Site icon CPI(M)

Ideology Series (Part I): Essence of Historical Materialism

Idology Series 1

প্রাককথন

ইতিহাসকে বিবেচনা ও পর্যালোচনার বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গির প্রসঙ্গে কার্ল মার্কসের যাবতীয় রচনার অন্যতম একটি হল রাজনৈতিক অর্থশাস্ত্রের সমালোচনা প্রসঙ্গে, ইংরেজিতে ‘আ কনট্রিবিউশন ট্যু দ্য ক্রিটিক অফ পলিটিক্যাল ইকোনমি’। ক্যাপিটাল রচনায় ব্যস্ত হওয়ার আগে অবধি পুঁজিবাদী অর্থশাস্ত্র প্রসঙ্গে মার্কসের মৌলিক চিন্তাভাবনা (যাকে তৎকালীন সাহিত্যরীতি অনুসারে ক্রিটিক বলাই ছিল দস্তুর) এই বইতেই পাওয়া যায়। ততদিনে সংশ্লিষ্ট প্রসঙ্গে নিজের বিপুল আকারের পড়াশোনাকে নোটের আকারে অনেকটাই সাজিয়ে ফেলেছেন, তারই নাম ‘গ্রুন্ডরিসে’। ১৮৫৭ নাগাদ গ্রুন্ডরিসের কাজ শেষ হয়ে যায়। এর পরে মার্কস মনোযোগী হন পুঁজিবাদী ধনবিজ্ঞান প্রসঙ্গে নিজের বক্তব্যকে বিস্তারিত আকারে প্রকাশ করায়। যদিও সেই কাজ সম্পূর্ণ করতে পারেননি। ক্যাপিটাল লেখার সম্পর্কে মার্কসের প্রাথমিক পরিকল্পনা ছিল ৬খন্ডের ব্যাপক কলেবরে কাজটি শেষ করার। নিদারুণ আর্থিক অনটন, একের পর এক গুরুতর রোগাক্রান্ত হতে হতে রীতিমত স্বাস্থ্যহানী পরিকল্পনামতো কিছুতেই কাজটি সম্পন্ন হতে দেয়নি। যদিও প্রথম খণ্ডের প্রাথমিক অধ্যায়ে তিনি যা কিছু লিখতে চেয়েছিলেন সেটুকু ১৯৫৯ সাল নাগাদই শেষ করে ফেলেছিলেন। ‘আ কনট্রিবিউশন ট্যু দ্য ক্রিটিক অফ পলিটিক্যাল ইকোনমি’- নামে আমরা যে বইটিকে চিনি তা আসলে মার্কসের লেখা সেই প্রাথমিক অধ্যায়। ১৮৫৮ সালের আগস্ট মাস থেকে শুরু করে ১৮৫৯ সালের জানুয়ারি- এই ছিল এর রচনাকাল।

তারই মুখবন্ধের একটি অংশবিশেষ আজকের প্রতিবেদন। ইতিহাসের বস্তুবাদী ধারণার মর্মবস্তু বা শাঁস যাই বলা যাক না কেন এতেই সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। ধনতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থা প্রসঙ্গে বিরাট আকারের (৬খন্ড) পরিকল্পনাটি পরবর্তীকালে মার্কস নিজেই খারিজ করেন। তাঁরই নতুন পরিকল্পনার ফলশ্রুতিতে তিন খণ্ডের ‘ক্যাপিটাল’ গ্রন্থটি লেখা হয়। এই কারণেই পড়তে বসে ক্যাপিটালের প্রথম খন্ডটি (দ্য প্রসেস অফ প্রোডাকশন অফ ক্যাপিটাল) অনেকসময়েই ‘আ কনট্রিবিউশন ট্যু দ্য ক্রিটিক অফ পলিটিক্যাল ইকোনমি’-র সাথে খানিকটা গুলিয়ে যায়, দুটি রচনার মূল ভাবনায় বেশ কিছুটা মিল ছিল বলেই এমনটি ঘটে।

