যায়, সেই ধারাটি এই বিশালাকার গণেশ মূর্তি থেকেই এসেছে।দক্ষিণ ভারতের এই কাটআউট সংস্কৃতি, যার উৎপত্তির ভিতরে রাজনৈতিক হিন্দু পুনরুত্থানবাদী চিন্তা বেশ জোরদার ভাবেই আছে, সেই সংস্কৃতি ই গত প্রায় বছর দশেক হল পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের একাংশের সংস্কৃতির অঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বাল গঙ্গাধর তিলক বিশালাকার গণেশ মূর্তির পাশাপাশি মেলার আয়োজন করতেন ।সেই মেলাতে বহু স্থানীয় গায়ক সমবেত হয়ে রাজনৈতিক প্ররোচনামূলক গান গাইতো।ধর্ম আর রাজনীতির মিশেলযুক্ত সেইসব গানের ভিতরে হিন্দু জনতার উদ্দেশে মুসলমানেদের মুহররমের শোভাযাত্রায় অংশ না নেওয়ার জন্যে আহ্বান থাকত।নানা ধরণের উসকানিমূলক কথাও মুসলমানেদের প্রতি সেইসব গানে বলা হতো। জাতীয়তাবাদের সেই সময়ের যে হিন্দু পুনরুত্থানবাদী দৃষ্টিভঙ্গি ছিল, সেটিকে মানুষের ভিতরে ছড়িয়ে দেওয়াই ছিল এই মেলার গায়কদের অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য। হিন্দু সমাজের ভিতরে বহুত্ববাদী ভারতের চিরন্তন চেতনা তখন এতোটাই গভীর ছিল যে, মুহররমের মিছিলে হিন্দুদের অংশগ্রহণ একটি অতি স্বাভাবিক ঘটনা ছিল।গণপতি উৎসবকে ঘিরে একটা সাম্প্রদায়িক বিভাজনমূলক প্রবণতাকে তীব্র করে তোলা হয়, যার জেরে যে হিন্দুরা মুহররমের মিছিলে অংশ নিতেন, রাতারাতি তাঁরা সেই মিছিল বয়কট করতে শুরু করেন।মুহররমের মিছিল বয়কট করে এইসব মানুষেরা ভিড় জমাতে শুরু করলো গণপতি উৎসবে।১৮৯৫ সাল থেকেই পুনা শহরের ভৌগলিক পরিমন্ডল কে অতিক্রম করে গোটা দাক্ষিণাত্যে এই গণপতি উৎসব ছড়িয়ে পড়ল।ধর্মের কোনো আকর্ষণ।থেকে এই পুজোর বিষয়টি কিন্তু ছড়ালো না।মুসলমান সমাজের সঙ্গে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার তাগিদেই বাল গঙ্গাধর তিলক 'গণেশ' কে ব্যবহার করলেন সাম্প্রদায়িকতা মিশ্রিত রাজনীতির স্বার্থে।বঙ্গভঙ্গের বছরে (১৯০৫) দেখা গেল, এই গণপতি উৎসব পুনা শহর কে অতিক্রম করে দাক্ষিণাত্যের আরো বিহিত্তরটি শহরে বিশেষ আড়ম্বরের সঙ্গে পালিত হচ্ছে।
বাংলায় রামকৃষ্ণ ভাব আন্দোলন, ব্রাহ্ম সমাজের সংস্কারবাদী আন্দোলন, রামমোহন- বিদ্যাসাগর বিন্ধ্য পর্বত অতিক্রম করে সংস্কারবাদী চেতনার বিকাশে বিশেষ কার্যকরী হতে পারে নি।আর্য সমাজের প্রতিষ্ঠাতা দয়ানন্দ সরস্বতী শ্রীরামকৃষ্ণের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলেন।তবে নিজের সাম্প্রদায়িক সংস্কর, মুসলিম বিদ্বেষের দ্বারা শ্রীরামকৃষ্ণকে এতোটুকু প্রভাবিত করতে পারেন নি।