ভারতের জাতীয় আন্দোলন ও আর এস এস (পর্ব - ২২)

ধারাবাহিক রচনায়ঃ গৌতম রায়

স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতীর আর্য সমাজ প্রতিষ্ঠা ভারতবর্ষে হিন্দু পুনরুত্থানবাদী  আন্দোলনের ক্ষেত্রে একটি বিশেষ উল্লেখযোগ্য বিষয়। ১৮৭৫  সালে দয়ানন্দ সরস্বতী আর্য সমাজ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তবে দয়া ন্দ সরস্বতী কে কিন্তু তাঁর সহকর্মীদের মত ঘোরতর হিন্দু সাম্প্রদায়িক ,মৌলবাদী হিসেবে চিহ্নিত করে দেওয়ার ক্ষেত্রে কিছু প্রশ্ন থেকেই যায় ।

স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতী

দয়ানন্দের অনুগামী লালা হরদয়াল, যিনি পরবর্তীকালে,' স্বামী শ্রদ্ধানন্দ'  নাম গ্রহণ করে আর্য সমাজ প্রবর্তিত শুদ্ধি আন্দোলনের একজন বিশিষ্ট নেতা হয়ে উঠেছিলেন। শ্রদ্ধানন্দ  বা তাঁর সহকর্মীদের দৃষ্টিভঙ্গির ভেতর যে ধরনের পর  ধর্মবিদ্বেষ একটা ভয়াবহ আকার ধারণ করেছিল ,চেতনার ক্ষেত্রে তেমন উগ্রতা দয়ানন্দের ছিল কি না তা নিয়ে কিন্তু যথেষ্ট বিতর্কের অবকাশ আছে।
                          

ভারতবর্ষে উনিশ শতকে গোরক্ষা কে ঘিরে সাম্প্রদায়িক বাতাবরণ সৃষ্টির ক্ষেত্রে দয়ানন্দ সরস্বতী প্রতিষ্ঠিত আর্য সমাজের একটি বিশেষ রকমের নেতিবাচক ভূমিকা আছে ।গোহত্যাকে  ঘিরে যে কর্মকাণ্ড ,সেটি রাজনৈতিক হিন্দুদের সঙ্ঘবদ্ধ হওয়ার ক্ষেত্রে একটা বড় রকমের অনুঘটকের ভূমিকা পালন করেছিল। সেই ভূমিকার ক্ষেত্রে প্রাচীন ভারতীয় মূল্যবোধের নাম করে, ধর্মীয় ধ্যান-ধারণার সঙ্গে সম্পৃক্ত বিষয়াবলী ,বিশেষ করে প্রতীককে সংযুক্ত করার প্রবণতা ক্রমশ উত্তর ভারতে যে জঙ্গি রূপ নিয়েছিল, সেটিই পরবর্তীকালে জাতীয় আন্দোলন চলাকালীন সময়ে, হিন্দু সাম্প্রদায়িক ,মৌলবাদী শক্তিকে, তাদের বিভাজনের যাবতীয় কর্মকাণ্ডকে প্রসারিত করার লক্ষ্যে এবং তার পাল্টা হিসেবে মুসলিম সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদী শক্তির বিকাশের ক্ষেত্রে অত্যন্ত বড় ভূমিকা পালন করতে দেখা যায়।
                 

যদিও দয়ানন্দ সরস্বতী প্রত্যক্ষভাবে নিজের মুসলিমবিরোধী মানসিকতাকে কখনো প্রকাশ্যে নিয়ে আসেন নি ।দয়ানন্দের সহকর্মী এবং সমর্থকদের ভেতরে যেভাবে নগ্ন মুসলিম বিরোধিতা কাজ করেছে, তেমনটা কিন্তু দয়া ন্দ সরস্বতীর  ভিতর কখনো দেখতে পাওয়া যায়নি। শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের সঙ্গে দয়ানন্দ সরস্বতী সাক্ষাৎ ঘটেছিল ।সমন্বয়ী চিন্তা চেতনার প্রতীক শ্রীরামকৃষ্ণ কিন্তু দয়ানন্দের সঙ্গে আলাপ পর্বে, তাঁর ভেতরে সাম্প্রদায়িক চিন্তা ,পরধর্ম অসহিষ্ণুতা ,পরমত বিদ্বেষী চেতনার কোন অভিমত দেখতে পেয়েছিলেন, এমন কথা কিন্তু বলেননি।
                   

