ভারতের জাতীয় আন্দোলন ও আর এস এস – (পর্ব – ১৬)
উনিশ শতকের আলোকপ্রাপ্ত সমাজের কাছে ব্রাহ্মসমাজের বৌদ্ধিক আবেদন, যুক্তিবাদী চিন্তাভাবনা প্রয়োগ, বাংলার প্রেক্ষাপটকে একটি ইতিবাচক ধারায় প্রবাহিত করেছিল। সেই প্রভাব বাংলার পরিমণ্ডলকে অতিক্রম করে গোটা দেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সমানভাবে পড়েছিল ।তার পাশাপাশি শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের, মানুষের কাছে মানবিক আবেদন, মানুষের ভাবের কাছে আবেদন– সেগুলি যেমন একদিকে বাংলার শিক্ষিত মধ্যবিত্ত কে একটা বিশেষ রকমের আলোক প্রাপ্তির দিকে টেনে নিয়ে গিয়েছিল, তেমনি ই তার আবেদন গোটা ভারতবর্ষে, চিরন্তন ভারতবর্ষের বহুত্ববাদী সমন্বয়ী চিন্তা-চেতনার ধারাকে একটি নতুন আঙ্গিকে ,মানবিক দৃষ্টিভঙ্গিতে, লোকায়ত ভঙ্গিমার ভেতর দিয়ে ,উপস্থাপিত করেছিল।
শ্রীরামকৃষ্ণের কোনো প্রথাগত পাশ্চাত্য যুক্তিবাদী শিক্ষা ছিল না। প্রথাগত প্রাচ্যের কোনো শিক্ষার আঙ্গিকে তিনি কখনো প্রবেশ করেন নি ।অথচ সেই মানুষটি ই , প্রচলিত বোধের ওপর দাঁড়িয়ে, প্রবাহিত ভারতবর্ষের আধ্যাত্বিক চিন্তা-চেতনার এমন একটি সহজ- সরল- অনাড়ম্বর -মানবিক দ্যোতনা উপস্থাপিত করেছিলেন, যা একদিকে অতিসাধারণ মানুষকেও বিশেষভাবে প্রভাবিত করেছিল, অপরপক্ষে পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত মানুষজন ও তাঁর চিন্তাচেতনার দ্বারা নিজেদের মননলোককে অত্যন্ত সজাগভাবে আন্দোলিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন।
প্রথাগত শিক্ষার সুযোগ না পাওয়া শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব তাঁর মানবিক মূল্যবোধ সম্পন্ন জীবনচর্চা উপদেশাবলী ভেতর দিয়ে ঔপনিবেশিক শাসন কিভাবে ভারতবর্ষের বহুত্ববাদী মূল্যবোধকে আলগা করে দিচ্ছে, লোকায়ত ভঙ্গিমার ভেতর দিয়ে সেটি প্রকাশ করেছিলেন। রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের মত শ্রীরামকৃষ্ণের কথার ভঙ্গিতে কখনও কোনো অবস্থাতেই ঔপনিবেশিকতার প্রতি বিদ্বেষ, কিংবা রাজনৈতিক অভিব্যক্তি ঝরে পড়েনি ।
তা সত্বেও যুক্তিবোধের আধিক্যের ভেতর দিয়ে, উপনিবেশিক শিক্ষা ব্যবস্থা আমাদের দেশের মানবিক চিন্তা চেতনার ধারাকে কতখানি ওলট পালট করে দিচ্ছে, সে বিষয়ে দৃষ্টি নিক্ষেপ করতে শ্রীরামকৃষ্ণ পিছপা হন নি ।পাশ্চাত্য শিক্ষার মূল্যবোধ অপেক্ষা, প্রাচ্যের বহুত্ববাদী, সমন্বয়ী , ধর্মনিরপেক্ষ, সম্প্রীতির মানসিকতাসম্পন্ন মূল্যবোধ যে মানবজাতির কল্যাণের পক্ষে বিশেষ সহায়ক, সেই ভাবনা-চিন্তা শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁর গোটা জীবনব্যাপী যাপন চিত্র, উপদেশাবলী ভেতর দিয়ে ব্যক্ত করে গিয়েছেন ।
