ভারতের জাতীয় আন্দোলন ও আর এস এস – (পর্ব - ১২)

ধারাবাহিক রচনায়ঃ গৌতম রায়

জাতীয় কংগ্রেসের প্রথম পর্বের কুড়ি বছরে, তাঁদের নেতৃত্বের  কোনো দাবির সঙ্গে হেডগেওয়ার বা তাঁর কোনো সহযোগীর বিন্দুমাত্র কোন সংযোগ ছিল না ।আরএসএস তার প্রতিষ্ঠাতাদের জাতীয় আন্দোলনে অংশগ্রহণের যে তত্ত্বের অবতারণা করে ,সেই আজগুবি বিষয়টির সঙ্গে বাস্তবের যদি কোনো মিল থাকতো ,তাহলে কংগ্রেসের নরমপন্থী নেতৃত্ব ,তাঁদের কার্যকলাপের  ভেতরে খুব মৃদুস্বরে হলেও, যে ব্রিটিশবিরোধী মানসিকতাকে ধীরে ধীরে একটা উচ্চ নাদির  দিকে পৌঁছে দিচ্ছিলেন, সেই পরিবেশ -পরিস্থিতির সঙ্গে, হেডগেওয়ার বা তার সহযোগী বিএস মুজ্ঞে কিংবা অন্যান্য আরএসএসের  প্রথম যুগের নেতৃত্বের কোনো না কোনো সম্পর্কের ইতিহাস গত কোনো তথ্য-প্রমাণ থাকতো। তাহলে সেই তথ্যপ্রমাণ তারা অবশ্যই হাজির করতো। বলাবাহুল্য আজ পর্যন্ত এরকম কোনো তথ্য প্রমাণ কিন্তু গোটা হিন্দু সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী শিবির প্রকাশ্যে দাখিল করতে পারে নি।
                 

নরমপন্থী রাজনীতিকরা নানা ধরনের সংস্কারের পাশাপাশি তাঁদের কার্যকলাপের সময়কালে প্রশাসনিক ব্যবস্থায় জুড়ি প্রথাকে  বিচার ব্যবস্থায়  সম্প্রসারণের যে দাবি জানিয়েছিলেন, সেই দাবির প্রতি ব্রিটিশ সে অর্থে কোনরকম কর্ণপাত করেনি ।নরমপন্থী রাজনীতিকরা অস্ত্র আইন প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছিলেন ।জমির খাজনা নিয়ে যে ধরনের মূল্যায়ন করা হচ্ছে, সেই মূল্যায়ন পুনর্বিবেচনার দাবি জানিয়েছিলেন। এমনকি চিরস্থায়ী ব্যবস্থা সম্প্রসারণের দাবিও তাঁরা তোলেন ।লবণ কর অবলুপ্তির দাবি তোলেন। আসামে চা বাগান গুলিতে চুক্তিভিত্তিক শ্রমিক শোষণের বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপিত করেন।
                

এইসব দাবিগুলোর ভেতর থেকে বোঝা যায় ;জাতীয় কংগ্রেসের প্রথম স্তরের নেতারা ব্রিটিশের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে বিদ্রোহ না করলেও, জাতিগত সমতার বিষয়টি সম্পর্কে ধীরে ধীরে ওয়াকিবহাল হয়ে উঠছিলেন। অপরপক্ষে জাতিগত সমতার প্রশ্নে হিন্দু রাজনৈতিক  ,সাম্প্রদায়িক শিবির কিন্তু প্রথম থেকেই ছিল অত্যন্ত সংকীর্ণমনা। জাতিবিদ্বেষ কে ই তাদের সামাজিক ভিত্তির  প্রধান উপপাদ্য হিসেবে তুলে ধরে, তাকেই তারা তাদের অঘোষিত রাজনৈতিক চিন্তাভাবনার মূল বিষয় হিসেবে উপস্থাপিত করত।
                  