দয়ানন্দের  জীবিতাবস্থায় গোরক্ষা আন্দোলন কিভাবে বিকাশ লাভ করেছিল তাঁর চিন্তাভাবনার ভেতরে তা বিশ্লেষণের দাবি রাখে। সেই মানসিকতা তে প্রত্যক্ষভাবে মুসলিমবিরোধীতার কোনো ইঙ্গিত না থাকার পাশাপাশি ,ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে একটু চিন্তা চেতনার উন্মেষের লক্ষণ কিন্তু দেখতে পাওয়া গিয়েছিল ।জাতীয় কংগ্রেসের প্রথম যুগের নরমপন্থী নেতারা, ব্রিটিশের অর্থনৈতিক শোষণ সম্পর্কে ভারতবাসীকে সচেতন করার যে উদ্যোগ নিয়েছিলেন, তেমন উদ্যোগ কিন্তু দয়ানন্দের সময়কালে তাঁর প্রবর্তিত আর্থ- সামাজিক কার্যকলাপ এবং গোরক্ষা আন্দোলনের ভেতরেও সামান্য পরিমাণে হলেও বিদ্যমান ছিল।
             

ব্রিটিশের অর্থনৈতিক শোষণ সম্পর্কে ভারতবাসীকে সচেতন করার প্রশ্নের দয়ানন্দ যেভাবে সোচ্চার ছিলেন, সেটি কিন্তু পরবর্তীকালে তাঁর সতীর্থরা বা তাঁর  মতাবলম্বী রা, যারা  তাঁকে ব্যবহার করে  হিন্দু মহাসভা বা আর এসএসের  বিস্তার লাভ ঘটান, তারা কেউই সেভাবে ব্রিটিশের অর্থনৈতিক শোষণ সম্পর্কে কোনোদিনও একটিও শব্দ উচ্চারণ করেননি। দয়ানন্দ সরস্বতী কিন্তু তাঁর সামগ্রিক কর্মকান্ডের মধ্যে একটি জাতীয়তাবাদী চেতনার বিকাশ ঘটানোর চেষ্টা করেছিলেন তাঁর সময়কালের প্রচলিত ধারা অনুযায়ী। সেই জাতীয়তাবাদী চেতনায় হিন্দু পুনরুত্থানবাদী  নির্যাস থাকলেও ,সেই জাতীয়তার ভেতর কিন্তু ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে একটি প্রতিবাদ-প্রতিরোধের ধ্বনি ও উচ্চারিত হয়েছিল ।
                

এই ব্রিটিশ বিরোধিতা কিন্তু দয়ানন্দের পরবর্তীকালে আর্য  সমাজ এবং গো রক্ষা আন্দোলন যারা পরিচালনা করেছেন, তাদের কারো মধ্যেই পরিচালিত হয়নি। অথচ দয়ানন্দ কে বা তাঁর পরবর্তী কালে  তাঁর  সমমতাবলম্বীদের সমস্ত ধরনের চিন্তাভাবনা কে নিজেদের চিন্তা ভাবনার সঙ্গে একাত্ম করে, হিন্দু মহাসভা- আরএসএস, তাদের কর্মকান্ড প্রসারিত করলেও ,দয়ানন্দের ভেতরে যে ব্রিটিশের অর্থনৈতিক শোষণ সম্বন্ধে একটি তীব্র প্রতিরোধী- প্রতিবাদী ভূমিকা, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে একটি প্রতিবাদের সংকল্প এবং প্রকাশ্যভাবে মুসলিম বিরোধিতা না করার দৃষ্টিভঙ্গি ছিল, সেগুলি কিন্তু পরবর্তী কালের হিন্দুত্ববাদী কোনো নেতারাই প্রকাশ্যে স্বীকার করেন না।
                

দয়ানন্দ সরস্বতী নিজের সরাসরি প্রত্যক্ষ মুসলিম বিরোধী কোন মানসিকতার পরিচয় না দিলেও, তাঁর চিন্তাচেতনার ভেতর দিয়ে যে ধরনের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ভারতবর্ষে সংঘটিত হয়েছে, সেই দাঙ্গা গুলি র স্বরূপ বিশ্লেষণ করলে ,এটা খুব পরিষ্কার হয়ে যায় যে, ধর্মের ভিত্তিতে, জাতপাতের ভিত্তিতে, সামাজিক বিভাজনের যে ভূমিকা, সেই ভূমিকা অত্যন্ত নেতিবাচক ই ছিল।
                       