১৯৮৩ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রগতি প্রকাশনের পক্ষ থেকে বইটির প্রথম বাংলা অনুবাদ প্রকাশিত হয়, অনুবাদক ছিলেন প্রফুল্ল রায়। বাংলায় ভাষান্তরের কাজে মরিস ডব সম্পাদিত ইংরেজি অনুবাদটিকেই মূল হিসাবে ব্যবহার করা হয়। রায়ের বঙ্গানুবাদে বইয়ের শিরোনাম ছিল ‘অর্থশাস্ত্র বিচার প্রসঙ্গে’।   

রাজ্য ওয়েবডেস্কের তরফে ‘মতাদর্শ সিরিজ’ প্রকাশের সময় সেই অনুবাদটি ব্যবহার করা হয়নি, তবু উপরের তথ্যটি জানিয়ে রাখা জরুরী, নাহলে ইতিহাসের বিকৃতি ঘটার সম্ভাবনা রয়ে যায়। ১৯৬৮ সালে মস্কো থেকে প্রকাশিত মার্কস-এঙ্গেলস নির্বাচিত রচনাবলীটিই (ওয়ান ভল্যুম এডিশন) আমাদের অনুবাদের ভিত্তি।

Karl Marx Monument in Chemnitz – Saxony, Germany

কার্ল মার্কস

সামাজিক উৎপাদন প্রক্রিয়ার কারণেই মানুষ এমন কিছু সুনির্দিষ্ট সামাজিক সম্পর্কে উপনীত হয় যা একদিকে অপরিহার্য আরেকদিকে তাদের নিজস্ব ইচ্ছানিরপেক্ষ। এরই নাম উৎপাদন সম্পর্ক। বিষয়টি ইতিহাসের নির্দিষ্ট পর্যায় নিরপেক্ষরূপে অনড় অটল হিসাবে আদৌ টিকে থাকে না। একেক যুগের বস্তুগত উৎপাদিকা শক্তির ক্রমবিকাশের সাথে সম্পর্কযুক্ত হয়েই উৎপাদন সম্পর্কেরও বিকাশ ঘটতে থাকে। ইতিহাসের যেকোনো একটি নির্দিষ্ট পর্বে বিদ্যমান যাবতীয় উৎপাদন সম্পর্কের সম্মিলিত চেহারাটিই সেই যুগের অর্থনৈতিক কাঠামো। যেকোনো সামাজিক ব্যবস্থার এটাই হল মূল ভিত্তি। এই ভিত্তির উপরে নির্ভর করেই গড়ে ওঠে সংশ্লিষ্ট সামাজিক বন্দোবস্তের উপরিসৌধ বা উপরিকাঠামো সমূহ। আইন-কানুন, রাজনৈতিক ব্যবস্থা যাবতীয় কিছুই আসলে ক্রমবিকাশমান ইতিহাসের একটি নির্দিষ্ট পর্বে সামাজিক মানুষের সম্মিলিত চেতনারই সুনির্দিষ্ট বহিঃপ্রকাশমাত্র। সামাজিক, রাজনৈতিক ও বৌদ্ধিক জীবন বলতে যা কিছু বোঝানো হয় সে সবই আসলে ঐ নির্দিষ্ট যুগে বিদ্যমান উৎপাদন প্রক্রিয়ার নির্দিষ্ট রূপকে ভিত্তি করে নির্মিত হয়। উৎপাদন প্রক্রিয়ার যাবতীয় সীমাবদ্ধতার দ্বারা শর্তাধীন থেকেই সংশ্লিষ্ট যুগের যাবতীয় উপরিকাঠামোগুলি টিকে থাকে। ইতিহাসের প্রত্যেক পর্বে মানুষের বস্তুগত অবস্থাটি তাদের নিজস্ব চেতনার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় না, বরং উল্টোটিই সত্য। একেকটি যুগের সুনির্দিষ্ট বস্তুগত বাস্তবতাই সমসাময়িক মানবসমাজের সাধারণ চেতনাকে নিয়ন্ত্রণ করে। ক্রমবিকাশের কারণে বিদ্যমান সমাজের