"আমার সকল দুখের প্রদীপ জ্বেলে দিবস গেলে করব নিবেদন-- আমার ব্যথার পূজা হয় নি সমাপন।"
অনেক ব্যাথা-বেদনা চেপে ধরে আছে এই দেশের মানুষ। মুক্তি কোথায়? দিনমজুরের কাজ নেই। রিকশা চালকের চাকা ঘোরেনা সপ্তাহ দুই। চটকলের ভাগা শ্রমিক দাওয়ায় বসে বিড়ি টানছে। মুটেমজুর মাথায় বোঝা তোলেনা ১২দিন। চায়ের দোকান বন্ধ রাখতে হয়েছে। রান্নাঘরে বাড়ন্ত চাল। বেসরকারি সংস্থার কর্মীদের বেতন হয়নি, মাসের প্রথম সপ্তাহ পেরিয়ে গেলেও।
কি করবেন এরা? দেশের সরকার হাত গুটিয়ে নিয়েছে। একদিকে সংক্রমণের ভয়, অন্যদিকে ট্যাঁকের টান। দিশেহারা অসহায় মানুষ যা পাচ্ছে আঁকড়ে ধরছে। জানে লাভ নেই, তাও ঈশ্বর-আল্লাহ ই ভরসা। জ্বালাও প্রদীপ-বাজাও ঘন্টা - যদি কিছু হয়।
"ধর্ম নিপীড়িত মানুষের দীর্ঘশ্বাস, হৃদয়হীন বিশ্বের হৃদয় এবং প্রাণহীন অবস্থার প্রাণ। আফিমের মতো।" আফিমে যেমন সাময়িকভাবে যন্ত্রণার অবসান হয়, তেমনই সর্বশক্তিমান যন্ত্রণার কারণ দূর করতে পারেন না, কিন্তু সাময়িকভাবে মানসিক যন্ত্রণার রিলিফ দেন।
মানুষ যখন বিপদে পড়ে, কোনও আশার আলো দেখতে পায় না, তখন নিপীড়িতের দীর্ঘশ্বাস আছড়ে পড়ে ধর্মস্থানে, স্বান্ত্বনা খোঁজে।
যারা কাঁসর বাজালেন, প্রদীপ বা মোমবাতি জ্বালালেন তাঁরা সবাই সংঘবাহিনীর ভক্ত নয়। এই ভুল যেন আমরা কেউ না করি। রোজগার নেই - এটা সংক্রমণের আতঙ্কের চাইতেও বেশী। চাল নেই, খিদের জ্বালায় ক্রন্দনরত বাচ্চার আওয়াজ ধামাচাপা দেওয়ার জন্য আপাতত কাঁসর ঘন্টা বা বাজীর আওয়াজই সম্বল।
কিন্তু ঐ ৯ মিনিটের হৈচৈ, ব্যাস! তারপর? সেই ঘরে ফেরা,
"সেই সব- সেই সব - সেই হাহাকার বেদনা/ সেই অশ্রুধারা, হৃদয় বেদনা।"
তাই এরা সবাই মোদিজির পেছনে আজন্মকাল ছুটবে মনে করার কোনও কারণ নেই।
আর মোদিজির কাছেই বা রাস্তা কি! লাখ লাখ লোকের কাজ নেই, মানুষের হাঁড়িতে চাল নেই, ৫কোটি সবহারা পরিযায়ী মজুরের দল রাস্তায় ঘুরছে, সঞ্চয়ের সুদ কমছে, জিনিসপত্রের দাম আকাশের পানে ছুটছে। অন্যদিকে সংক্রমণে আক্রান্তদের চিকিৎসা কি আছে এখনো কেউ জানে না। যে চিকিৎসক- স্বাস্থ্যকর্মীরা জীবন বাজী রেখে লড়ছেন - তাঁদের সুরক্ষার পোশাক নেই। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশিকা মেনে মাত্র ৪ ঘন্টার নোটিশে দেশের মানুষকে ঘরবন্দী করে দিয়েছে সরকার, কিন্তু দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ কাজ, রোগ নির্ণয় করার জন্য ব্যাপকভাবে পরীক্ষার কোনও ব্যবস্থা বা উদ্যোগও নেই। রাস্তায় আটকে ৫কোটি সবহারা পরিযায়ী মজুরের দল। খাবার নেই, ওষুধ নেই - খোলা আকাশই ছাদ।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশিকা উপেক্ষা করে ১৩ দিনে ১৬লক্ষ বিত্তবান মানুষকে বিনা নজরদারিতে দেশে অবাধে ঘুরতে দেওয়ার অপরাধে অপরাধী মোদিজি। এইসব থেকে চোখ ঘোরানোর জন্য নিজামুদ্দিন-কাঁসর ঘন্টা-মোমবাতি হাতে ধরানোর কোনও বিকল্প আপাতত মোদি সরকারের কাছে নেই। তাই অসহায় মানুষের ধর্মীয় ভাবাবেগে সুড়সুড়ি দেওয়ার পুরনো কায়দা। সঙ্কটের বিহ্বলতায় এক অংশের মানুষ শক্তির আরাধনায় সাড়া দেবেন - এটা জেনেই ঘন্টা-প্রদীপ বাজারে নামিয়েছে RSS।