আর্য সমাজ প্রতিষ্ঠার বেশ কিছুকাল পরে ১৮৯৩  সালে গো হত্যাকে   কেন্দ্র করে যে ভয়াবহ দাঙ্গা হয়। সেটি গোটা উত্তর ভারত এবং অবিভক্ত পাঞ্জাব,  এমনকি উত্তর পশ্চিম প্রদেশে আর্য সমাজ কে, তাদের সাম্প্রদায়িক কর্মকাণ্ড চালানোর ক্ষেত্রে একটা শক্তপোক্ত জায়গায় এনে দাঁড় করায়। প্রচলিত হিন্দু সমাজের ধর্মীয় আচার-আচরণের সমালোচনার ভেতর দিয়ে আর্য সমাজ এক ধরনের তথাকথিত বিপ্লবীয়ানার কৌশল অবলম্বন করে সাধারণ মানুষদের ভেতর নিজের একটা বড় রকমের গ্রহণযোগ্যতার পরিবেশ তৈরি করে।
                    

হিন্দু সমাজের প্রচলিত সেই সময়ের কিছু রীতিনীতি ঘিরে, যেমন;  বাল্যবিবাহ ঘিরে যে ধরনের সংস্কার, কিংবা বৈধব্য বিধি মেনে চলা কে ঘিরে বিভিন্ন ধরনের নিষেধাজ্ঞা ,বিদেশ ভ্রমণ জনিত অচলায়তন ,পৌত্তলিকতা ঘিরে নানা ধরনের সংস্কার ,ব্রাহ্মণ্যবাদের আধিপত্য, জাতিভেদের আধিপত্য --এই সমস্ত বিষয়গুলি কে ঘিরে আর্য সমাজের অবস্থান ,প্রচলিত ধ্যান-ধারণাকে খানিকটা নাড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে।
                  

এই কার্যক্রমের  ভেতর দিয়ে একটা সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা তৈরি করে নেয় আর্য সমাজ।  বেদ কেন্দ্রিক প্রাচীন ভারতীয় ধর্মের নানা ধরনের ইতিবাচক দিক গুলি কে নিজস্ব ভঙ্গিমায় দেখানোর ভেতর দিয়ে প্রার্থনা সমাজ প্রচলিত হিন্দু ধর্মকে একটা আক্রমণাত্মক আত্মরক্ষার ভেতর দিয়ে প্রতিষ্ঠিত করে, যেটি পরবর্তীকালে সাম্প্রদায়িক হিন্দু চিন্তাচেতনার বিকাশের ক্ষেত্রে একটি বড় ভূমিকা গ্রহণ করেছিল ,অন্য যাবতীয় ধর্মবিশ্বাসের থেকে প্রাচীন ভারতীয় ধর্ম বিশ্বাস অনেক বেশি শক্তিশালী এবং সব ধরনের ধর্মবিশ্বাসের মধ্যে প্রাচীন ভারতীয় ধর্মবিশ্বাস সেরা, এই রকম কথা বলে ,হিন্দু অস্মিতা কে একটা রাজনৈতিক চিন্তা চেতনার দিকে পরিচালিত করবার ক্ষেত্রে প্রার্থনা সমাজ নিজেদেরকে প্রতিষ্ঠিত করতে শুরু করে ।
                 

এই দৃষ্টিভঙ্গির ভেতর দিয়ে খুব সহজে প্রার্থনা সমাজ এবং আর্য সমাজের কর্মপদ্ধতি গুলি, হিন্দু পুনরুজ্জীবনবাদী ,  পুনরুত্থানবাদী  চিন্তা চেতনার সঙ্গে একটা অলিখিত সাযুজ্যের  সুরে নিজেদেরকে মিশিয়ে ফেলতে সক্ষম হয়। আর্য সমাজ এবং তাদের প্রাচীন সমালোচকেরা একসাথে কিন্তু প্রচলিত হিন্দু সমাজকে ,হিন্দু জাতিকে রক্ষার মানসিকতার ভেতর দিয়ে সা,ম্প্রদায়িক চিন্তা-চেতনা ,মৌলবাদী চিন্তা-চেতনার বিকাশ ও প্রসারের ক্ষেত্রে এভাবেই একটা অভিন্ন সূত্রে নিজেদেরকে জুড়ে ,কার্যত একটা একমঞ্চে নিজেদেরকে উপস্থাপিত করেন ।
                