একঘেয়ে জীবন চর্চার পরিবর্তে মানুষের জীবনে বৈচিত্রের ভেতর দিয়ে কিভাবে ঐক্যের সাধনা সাধিত হয়, তার যেন একটা দিশা তিনি তাঁর গোটা জীবনের চর্চার ভেতর দিয়ে আমাদের সামনে উপস্থাপিত করে গেছেন ।শিক্ষিত মধ্যবিত্তের কাছে পাশ্চাত্যের যুক্তিবোধের করা নিয়মাবলী এবং সার্বিক আঙ্গিক, প্রাচ্যের জীবনধারার সঙ্গে কোথায় সাযুজ্যের অভাব তৈরি করছে, তার দিক নির্দেশ করে, জীবন চর্চা কে একটি অসাম্প্রদায়িক ভিত্তির উপর দাঁড় করিয়ে, পরমত সহিষ্ণুতা, পরধর্মের প্রতি শ্রদ্ধা, সম্মান ,মর্যাদা প্রকাশের যে শিক্ষা শ্রীরামকৃষ্ণ দিয়ে গিয়েছেন, তার ভেতর দিয়ে কিন্তু কেবলমাত্র বাংলা নয় ,গোটা ভারতের মধ্যবিত্ত সম্প্রদায় জীবনবোধের একটি নতুন মাত্রা খুঁজে পেয়েছিল।
এই বোধটা কিন্তু ভারতের জাতীয় আন্দোলনের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্র উপস্থাপনার ক্ষেত্রে এবং পরবর্তী কালের ভারত স্বাধীন ভারতবর্ষের ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধান প্রণয়নের ক্ষেত্রে একটি ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছিল। লোকায়ত পরম্পরা কে নিজের ভেতরে গেঁথে নিয়ে ,সেই পরমপরার ভেতর দিয়ে নিজের এবং পারিপার্শ্বিকতার একটি বিশুদ্ধ ভাবধারার প্রণয়ন করে ,দেশের চির প্রবাহমান জ্ঞানতৃষ্ণা প্রতি এক অন্তহীন শ্রদ্ধা-ভালোবাসা মর্যাদার পরিবেশ তৈরি করা ,শ্রীরামকৃষ্ণের জীবন ও আদর্শের সর্বশ্রেষ্ঠ প্রকাশ হিসেবে আমরা দেখি ।
উনিশ শতকের শেষ দিকে সাম্প্রদায়িক ভাবনায় জারিত হয়ে হিন্দু সম্প্রদায়ের ভেতরে যে একটি রাজনৈতিক দ্যোতনার অভিব্যক্তি , পুনর্জাগরণবাদী চিন্তাচেতনা হিশেবে ক্রমশ বিকাশলাভ করছিল, যে চিন্তা-চেতনাকে আরএসএস প্রতিষ্ঠার আগে ,তাদের রাজনৈতিক ও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ লোকজনেরা আত্মস্থ করার চেষ্টা করেছিলেন ।পরবর্তীকালে আরএসএস প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর ,যে সমস্ত লোকজন সেই পুনর্জাগরণ বাদী চিন্তা-চেতনাকে জীবনের চেতনার একটি বৈশিষ্ট্য ধারা হিসেবে দেখে ,ভারতবর্ষের বহুত্ববাদী চিন্তা-চেতনার প্রবাহমান ঐতিহ্যকে একটি সাম্প্রদায়িক অভিমুখে পরিচালিত করবার চেষ্টা করেছিলেন, তাদের চিন্তা-চেতনা- দৃষ্টিভঙ্গি- পথ চলা, কোনো কিছুর সঙ্গে কিন্তু শ্রীরামকৃষ্ণের জীবন, তাঁর গোটা যাপন চিত্র এবং উপদেশাবলী কোনোরকম সাযুজ্য নেই।
