Indian Freedom Struggle And RSS – A Retrospective (Part-21)

ভারতের জাতীয় আন্দোলন ও আর এস এস (পর্ব – ২১)

ধারাবাহিক রচনায়ঃ গৌতম রায়

উনিশ শতকের  শেষভাগে বাংলার পাশাপাশি মহারাষ্ট্র জুড়ে যে পুনর্জাগরণ বাদী আন্দোলন সংগঠিত হয়, সেই আন্দোলন ,মহারাষ্ট্র অঞ্চলের তথা গোটা বোম্বাই প্রেসিডেন্সির  সামাজিক প্রেক্ষিতে ইতিবাচক এবং নেতিবাচক দু’রকম ই প্রভাব রেখেছিল। অপরপক্ষে এই পুনর্জাগরণ বাদী আন্দোলনের ধারা মারাঠি অভিমানসকে এমন একটা জায়গায় পৌঁছে দেওয়ার মতো অবস্থায় পৌঁছে দেয়, যা পরবর্তীকালে মারাঠা অঞ্চল তথা গোটা বিন্ধ পর্বতের  অপর প্রান্তে ,সামাজিক- সাংস্কৃতিক ,পরিমন্ডল কে ব্যক্ত করে, রাজনৈতিক পরিমণ্ডল কে প্রভাবিত করে ।সেই প্রভাবকে রাজনৈতিক হিন্দু সাম্প্রদায়িকেরা  বিশেষ ভাবে নিজেদের পক্ষে কাজে লাগিয়েছিল।
                     

মহারাষ্ট্রে উনিশ শতকের শেষ ভাগে যে হিন্দু পুনর্জাগরণবাদী  দৃষ্টিভঙ্গিরম প্রসার লাভ করেছিল , সেই দৃষ্টিভঙ্গির ভিতরে কিন্তু কোন ধরনের সংকীর্ণ মানসিকতা বা  রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের লক্ষ্য ছিল না । তাঁদের মধ্যে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরোধিতা বিষয়টি খুব স্পষ্ট এবং প্রবল ছিল ।
                    

অপরপক্ষে আরএসএসের পূর্বসূরিরা, বিশেষ করে, হিন্দু মহাসভার লোকজন, তারা তখন যেভাবে ধীরে ধীরে নিজেদের বিস্তার লাভ করার সুযোগ সুবিধে তৈরি করছে, তারা কিন্তু বাংলা ও মহারাষ্ট্রের এই সংস্কারবাদীদের দৃষ্টিভঙ্গি গুলি, নিজেদের সংকীর্ণ রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের স্বার্থে ব্যবহার করতে বিশেষ রকমভাবে আগ্রহী ছিল ।তার সাথে এটাও খুব জোরের সঙ্গে উল্লেখ করতে হয় যে ,রাজনৈতিক হিন্দুদের এইসব দৃষ্টিভঙ্গির ভেতর একটিবারের জন্য কিন্তু ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে কোনো রকম নেতিবাচক একটি শব্দ ও  উচ্চারিত হয়নি।
                  

পুনা সার্বজনিক সভা নামক বালগঙ্গাধর তিলকের সংগঠন এবং তার পাশাপাশি ওঁকে কেন্দ্র করে যে সমস্ত পুনর্জাগরণ বাদী সংগঠন ছিল,  তাঁরা গোটা মহারাষ্ট্রে ধীরে ধীরে তাঁদের কর্মকাণ্ডের বিস্তার ঘটাতে শুরু করে। মজার কথা হল যে, হেডগেওয়ারের  কর্মভূমি নাগপুর কে কেন্দ্র করে আরএসএস সার্বিকভাবে ,সংশ্লিষ্ট অঞ্চলে নিজেদের তথাকথিত  সামাজিক, রাজনৈতিক ,এমনকি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী ভূমিকাকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে তুলে ধরবার যে চেষ্টা করে, তারা কিন্তু  এই পর্বে বালগঙ্গাধর তিলকের সঙ্গে কোনো অবস্থাতেই সঙ্গে যুক্ত ছিল  না।
                      