দয়ানন্দ সরস্বতীর জীবিতাবস্থা পর্যন্ত কিন্তু এই রকম পরিস্থিতি ছিল না ।দয়ানন্দের  প্রচলিত হিন্দুধর্মের ধ্যান-ধারণা প্রচারের ক্ষেত্রে যথেষ্ট রক্ষণশীল চিন্তাভাবনা থাকলেও, মুসলিম বিদ্বেষ কিন্তু সেভাবে কার্যকরী হয়নি তাঁর চিন্তাতে।১৮৮৩  সালে দয়ানন্দ সরস্বতীর জীবনাবসান ঘটে। তারপর থেকেই আর্য  সমাজ  এবং প্রার্থনা সমাজের লোকজনেরা ,তাদের চিন্তা ভাবনার ভেতর, রাজনৈতিক হিন্দু সাম্প্রদায়িক ,মৌলবাদী দৃষ্টিভঙ্গিকে, হিন্দু পুনরুত্থানবাদের মোড়কে উপস্থাপিত করবার জন্য আসরের জোরদারভাবে নেমে পড়তে শুরু করেন ।
                 

ক্রিশ্চান ধর্মযাজকদের কর্মকাণ্ড, আর্য সমাজ তাদের সাম্প্রদায়িকতার দৃষ্টিভঙ্গি প্রসারের ক্ষেত্রে বেশ খানিকটা উর্বর ভূমির ওপর দাঁড় করিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছিল তা আর বলার অপেক্ষা রাখেনা ।বস্তুত, আজকে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতির ক্ষেত্রে বিজেপির নেতৃত্বাধীন যাবতীয় কর্মকাণ্ডের ভেতর দিয়ে যে ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িকতা ,মৌলবাদ অত্যন্ত তীব্র হয়ে উঠছে, তাকে একটা সুস্পষ্ট রূপ দেওয়ার জন্য ,তার একটা রাজনৈতিক ভিত্তি নির্মাণের জন্য, এবং ভোটের রাজনীতিতে তাকে একটা সুস্থিতি দেওয়ার জন্য ,রাজ্যের শাসক দের পক্ষ থেকে যে প্রতিযোগিতামূলক সাম্প্রদায়িকতা এবং ভাষাভিত্তিক সাম্প্রদায়িকতাকে তীব্র করে তোলা হচ্ছে, রামনবমীর সশস্ত্র মিছিল ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িক শক্তি করছে ,অপরপক্ষে প্রচার পাল্টা হিসেবে প্রতিযোগিতামূলক সাম্প্রদায়িকেরা হনুমান জয়ন্তী পালন করছে --এইযে ধর্মীয় প্রতিযোগিতার বাতাবরণ ,যার ভেতর দিয়ে ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িক ,ফ্যাসিবাদী ,মৌলবাদী শক্তি সমস্ত রকম ভাবে নিজেদের সামাজিক, রাজনৈতিক ,সাংস্কৃতিক একটা ভিত্তিভূমি কে অত্যন্ত জোরদার করে ফেলবার সুযোগ পেয়ে যাচ্ছে-- সেই পরিস্থিতি কিন্তু ভারতবর্ষের প্রেক্ষিতে উনিশ শতকের শেষ দিকে, দয়ানন্দ সরস্বতীর  মৃত্যুর পরবর্তীকালে ,অবিভক্ত পাঞ্জাবে  খ্রিস্টান ধর্ম প্রচারকদের সঙ্গে ,আর্য সমাজ এবং প্রার্থনা সমাজের লোকজনদের যে ধর্মীয় প্রতিযোগিতা ,তার ভেতর দিয়ে ভারতীয় প্রেক্ষিতে এই প্রতিযোগিতামূলক ধর্মান্ধতা, প্রতিযোগিতামূলক সাম্প্রদায়িকতার সূচনা আমরা দেখতে পাই ।
                     

আর্য ধর্ম কে ভারতবর্ষের চিন্তা চেতনার মূল ভিত্তি হিসেবে উপস্থাপিত করে, প্রচলিত হিন্দু ধর্মের সঙ্গে আর্য  ধর্মের একটা কল্পিত চিন্তাভাবনার সাযুজ্য টেনে, আর্যাবর্তের শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণার ভেতর দিয়ে ,আর্য সমাজ যে মেরুকরণের রাজনীতি র প্রাদুর্ভাব ভারতীয় সমাজে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকতার যুগে ঘটিয়েছিল, সেটিই পরবর্তীকালে কিন্তু অনেক ঘষামাজার ভেতর দিয়ে হিটলার- মুসোলিনি গ্রহণ করে এবং তাকে উনিশ শতকেল কের শেষ দিক থেকে, হিন্দু সাম্প্রদায়িক দের সঙ্ঘবদ্ধ হওয়ার ভেতরেও আমরা পরিস্ফুট হয়ে উঠতে দেখি।
                  