অনেক মোদি বিরোধীর বাড়িতে প্রজ্জ্বলিত প্রদীপ দেখে আমিও উদ্বিগ্ন হয়েছিলাম। কিন্তু মনে পড়ে গেল মার্কস সাহেবের লেখা, A contribution to the critique of Helgel's Philosophy of Right - এটাতো 'ধর্ম - নিপীড়িত মানুষের দীর্ঘশ্বাস, হৃদয়হীন বিশ্বের হৃদয় এবং প্রাণহীন অবস্থার প্রাণ।'
গল্পটা এই দীর্ঘশ্বাসে কিন্তু শেষ হয় না। করোনার আক্রমণ প্রতিহত ক'রে যে ভারতবাসী বেঁচে থাকবে তাদের প্রায় ১৪ কোটি কাজ হারাবে বলে অনুমান করছেন অর্থনীতির বিশেষজ্ঞরা। দিশেহারা অর্থনীতি ধনীদের মুনাফার হার ধরে রাখতে চাপাবে নতুন নতুন কর/সেস। যেমন এই করোনা সঙ্কটের মাঝেই বেড়েছে পেট্রোপণ্যের উপর কর আর কমেছে স্বল্প সঞ্চয়ে সুদের হার। কাঁসর ঘন্টা বাজিয়ে তখন মজা লোটার মন-মানসিকতা থাকবে না কাজ হারানো, খিদের যন্ত্রণায় নীল হয়ে যাওয়া মানুষের। রুখে দাঁড়াবেই মানুষ।
তাই এখন আমরা যেমন সীমিত সাধ্য নিয়ে রাজনীতি বা ধর্মের রঙ বিচার না করেই মানুষের পাশে সীমিত সাধ্যের সহযোগিতার ডালি নিয়ে যাচ্ছি, তেমনই যাবো, আর সাথে ঐ লড়াইটার প্রস্তুতি চলুক।
(২)
রাজ্যের অবস্থা তথৈবচ। মুখ্যমন্ত্রী টিভির পর্দায় ভাষন দিচ্ছেন, আর মানুষ রেশন দোকানের সামনে ভীড় জমাচ্ছে। চাল আছে তো গম নেই চিনি নেই আটা নেই। ডিলার বলে পাইনি তো দেব কি করে! এদিকে মুখ্যমন্ত্রী আর টিভির সঞ্চালক বলছেন সব ঠিক হ্যায়। গলা নামিয়ে ফিসফিস করে ডিলার বলছে, মালের ২৫% দিদির ভাইদের দিতে হচ্ছে, করবো কি? কোথায় কার্ডহীনদের রেশনের স্লিপ? লক ডাউনের পর ১৩ দিন কেটে গেল। কাজও নেই খাবারও নেই। RSK 2 এর কার্ডে ৯টাকা গম, ১৩ টাকা চাল। ঘরবন্দী কাজ হারানো মানুষের রোজগার আছে, যে পয়সা দিয়ে কিনবে? আত্মপ্রচারের আনন্দে বিভোর মুখ্যমন্ত্রীকে কে বোঝাবে? কে বোঝাবে বিজ্ঞাপনের অর্থের কাছে আত্মসমর্পণ করাটাই সংবাদমাধ্যমের মালিকের একমাত্র কাজ নয়, সামাজিক দায়বদ্ধতাও থাকতে হয়। শুধুই মুনাফার ব্যবসা করতে চাইলে এই ব্যবসা ছেড়ে চিঁটে গুড় বা লোহার ছাঁটের ব্যবসা করুন। মুনাফা ছাড়া আর কারুর কাছে কোনো দায়বদ্ধতা থাকবে না।
রাজ্যের মানুষ বুঝতেই পারছে না কতজন করোনা সংক্রামিত মানুষ আছেন এই রাজ্যে। দুঃখজনকভাবে মৃত্যুই বা হচ্ছে কতজনের। থার্মোমিটারের পারদের মত মৃত মানুষের সংখ্যা উঠছে নামছে। একি 'হযবরল' এর বুড়োর গুণতি! ৪০ এর পর আর বাড়ে না, তারপর কমতির দিকে!! সরকার চলছে নাকি ফাজলামি হচ্ছে? মৃত্যুর কারণ এই রাজ্যে ডাক্তার বলতে পারবে না, বলবে আমলা! বাহ!