নিজস্ব উৎপাদিকা শক্তি সমাজবিকাশের সুনির্দিষ্ট পর্যায়ে এমন চেহারায় পৌঁছায় যখন আর পুরানো কায়দার উৎপাদন সম্পর্ক তার সাথে সুসামঞ্জস্য বজায় রাখতে পারে না। তখনই বিকশিত উৎপাদিকা শক্তির সাথে বিদ্যমান উৎপাদন সম্পর্কের দ্বন্দ্ব বাঁধে। ইতিহাসের একেকটি পর্বে সম্পত্তির অধিকার সম্পর্কে আইনানুগ বন্দোবস্তটি যে কায়দায় বদলাতে থাকে ঐ সামাজিক টানাপোড়েনকে উপলব্ধি করতে সেটিই হল কার্যত ঐ দ্বন্দ্বের আইনি প্রতিচ্ছবি। এতদিন যে সমস্ত আইন-কানুন বিদ্যমান সামাজিক সম্পর্ক অনুসারে স্বাভাবিক ন্যায়ের প্রতিবিম্ব ছিল এবারে উৎপাদিকা শক্তির বিকশিত চেহারার ধাক্কায় সেসবই হয়ে ওঠে অকেজো, সামনে এগোনোর পথে পায়ের বেড়ি বিশেষ। যতবার এমনটা ঘটে, ইতিহাসের সেই সকল মুহূর্তেই সমাজবিপ্লবের সুত্রপাত হয়। বুনিয়াদী কাঠামো হিসাবে অর্থনৈতিক ভিত্তির বদল ঘটলে বিদ্যমান সমাজব্যবস্থার যাবতীয় উপরিকাঠামোকেও অ্যাজ হোক বা কাল বদলাতেই হয়। এহেন সামাজিক রূপান্তরকে সঠিকভাবে উপলব্ধি করতে হলে বুনিয়াদী অর্থনৈতিক কাঠামোর বদলের সাথে উপরিকাঠামোগুলির বদলানোকে (বিদ্যমান সামাজিক আইন-কানুন, রাজনৈতিক ব্যবস্থা, ধর্মীয় রুচি-সংস্কৃতি-অভ্যাসসমূহ, শিল্পসাহিত্য, দার্শনিক ও বৌদ্ধিক কর্মকান্ডের সাধারণ পরিসর ইত্যাদি) কিছুতেই একই কায়দায় বিবেচনা করা চলে না, এ দুটিকে পর্যালোচনার সময় সর্বদা ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি বজায় রেখে এগোতে হয়। অর্থনৈতিক ভিত্তির বদল ঘটে প্রকৃতিবিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখার ন্যায় নিখুঁত ওঠা-নামার হিসাব মেনে। উপরিকাঠামোর বেলায় অমন গণিত আদৌ কাজে আসে না। অন্যভাবে বলা যায়, সামাজিক মানুষের সম্মিলিত চেতনা কোনও একটি নির্দিষ্ট ঐতিহাসিক পর্বে যে চেহারায় থাকে ক্রমবিকাশমান উৎপাদিকা শক্তির সাথে তাল মিলিয়ে একসময় মানুষকে সেই চেতনার বিরুদ্ধেই সংগ্রাম চালাতে হয়। কোনও এক ব্যক্তি নিজের সম্পর্কে কি মতামত পোষণ করে তার উপরে ভিত্তি করে যেমন তার সামাজিক পরিচিতি বিবেচিত হয় না তেমনই ইতিহাসের কোনও নির্দিষ্ট পর্বে সংগঠিত সামাজিক রূপান্তরকে সংশ্লিষ্ট যুগের গড়পড়তা চৈতন্য হতে উৎসারিত সামাজিক কর্মকাণ্ডের ফলাফল হিসাবে বিবেচনা করা চলে না। সমাজ বদলে যে চৈতন্য প্রকৃত ভূমিকা পালন করে তাকে উপলব্ধি করতে হয় তৎকালীন সমাজজীবনের বস্তুগত দ্বন্দ্বের