শিবনাথ শাস্ত্রী তাঁর ' রামতনু লাহিড়ি ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ ' গ্রন্থে, উনিশ শতকে বাংলার পরিমন্ডলকে সাম্প্রদায়িক খাতে দয়ানন্দের প্রবাহিত করবার চেষ্টার কঠোর সমালোচনা করেছিলেন। কিন্তু এই সংস্কারবাদী চেতনা র বিরোধিতা র ভিতর দিয়ে ধর্মান্ধভাবনাকে প্রতিষ্ঠিত করা তিলক এবং তাঁর সহমতাবলম্বীদের একটা অভ্যাসে পরিণত হয়েছিল।পরবর্তী কালে আর এস এস যে হিন্দু ধর্মের প্রতীক সহ আন্দোলনকে সামাজিক আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়ে, রাজনৈতিক আন্দোলনে ধর্মান্ধতার অনুপ্রবেশ ঘটিয়েছে, সেই ধারাটি তিলকের নেতৃত্বে পুনা শহরকে কেন্দ্র করে বিকাশ লাভ করে।
হিন্দু সাম্প্রদায়িক ভাবনার ধারক বাহকেরা জাতীয় কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠা লগ্ন থেকে কার্যত সামাজিক আলোচনার নাম করে, রাজনীতি আর ধর্মান্ধতার মিশ্রণে র ভিতর দিয়ে ব্রিটিশ সাম্রৃজ্যবাদের বিরোধিতার যাবতীয় প্রেক্ষাপটটিকে গুলিয়ে দিতে অভ্যস্থ হয়ে উঠেছিল।সীমাবদ্ধ পরিসরে জাতীয় কংগ্রেস যেটুকু ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরোধিতা করতে শুরু করছে, সেটি যাতে কোনো অবস্থাতেই সাধারণ মানুষকে প্রভাবিত করে, তাঁদের ভিতরে একটা ব্রিটিশ বিরোধী মানসিকতার জন্ম না দেয়, সে জন্যে হিন্দু সাম্প্রদায়িকদের চেষ্টার ত্রুটি ছিল না।জাতীয় কংগ্রেসের বার্ষিক অধিবেশন যখন ই অনুষ্ঠিত হতো, তখন ই সামাজিক আলোচনার নাম করে রাজনীতির সঙ্গে ধর্ম এবং ধর্মান্ধতার উপাদানের মিশেল ঘটাতে গোবিন্দবল্লভ রানাডের উদ্যোগে বিভিন্ন জায়গাতে সমান্তরাল আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হতো। কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠাকাল থেকে (১৮৮৫) প্রথম দশ বছর, অর্থাৎ; ১৮৯৫ সাল পর্যন্ত রানাডের নেতৃত্বে এই সমান্তরাল সভার রেওয়াজ ছিল।ব্রিটিশ শক্তি কিন্তু কখনোই রানাডের নেতৃত্বে কংগ্রেসের এই সমান্তরাল সভা কে কোনো রকম বাঁধা দেয় নি। হিন্দু সাম্প্রদায়িক দের ভিতরে আধিপত্য কায়েম করবার নিরঙ্কুশ ক্ষমতা জনিত গোষ্ঠী দ্বন্দ্বের জেরে রানাডের এই সমান্তরাল সভাকে ভালো চোখে দেখতেন না তিলক।ফলে, তিলকের বিরুদ্ধতাতেই ১৮৯৫ সাল থেকে রানাডের নেতৃত্বাধীন এই সমান্তরাল সভার প্রচলন বন্ধ হয়ে যায়।
গণেশ উৎসবের ভিতর দিয়ে সামাজিক মেরুকরনের যে কাজটি তিলক শুরু করেছিরেন, তাকে সম্পূর্ণতা দিতেই ১৮৯৬ সালে তিনি প্রবর্তন করেছিলেন শিবাজী উৎসব।শিবাজীর রাজ্যাভিষেককে স্মরণ করে এই উৎসব সামাজিক ক্ষেত্র কে যথেষ্ট প্রভাবিত করেছিল।শিবাজী উৎসব কে কেন্দ্র করে বাংলায় একটা ভয়াবহ মেরুকরণের চেষ্টা চলেছিল।সখারাম গণেশ দেউস্কর শিবাজী উৎসব কে বাংলায় প্রবর্তনে সক্রিয় হন। সখারামের অনুরোধে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ' শিবাজী উৎসব 'নামক একটি কবিতা লেখেন।সেটি ১৩৯১ সালের আশ্বিন সংখ্যা 'বঙ্গদর্শনে'প্রকাশিত হয়।