ধর্মীয় সমন্বয়বাদ কে মানুষের জীবনে খোদাই করে ,সেই সমন্বয়ে র চিন্তা-চেতনার দ্বারা মানুষের জীবনকে তাড়িত করে ,একটি সুন্দর সুস্থ জীবনের দিকে মানব সমাজকে প্রবাহিত করিয়ে দেওয়াই ছিল শ্রীরামকৃষ্ণের গোটা জীবনব্যাপী সংগ্রামের সব থেকে বড় অঙ্গ। সহজ, উন্মুক্ত, পরিবর্তনশীল সমাজের প্রচারের সঙ্গে কিন্তু শ্রীরামকৃষ্ণের কখনো কোনো সম্পর্ক ছিল না ।ঈশ্বর লাভের উদ্দেশ্যে একাধিক পথ এবং মত কে সম্মান, মর্যাদা জানিয়ে, প্রতিটি মত ও পথের ভেতর দিয়ে ,মানুষ কিভাবে নিজের ভাবনাটাকে ,নিজের বিচার বুদ্ধির দ্বারাই পরিচালিত করবে– সেই আত্মানুসন্ধানের দিকে শ্রীরামকৃষ্ণের গোটা জীবনব্যাপী সাধনা ব্যক্ত হয়েছিল।
এভাবেই সার্বজনীন উদারতার ভেতর দিয়ে প্রচলিত হিন্দু ধর্মের দাঁড় করিয়ে, তাকে শ্রীরামকৃষ্ণ তুলে ধরেছিলেন। তিনি যেভাবে প্রচলিত হিন্দুধর্মের সারবত্তা, সার্বজনীনতা নির্মাণ করেছেন, রাজনৈতিক হিন্দুরা কিন্তু সে পথ দিয়ে কখনো হাঁটেনি। তারা তাদের ধর্মীয় বোধকে একটি রাজনৈতিক আঙ্গিক থেকে দেখে ,কৌণিক অবস্থানের ভিত্তিতে বিচার করে, সার্বজনীনতা কে উপস্থাপিত করেছিলেন একটি খণ্ড ক্ষুদ্র স্থানিক বিন্দুতে ।সার্বজনীন উদারতার ভিত্তিতে প্রতিস্থাপিত হিন্দু ধর্মকে যে মহান ঔদার্যের উপর শ্রীরামকৃষ্ণ স্থাপিত করেছিলেন ,সেই পথকেই সার্বজনীন গ্রহণযোগ্যতার দিকে পরিচালিত করার লক্ষ্যে তাঁর শিষ্য স্বামী বিবেকানন্দ জীবন ভোর কাজ করে গিয়েছেন।
বিবেকানন্দের চিন্তা-চেতনার ভেতরে যে সমন্বয়ী, বহুত্ববাদের উপর প্রতিষ্ঠিত, শ্রদ্ধাশীল, পরমতসহিষ্ণুতার প্রতি শ্রদ্ধা যুক্ত দৃষ্টিভঙ্গি বিকাশ লাভ করেছিল, তার সঙ্গে কিন্তু রাজনৈতিক হিন্দুদের পরিচালিত ধর্মীয় ধ্যান-ধারণার বিন্দুমাত্র সাযুজ্য কখনো ছিল না ।সমসাময়িক যুগের সংস্কারবাদী আন্দোলন গুলি বিবেকানন্দের দৃষ্টিভঙ্গিকে সম্যকভাবে মেনে নিতে পারেনি। অপরপক্ষে বিবেকানন্দ নিজেও সংস্কারবাদী আন্দোলন গুলিকে উচ্চ কোটির বলে তীব্র সমালোচনা পর্যন্ত করেছিলেন। প্রতিটি জীবের মধ্যে শিবের উপস্থিতি অনুভব করে ,সমাজসেবার যে আঙ্গিক, ধর্মীয় চেতনার সঙ্গে বিবেকানন্দ অঙ্গীভূত করেছিলেন, যেভাবে তিনি গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন দরিদ্র মানুষকে সেবা করাই হলো ঈশ্বর সেবার সব থেকে উৎকৃষ্ট উপায় ,মানুষকে সেবা করার সেই মহান আদর্শ অবলম্বন করে ১৮৯৭ সালে তাঁর প্রতিষ্ঠিত রামকৃষ্ণ মিশন পরিচালিত হতে শুরু করে।