বালগঙ্গাধর তিলক হিন্দু ব্রাহ্মণ , মারাঠা গৌরবের যে পুনর্জাগরণ এবং এক ধরনের অস্মিতা কে জাগানোর চেষ্টা করেছিলেন, সেটি কে  তিনি তাঁর সামাজিক কর্মকান্ডের একটি বড় পর্যায় হিসেবে তুলে ধরেন। সেই পর্যায়টি ,সেই সময়ের সামাজিক প্রেক্ষিতে, বেশ কিছু ভূমিকা রাখলেও পরবর্তীকালে রাজনৈতিক ,সাম্প্রদায়িক শক্তি ,গোটা প্রেক্ষিত টি থেকে একটি সংকীর্ণ ,ক্ষমতা দখলের আকাঙ্ক্ষার ভেতর পর্যবসিত করার তাগিদ খুঁজে নেয়।
               

বালগঙ্গাধর তিলক

বালগঙ্গাধর তিলক দের এবং তাঁর সহযোগীদের ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সার্বিক মানসিকতা কে  একটি সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গির ভিতর  দিয়ে দেখে ,ইতিহাস চর্চার গোটা বিষয়াবলীকে একটি বিকৃত দিকে পরিচালিত করার চেষ্টা করে রাজনেতিক হিন্দুদের প্রতিনিধি আর এস এস এবং তার সঙ্গীসাথীরা আর তাদের রাজনৈতিক সংগঠন ফ
বিজেপি।
                           

ভারতবর্ষের প্রচলিত  হিন্দু সমাজের সামাজিক বিধি বিধানের ক্ষেত্রে ঔপনিবেশিক শাসকেরা হস্তক্ষেপ করতে পারে কি পারে না –এই প্রশ্নে রামমোহন রায়ের সময়কাল থেকেই সংস্কারবাদীদের ভিতর বহু বাদ – প্রতিবাদ এবং সংশয় কাজ করে এসেছে। সতীদাহ প্রথা উচ্ছেদের জন্য আত্মনিবেদিত রামমোহন রায় ,বিদেশী শাসকরা আইন মারফত ভারতবর্ষের মানুষদের সামাজিক বিধি বিধান নীতি নির্ধারণ করুন– এটি খুব মন থেকে মেনে নিতে পারেননি।
               

হাইড ইস্টকে  লেখা চিঠিপত্রের ভেতর দিয়ে ,সতীদাহ প্রথা নিবারণার্থে  ব্রিটিশের আইন করা  বিষয়ে রামমোহনের কিছু মানসিক দ্বন্দ্বের পরিচয় আমরা পাই।রামমোহন খুব আন্তরিকভাবে চেয়ে ছিলেন, ভারতবর্ষীয় জনগণের ভেতর থেকেই এমন একটি সামাজিক আন্দোলন তৈরি হোক, সেই  আন্দোলনের জেরে, শেষ পর্যন্ত হিন্দু সমাজের ভেতর থেকেই সতীদাহ প্রথা নিবারণ হয় ।
                

তবে একথা অস্বীকার করা যায় না যে ,আইন করে বিদেশী শাসকরা ভারতবর্ষের হিন্দু সমাজের সামাজিক বিধি-বিধান নির্দিষ্ট করুক, নির্ধারণ করুক– এটা রামমোহনকে অন্তর থেকে মেনে না নিলেও, সতীদাহ প্রথা নিবারণের  উদ্দেশ্যে ব্রিটিশ যখন আইন প্রণয়ন করে, সেই আইনকে সমর্থনের প্রশ্নে কিন্তু রামমোহন কোনরকম দ্বিধা দেখাননি।
                    

অপরপক্ষে ১৮৫৫ সাল নাগাদ ভারতবর্ষীয় বিবাহ আইন সংক্রান্ত বিষয়টিকে  ঘিরে সামাজিক আলোড়ন একটি গুরুত্বপূর্ণ আকার ধারণ করে। ভারতবর্ষের সামাজিক আন্দোলনের ইতিহাসে ওই সালের জানুয়ারি মাসে লোকমান্য বাল গঙ্গাধর তিলকের নেতৃত্বে ভারতবর্ষীয় মানুষদের বিবাহের ক্ষেত্রে সরকারি হস্তক্ষেপের বিরোধিতা করে একটি সভার আয়োজন করা হয়। সেই সভায় প্রচুর জনসমাগম হয়েছিল ।পুনেতে অনুষ্ঠিত সেইসভা থেকে লোকমান্য তিলক এই প্রস্তাব দিয়েছিলেন যে, বাল্যবিবাহের মত ভারতবর্ষীয় সমাজের যে ভয়ঙ্কর প্রথা বিদ্যমান রয়েছে, সেই সব কু প্রথাকে একদম শেষ করে দেওয়ার ক্ষেত্রে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো, ভারতবর্ষের মানুষদের শিক্ষার ক্ষেত্রে সার্বিক সচেতনতা পরিবেশ তৈরি করা।
                   