নরমপন্থী নেতৃত্ব মানুষের সাধারণ, সামাজিক অধিকারের বিষয়গুলো নিয়ে যেভাবে সোচ্চার হয়েছিল, সেটি কিন্তু সেই সময়ের ভারতীয় সামাজিক পরিবেশে, বিশেষ করে উদীয়মান মধ্যবিত্ত সমাজের সামগ্রিক প্রেক্ষাপট কে অনেকখানি প্রভাবিত করতে পেরেছিল। সমাজের নিচুতলার মানুষ ,পিছিয়ে পড়া মানুষের কথা ধীরে ধীরে কিন্তু জাতীয় কংগ্রেসের প্রথম স্তরের নেতাদের চিন্তা ভাবনার মধ্যে প্রতিফলিত হতে শুরু করে ।
                

এই পিছিয়ে পড়া মানুষদের ক্ষেত্র  গুলি সম্পর্কে আলোচনা র পর্যায়টি ছিল অত্যন্ত সীমিত। পরবর্তীকালে জাতীয় কংগ্রেস বা জাতীয় আন্দোলনের অন্যান্য নেতৃত্ব ,বামপন্থী ধারা, তাঁরা যেভাবে পিছিয়ে পড়া অংশের মানুষদের কথা কে সামনে তুলে ধরেছিলেন ,তেমন পর্যায় কিন্তু জাতীয় কংগ্রেসের প্রথম স্তরের নেতাদের মধ্যে দেখা যায়নি। তবুও পিছিয়ে পড়া মানুষদের সমস্যাবলী সম্পর্কে আলোচনার যে সূচনা তাঁরা করেছিলেন, একইসঙ্গে ভারতবর্ষের রাজনৈতিক এবং সামাজিক প্রেক্ষাপট কে অনেকখানি প্রলম্বিত করেছিলেন, আরএসএস কিন্তু তার সূচনাপর্বের কোন পর্যায়ে ই পিছিয়ে পড়া অংশের মানুষদের নিয়ে কোনোরকম ভাবনা চিন্তার কথা আনেনি ।
                   

মনে রাখা দরকার নরমপন্থী নেতৃত্ব দের যে সমস্ত প্রশাসনিক সংস্কারের দাবি ,সমাজের পিছিয়ে পড়া অংশের দাবি-দাওয়া গুলিকে উত্থাপিত করার ভেতর দিয়ে সামাজিক বিন্যাসে একটা অদলবদল আনার চেষ্টা, এসবের প্রতি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শক্তি কোন রকম ভাবেই কর্ণপাত করেনি।
                         

প্রশাসনিক ক্ষেত্রে সংস্কারের যে সমস্ত দাবি-দাওয়া গুলি নরমপন্থী রাজনীতিকেরা তুলেছিলেন, ব্রিটিশের কাছ থেকে সেগুলির প্রায় কোনোটিই তাঁরা আদায় করতে পারেননি। তা বলে এটা ধরে নেওয়ার কোনো কারণ নেই যে ,নরমপন্থী রাজনীতিকেরা তাঁদের কার্যকালের প্রেক্ষিতে ,রাজনৈতিক চিন্তা চেতনার উন্মেষেথ  আঙ্গিক কে প্রসারিত করার ক্ষেত্রে ,একেবারে ব্যর্থ হয়েছিলেন।
                      

প্রশাসনিক সংস্কারের দাবি গুলি নরমপন্থী রাজনীতিকেরা সেভাবে ব্রিটিশদের কাছ থেকে আদায় করতে না পারলেও, ব্রিটিশের অর্থনৈতিক শোষণের যে স্বরূপ টিকে তাঁরা উদঘাটিত করতে পেরেছিলেন এবং সেটিকে ভারতবর্ষের মানুষের ভিতরে একটা স্তরে প্রসারিত করতে পেরেছিলেন ,তার সুফল আমরা পরবর্তীকালে আমাদের জাতীয় আন্দোলনের সামগ্রিক প্রেক্ষাপটে বার বার পেয়েছি ।                