কবিতাটি লেখার পর ই শিবাজী কল্পিত ' অখন্ড ভারত'চেতনা, যেটিকে 'শিবাজী উৎসবে' জোরদার ভাবে তুলে ধরা হচ্ছিল, সেই বোধ সম্পর্কে সন্দিহান হয়ে ওঠেন রবীন্দ্রনাথ।স্বদেশ পর্যায়ের যেকোনো উদ্যোগে ব্রিটিশ নানা রকমের বাঁধা সৃষ্টি করতো।কিন্তু মহারাষ্ট্র এবং বাংলায় 'শিবাজী উৎসব 'ঘিরে ব্রিটিশ কার্যত নীরব রইলো।ব্রিটিশের এই নীরবতা যে ভারোএর একাংশের মানুষের সাম্প্রদায়িক চেতনায় উৎসুক হয়ে যাওয়া ঘিরে উৎসাহব্যঞ্জক অবস্থানের ই শামিল, তা বুঝে নিতে অসুবিধা হল না রবীন্দ্রনাথের। তাই সেই সময়ের কলকাতায় 'পতির মাঠ '( বর্তমান বিধান সরণীতে যেখানে এখন বিদ্যাসাগর কলেজ) , সেখানে ১৯১৬ সালের ৪-৮ ই জুন যে ' শিবাজী উৎসব ' হয়, সেখানে আর ব্যক্তিগত ভাবে উপস্থিত হন নি রবীন্দ্রনাথ।যদিও সেখানে শ্যামসুন্দর চক্রবর্তী রবীন্দ্রনাথের লেখা 'শিবাজী উৎসব ' কবিতাটি পাঠ করেছিলেন।এই উৎসবে বাল গঙ্গাধর তিলক, গণেশ কৃষ্ণ খাপার্দে এবং আর এস এসের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ডাঃ বি এস মুঞ্জে উপস্থিত ছিলেন।পরবর্তীতে এই মুঞ্জে ই মুসোলিনীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে , মুসোলিনীর ফ্যাসিবাহিনীর সশস্ত্র সংগঠন 'বালিল্লা' র আদলে প্রতিষ্ঠার পর আর এস এসের সশস্ত্র, সন্ত্রাসী প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছিলেন।
তৎকালীন কর্ণওয়ালিস স্ট্রীটের ' পাতির মাঠে' ' শিবাজী উৎসবে'অংশ গ্রহণ ই ছিল বাংলায় আর এস এসের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ডাঃ বি এস মুঞ্জের প্রথম প্রকাশ্য সভা।অনুমান করা যায় যে, মুঞ্জেদের সাম্প্রদায়িক চিন্তা এবং ধর্মান্ধ মানসিকতা সম্পর্কে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল ছিলেন রবীন্দ্রনাথ।তাই কোনো সাম্প্রদায়িক মানসিকতা সম্পন্ন ব্যক্তির সঙ্গে একমঞ্চে থাকতে তিনি রাজি হন নি।শিবাজী হিন্দুর আত্মসম্মানকে তুলে ধরেছিলেন বলেই তাঁকে ঘিরে এই উৎসব-- একথা খুব পরিস্কার ভাবেই তিলক প্রকাশ্যে বলেছিলেন।