সেখানে লোকমান্য তিলক অত্যন্ত জোরে সঙ্গে বলেন ; কেবলমাত্র আইন তৈরি করে সাধারন মানুষদের ভেতর সংশ্লিষ্ট বিষয়টি ঘিরে কোন সচেতনতা তৈরি হবে না এবং সে আইন থেকে কোনরকম সাফল্য আসবে না ।এই বিতর্কটি ধীরে ধীরে অত্যন্ত তীব্র আকার ধারণ করে। ১৮৯০  সালের শেষের দিকে বিতর্কটি একটি বড় রকমের সামাজিক ঘূর্ণাবর্তের মধ্যে গোটা দেশের সামাজিক প্রেক্ষিত কে এনে ফেলে ।
                  

এই সময়ে ফুলমনি নামক একটি শিশু কন্যা র, তার  থেকে ২৯  বছরের বড় এক ব্যক্তির সঙ্গে বিয়ে দেওয়াকে   কেন্দ্র করে সামাজিক ক্ষেত্রে ব্যাপক আলোড়ন তৈরি হয় ।শিশুকন্যা ফুলমণির উপর তার থেকে  ৪০  বছরের বেশি  বয়স্ক স্বামী যখন দাম্পত্য সম্পর্কের দাবিতে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করতে চায়,  সেই যৌন অত্যাচারের ফুলমনির মৃত্যু হয়।
               

এই ঘটনাটি সামাজিকভাবে ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রেক্ষিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আকার ধারণ করে ।সংস্কারে বিশ্বাস করেন, এমন সব সামাজিক ব্যক্তিত্বেরা অত্যন্ত সোচ্চার হয়ে ওঠেন হিন্দু নারীর বিবাহের ক্ষেত্রে বয়স নির্ধারণের প্রসঙ্গে। অপরপক্ষে প্রাচীন পন্থীদের ভেতর থেকে এ নিয়ে তীব্র বিরোধিতা উঠে আসতে থাকে। তিলক সম্পাদিত কেশরী পত্রিকা এবং মারাঠা পত্রিকাতে গর্ভাধান সংস্কার মূলক অনুষ্ঠানের স্বপক্ষে যে প্রাচীন ভারতীয় চিন্তা ধারা ,তার প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন করা হয় ।
              

সেই প্রাচীন চিন্তাধারা তে হিন্দু মেয়েদের বয়সন্ধিকালে বিয়ে দেওয়ার কথা বলা হয়েছে, যদিও সেখানে ঋতুস্রাবের আগের সময় পর্যন্ত যৌন সঙ্গম করার কথা বিষয়ে খুব স্পষ্টভাবেই নিষেধাজ্ঞার কথা রয়েছে –তিলক এবং তাঁর মতাবলম্বী  লোকজন এই কথাই বলেন ।তাঁদের মতে, এই প্রথা কোনো রকম হস্তক্ষেপ যদি করা হয় ,তাহলে হিন্দু ধর্ম বিপন্ন হয়ে পড়বে।
                 

তিলকের  পাশাপাশি গোটা রক্ষণশীল হিন্দু সমাজ এই রকম মতামতেই নিজেদেরকে দৃঢ় রাখেন। তাঁদের এই প্রচার বাংলাতে এসেও আন্দোলিত হয়। এই মতের বিপক্ষে কিন্তু অত্যন্ত স্পষ্ট এবং বলিষ্ঠ অভিমত ব্যক্ত করেছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র থেকে স্বামী বিবেকানন্দের মত ব্যক্তিত্বেরা।
                       