এ সমস্ত কিছুকে যদি আমরা পুনর্জাগরণবাদী তকমা এঁটে দিতে হয়, রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ আন্দোলনের সার্বজনীনতা, যার সঙ্গে ভারতের চিরন্তন- বহুত্ববাদী সংস্কৃতির পরিপূর্ণ অংশ রয়েছে, তাকে আমরা অস্বীকার করব ।বৈদিক ঐতিহ্য বিবেকানন্দের উৎস হলেও ,ধর্মীয় আচার-আচরণের প্রতি তাঁর যথেষ্ট শ্রদ্ধা পূর্ণ মানসিকতা থাকলেও ,প্রাচীন ভারতীয় সভ্যতার গৌরবময় ঐতিহ্যের প্রতি তাঁর বিশেষ অনুরাগ থাকলেও, এইসব বিষয়ে গুলিকে যেমন বিকৃতভাবে পুনর্জাগরণ বাদীরা নিজেদের স্বার্থে কাজে লাগিয়েছে ,পরবর্তীকালে ও একই ধারা পুনর্জাগরণ বাদীরা বজায় রেখেছে, বা আজকের দিনে ধর্মের রাজনৈতিক কারবারিরা সেই একই পথে বিবেকানন্দকে বিকৃত উপায়ে নিজেদের সংকীর্ণ স্বার্থে ব্যবহার করে চলেছে, তার সঙ্গে বিবেকানন্দের এতোটুকু সম্পর্ক নেই।
প্রাচীন ভারতীয় সভ্যতার সঙ্গে বিবেকানন্দ যেভাবে স্বদেশ প্রেম কে একাত্ম করেছিলেন, পুনর্জাগরণ বাদীরা কিন্তু প্রাচীন ভারতীয় সভ্যতার সভ্যতাকে হিন্দু সভ্যতা হিসেবে পরিগণিত করতে অভ্যস্ত , তার সঙ্গে কোনো অবস্থাতেই স্বদেশ প্রেমকে এতোটুকুই জায়গা দেয়নি তারা। ভারতীয় জাতির পুরুষত্বকে ফিরিয়ে আনার প্রতি বিবেকানন্দের ছিল একটি গভীর অনুরাগ ।প্রাচীন ভারতীয় পুরুষত্বকে ,শৌর্যবীর্য ,মহত্বকে ঔপনিবেশিক শাসকেরা অস্বীকার করতো। ঔপনিবেশিক শাসকদের এই প্রাচীন ভারতীয় ধ্যান-ধারণার প্রতীককে অস্বীকারের মানসিকতাকে তীব্র ভাষায় সমালোচনা করেছেন বিবেকানন্দ। তাদের সেই মানসিকতাকে তিনি আজীবন ঘৃণা করে এসেছেন। বাংলায় জাতীয়তাবাদের বিস্তারের ক্ষেত্রে ,বিশেষ করে সশস্ত্র বিপ্লববাদী চিন্তা-চেতনায় উদ্বুদ্ধ মানুষদের, জাতীয় চেতনার ভেতরে বিবেকানন্দ কে ব্যবহারে , অনেক ক্ষেত্রে সংস্কারবাদী চিন্তা-চেতনার বিকাশ বলে আমরা কিছুটা ভুল ভাবে দেখে থাকি।
বিবেকানন্দ প্রাচীন ভারতীয় সভ্যতার ঐতিহ্যকে যে ঔজ্জ্বলের সঙ্গে দেখেছিলেন ,সেই বিষয়টিকে সাম্প্রদায়িক রাজনীতিরা অত্যন্ত জরুরি ভাবে উপস্থাপিত করে, বিবেকানন্দকে একটা সাম্প্রদায়িক দোত্যনায় উপস্থাপিত করবার সব রকমের চেষ্টা করে। কিন্তু একথা তারা একটিবারের জন্য বলে না যে, প্রচলিত হিন্দুধর্মের নেতিবাচক দিকগুলিকে বিবেকানন্দের মত এত স্পষ্ট ভাষায় ,এত স্পষ্ট ভাবে আর কেউ দেখান নি। আর কেউ এভাবে নিন্দা করেননি।