পরিসরে- অর্থাৎ উৎপাদিকা শক্তির সাথে উৎপাদন সম্পর্কের দ্বন্দ্বের ফলাফল হিসাবে। প্রতিটি সামাজিক রীতিনীতি ততদিন অবধি টিকে থাকে যতদিন না তাকে উচ্ছেদের জন্য, বাতিলের জন্য বিদ্যমান উৎপাদিকা শক্তির জরুরী বিকাশটুকু ঘটছে। একইভাবে বলা যায়, বিদ্যমান সমাজব্যবস্থার গর্ভে নতুন সামাজিক সম্পর্কের বস্তুগত শর্তসমূহের ভ্রূণসঞ্চার ও যথেষ্ট বিকাশ না হওয়া অবধি পুরানো উৎপাদন সম্পর্কগুলিকে বাতিল করে নতুন ও উন্নততর সামাজিক সম্পর্কসমূহ কার্যকরী হবে না। এই কারণেই সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার পথে মানবসমাজ এমনসব কর্তব্যই চিহ্নিত করে যাকিছু উপযুক্ত কায়দায় সম্পন্ন করার জন্য প্রয়োজনীয় যোগ্যতাটুকু তারা ইতিমধ্যেই অর্জন করেছে। অল্পবিস্তর গভীর পর্যালোচনাতেই এমন ঘটার কারণটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। যেকোনো সামাজিক সমস্যা ততদিন অবধি উপলব্ধি করা যায় না যতদিন না ঐ সমস্যা সমাধানের জন্য প্রয়োজনীয় বস্তুগত শর্তগুলি আবিষ্কৃত হয়েছে অথবা সে পথে এগোনোটুকু অন্তত শুরু হয়েছে। এই দৃষ্টিভঙ্গিকে দুনিয়াজুড়ে প্রশস্ত করলেই বোঝা যায় এযাবৎ কাল অবধি মানবসমাজের ইতিহাসে এশিয়াটিক, আদিম (অ্যানসিয়েন্ট), সামন্ত (ফিউডাল) ও আধুনিক বুর্জোয়া অবধি উৎপাদনের প্রক্রিয়া হিসাবে যে বিভিন্ন অর্থনৈতিক বন্দোবস্তসমূহের কথা জানা গেছে তারা সকলেই ইতিহাসের একেক পর্যায়ে সমাজের নতুন অর্থনৈতিক কাঠামো নির্মাণে প্রগতিশীল ভূমিকাই পালন করেছিল। উৎপাদিকা শক্তির ক্রমবিকাশের ধারায় গড়ে ওঠা বুর্জোয়া উৎপাদন সম্পর্কই হল সেই পর্যায় যখন সামাজিক ব্যবস্থার অন্তর্নিহিত ঐতিহাসিক দ্বন্দ্বের অবসান ঘটবে। এখানে দ্বন্দ্ব বলতে মানবসমাজে একের সাথে অন্যের যাবতীয় ব্যক্তিগত বৈরিতাকে বুঝলে চলবে না। বুর্জোয়া ব্যবস্থা যে কায়দায় একক ব্যক্তির সামাজিক অস্তিত্বকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রাখে তার থেকে মুক্ত হতে ইতিহাস নির্ধারিত সংঘাতই হল ঐ দ্বন্দ্ব। এই সংঘাতের পাশপাশি বুর্জোয়া সমাজের গর্ভেই বিকশিত হতে থাকবে নতুন উৎপাদিকা শক্তি যা সেই দ্বন্দ্বের অবসানের জন্য বস্তুগত ক্ষেত্রটিকে সাজিয়ে তুলবে। এ যুদ্ধের অবসানের সাথেই মানবসমাজ এক নতুন পরিস্থিতির সম্মুখীন হবে, প্রাক-ইতিহাস পর্ব শেষ হওয়ার পরে যেমনটা ঘটেছিল।  

প্রাককথন ও অনুবাদ – সৌভিক ঘোষ

শেয়ার করুন