সেই সময় এই গোটা প্রেক্ষিত কে কেন্দ্র করে রক্ষণশীল হিন্দুদের প্রতিনিধি শশধর তর্কচূড়ামণি এবং তাঁর সহযোগীরা’ বঙ্গবাসী’  নামক একটি পত্রিকায় প্রাচীন মত  বজায় রাখার পক্ষে তাঁর  নিজস্ব অভিমত ব্যক্ত করেন।এমনকি প্রাচীন মতকে  অমান্য করার দায় ,বঙ্কিমচন্দ্র এবং বিবেকানন্দের মত মানুষ কে অভিযুক্ত করে, তাঁদের হিন্দু ধর্মের প্রতি আস্থা কে ঘিরে খুব জোরদারভাবে সন্দেহ প্রকাশ করা হয়েছিল।
               

এইরকম একটি পরিস্থিতিতে পুনা ডেকান কলেজের অধ্যাপক রামকৃষ্ণ গোবিন্দ ভান্ডারকর যে অভিমত ব্যক্ত করেন ,সেটিও কিন্তু তৎকালীন সমাজের প্রেক্ষিতে অত্যন্ত বড় রকমের সামাজিক প্রতিক্রিয়া তৈরি করেছিল। গ্রন্থ নির্ভর প্রাচ্যবাদী ভারতবর্ষের পরম্পরা অনুসরণ করতে গিয়ে ভাণ্ডারকর তাঁর নিজস্ব গবেষণায় দেখান ; বয়সন্ধিকালের পরেই কিন্তু হিন্দু মেয়েদের বিবাহ স্বাস্থ্যসম্মত এবং সেই বিবাহের ক্ষেত্রে হিন্দু ধর্মীয় ধর্মীয় আইনের কোনো রকম বিরুদ্ধতা করা হচ্ছে না।
                 

মজার কথা হল;  লোকমান্য বালগঙ্গাধর তিলক নিজে রক্ষণশীলতার অন্ধ সমর্থক হয়ে মেয়েদের বিবাহের বয়সের ক্ষেত্রে যে ধরনের প্রতিক্রিয়াশীল দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় দিয়েছিলেন, তাঃর  নিজের ব্যক্তি জীবনে কিন্তু তিনি  সেই পথের ধার  পাশ দিয়ে হাঁটেননি। বয়সন্ধিকালের সময়ে, অর্থাৎ;  ১৩  বছর বয়সেও তাঁর  জ্যেষ্ঠ কন্যা অবিবাহিতা ছিলেন, এটি কিন্তু ঐতিহাসিকভাবে সত্য। আশ্চর্যের বিষয় হল ;বাল্য বিবাহ বিষয়ক বিতর্ক কে কেন্দ্র করে গোটা পরিবেশ-পরিস্থিতি অদ্ভুত রকম ভাবে বিদেশি শাসনের বিরুদ্ধে পরিচালিত হয়। জাতীয় কংগ্রেসের প্রথম সারির নেতৃত্ব,  কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার পরবর্তীকালে যখন ইংরেজদের অর্থনৈতিক শোষণের ভিত্তিতে , ভারতবর্ষের সাধারণ মানুষদের ভেতর ব্রিটিশের অর্থনৈতিক অনাচার ঘিরে সচেতনতা তৈরীর ভেতর দিয়ে, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী মানসিকতা তৈরি করে তুলতে চেষ্টা করছেন, তখন কিন্তু এই রক্ষণশীলরা ব্রিটিশ কর্তৃক ভারতীয় জনগণের ধর্মীয় অধিকার সুরক্ষিত না থাকার বিষয়টিকে কেন্দ্র করে, ব্রিটিশবিরোধীতার একটি অদ্ভুতুড়ে মানসিকতা সমাজজীবনের ভিতরে ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন।
                 

হিন্দু নারীর দেহটিকে একটি সংগ্রামের ক্ষেত্র হিসেবে উপস্থাপিত করে, সেই সংগ্রামে ভিনদেশী ক্ষমতাবানেরা তাঁদের শিক্ষাদীক্ষা, রীতিনীতি , বিশেষ করে ইংরেজি শিক্ষা, সেই গুলির উপর ভিত্তি করে ধ্যানধারণা ,ভারতীয়দের ধ্যান-ধারণাকে বিনষ্ট করে দিচ্ছে –এমন একটি ধারণা তৈরি করে ,একটা অদ্ভুত ভাবে ব্রিটিশবিরোধীতার কৌশল নামিয়ে আনা হয়। এই কৌশলের ভিতরে  কিন্তু ব্রিটিশের সাম্রাজ্যবাদী শোষণ অর্থনৈতিক শোষণ, ভারতবর্ষের মানুষদের  উপর যে অনাচার সৃষ্টি করছে,  সে সম্পর্কে কিন্তু একটিও শব্দ উচ্চারিত হয় না।
                    