আর বিশ শতকের সূচনা লগ্ন থেকেই হিন্দু মহাসভা এবং ১৯২৫  সালে আরএসএস প্রতিষ্ঠার ভেতর দিয়ে রাজনৈতিক হিন্দুদের সঙ্ঘবদ্ধ হওয়া, চিন্তা-চেতনা এবং কর্মসূচি কার্যসূচি তৈরি করা-- এগুলির , তার ভেতরে একটা সংঘবদ্ধ রূপ পেতে আমরা দেখি। আর্যাবর্তের শ্রেষ্ঠত্ব প্রচারের  ভেতর দিয়ে আর্য সমাজ যে  সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ ভারতবর্ষের বুকে শুরু করেছিল, তার মূল লক্ষ্য কিন্তু ছিল ;মুসলমান এবং খ্রিস্টানদের বিরুদ্ধে।
               

গোটা প্রচার এবং কর্মসূচীর পরিচালিত করা হয়েছিল  এই ভাবে যে; ক্রিশ্চান সমাজ ধর্মান্তরিতকরণের  ভেতর দিয়ে ভারতবর্ষের হিন্দুদের সর্বতোভাবে শেষ করে দিতে চাইছে , যে কাজটা অতীতে ইসলাম ধর্মাবলম্বী রা  ভারতবর্ষে করেছিল ,এই ধরনের প্রচারের  ভেতর দিয়ে আর্য সমাজ একটা শুদ্ধির ধারণা ভারতবর্ষের মানুষদের উপর চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। এই শুদ্ধির  ধারণার প্রধান লক্ষ্য ছিল ; পবিত্র ইসলাম এবং খ্রিস্টান ধর্মের যেসব মানুষরা রয়েছেন, ভারতীয়রা রয়েছেন এমনকি শিখ ধর্মের ভারতীয়রা রয়েছেন, আর্য সমাজ মনে করে, তাঁরা প্রত্যেকেই ধর্মান্তরিত। তাই শুদ্ধি আন্দোলনের ভেতর দিয়ে তাঁদের হিন্দু ধর্মে ফিরিয়ে নেওয়ার কর্মসূচি।এই কর্মসূচির  ভেতর দিয়ে সাম্প্রদায়িকতা এবং একটা বিদ্বেষ -বিভাজন, বিতৃষ্ণার মানসিকতা তৈরি করে, ভারতীয় সমাজকে, ভারতবর্ষের চিরন্তন বহুত্ববাদী সংস্কৃতিকে ,মধ্যকালীন ভারতের সমন্বয়বাদী চেতনাকে ,খন্ড-বিখন্ড করে দেওয়া আর্য সমাজের  প্রধান লক্ষ্য ।
              

এই লক্ষ্য ধরে তারা তাদের কর্মসূচি চালাতে থাকে এবং পরবর্তীকালে রাজনৈতিক হিন্দুরা এই কর্মসূচি গ্রহণ করে ।আজ পর্যন্ত এই কর্মসূচিকে তারা নানা ভাবে, নানা আঙ্গিকে ভারতীয় প্রেক্ষাপটে  উপস্থাপিত করে ,ভারতীয় সমাজ, সভ্যতা,  সংস্কৃতিকে একেবারে ধ্বংসের মুখে টেনে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে।
                    

আর্য সমাজের ভেতর কিন্তু জাতীয় কংগ্রেসের প্রথম যুগের মতোই বেশকিছু নরমপন্থী ব্যক্তিত্বেরা ছিলেন, যাঁরা প্রত্যক্ষ ভাবে উগ্র সাম্প্রদায়িক ছিলেন না। এই অংশের মানুষরা কিন্তু ১৮৯৩ সালের মধ্যেই ক্রমশ আর্য সমাজের ভেতর একটা প্রান্তিক অবস্থানে, একটা কৌণিক অবস্থানে পৌঁছে যেতে শুরু করেছিলেন। সেই  কৌণিক অবস্থা থেকে, প্রান্তিক অবস্থা থেকে ,নিজেদেরকে প্রতিষ্ঠিত করবার লক্ষ্যে, নিজেদের সামাজিক-রাজনৈতিক অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখবার স্বার্থেই ,প্রাচীনপন্থী লোকজন, যারা আর্য সমাজের দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে খুব একটা সাযুজ্যপূর্ণ ছিলেন না, তাদের সঙ্গে একটা মিতালী পাতাতে শুরু করেন এবং সেই মিতালির প্রথম এবং প্রধান সূত্র হয়ে দাঁড়ায় উগ্র মুসলমান বিরোধিতা ।
                  