হিন্দুর আত্মসম্মান বৃদ্ধিকারীকে ঘিরে এই উৎসব পালন নিজেদের পক্ষে তো আদৌ বিপদজনক নয়, বরংচ হিন্দু অস্মিতা জোরদার হলে, হিন্দু- মুসলমানের সংঘাত আরো তীব্র হবে-- এটাই ছিল তৎকালীন ব্রিটিশ সরকারের অভিমত।তাই বোম্বাইয়ের প্রাদেশিক সরকার যেমন এই 'শিবাজী উৎসব ' সম্পর্কে কার্যত নীরব থেকে আয়োজকদের সমর্থন করে গেছে,তেমনটাই অবস্থান ছিল বাংলার সরকারের ও।এই উৎসব কোনো অবস্থাতেই ব্রিটিশের স্বার্থহানি ঘটাবে না , বরং বিভাজন প্রক্রিয়া হিন্দু- মুসলমানের ভিতরে তীব্র থেকে তীব্রতর করে তুলে ব্রিটিশের সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থকে সুরক্সিত রাখবে।এই দৃষ্টিভঙ্গির থেকেই ব্রিটিশ কোনো অবস্থাতেই 'শিবাজী উৎসবে'র ভিতর দিয়ে সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতি জটিল হচ্ছে, এটা জেনে বুঝেও এই উৎসব পালনে এতোটুকু প্রতিবন্ধকতার কারন হয় নি।সাভারকর , তার তথাকথিত সশস্ত্র কর্মকান্ডে এই শিবাজী উৎসব কে নানা ভাবে ব্যবহার করেছিল।ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে হিন্দু সাম্প্রদায়িক শক্তির প্রত্যক্ষ সংযোগের প্রমাণ হিশেবে এই শিবাজী উৎসব, আর সেই উৎসবকে ঘিরে মুসলমান সম্প্রদায়ৃর মানুষদের প্রতি প্ররোচনামূলক কর্মকান্ড, আর তাকে ঘিরে ব্রিটিশের নিরীহ, নিস্পৃহ মানসিকতাকে বিশেষ ভাবে উল্লেখ করতে হয়।
ধারাবাহিক লেখাগুলি পড়তে ক্লিক করুনঃ www.cpimwb.org.in
ভারতের জাতীয় আন্দোলন ও আর এস এস (পর্ব - ২৫)
ভারতের জাতীয় আন্দোলন ও আর এস এস (পর্ব - ২৪)
ভারতের জাতীয় আন্দোলন ও আর এস এস - (পর্ব - ২৩)
ভারতের জাতীয় আন্দোলন ও আর এস এস - (পর্ব - ২২)
ভারতের জাতীয় আন্দোলন ও আর এস এস – (পর্ব – ২১)
ভারতের জাতীয় আন্দোলন ও আর এস এস – (পর্ব – ২০)
ভারতের জাতীয় আন্দোলন ও আর এস এস – (পর্ব – ১৯)
ভারতের জাতীয় আন্দোলন ও আর এস এস – (পর্ব – ১৮)
ভারতের জাতীয় আন্দোলন ও আর এস এস – (পর্ব – ১৭)
ভারতের জাতীয় আন্দোলন ও আর এস এস – (পর্ব – ১৬)
ভারতের জাতীয় আন্দোলন ও আর এস এস – (পর্ব – ১৫)
ভারতের জাতীয় আন্দোলন ও আর এস এস – (পর্ব – ১৪)
ভারতের জাতীয় আন্দোলন ও আর এস এস – (পর্ব – ১৩)
ভারতের জাতীয় আন্দোলন ও আর এস এস – (পর্ব – ১২)
ভারতের জাতীয় আন্দোলন ও আর এস এস – (পর্ব – ১১)
ভারতের জাতীয় আন্দোলন ও আর এস এস – (পর্ব – ১০)
ভারতের জাতীয় আন্দোলন ও আর এস এস – (পর্ব- ৯)
ভারতের জাতীয় আন্দোলন ও আর এস এস – (অষ্টম পর্ব)
ভারতের জাতীয় আন্দোলন ও আর এস এস – (সপ্তম পর্ব)
ভারতের জাতীয় আন্দোলন ও আর এস এস – (ষষ্ঠ পর্ব)
ভারতের জাতীয় আন্দোলন ও আর এস এস – (পঞ্চম পর্ব)
ভারতের জাতীয় আন্দোলন ও আর এস এস – (চতুর্থ পর্ব)
ভারতের জাতীয় আন্দোলন ও আর এস এস – (তৃতীয় পর্ব)
ভারতের জাতীয় আন্দোলন ও আর এস এস – (দ্বিতীয় পর্ব)
ভারতের জাতীয় আন্দোলন ও আর এস এস – (প্রথম পর্ব)