রাজ্যের ৪/৫ লক্ষ মানুষ অন্য রাজ্যে আটকে। শুধু চিঠি আর প্রেস কনফারেন্স? ব্যাস?পঞ্চায়েত/পৌরসভা থেকে তালিকা সংগ্রহ করে, রাজ্যের শ্রম দপ্তরের সচিব অন্য রাজ্যের সরকারগুলোর সাথে কথা বলতে পারেন না? আপনার সরকার বলতে পারে না, এরা আমার রাজ্যের মানুষ, এদের খাবার-বাসস্থানের ব্যবস্থা করুন। আপনারা অর্থ না দিতে পারলে পশ্চিম বাংলার সরকার সেই অর্থ দিয়ে দেবে। খুব কঠিন কাজ? এই বাজারে গতকাল সোনারপুর থানার পুলিশ ক্লাব ডেকে টাকা বিলিয়েছে। ক্লাবগুলোকে এই বাজারেও টাকা দিতে পারেন, আর বিনা পয়সায় রাজ্যের ৫কোটি মানুষকে খাওয়াতে পারেন না!
ঘরে থাকুন সবাই, আমার সরকার খাবার পৌঁছে দেবে, ওষুধের আকাল দূর করবে - এই বাণী নয়, এই কাজ দেখতে চায় মানুষ। টিভির পর্দায় আপনার মুখ দেখে দেখে ক্লান্ত মানুষ একটু খেয়ে পড়ে বাঁচতে চায়। নিশ্চিত হতে চায় তার পাড়ায় কেউ আক্রান্ত হলে তা যেন চিহ্নিত হয়, গোপনে যেন না থাকে। উপসর্গ থাকলে, পাড়ার ডাক্তার বাবু বললেই যেন বিনা অর্থে তার নিজের জেলাতেই করোনা নির্ণয় করার পরীক্ষা করা যায়। আর জীবন বাজী রেখে কাজ করছেন যে চিকিৎসক-স্বাস্থ্য কর্মীরা তাদের সুরক্ষার পোশাক দিন, যাতে তাঁরা প্রাণ ঢেলে নিশ্চিন্তে নিরাপদে কাজ করতে পারেন। রাজ্যে কিন্তু ২০০ র বেশী ডাক্তার কোয়ারেন্টাইনে চলে গেছেন। সাধারণ স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রাণের দাম কম, তাই কেউ ওদের হিসাব রাখে না।
এবিপি'র বিজ্ঞাপনী ভাষায় আপনি তো 'জগত জননী মা'। বিনা অর্থে একটু খাবার, ওষুধের যোগান, বন্ধ থাকা বেসরকারি অফিস- কারখানার শ্রমিক-কর্মচারীদের দের মজুরিদানের নির্দেশনামা, দিনমজুরদের বেঁচে থাকার জন্য কিছু অর্থ, ভিন রাজ্যে আটকে পড়া সবহারাদের সুলুক সন্ধান করে মাথা গোঁজার ঠাই আর পেটে দুটো দানা-পানির ব্যবস্থা - আপাতত এইটুকুই হোক।
'কে লইবে মোর কার্য, কহে সন্ধ্যারবি / শুনিয়া জগৎ রহে নিরুত্তর ছবি।/ মাটির প্রদীপ ছিল; সে কহিল স্বামী, / আমার যেটুকু সাধ্য করিব তা আমি।'
এই কাজে আমরা বামপন্থীরাও সাধ্যাতীতভাবেই আছি ও থাকবো।
শেয়ার করুন