এই পর্যায় কেই  কিন্তু পরবর্তীকালে রাজনৈতিক হিন্দুরা ,তাদের ব্রিটিশ বিরোধীতার একটি মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করে থাকে। মজার কথা হলো;  ব্রিটিশ ভারতবর্ষের কৃষ্টি ধ্বংস করছে, ব্রিটিশ ভারতবর্ষে হিন্দুদের নিজস্ব রীতিনীতির উপর হস্তক্ষেপ করছে– এই অজুহাত তুলে ,ব্রিটিশের বিরোধিতা, আর ব্রিটিশের অর্থনৈতিক শোষণ ,ব্রিটিশের  সাম্রাজ্যবাদী দৃষ্টিভঙ্গি ,রাজনৈতিক অনাচার সামাজিক অত্যাচার, তার উপর তৈরি হওয়া ,তার ভিত্তিতে তৈরি হওয়া ব্রিটিশ বিরোধীতাকে এক করে না দেখার, এইযে মানসিকতার ভেতর দিয়ে, রাজনৈতিক হিন্দুদের, রাজনৈতিক বোধের ,ব্যক্তিগত পরিবেশের  মধ্যে যে পারস্পরিক পার্থক্য রয়েছে, সেই  বিষয়টি সম্পর্কে আমাদের সামাজিক বিচার-বিশ্লেষণের প্রশ্নে আমরা বেশ নীরব থেকে গেছি।
                   

বিবাহের নাম করে শিশু কন্যার উপর যে ভয়াবহ সামাজিক অত্যাচার, সেই সামাজিক অত্যাচার কে প্রতিষ্ঠা করে ,এক ধরনের পুরুষতান্ত্রিকতা সমাজের উপর চাপিয়ে দিয়ে, ভয়াবহ লিঙ্গবৈষম্যের পরিবেশের ভেতর দিয়ে যে  ব্রিটিশবিরোধী তার একটি ছদ্মবেশ, প্রাচীন পন্থী ,সংস্কার বিরোধী ,হিন্দু সমাজের প্রতিনিধিরা,  আমাদের সামাজিক বিধি বিধানের উপর চাপিয়ে দেবার চেষ্টা করেছিল এবং সেই চাপিয়ে দেবার বিষয়টিকেই পরবর্তীকালে রাজনৈতিক হিন্দু ,সাম্প্রদায়িক হিন্দু, মৌলবাদী হিন্দু ,সন্ত্রাসী হিন্দুরা ,তাদের রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের সবথেকে বড় অভিপ্রায় হিসেবে ব্যবহার করেছে– এই গোটা কার্যক্রমটি র উপর আমরা কিন্তু সবিশেষ দৃষ্টি নিক্ষেপ করি না ।
                   

দুঃখজনক বিষয় হলো যে; উনিশ শতকের সূচনাপর্বে  যেমনটি ছিল ভারতীয় হিন্দুদের  বিবাহ সংক্রান্ত কার্যকারণের  ক্ষেত্রের  সামাজিক প্রেক্ষিত টি,  উনিশ শতকের  শেষ ভাগে এসে আমরা দেখছি, কিন্তু সেই প্রেক্ষিতে কোনরকম অদলবদল ঘটেনি। বাল্যবিবাহ এবং যৌনসংগমের বিষয়টিকে ধর্মের অন্তর্ভুক্ত হিসেবে দেখা  যে পুরুষতান্ত্রিক, সাম্প্রদায়িক ,মৌলবাদী প্রবণতা– ভারতবর্ষের রাজনৈতিক হিন্দুদের ভিতর উনিশ শতকের সূচনাপর্ব  থেকে প্রবাহিত হয়ে , যার বিরুদ্ধে রামমোহন ,বিদ্যাসাগর, বিবেকানন্দ প্রমূখ প্রাতঃস্মরণীয় ব্যক্তিত্বেরা  সেদিন লড়াই করেছিলেন, আজও আমাদের ঠিক সেই একই ভাবে সেই প্রতিক্রিয়াশীলতার বিরুদ্ধে লড়াই করতে হয়।
               