এই অংশের মানুষ, প্রাচীন পন্থীদের সঙ্গে একত্রিত হয়ে ধীরে ধীরে নানা ধরনের মুসলমানবিরোধী হিংসাশ্রয়ী ঘটনার সঙ্গে নিজেদেরকে একাত্ম করে ফেলেন ।গোরক্ষা কে কেন্দ্র করে মুসলমানদের বিরুদ্ধে বিবাদ-বিসংবাদ- বিতৃষ্ণা -সংঘর্ষ -হিংসা-দ্বেষ ক্রমশ একটা বল্গাহীন আকার ধারণ করতে শুরু করে।
                              

প্রাচীন ভারতবর্ষের সামাজিক বিন্যাসের যাবতীয় প্রেক্ষিত, বিশেষ করে অর্থনৈতিক ধারা প্রবাহের ক্ষেত্রে, কৃষির যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি ভূমিকা ছিল ,সেই ভূমিকাকে সার্বিকভাবে পরিস্ফুট করবার ক্ষেত্রে গরুর একটা বিশেষ রকমের অবস্থান  ও কিন্তু আছে,  অংশগ্রহণ ও কোন কিন্তু আছে। তাই আমরা আর্যদের ভারত আগমনের অনেক আগে, হরপ্পা সভ্যতার কালেও সামাজিক রীতিনীতির বহু প্রেক্ষিতে গরুর ব্যবহারের নানা ইতিহাস গত নিদর্শন পাই ।
            

হরপ্পা চক্রবর্তী সভ্যতার আগে  মেহেরগড় সভ্যতার ক্ষেত্রেও গরু কে কেন্দ্র করে অর্থনীতির নানা গতি-প্রকৃতি নির্ধারণের একটা স্পষ্ট ইঙ্গিত পাই। ভারতের কৃষিভিত্তিক অর্থনীতির ক্ষেত্রে গরু একটি অত্যন্ত প্রয়োজনীয় সংযোগ হিসেবে প্রাচীন ভারতবর্ষে বিশেষ রকমের গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় ছিল ।অর্থনীতিতে গরুর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা কে কেন্দ্র করে, গরুকে নিয়ে ধীরে ধীরে ধীরে নানা ধরনের ধর্মীয় ট্যাবু রচনা হয়েছে। অর্থনীতির প্রয়োজনীয়তার নিরিখে গরুর প্রতি গুরুত্ব দিতে দিতে  গরুকে একটা দেবত্বের জায়গায় উপনীত করেছে ।
              

সেই জায়গা থেকে গরুকে ঘিরে এক ধরনের পবিত্রতার দৃষ্টিভঙ্গি ,এক ধরনের অলঙ্ঘনীয় চিন্তা চেতনার উন্মেষ আমরা প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্যগুলোতে দেখতে পাই। অপরপক্ষে মধ্যকালীন ভারতের সেই সময়ের শাসক সম্প্রদায়ের একটি বড় অংশ বাকর ঈদ উৎসব উপলক্ষে গরু কে কেন্দ্র করে যে ধরনের অবস্থান গ্রহণ করতেন ,তা কিন্তু নিম্নবর্গের মানুষদের কাছে নানা ধরনের বিতর্কের অবতারণা তৈরি করত ।
              