ব্রিটিশের এই অর্থনৈতিক শোষণের সার্বিক চিত্র টি কে ভারতবর্ষের মানুষের সামনে তুলে ধরাই হল নরমপন্থী রাজনীতিকদের সবথেকে বড় সাফল্য। অথচ এই সময়কালে র রাজনৈতিক হিন্দুরা ,যেখানে যেভাবে বিক্ষিপ্ত আকারের সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করছিল, বা তাদের পক্ষে দাবি করা হয়, জাতীয় আন্দোলনের প্রেক্ষিতের  সঙ্গে তাদের সংযোগ গড়ে উঠেছিল ,এসবের কোনো  ক্ষেত্রে ই  কিন্তু নরমপন্থী রাজনীতিকদের উত্থাপিত, ব্রিটিশের অর্থনৈতিক শোষণ এবং তাকে ভিত্তি করে অর্থনৈতিক জাতীয়তাবাদ গড়ে তোলবার প্রথম পর্যায় টিকে নিয়ে এই হিন্দুত্ববাদী ব্যক্তিদের কাছ থেকে একটি শব্দ ও আমরা উচ্চারিত হতে দেখি না।
                      

অর্থনৈতিক জাতীয়তাবাদ নরমপন্থী রাজনীতিকরা উত্থাপন করে, সেটিকে পরবর্তীকালে আমাদের জাতীয় আন্দোলনের বিভিন্ন প্রেক্ষিতে তাঁরা অত্যন্ত সাফল্যের সঙ্গে উপস্থাপিত করবার ক্ষেত্রটিকে প্রসারিত করে দিতে পেরেছিলেন। জাতীয় কংগ্রেসের প্রথম যুগের নেতাদের এই ব্রিটিশের অর্থনৈতিক শোষণ সম্বন্ধে  চিন্তা ভাবনা, সেটি স্বাধীন ভারতে নেহরু ঘরানার অর্থনৈতিক চিন্তা-চেতনার ক্ষেত্রটিকে অনেকখানি প্রভাবিত করেছিল একথা অত্যন্ত জোরের সঙ্গে বলতে পারা যায় ।
                     

জাতীয় কংগ্রেসের প্রথম স্তরের অর্থনৈতিক চিন্তাভাবনার উন্মেষের ক্ষেত্রে তিনজন ব্যক্তিত্ব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। যাঁদের মধ্যে প্রথমজন হলেন দাদাভাই নওরোজি। পেশায় ব্যবসায়ী এই ব্যক্তিত্ব টি তাঁর' ড্রেন অফ ওয়েলথ '  তত্ত্বের ভেতর দিয়ে ব্রিটিশের   অর্থনৈতিক শোষণের যে স্বরূপ ভারতবর্ষের সামনে তুলে ধরেছিলেন, সেটি পরবর্তীকালে ব্রিটিশের সাম্রাজ্যবাদী চিন্তা এবং তাথ  প্রতিক্রিয়া সম্বন্ধে ভারতবর্ষের মানুষদের সার্বিক ভাবে বুঝে উঠবার ক্ষেত্রে অত্যন্ত ইতিবাচক একটি ভূমিকা পালন করেছিল ।
                

দাদাভাই নওরোজি

দ্বিতীয় ব্যক্তিত্ব ,যিনি ব্রিটিশের অর্থনৈতিক শোষণের স্বরূপ টিকে ভারতীয়দের সামনে তুলে ধরেছিলেন তিনি অবসরপ্রাপ্ত আইসিএস রমেশচন্দ্র দত্ত। তাঁর দুই খন্ডে লেখা' ভারতবর্ষের অর্থনৈতিক ইতিহাস ' ঔপনিবেশিক ভারতের অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট বোঝবার একটি আকর গ্রন্থ বিশেষ ।অর্থনৈতিক জাতীয়তাবাদের ক্ষেত্রকে বিস্তার করবার ক্ষেত্র  বিষয়ে ,ভারতবর্ষের দারিদ্র্য কতখানি গভীরে নিজের স্থান করে নিতে পেরেছিল, তা বুঝতে পারা যায় রমেশচন্দ্র দত্তের এই ভারতের অর্থনৈতিক ইতিহাস পড়ে।
                      