সবথেকে দুঃখের বিষয় হলো এই যে ;ভারতবর্ষের বর্তমান ক্ষমতাসীন বিজেপি নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় সরকার এই বিবাহ সম্মতি আইনে মেয়েদের বয়স সংক্রান্ত বিষয়টি আবার পূনর্বিবেচনার একটি ইঙ্গিত দেয়ার ভেতর দিয়ে উনিশ শতকের রক্ষণশীল, প্রতিক্রিয়াশীল হিন্দু সমাজের প্রতিনিধিদের যে ভয়াবহ মানসিকতা ছিল, সেই দূর্ভাগ্যজনক, বেদনা বহুল, সার্বিক পরিবেশকে, এই একুশ শতকের দ্বিতীয় দশকে ও আবার নতুন করে ফিরিয়ে আনবার নানা ধরনের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে ।
                   

ভারতবর্ষীয় পুরুষদের পৌরুষ দেখাবার একটি পৃথক ক্ষেত্র হিসেবে মেয়েদের বিয়ের বয়স কে ঘিরে, উনিশ শতকের রক্ষণশীল হিন্দু সমাজের যে প্রতিক্রিয়া ছিল ,সেই প্রতিক্রিয়া টিই পরবর্তীকালে আরএসএস ,তাদের সামাজিক অন্ধকারের আবাহনের ভিতর দিয়ে  অনেক বেশি ফলপ্রসূ করেছে ।আজ তাদের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপি কেন্দ্রের ক্ষমতা দখল করে রয়েছে। গোটা রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে ঠিক একই ভাবে মেয়েদের বিয়ের বয়স থেকে ঘিরে পুরুষের পৌরুষ দেখাবার একটি পৃথক একক ক্ষেত্র হিসেবে বিষয়টিকে  ব্যবহারের নতুন করে ষড়যন্ত্র করছে ।
                  

উনিশ শতকে  প্রাচীন পন্থীদের উদ্যোগ-আয়োজনের  পেছনে ইংল্যান্ডের পুরুষ সমাজের একটা প্রচ্ছন্ন সমর্থন কিন্তু তীব্র হয়ে উঠেছিল। ইংল্যান্ডের পুরুষ সমাজের সেদিনের সেই ভূমিকা ছিল কিন্তু সার্বিকভাবে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের স্বার্থকে সুরক্ষিত রাখার তাগিদেই ।কিন্তু সেই তাগিদ উনিশ শতকে সংস্কার বিরোধী, প্রাচীন রক্ষণশীল, মৌলবাদী দৃষ্টিভঙ্গির ভেতর দিয়ে উঠে আসা, রাজনৈতিক হিন্দুদের পূর্বসূরিরা, নিজেদের স্বার্থে জোরদারভাবে ব্যবহার করতে শুরু করে ।
                  

এই সমস্ত ধরনের প্রতিবন্ধকতা কে অস্বীকার করেই, তার সঙ্গে খুব সাহসিকতার সঙ্গে একটা মোকাবিলা করেই ,ব্রিটিশ সরকার কিন্তু বিবাহ সম্মতি সংস্কারের পক্ষে তখন দৃঢ় এবং কঠোর অবস্থান গ্রহণ করে ।এই অবস্থান গ্রহণের পেছনে তাদের সেই সময়ের কিছু রাজনৈতিক পারিপার্শ্বিকতা অত্যন্ত নিবিড় ভাবে কাজ করেছিল। সেই প্রেক্ষিতে উপর ভিত্তি করে, সমস্ত ধরনের বিরোধিতা কে অস্বীকার করে ,বিবাহের বয়স সম্মতি বিষয়ক বিল পাস হয়ে যায় ১৮৯১  সালের ১৯  শে মার্চ ।
                     

যদিও সেই বিলের  শিক্ষাগত প্রভাব খুব বেশি ভারতবর্ষের সামাজিক জীবনে পড়েছিল কিনা তা ঘীরে সমাজতত্ত্ববিদের  ভিতরে যথেষ্ট বিতর্ক রয়েছে।  এই ধরনের সংস্কার বিষয়ক যে তর্ক-বিতর্ক ,তার এক বিশেষ ধারা যেন আমাদের ভারতবর্ষের সামাজিক গোটা প্রেক্ষিত কে ক্রমশ ক্লিন্ন করতে শুরু করে দিয়েছিল ।সেই ক্লিন্নতার ভেতর দিয়ে সংস্কারবাদ, ভারতবর্ষের জাতীয়তাবাদী ধ্যান-ধারণার একটি অংশ হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে ফেলে। তার ফলে পরবর্তীকালে একটা সংঘবদ্ধ আক্রমণ, এমনকি জঙ্গি আক্রমণ ও ঐক্যবদ্ধ হয় ব্রিটিশের বিরুদ্ধে ।
                 