কৃষির সঙ্গে সম্পৃক্ত মুসলমান সমাজ কিন্তু মধ্যকালীন ভারতেও বকর  ঈদ ইত্যাদি কে উপলক্ষ করে গরুকে ঘিরে কোনরকম অতিরিক্ত উন্মাদনাতে  মাততেন না, এটা  জেমস ওয়াইজ তাঁর বাংলা ভ্রমণ সংক্রান্ত যে  নৃতত্ত্ব নির্ভর কাহিনী লিপিবদ্ধ করে গেছেন ,তাতে দেখা যাচ্ছে ।তিনি দেখিয়েছেন যে;  বাংলায় কৃষিকেন্দ্রিক যে স্থানীয় মুসলমানরা ছিলেন,  তাঁরা পবিত্র ইসলামের অবশ্যপালনীয় নামায, রোযা, যাকাত ইত্যাদি সম্পর্কে সেভাবে ওয়াকিবহাল ছিলেন না ।তাই তাঁদের ভিতর  গো হত্যা ইত্যাদি ব্যাপার গুলি সেভাবে প্রচলিত ছিল না ।অভিজাত, উচ্চবর্গীয় মুসলমানেরা কিন্তু ধর্মীয় উৎসবের রীতিনীতি উপলক্ষে পশু হত্যা জনিত নানা ধরনের কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। আর সেই জায়গা থেকেই একটা বড় অংশের হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষের ভেতরে গরুকে ঘিরে এক ধরনের প্রাচীন মূল্যবোধ জনিত পবিত্রতার ধারণা ক্রমশ প্রবল থেকে প্রবলতর হতে শুরু করে ।
             

এই ধারণাটি পরবর্তীকালে হিন্দু পুনরুত্থানবাদীরা  যেমন নিজেদের শ্রেণী স্বার্থে ব্যবহার করে ,তেমনি ই আর্য সমাজ , প্রার্থনা সমাজের মানুষজন নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থ ,যেটিকে তারা সামাজিক স্বার্থের একটা মোড়ক পড়িয়ে  উপস্থাপিত করেছিল ,সেগুলো সুরক্ষিত রাখবার জন্য ব্যবহার করে এসেছে ।এই স্বার্থান্বেষী ট্র্যাডিশনের ওপর ভিত্তি করে কিন্তু গরুকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক হিন্দু সাম্প্রদায়িক ,মৌলবাদী শিবিরের ভেতর এক ধরনের আকর্ষণের দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি হয়েছিল এবং সেই দৃষ্টিভঙ্গি তারা আজ পর্যন্ত বহন করে আসছে।
                 

তবে একটা কথা বিশেষভাবে মনে রাখা দরকার যে ; মধ্যকালীন ভারতে বাকর ঈদ কে কেন্দ্র করে মুসলমান সম্প্রদায়ের ভেতর যে গো হত্যা এবং তার পাল্টা হিসেবে একাংশের হিন্দুদের ভেতর গরু কে কেন্দ্র করে এক ধরনের পবিত্রতার ধারণাকে কার্যত ধর্মীয় ধ্যান-ধারণার সঙ্গে একীভূত করে ফেলা--  এই চাপানউতোর পর্বে কিন্তু সেভাবে আমরা ,সেই সময়ের ভারতবর্ষে সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ গরু কে কেন্দ্র করে ঘটছে--এমনটা  দেখতে পাই না।
                    

ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ যখন এদেশে তার নখ দন্ত বিস্তার করতে শুরু করে ,সেই প্রথম পর্যায়ক্রম টিকে ঘিরে সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ, হিংসা ,দাঙ্গা ইত্যাদির পরিবেশ কিন্তু আমরা খুব একটা প্রবলভাবে দেখতে পাই না ।স্থানীয় নানা বিষয়, বিশেষ করে স্থানীয় আধিপত্য বজায় রাখার চিরন্তন চেষ্টার  বিষয়কে কেন্দ্র করে কিন্তু সেই সময় নানা ধরনের ধর্মীয় সংঘর্ষ ,সাম্প্রদায়িক চেতনার উন্মেষ ঘটতো ।এই ঘটনাক্রমঃ গুলির ভেতরে হিন্দু -মুসলমান, এক একটি সম্প্রদায়ের মানুষের এলাকা দখলের প্রবণতা ,নিজের নিজের সীমানাকে নির্দিষ্ট করতে পারার  প্রবণতা --সেগুলি একটা সাম্প্রদায়িক চিন্তা-চেতনার ভেতর দিয়ে প্রকাশিত হতো ।
                