আইসিএস রমেশচন্দ্র দত্ত

এ প্রসঙ্গে তৃতীয় যে ব্যক্তিত্বের কথা অত্যন্ত শ্রদ্ধার সঙ্গে উল্লেখ করতে হয় তিনি হলেন বিচারপতি এম ডি রানাডে ।তিনিও ভারতের অর্থনৈতিক জাতীয়তাবাদের ক্ষেত্র উন্মোচনের বিষয়ে অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছিলেন ।ভারতবর্ষের দারিদ্র, ঔপনিবেশিক আমলে ব্রিটিশের অবাধ বাণিজ্যের ক্ষেত্রটিকে আরো বিস্তৃত করবার লক্ষ্যে যে ইচ্ছাকৃত ভাবে তৈরি করা হয়েছে ,সেটি এই তিনজন ব্যক্তিত্ব, যাঁরা অর্থনৈতিক জাতীয়তাবাদের ক্ষেত্রটিকে প্রথম আমাদের সামনে প্রথম  তুলে ধরেন ,তাঁরা অত্যন্ত যুক্তির সঙ্গে এই বিষয়টিকে মেলে ধরেছিলেন।                

বিচারপতি এম ডি রানাডে

ঊনবিংশ শতাব্দীতে ঔপনিবেশিক চরিত্রের ভেতরে যে যে পরিবর্তনগুলো এসেছে, সেই পরিবর্তনের নিরিখে, আমাদের দেশের অর্থনীতির ক্ষেত্রে কী ধরনের প্রভাব ক্রমশ বিস্তৃত হচ্ছে ,সে সম্পর্কেও জাতীয় কংগ্রেসের প্রথম স্তরের নেতারা ভারতবাসী সামনে তাদের নিজেদের অভিমতকে তুলে ধরতে শুরু করেন ।মার্কেনটাইল ক্যাপিটাল কিভাবে ধীরে ধীরে তার চরিত্রের অদল বদলের  ভেতর দিয়ে ভারতীয় অর্থনীতিকে প্রভাবিত করছে ,অতীতের সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থার নজরানা আদায় ইত্যাদি ব্যবস্থা গুলির ভেতর দিয়ে যে অর্থনৈতিক পরিকাঠামো ছিল ,সেই পরিকাঠামোর  কি ধরনের অদলবদল, উনিশ শতকের ভারতবর্ষে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শক্তি ঘটাচ্ছে লুটপাটের ভেতর দিয়ে ,অর্থনৈতিক পরিকাঠামো অদল বদলের  যে ধারাটি সামন্ততান্ত্রিক যুগে ছিল, সেটি কীভাবে সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশদের দ্বারা পরিবর্তিত হয়ে, গোটা বিষয়টি ব্রিটিশ স্বার্থের  পক্ষে একটা উল্লেখযোগ্য বিষয় হয়ে দাঁড়াচ্ছে --এগুলি ভারতবর্ষের মানুষদের সামনে তুলে ধরার ক্ষেত্রে নরমপন্থী নেতার অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছিলেন।
                    

আমাদের দেশের শিল্প থেকে কৃষি ,সমস্ত ক্ষেত্রে কিভাবে ধীরে ধীরে বিদেশী মূলধন বিনিয়োগ করা শুরু হচ্ছে ,বিশেষ করে চা শিল্পে ,পাট শিল্পে, নীল চাষে --সেগুলি নরমপন্থী নেতারা প্রথম ভারতবাসী সামনে প্রথম তুলে ধরেন। ব্রিটিশের অবাধ বাণিজ্যের ভেতর দিয়ে  অর্থনৈতিক শোষণের যে ছবিটা তখন ধীরে ধীরে পরিস্কার হতে শুরু করেছিল, সে সম্পর্কেও ভারতবর্ষের মানুষদেরকে প্রথম সচেতন করে তুলেছিলেন কিন্তু নরমপন্থী নেতৃত্বে ।  
                