আর সেই আক্রমণ সংঘটিত হওয়ার ক্ষেত্রে একটি প্রচলিত ধারণা, ভাষা চেতনা, তথা সার্বিক প্রেক্ষাপট হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে নেয় প্রচলিত হিন্দু ধর্ম ।একটা রাজনৈতিক দ্যোতোনার ভেতর দিয়ে ,যে রাজনৈতিক দ্যোতনা পরবর্তীকালে ক্ষমতা দখলের সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গির ভেতর দিয়ে, রাজনীতি কে একটি পঙ্কিল আবর্তে এনে উপস্থাপিত করে ।
            

সেই উপস্থাপনাকে  কিন্তু রাজনৈতিক হিন্দুরা পরবর্তীকালে অত্যন্ত জোরদারভাবে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করেছে ।আরএসএসের জন্মলগ্ন থেকে সেটি ব্যবহার করেছে ।এমনকি আরএসএসের ভিত্তি তৈরীর জন্য তার অনেক আগে থেকে, হিন্দু মহাসভা যে ধরনের কর্মকাণ্ড গোটা উত্তর ভারত জুড়ে, বিশেষ করে অবিভক্ত পাঞ্জাবে করেছিল, তার ভেতরেও বিশেষ রকমের প্রতিক্রিয়া তৈরি করেছিল ।যে প্রতিক্রিয়া ,প্রভাব আরএসএস তাদের কর্মপদ্ধতিতে অত্যন্ত কৌশলের সঙ্গে তীক্ষ্ণ ভাবে ব্যবহার করে এসেছে এবং আজ পর্যন্ত আসছে।

ধারাবাহিক লেখাগুলি পড়তে ক্লিক করুনঃ www.cpimwb.org.in

ভারতের জাতীয় আন্দোলন ও আর এস এস – (পর্ব – ২০)

ভারতের জাতীয় আন্দোলন ও আর এস এস – (পর্ব – ১৯)

ভারতের জাতীয় আন্দোলন ও আর এস এস – (পর্ব – ১৮)

ভারতের জাতীয় আন্দোলন ও আর এস এস – (পর্ব – ১৭)

ভারতের জাতীয় আন্দোলন ও আর এস এস – (পর্ব – ১৬)

ভারতের জাতীয় আন্দোলন ও আর এস এস – (পর্ব – ১৫)

ভারতের জাতীয় আন্দোলন ও আর এস এস – (পর্ব – ১৪)

ভারতের জাতীয় আন্দোলন ও আর এস এস – (পর্ব – ১৩)

ভারতের জাতীয় আন্দোলন ও আর এস এস – (পর্ব – ১২)

ভারতের জাতীয় আন্দোলন ও আর এস এস – (পর্ব – ১১)

ভারতের জাতীয় আন্দোলন ও আর এস এস – (পর্ব – ১০)

ভারতের জাতীয় আন্দোলন ও আর এস এস – (পর্ব- ৯)

ভারতের জাতীয় আন্দোলন ও আর এস এস – (অষ্টম পর্ব)

ভারতের জাতীয় আন্দোলন ও আর এস এস – (সপ্তম পর্ব)

ভারতের জাতীয় আন্দোলন ও আর এস এস – (ষষ্ঠ পর্ব)

ভারতের জাতীয় আন্দোলন ও আর এস এস – (পঞ্চম পর্ব)

ভারতের জাতীয় আন্দোলন ও আর এস এস – (চতুর্থ পর্ব)

ভারতের জাতীয় আন্দোলন ও আর এস এস – (তৃতীয় পর্ব)

ভারতের জাতীয় আন্দোলন ও আর এস এস – (দ্বিতীয় পর্ব)

ভারতের জাতীয় আন্দোলন ও আর এস এস – (প্রথম পর্ব)

Spread the word

Leave a Reply