সেইসব সাম্প্রদায়িক ঘটনাক্রম গুলি যেমন হঠাৎ হঠাৎ অগ্ন্যুৎপাতের মতন দেখা দিত ।আবার তেমনি হঠাৎ, হঠাৎ সেগুলো কিন্তু নিভে ও যেত। অশান্তির রেশ  ভারতীয় সমাজ- সংস্কৃতি- রাজনীতি -অর্থনীতি- সাংস্কৃতিক জীবনে পরবর্তী সময়ের মতো একটা দীর্ঘস্থায়ী ক্ষত রেখে যেত না। উনিশ শতকের শেষ দিক থেকে হিন্দুত্ববাদী আর্য সমাজ,  প্রার্থনা সমাজ প্রমূখ প্রচলিত হিন্দু সমাজের সাম্প্রদায়িক ধারণা নিয়ে পরিচালিত হওয়া সংগঠনের পরিচালক ব্যক্তিত্বগণ, যারা ধর্মীয় চেতনাকে ধীরে ধীরে একটি রাজনৈতিক চেতনার ভেতর উপস্থাপিত করে ,রাষ্ট্রক্ষমতা নিয়ন্ত্রণের প্রতি একটা লোলুপ দৃষ্টি প্রসারিত করতে শুরু করেছিলেন,তারাই এদেশের বুকে ইংরেজ কাঙ্খিত বিভাজনের মানসিকতাকে তীব্র করে তুলতে সর্ব শক্তি নিয়োগ করে।
              

গরু কে কেন্দ্র করে যে সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ গুলি তৈরি হতে শুরু করেছিল উনিশ শতকের শেষ লগ্নে, তা থেকে তৈরি হওয়া   সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ গুলিতে ভারতীয় সমাজ -সভ্যতা- সংস্কৃতি- অর্থনীতি -রাজনীতি ,সমস্ত প্রেক্ষাপটেই একটা দীর্ঘস্থায়ী প্রবাহমানতা বজায় রাখতে শুরু ঈরে। সেই ব্যাপারে আর্য সমাজ, প্রার্থনা সমাজ সহ যাবতীয় হিন্দু পুনরুত্থানবাদীরৃ  অত্যন্ত বেশী রকমের সক্রিয় ছিলেন, সচেতন ছিলেন, এবং নিজেদেরকে সেই উদ্দেশ্যে নিয়োজিত রাখতেন ।
                  

এই ঘটনা ক্রমটি কিন্তু রাজনৈতিক হিন্দু সাম্প্রদায়িক ,মৌলবাদী শিবিরকে তাদের সামাজিক আন্দোলনের বর্ম পরে, ছদ্মবেশ ধরে ,সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী হিন্দু চেতনাকে উপস্থাপিত করার ক্ষেত্রে বিশেষ রকম সাহায্য করেছিল।

ধারাবাহিক লেখাগুলি পড়তে ক্লিক করুনঃ www.cpimwb.org.in

ভারতের জাতীয় আন্দোলন ও আর এস এস - (পর্ব - ২১)

ভারতের জাতীয় আন্দোলন ও আর এস এস – (পর্ব – ২০)

ভারতের জাতীয় আন্দোলন ও আর এস এস – (পর্ব – ১৯)

ভারতের জাতীয় আন্দোলন ও আর এস এস – (পর্ব – ১৮)

ভারতের জাতীয় আন্দোলন ও আর এস এস – (পর্ব – ১৭)

ভারতের জাতীয় আন্দোলন ও আর এস এস – (পর্ব – ১৬)

ভারতের জাতীয় আন্দোলন ও আর এস এস – (পর্ব – ১৫)

ভারতের জাতীয় আন্দোলন ও আর এস এস – (পর্ব – ১৪)

ভারতের জাতীয় আন্দোলন ও আর এস এস – (পর্ব – ১৩)

ভারতের জাতীয় আন্দোলন ও আর এস এস – (পর্ব – ১২)

ভারতের জাতীয় আন্দোলন ও আর এস এস – (পর্ব – ১১)

ভারতের জাতীয় আন্দোলন ও আর এস এস – (পর্ব – ১০)

ভারতের জাতীয় আন্দোলন ও আর এস এস – (পর্ব- ৯)

ভারতের জাতীয় আন্দোলন ও আর এস এস – (অষ্টম পর্ব)

ভারতের জাতীয় আন্দোলন ও আর এস এস – (সপ্তম পর্ব)

ভারতের জাতীয় আন্দোলন ও আর এস এস – (ষষ্ঠ পর্ব)

ভারতের জাতীয় আন্দোলন ও আর এস এস – (পঞ্চম পর্ব)

ভারতের জাতীয় আন্দোলন ও আর এস এস – (চতুর্থ পর্ব)

ভারতের জাতীয় আন্দোলন ও আর এস এস – (তৃতীয় পর্ব)

ভারতের জাতীয় আন্দোলন ও আর এস এস – (দ্বিতীয় পর্ব)

ভারতের জাতীয় আন্দোলন ও আর এস এস – (প্রথম পর্ব)


শেয়ার করুন

উত্তর দিন