বিবেকানন্দের মানবতাবাদী কাজকর্ম গুলিকে অনুসরণ না করে, সাম্প্রদায়িক রাজনীতিকরা বরাবর বিবেকানন্দের প্রাচীন ভারতীয় সংস্কার সভ্যতার প্রতি যে অনুরাগ ,তাকে একটি সাম্প্রদায়িক কৌণিক বিন্দু থেকে, বিকৃত ভাবে উপস্থাপিত করে, নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করে এসেছে ।যে ব্রাহ্মণ্যবাদী চিন্তা-চেতনার দ্বারা আরএসএস, তার গোটা কর্মকাণ্ড এবং তাদের রাজনৈতিক সংগঠনগুলিকে পরিচালিত করে থাকে, বিবেকানন্দ কিন্তু তাঁর সামগ্রিক জীবনের প্রায় প্রতিটি কাজে, সেই ব্রাহ্মণ্যবাদী ভাবধারার ঘোরতর সমালোচনা করে এসেছেন ।
রাজনৈতিক হিন্দুরা কখনোই নারী নির্যাতনের প্রকাশ্য সমালোচনা করে না ।অথচ বিবেকানন্দ কিন্তু তাঁর যাবতীয় ধ্যান-ধারণায় নারীর প্রতি অত্যন্ত সম্মানীয় মানসিকতা প্রকাশের পাশাপাশি, নারী নির্যাতনের যে কোনো পর্যায় কে তীব্রভাবে আক্রমণ করে গেছেন ।এইসব বিষয় গুলি কিন্তু আমাদের সামাজিক ইতিহাস আলোচনার ক্ষেত্রে সেভাবে উঠে আসে না বলেই রাজনৈতিক হিন্দুদের পক্ষে বিবেকানন্দকে নিজেদের সংকীর্ণ দলীয় স্বার্থে ব্যবহার করবার সুযোগ টা অনেক বেশি বিস্তৃত হয়ে আসছে ।
চরমপন্থী রাজনীতিতে বিশ্বাসী বাংলা তথা ভারতের বিপ্লবী যুবকেরা বিবেকানন্দকে প্রথম পথ প্রদর্শক হিসেবে গণ্য করেছিলেন। আবার তাদের মধ্যে অনেকে প্রাচীন ভারতের গৌরব কে হিন্দু গৌরব হিসেবে উপস্থাপিত করে সেই গৌরবের একজন প্রচারক হিসেবে বিবেকানন্দকে বিকৃতভাবে উপস্থাপন করে বিবেকানন্দের অসাম্প্রদায়িক ধর্মনিরপেক্ষ পরমতসহিষ্ণু সম্প্রীতির দৃষ্টিভঙ্গির সামগ্রিক জীবন ও চর্চার চর্চাকে একদম ভুল ভাবে বিকৃত ভাবে উপস্থাপিত করে পরবর্তীকালে রাজনৈতিক হিন্দুদের ধর্মের রাজনৈতিক আগ্রাসনের ক্ষেত্রটিকে অনেকখানি বিস্তার লাভ করবার ক্ষেত্রে ইতিবাচক একটা পরিস্থিতি তৈরি করে দিয়েছে।
ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের প্রথম কুড়ি বছরের কার্যকালে যে রাজনৈতিক ,সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক টানাপোড়েন ,সেই প্রেক্ষিতে, বাংলায় যে একটি সামাজিক আন্দোলন ধীরে ধীরে বিকাশ লাভ করে ,সেই ধারায় যুক্তিবাদ -বিজ্ঞানচেতনা- আধুনিক ধ্যান ধারনার একটি বিশেষ রকমের ভূমিকা এবং গ্রহণযোগ্যতা ছিল। অপরপক্ষে পাশ্চাত্যের ধ্যানধারণা কেন্দ্রিক এই দৃষ্টিভঙ্গির সমালোচনা ই শুধু নয়, প্রতিদ্বন্দী হিসেবে প্রাচীন ভারতীয় চিন্তা চেতনার সঙ্গে, ধর্মীয় মোড়কে একাত্ম করে ,এক ধরনের রাজনৈতিক অভিঘাত পরিচালিত করার প্রচেষ্টা কিন্তু তখন সক্রিয় হয়ে উঠেছিল।