পরিশীলিত পদ্ধতির ভেতর দিয়ে ব্রিটিশ কিভাবে অত্যন্ত কৌশলে, ভারতবর্ষের অর্থনীতিকে ধ্বংস করে দিচ্ছে, তার যে ক্ষেত্রটিকে ভারতবর্ষের মানুষদের সামনে নরমপন্থী নেতারা তুলে ধরেছিলেন, সেটি কিন্তু পরবর্তীকালে জাতীয় আন্দোলনের বিভিন্ন পর্যায়ে দেশের মানুষের সর্বস্তরে, হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে ,জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে, সমস্ত ভারতীয়দের ভেতরে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের সম্বন্ধে প্রবল ঘৃণার  মানসিকতা তৈরি র ক্ষেত্রে একটি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছিল সে কথা বলবা বলবার অপেক্ষা রাখে না ।
                 

কৃষি থেকে শিল্পের বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিদেশী মূলধন নিয়োগের ফলে আমাদের দেশের কৃষির গভীর সংকট দেখা দিল ।আর বিদেশের শিল্পকে আরো উন্নত  করবার লক্ষ্যে ,আমাদের দেশ যে কেবল কৃষিজ  কাঁচামালের একটা সরবরাহকারী কেন্দ্রে পরিণত হল-- এই বিষয়টি কে  আমাদের দেশের মানুষের সামনে প্রথম চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে ছিলেন জাতীয় কংগ্রেসের প্রথম স্তরের নেতৃত্বে। এইসব প্রণম্য  মানুষেরা আমাদের দেশে উৎপাদিত খাদ্য সামগ্রী ব্রিটেনে চালান করার ভেতর দিয়ে কিভাবে আমাদের দেশে আগামী দিনে একটি খাদ্য সংকটের প্রেক্ষাপটে ধীরে রচিত হতে শুরু করেছে-- সে সম্পর্কেও ভারতবর্ষের মানুষদের প্রথম সচেতন করেছিলেন।
                      

জাতীয় কংগ্রেসের প্রথম স্তরের এইসব নেতৃত্ব ব্রিটিশ কিভাবে  ব্রিটেনে তৈরি জিনিসপত্র দিয়ে আমাদের দেশের বাজার   ছেয়ে ফেলছে -- সে সম্পর্কে ভারতীয়দের সচেতন করেন।ব্রিটিশের এই  নীতির  ফলে আমাদের দেশের বাজারে, আমাদের দেশের উৎপাদিত দ্রব্যাদি বিক্রির ক্ষেত্রটি  কীভাবে ক্রমশ সংকুচিত হয়ে উঠছে --সেই বিষয়টিও কিন্তু নরমপন্থী নেতারা ই  প্রথম আমাদের দেশের মানুষের সামনে তুলে ধরেন ।
                 

ভারতের কৃষি প্রধান অর্থনীতি কিভাবে ধীরে ধীরে একেবারে ব্রিটেন  নির্ভর হয়ে উঠছে এবং সেই নির্ভরতা কিভাবে আমাদের অর্থনৈতিক বুনিয়াদ কে একেবারে ঝরঝরে করে দিচ্ছে, সে সম্পর্কে ভারতবর্ষের মানুষদের সচেতন করে তোলার ক্ষেত্রে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছিল জাতীয় কংগ্রেসের প্রথম পর্যায়ের এই নেতৃত্ব ।ব্রিটিশ মূলধনের বিনিয়োগের ক্ষেত্র হিসেবে ভারতবর্ষ ক্রমশ একটা নির্দিষ্ট লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে, ভারতবর্ষের মানুষ মানব সম্পদ কি ধরনের সংকটের ভিতর ক্রমশ নিমগ্ন হতে শুরু করেছে, সে সম্পর্কে ভারতবর্ষের মানুষদের সচেতন করে, ব্রিটিশবিরোধী অর্থনৈতিক জাতীয়তাবাদী চিন্তাকে একটা সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যমাত্রায় উপনীত করবার ক্ষেত্রে এইসব নেতৃত্ব অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেন।
                   

