RSS Cover 2

রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ: মতাদর্শের স্বরূপ (২য় পর্ব)

অর্ণব রায়, বাবিন ঘোষ

গান্ধী হত্যা এবং নিষিদ্ধ সময়

দেশভাগ পরবর্তী সময়ে সংঘ অনুকূল পরিবেশ পায় তার হিন্দুত্ববাদের রাজনীতিকে ছড়িয়ে। দিতে। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার কারণে বাস্তচ্যুত মানুষের মধ্যে একে অপরের ধর্মের প্রতি বিদ্বেষ জাগিয়ে তোলার প্রকৃষ্ট আবহ তৈরি হয় ১৯৪৬-৪৭ সালে। তীব্র সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের যে পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হয়,  হিন্দুত্ববাদের প্রচারে গান্ধীকে যেভাবে দেশভাগের কারিগর হিসেবে দেখানো হয় তারই ফলশ্রুতিতে ঘটে গান্ধী হত্যা। সংঘ এবং হিন্দু মহাসভার সাথে গান্ধী হত্যাকারী নাথুরাম গডসের সম্পর্ক তার নিজের লেখাতেই পাওয়া যায়। ১৯৩০ সালে সংঘে যোগদান করে গডসে অতি দ্রুত 'বৌদ্ধিক প্রচারক' এর পদ পায়। সেই সময় যেহেতু রাজনীতিতে সরাসরি অংশগ্রহণকারী একমাত্র হিন্দুত্ববাদী সংগঠন ছিল হিন্দু মহাসভা তাই গডসে পরবর্তীকালে ১৯৪৪ সালে তাতে যোগ দেয়। সংঘ থেকে হিন্দু মহাসভায় যোগ দেওয়ার কারণ গডসের স্বরচিত গ্রন্থ "Why I assassinated Mahatma Gandhi"-তে লিপিবদ্ধ রয়েছে। গডসে তার লেখায় দেশভাগের জন্য গান্ধীকেই সরাসরি দায়ী করে। তার মতে গান্ধীর নেতৃত্বাধীন জাতীয় কংগ্রেসের দ্বারা পরিচালিত বিভিন্ন প্রাদেশিক সরকারের 'মুসলমান-তোষণ' নীতির ফলেই মুসলীম লিগের মতো বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তির বৃদ্ধি ঘটে। গান্ধী হত্যার পর সংঘ গডসের সঙ্গে তাদের সম্পর্ককে অস্বীকার করে। গডসের নিজের লেখা থেকে এবং ১৯৯৪ সালের ফ্রন্টলাইন পত্রিকায় তার ভাই গোপাল গডসের দেওয়া সাক্ষাৎকারে অবশ্য এই সম্পর্কের বহু অকাট্য প্রমাণ মেলে। ১৯৬৮ সালে সংঘের ইংরেজি মুখপত্র 'অর্গানাইজার'-র তদানীন্তন সম্পাদক কেবলরাম রতনমল মালকানি তার ১১ই জানুয়ারি ১৯৭০-এর সম্পাদকীয়তে লেখেন যে গান্ধী অনশন করেছিলেন নেহরুর দেশভাগের সিদ্ধান্তের সমর্থনে এবং সেই কারণেই তিনি জনতার ক্ষোভের শিকার হন। ১৯৬১ সালে বিজেপির পূর্বসুরি ভারতীয় জনসংঘের তৎকালীন জাতীয় সম্পাদক দীনদয়াল উপাধ্যায় মন্তব্য করেছিলেন যে গান্ধীকে জাতির জনক বলা অর্থহীন কারণ তার মতে ভারতীয় জাতীয়তাবাদের প্রাচীন ইতিহাস থেকে বোঝা যায় যে তা আদতে হিন্দু ধর্ম। গান্ধী সম্বন্ধে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ এবং ভারতীয় জনসংঘের এহেন মতামত জানা জরুরি যখন বর্তমানে বিজেপি নেতৃত্বাধীন সরকারের দ্বারা গান্ধীর নাম এবং ছবি বহুলভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এই বাহুল্য'র সূত্রপাত বিগত বাজপেয়ী সরকারের জমানায়, নিতান্তই নির্বাচনী স্বার্থে। এ কথা মনে রাখা জরুরি যে গান্ধীহত্যা একা নাথুরাম গডসের ব্যক্তিগত বিদ্বেষপ্রসূত ছিল না। সাম্রাজ্যবাদবিরোধী জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের যে ব্যাকরণ গান্ধী নির্মাণ করেন, যাকে 'গান্ধীবাদ' বলা হয়ে থাকে, তার অন্যতম ভিত্তি হল হিন্দু-মুসলমানের সহাবস্থান। পরবর্তীকালে নেহরুর নেতৃত্বাধীন সরকার এবং কংগ্রেস দল গান্ধীবাদের ঐ বৈশিষ্ট্যকে (বিবিধ সময়ে বিচ্যুতি সত্ত্বেও) মোটামুটি অনুসরণ করে চলে। হিন্দুত্ববাদের মূল রাজনৈতিক মতবাদ যে দ্বিজাতিতত্ত্ব, তা গান্ধীবাদের পরিপন্থী। ভারতীয় জাতীয়তাবাদের উপর হিন্দুত্ববাদের প্রথম প্রত্যক্ষ আঘাত ঘটে গান্ধী হত্যার মাধ্যমে।