পাশ্চাত্যের যুক্তিবাদের সবকিছু দৃষ্টিভঙ্গিতে শ্রীরামকৃষ্ণ বা তাঁর পরিমণ্ডল ,সার্বিকভাবে সমর্থন করতে না পারলেও ,ভারতবর্ষের প্রাচীন নাম করে, হিন্দু সমাজের ভেতর, রক্ষণশীলতার দৃষ্টিভঙ্গি, প্রতিক্রিয়াশীল চিন্তা-চেতনার বিকাশ এই ধরণের কোনোকিছুর সাথেই তাঁরা কিন্তু কোন রকম ভাবেই নিজেদেরকে সম্পৃক্ত করেননি ।অপরপক্ষে হিন্দু ঐতিহ্যের নাম করে, প্রাচীন ভারতীয় ঐতিহ্যের সঙ্গে এক ধরনের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির সাথে সংযুক্ত করে দিয়ে, সেই সংযোজনা কে বাংলা তথা গোটা ভারতবর্ষের আপামর জনতার কাছে এক ধরনের সর্বজনগ্রাহ্য তা তৈরি করে ,তাকে মান্যতা দেওয়া এবং ন্যায়সঙ্গত করে তোলার লক্ষ্যে ,সমাজের একটি অংশ কিন্তু অত্যন্ত সক্রিয় ভূমিকা পালন করে ।
এই ভূমিকার পর্যবেক্ষণটির সঙ্গে যেন আজকের অনেক কিছু পরিবেশ পরিস্থিতির আমরা একটা অদ্ভুত সাযুজ্য দেখতে পাই। আজ যেমন রাজনৈতিক হিন্দুরা বিজ্ঞানের যাবতীয় আধুনিকতম আবিষ্কারের পেছনে প্রাচীন ভারতীয় ঐতিহ্যের একটা সংযোগ খুঁজে পেয়ে, গোটা বিষয়টিকে হিন্দু সংস্কৃতির একটি অবদান হিসেবে উপস্থাপিত করবার অদ্ভুতুড়ে প্রচেষ্টায় রত থাকে, ঠিক তেমন প্রবণতা একটা সময় উনিশ শতকের শেষ ভাগে, শশধর তর্কচূড়ামণি নেতৃত্বে একদল পুনরুত্থানবাদী হিন্দু, যাদের চিন্তা-চেতনাকে পরবর্তীকালে রাজনৈতিক হিন্দুরা বিশেষভাবে গ্রহণ করেছে ,তারা নিয়োজিত থাকতেন।
এই অংশের মানুষেরা পাশ্চাত্যের প্রতিটি বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার গুলিকে অতীতের ভারতবর্ষের এক একটি দৃষ্টান্ত হিসেবে উপস্থাপিত করে, অতীতের সেই ভারতবর্ষের সঙ্গে হিন্দু সংস্কৃতি কে একটি কৌণিক অবস্থানে দেখিয়ে ,প্রাচীন ভারতীয় সভ্যতা সংস্কৃতির, বহুত্ববাদী চেতনা, সমন্বয়ী দৃষ্টিভঙ্গিকে অস্বীকার করে উপস্থাপিত করতে ,একেবারে আদাজল খেয়ে নেমেছেন।
আধুনিক বিজ্ঞানকে তারা কখনো নিষিদ্ধ বা বাতিল বলে ঘোষণা করেন নি বটে, কিন্তু সেইসব আধুনিক বিজ্ঞানের আবিস্কার অতীতে ভারতবর্ষের প্রাচীন হিন্দু ঋষিদের আয়ত্তাধীন ছিল, এটা দেখাতে ,কিন্তু শশধর তর্কচূড়ামণিরা সবথেকে বেশি ব্যস্ত থাকতেন ,তাঁদের খুব সোজাসাপ্টা কথা ছিল ;আধুনিক বলে যে সমস্ত বিষয়কে দেখানো হচ্ছে ,জানানো হচ্ছে ,আবিষ্কার হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হচ্ছে ,সেই সমস্ত বিষয়গুলি কিন্তু প্রাচীন ভারতের মনীষীগণ হাজার হাজার বছর আগের থেকেই জানতেন ।তাঁরা সেই অনুযায়ী সেইসব বিষয়গুলিকে ব্যবহার পর্যন্ত করতেন ।