বলাবাহুল্য এইসব প্রেক্ষাপটে কিন্তু হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত লোকজন ,তারা তখন সেভাবে সংগঠিত উদ্যোগ শুরু না করলেও, তাদের বিক্ষিপ্তভাবে যেসব সম্প্রদায়িক কর্মকান্ড দেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ছিলো ,তাদের কারো ভিতরে কিন্তু অর্থনৈতিক জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে জাতীয় কংগ্রেসের প্রথম স্তরের নেতাদের যে বক্তব্য, তাকে ঘিরে কোনো রকম চিন্তা ভাবনা আমরা দেখতে পাই না।                              

ভারতবর্ষে যে সমস্ত ব্রিটিশ নাগরিক অর্থ বিনিয়োগ করত, তারা তাদের লভ্যাংশ খুব বেশি রকম ভাবে বুঝে নিয়ে তা তাদের নিজেদের দেশে নিয়ে যেত। এইযে সম্পদের নির্গমন, যাকে দাদাভাই নৌরজি ,'ড্রেন অফ ওয়েলথ 'বলেছিলেন ,এই অর্থ চলে যাওয়ার তত্ত্বটি অর্থনৈতিক জাতীয়তাবাদের একটি অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য বিষয় হিসেবে ভারতবর্ষের জাতীয় আন্দোলনের জাতীয় চেতনার বিকাশের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।
                      

ব্রিটেনের হোম চার্জেস, যেমন ব্রিটিশ আধিকারিকদের অবসরকালীন ভাতা বেতন সহ অন্যান্য নানা রকমের ভাতা ,সামরিক খাতে খরচ, এই সমস্ত কিছুই মেটানো হতো ভারতবর্ষের মানুষদের কষ্টার্জিত টাকার বিনিময়ে।সেই টাকা ভারতবর্ষ থেকে নিয়ে এগিয়ে বৃটেনের ঘাটতি পূরণ করা হতো। এভাবেই ভারতবর্ষের টাকা বৃটেনে চালান করা হতো ।
                 

শুধু তাই ই নয় ,আমাদের দেশের রেল শিল্পে যে টাকা ব্রিটিশ লগ্নি করতো, তার উপর যে সুদের প্রতিশ্রুতি ছিল, সেই সুদের টাকার কিস্তি ও ভারতবর্ষের মানুষদের কাছ থেকে আদায় করা হতো। দেশের সম্পদের বিদেশে পাচার হওয়ার এই বিষয়টি কিন্তু জাতীয় আন্দোলনের প্রথম পর্যায়ের নেতৃত্ব অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে তুলে ধরতে পেরেছিলেন ।উনিশ শতকের  নয়ের  দশকে এই ভারতবর্ষের টাকা বিদেশে চলে যাওয়ার বিষয়টি একটি বল্গাহীন আকার ধারণ করে ।
                  

গোটা ঘটনাক্রম ভারতবর্ষের অর্থনীতিকে খুব বেশি রকম ভাবে প্রভাবিত করে। বাজেট ঘাটতি ,উচ্চতর হারে কর বৃদ্ধি, সামরিক খাতে খরচ --এই সমস্ত বিষয়ক্রম  ভারতবর্ষের মানুষের উপর ব্রিটিশের  অর্থনৈতিক শোষণ কে একেবারে বল্গাহীন করে দেয় ।অংকের হিসাব দিয়ে দাদাভাই নওরোজি দেখিয়েছিলেন ;বছরে ১২  মিলিয়ন পাউন্ড অর্থ আমাদের ভারতবর্ষ থেকে বিদেশে চালান হয় ।
                       

উইলিয়াম ডিগবি

উইলিয়াম ডিগবি এই হিসেব আরো সংশোধিত করে বলেছিলেন; এই চালান হওয়া অর্থের পরিমাণ বছরে প্রায় ৩০ মিলিয়ন পাউন্ড। ব্রিটিশ ভারতীয় সরকারের মোট রাজস্বের প্রায় অর্ধেক টাকা ই ব্রিটিশ তাদের নিজেদের দেশে নিয়ে চলে যেত ।এই ঘটনা ভারতবর্ষের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি কে এক ভয়াবহ সংকটের সামনে এনে দাড় করিয়ে দেয় ।ভারতবর্ষে মূলধন তৈরি প্রক্রিয়াটিকে বিঘ্নিত করে দেয় ।ব্রিটিশ তাদের অর্থনৈতিক স্বার্থে, বাণিজ্যিক স্বার্থে ,সর্বোপরি সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থে ,ভূমি রাজস্বের হার একটা ভয়াবহ আকারে  ঠেলে দেয়।
                  