১৯৪৮ এ গান্ধী হত্যার পর সংঘকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। লিখিত সংবিধান এবং সামাজিক / সাংস্কৃতিক পরিধির মধ্যে নিজেদের কর্মকান্ড আবদ্ধ রাখার শর্তে এক বছরের মধ্যেই সংঘের উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয় সরকার। নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার পরে সংঘের নেতৃত্ব উপলব্ধি করে যে  গান্ধী হত্যার পর তাদের পক্ষে জনসমর্থন আর নেই। নিষিদ্ধ থাকার সময় সঙ্ঘ এও বুঝতে পারে যে অন্য কোনো রাজনৈতিক দল তাদের প্রতি সহমর্মিতা দেখাতে রাজি নয়। তাদের প্রয়োজন হয় একটি বিশুদ্ধ হিন্দুত্ববাদী রাজনৈতিক সংগঠনের। এই পটভূমিতেই জন্ম হয় ভারতীয় জনসংঘের, যা পরবর্তীকালে ভারতীয় জনতা পার্টিতে রূপান্তরিত হয়। জনসংঘ স্থাপনের পর জরুরি অবস্থার ঘোষণাকাল অবধি নির্বাচনী রাজনীতিতে তাদের প্রভাব খুবই কম ছিল। জরুরি অবস্থা বিরোধী রাজনৈতিক আন্দোলনকে সমর্থন করে, জনতা দল নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় সরকারের শরিক হয়ে, জন সঙ্ঘ / ভারতীয় জনতা পার্টি জাতীয় রাজনীতিতে গুরুত্ব লাভ করে।

১৯৮০ পরবর্তী সময়

৭৭ সালের নির্বাচনে সমূহ পরাজয়ের পর ইন্দিরা গান্ধীর নেতৃত্বাধীন কংগ্রেস সরকার যখন পুনরায়  ১৯৮০ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় তখন তাদের মধ্যে এক নির্দিষ্ট রক্ষণশীল দক্ষিণপন্থী ঝোঁক দেখা যায়।