এইরকম একটি দৃষ্টিভঙ্গির ভেতর দিয়েই শশধর তর্কচূড়ামণি এবং তাঁর সহযোগীরা শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মানুষদের কাছে হিন্দু ধর্মকে একটি কৌণিক অবস্থানে স্থাপন করে, হিন্দু ধর্মের চিরন্তন ,বহুত্ববাদী সংস্কৃতির সমন্বয়বাদী চেতনাকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করে অ,তীত গৌরবের সঙ্গে এক ধরনের অসূয়ার পরিবেশ, সহনশীলতার মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসবার তাগিদ প্রতিস্থাপনে ,সবথেকে বেশি উৎসাহী ছিলেন।
এই প্রবণতা কিন্তু আমরা আজকের দিনে আবার নতুন করে রাজনৈতিক হিন্দুত্ববাদীদের ভেতরে দেখতে পাচ্ছি ।গণেশের মাথায় হাতির মাথা স্থাপনকে প্রাচীন ভারতের প্লাস্টিক সার্জারির নিদর্শন কিংবা পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল জগদীশ ধনকরের করা মন্তব্য; অর্জুনের তীরে পরমাণু অস্ত্র ছিল –এই ধরনের যে দৃষ্টিভঙ্গি আরএসএস বা তার রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপি কিংবা তার সঙ্গী সাথীরা নতুন করে ভারতবর্ষের বুকে এক ধরনের প্রতিক্রিয়াশীলতার সৃষ্টির তাগিদ থেকে দেগে দিতে চাইছেন , তা কিন্তু উনিশ শতকে এই শশধর তর্কচূড়ামণি , বাসতাঁর সাঙ্গোপাঙ্গ ,যাঁরা চির প্রবাহমান, বহুত্ববাদী হিন্দু ধর্মকে একটি সংকীর্ণ কৌণিক অবস্থানে দেখেছিলেন, এবং সেইভাবেই হিন্দু ধর্মকে তার চিরন্তন ,পরমতসহিষ্ণু, পর ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল মানসিকতা থেকে একদম বিপরীত মেরুতে উপস্থাপিত করতে সচেষ্ট ছিলেন ,তাঁদের মতো করে দেখাতে সবথেকে বেশি উদগ্রীব হয়ে পড়েছেন।
ধারাবাহিক লেখাগুলি পড়তে ক্লিক করুনঃ www.cpimwb.org.in
ভারতের জাতীয় আন্দোলন ও আর এস এস – (পর্ব – ১৫)
ভারতের জাতীয় আন্দোলন ও আর এস এস – (পর্ব – ১৪)
ভারতের জাতীয় আন্দোলন ও আর এস এস – (পর্ব – ১৩)
ভারতের জাতীয় আন্দোলন ও আর এস এস – (পর্ব – ১২)
ভারতের জাতীয় আন্দোলন ও আর এস এস – (পর্ব – ১১)
ভারতের জাতীয় আন্দোলন ও আর এস এস – (পর্ব – ১০)
ভারতের জাতীয় আন্দোলন ও আর এস এস – (পর্ব- ৯)
ভারতের জাতীয় আন্দোলন ও আর এস এস – (অষ্টম পর্ব)
ভারতের জাতীয় আন্দোলন ও আর এস এস – (সপ্তম পর্ব)
ভারতের জাতীয় আন্দোলন ও আর এস এস – (ষষ্ঠ পর্ব)
ভারতের জাতীয় আন্দোলন ও আর এস এস – (পঞ্চম পর্ব)
ভারতের জাতীয় আন্দোলন ও আর এস এস – (চতুর্থ পর্ব)
ভারতের জাতীয় আন্দোলন ও আর এস এস – (তৃতীয় পর্ব)