ফলে জমি বেহাত হয়ে যাওয়া শুরু হয় ।এর প্রভাব ভয়াবহ আকারে পরে ভারতবর্ষের কৃষি ক্ষেত্রে এবং কৃষক সমাজের উপর পড়তে শুরু করে।কৃষক সমাজ ক্রমশ নিঃস্ব হয়ে যেতে শুরু করে। ব্রিটিশ যে সমস্ত শিল্পদ্রব্য তৈরি করত, সেগুলোর  স্বার্থে কোনো রকম আমদানি শুল্ক বা মাশুল সেগুলির উপরে কিন্তু বসায় নি কখনো।              

এর ফলে সেগুলি ভারতবর্ষের বাজারে এসে ভারতবর্ষের বাজারকে যে ভাবে দখল করতে শুরু করে, তার ফলশ্রুতিতে  আমাদের দেশের শিল্পায়ন একটা ভয়াবহ সংকটের সামনে এসে দাঁড়ায় ।আমাদের দেশের দারিদ্র ক্রমশ বাড়তেই থাকে ।ভারতবর্ষের আর্থিক দুর্দশার এই চক্রবৃদ্ধি হারে বৃদ্ধি জনিত বিষয়টি একদিকে যেমন আমাদের দেশের অর্থনৈতিক সংকট কে দৃঢ় করে, তেমনি ব্রিটিশবিরোধী মানসিকতা, সমাজের প্রায় সর্বস্তরের মানুষদের মধ্যে সঞ্চারিত করবার ক্ষেত্রেই পর্যায়ক্রম বিশেষ রকম ভাবে সহায়ক হয়েছিল। এই পর্যায় টিকে  প্রতি টি সাধারণ মানুষের কাছে তুলে ধরার ক্ষেত্রে জাতীয় কংগ্রেসের প্রথম যুগের নরমপন্থী নেতৃত্বে অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছিলেন।                  

দুর্ভাগ্যের বিষয় এই গোটা পর্যায়ক্রম সম্পর্কে কিন্তু হিন্দুত্ববাদী নেতৃত্ব, আরএসএস যারা পরবর্তীকালে তৈরি করে, তারা কোনোদিন কোনো রকম ভাবে একটি শব্দ ও উচ্চারণ করে নি। ব্রিটিশের  ভারতের অর্থনৈতিক শোষণ সম্পর্কে তাদের এই নীরবতাই , ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শক্তির  প্রতি তাদের অচলা ভক্তি একটি সুনির্দিষ্ট উদাহরণ।

ধারাবাহিক লেখাগুলি পড়তে ক্লিক করুনঃ www.cpimwb.org.in

ভারতের জাতীয় আন্দোলন ও আর এস এস – (পর্ব – ১১)

ভারতের জাতীয় আন্দোলন ও আর এস এস – (পর্ব – ১০)

ভারতের জাতীয় আন্দোলন ও আর এস এস – (পর্ব- ৯)

ভারতের জাতীয় আন্দোলন ও আর এস এস – (অষ্টম পর্ব)

ভারতের জাতীয় আন্দোলন ও আর এস এস – (সপ্তম পর্ব)

ভারতের জাতীয় আন্দোলন ও আর এস এস – (ষষ্ঠ পর্ব)

ভারতের জাতীয় আন্দোলন ও আর এস এস – (পঞ্চম পর্ব)

ভারতের জাতীয় আন্দোলন ও আর এস এস – (চতুর্থ পর্ব)

ভারতের জাতীয় আন্দোলন ও আর এস এস – (তৃতীয় পর্ব)

ভারতের জাতীয় আন্দোলন ও আর এস এস – (দ্বিতীয় পর্ব)

ভারতের জাতীয় আন্দোলন ও আর এস এস – (প্রথম পর্ব)


শেয়ার করুন

উত্তর দিন