জমিদার-বুর্জোয়া নেতৃত্বাধীন কংগ্রেস সরকারের দীর্ঘ সময়কালে ক্রমবর্মান বেকারত্ব, নিম্নগামী অর্থনীতি, জরুরি অবস্থার আধা ফ্যাসিবাদী শাসনকাল, কংগ্রেসের জনভিত্তি টলিয়ে দিয়েছিল। ধর্মীয় সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের সমর্থনলাভের উদ্দেশ্যে ইন্দিরা গান্ধীর নেতৃত্বাধীন কংগ্রেস সরকার 'নরম হিন্দুত্বের' পথ ধরে। এই ঝোঁকের আরেকটি কারণ ছিল উদীয়মান হিন্দুত্ববাদী রাজনৈতিক শক্তি, অর্থাৎ বিজেপির জনভিত্তিকে কংগ্রেসের দিকে নিয়ে আসাই ছিল লক্ষ্য। পাঞ্জাবে, কাশ্মীরে প্রকাশ্য সমাবেশ থেকে ইন্দিরা গান্ধী নরম হিন্দুত্বের প্রচারে সংখ্যাগুরু সম্পরদায়ের ধর্মীয় ভাবাবেগকে নির্বাচনী ক্ষেত্রে কাজে লাগাতে চাইলেন। ফলত, ধর্মীয় পরিচিতিকে কাজে লাগিয়ে নির্বাচনী প্রচার যা কিনা জনসংঘ এযাবৎকাল অবধি জাতীয় রাজনীতির মূলস্রোতের থেকে কিছুটা বিচ্ছিন্নভাবেই করে চলেছিল, তা এবার ব্যাপকভাবে উচ্চারিত হতে শুরু করল। কার্যত নির্বাচনী রাজনীতির একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা হল। এই রাজনীতির ফলশ্রুতিতেই উগ্র সাম্প্রদায়িকতা এবং সশস্ত্র বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের সূচনা ঘটে। নিজেদের কাজের ফলে সৃষ্ট বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন দমন করতে গিয়ে ইন্দিরা গান্ধী স্বর্ণমন্দিরে সামরিক অভিযান চালান এবং পরবর্তীতে নিজের দেহরক্ষীদের গুলিতেই তার প্রাণনাশ হয়। এই সকল ঘটনার ফলশ্রুতি হিসেবে ভারতের রাজনীতিতে অভূতপূর্ব ধর্মীয় মেরুকরণ ঘটে যায়। হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়েরই ধর্মীয় ভাবাবেগকে তোষণ করতে গিয়ে একদিকে শাহ বানো মামলায় সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে প্রতিষ্ঠিত আইনি দর্শনকে খন্ডন করতে যেমন নতুন আইন প্রণয়ন করা হয়, অপর দিকে অযোধ্যায় রাম মন্দিরের অর্গল খুলে দেওয়া হয়। এই ক্রমবর্ধমান সাম্প্রদায়িক মেরুকরণকে কাজে লাগিয়ে মাত্র ২টি লোকসভা আসন থেকে ১৯৮৯ এর নির্বাচনে বিজেপির আসন সংখ্যা ৮৬-তে পৌঁছে যায়।

উপরোক্ত সময়কালের এই সকল ঘটনাপঞ্জি থেকে দেখা যায় যে কংগ্রেস নেতৃত্বের সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের প্রতি সুবিধাবাদী, আপসকামী অবস্থান এবং মানুষের অর্থনৈতিক মানোন্নয়নের ক্ষেত্রে ব্যর্থতা ও নিরাপত্তাহীনতাই হিন্দুত্ববাদী রাজনীতিকে রসদ যুগিয়েছে।

১৯২৫ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকেই সংঘ নিজেদের বিবিধ অনুমোদিত সংগঠন/ সংস্থার মাধ্যমে এ দেশে তাবৎ রাষ্ট্রীয় এবং সামাজিক ক্ষেত্রে একচেটিয়া আধিপত্য কায়েম করার লক্ষ্যে কাজ করে চলেছে। ইউরোপীয় ফ্যাসিবাদের সাথে মতাদর্শগত মিল থাকলেও, তার দ্বারা অনুপ্রাণিত হলেও, রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ তার কার্যকলাপে স্বকীয়তার দাবি রাখে। ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দু রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মূল লক্ষ্যে এগোনোর প্রয়োজনে সমাজের বিভিন্ন অংশকে প্রভাবিত করার উদ্দেশ্যে ভিন্ন ভিন্ন সংগঠন / সংস্থার জন্ম দিয়েছে তারা। উদ্দিষ্ট বিবিধ জনসমষ্টির এই ভিন্নতাকে মাথায় রেখেই একেকটি সংগঠন / সংস্থার রাজনৈতিক উচ্চারণ একেক রকম, লক্ষ্য যদিও এক। হিন্দুত্বের ট্র্যাডিশনাল শ্রেণীগত সমর্থনের ভিত্তি হল ধনী বৃহৎ কৃষির মালিক, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী এবং মধ্যবিত্তের বিভিন্ন অংশ (আমলা, উচ্চ আয়ের পেশাদারি কর্মী ইত্যাদি)। পাঁচের দশকে পূর্বতন জমিদার শ্রেণীর সামাজিক সমর্থনের ভিত আলগা হয়ে যাওয়ার ফলে এবং তার উলটো দিকে ক্রমবর্ধমান কৃষক আন্দোলনের প্রেক্ষিতে, সংঘ জমিদারি প্রথার প্রতি খোলাখুলি সমর্থন প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়। ভারতের অধিকাংশ জায়গায় স্রেফ কাগজে কলমে জমিদারি বিলোপের ফলে এবং কৃষিজমির পুনর্বণ্টন না হওয়ার ফলে বৃহৎ ভূস্বামীদের একটি বড় অংশই শক্তিশালি থেকে যায়। এই শ্রেণীর মধ্যে কংগ্রেসের প্রতি সমর্থন থাকলেও ধীরে ধীরে জন সংঘ এবং পরবর্তীকালে বিজেপির প্রতি সমর্থন বাড়তে থাকে। সবুজ বিপ্লবের কল্যাণে চূড়ান্ত লাভবান উত্তর ভারতের বৃহৎ ভূস্বামীদের মধ্যে জনসংঘের রক্ষণশীল সামাজিক/ রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি সমর্থনের ভিত তৈরি করে। চরম পুরুষতান্ত্রিক রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের দ্বারা সৃষ্ট জনসংঘ কিংবা বিজেপি'কে কখনও খাপ পঞ্চায়েত বা বাল্যবিবাহ বন্ধ করার পক্ষে কোন কর্মসূচী গ্রহণ করতে দেখা যায়নি। রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘে কোনও মহিলার সদস্যপ্রাপ্তি নিষিদ্ধ। সংঘ অনুমোদিত মহিলা সংগঠন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবিকা সমিতির ঘোষিত অবস্থান নারী স্বাধীনতার সরাসরি বিরোধী।

১৯৯১ পরবর্তী সময়ে উদারনীতির কারণে প্রসারমান মধ্যবিত্তের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ বিজেপি'কে সমর্থন করতে থাকে। তার একটি প্রাথমিক কারণ ছিলো (অবশ্যই উচ্চ বর্ণের) মন্ডল কমিশন প্রণীত সংরক্ষণ বিরোধিতা। উদারীকরণের ফলে বেশ কিছু সুবিধাভোগী এবং অপর দিকে লাগামহীন পুঁজিবাদী ব্যবস্থার আর্থিক নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে থাকা এই মধ্যবিত্তের একটা বড় অংশেরই সমর্থন পায় বিজেপি। এই অংশের মধ্যে দক্ষিণপন্থী মতাদর্শের প্রভাব বাড়ছে।

আর এস এস-র হিন্দুত্ব আসলে কী ?

আর.এস.এস এর কাছে হিন্দুত্বের সংজ্ঞা কি? ঐতিহাসিকভাবে হিন্দুত্ববাদকে বুঝতে হলে আর.এস.এস-র অন্যতম প্রধান ভাষ্যকার সাভারকারের বই 'Hindutva: Who is a Hindu' থেকে কিছু অংশ উল্লেখ করা যুক্তিযুক্ত হবে। ১৯২৩ সালে রচিত এই বিখ্যাত ইস্তাহারকে আর.এস. এসের বাইবেল বললেও অত্যুক্তি করা হবে না। এই সেই বিখ্যাত বই যেখানে সাভারকার প্রধানত দুটি ধারণার ব্যাখা করছেনঃ হিন্দু কে? এবং হিন্দুত্ব কী? এই গোটা ব্যাপারটাই তিনি ব্যাখা করছেন একটা সংকীর্ণ সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিকোণ থেকে। সাভারকার হিন্দু ধারণাটাকে ব্যাখ্যা করছেন:

An American may become a citizen of India. He would certainly be entitled, if bona fide, to be 'treated as our Bharatiya or Hindi, a countryman and a fellow citizen of ours. But as long as in addition to our country, he has not adopted our culture and our history, inherited our blood, and has come to look upon our land not only as the land of his love but even of his worship, he cannot get himself incorporated into the Hindu fold.

কোনরকম রাখঢাক না রেখে আরও পরিষ্কার ভাষায় সাভারকার বলেছেন তারাই হিন্দু যাদের পিতৃভূমি এবং পুণ্যভূমি ভারত। মুসলিম বা খ্রিস্টান জনগণকে, সাভারকার লিখছেন, কখনোই এবং কোন অবস্থাতেই হিন্দু হিসেবে মেনে নেওয়া যায় না; কারণ “For though Hindusthan to them is Fatherland as to any other Hindu yet it is not to them a Holyland too. Their holyland is far off in Arabia or Palestine.” ঢাক পিটিয়ে তৈরি করা হল হিন্দু হিসেবে বিবেচিত হবার তিনটি প্রাথমিক শর্ত-

১) যিনি ভারতবর্ষকে মাতৃভূমি অথবা পিতৃভূমি হিসেবে মানবেন,

২) যিনি জন্মসূত্রে হিন্দু পিতা-মাতার সন্তান এবং

৩) যিনি ভারতবর্ষকে পুণ্যস্থান হিসেবে মনে করবেন।

এই তিনটি গুণাবলীকেই সাভারকার হিন্দুত্বের মুখ্য উপাদান হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। তাহলে হিন্দুত্ব হয়ে দাঁড়ালো একটা রাজনৈতিক অ্যাজেন্ডা, যার মূলে থাকল তিনটি ধারণা: একটি সাধারণ রাষ্ট্র, একটি সাধারণ জাতি, একটি সাধারণ সংস্কৃতি। খুবই সুচতুর ভাবে জাতীয়তাবাদী মোড়কে হিন্দু ধর্মকে ব্যখ্যা করা হল। সাভারকার বর্ণিত এই জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক militarized হিন্দু সত্ত্বাই হয়ে উঠলো ভারতীয় সত্ত্বা, ভারতীয় পরিচয়, ভারতীয় সমাজের মূল স্রোত। হিন্দুত্বের এই ধারণার ওপর কেন্দ্র করেই তৈরি হল হিন্দু জাতীয়তাবাদ - যেটা ভারতীয় জাতীয়তাবাদী আদর্শ থেকে একদম আলাদা। 'হিন্দু-হিন্দুত্ব-ভারতীয় জাতীয়তাবাদ' গোছের একটা সহজ সমীকরণে সকলকে বেঁধে ফেলার এই চেষ্টা সাভারকার থেকে শুরু যার ট্র্যাডিশন আর.এস. এস আজও বহন করে চলেছে।

হিন্দুত্বের কারবারিদের এই রাজনৈতিক ধারণা অনুসারে কোন একজন মুসলিম বা খ্রিস্টান ভারতে জন্মালেও তিনি ভারতীয় সমাজের মূল স্রোতের থেকে বাইরে থাকবেন কারণ এই দুই সম্প্রদায়ের - ক্ষেত্রেই 'পুণ্যভূমি' ভারত নয়। আর.এস.এস গোত্রীয় এই ভাবনার সার কথা হল যে একজন ভারতীয় মুসলমানের 'পুণ্যভূমি' মক্কা থাকতে পারবে না। ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সবার হবে একটাই পুণ্যভূমি আর সেটা হল ভারত। আমাদের বুঝতে অসুবিধে হয় না এমন একটি এককেন্দ্রিক হিন্দুত্ববাদী ধারণাকে কেন্দ্র করে সংঘ পরিবাবের রাজনৈতিক গুরুরা আসলে সংখ্যালঘুদের অধিকারকে খর্ব করতে চায়,  যে কোন অন্য বিশ্বাসকেই বিদেশী বলে ঘোষণা করতে চায়। আবার ভারতের মাটিতে উদ্ভূত অন্যান্য ধর্মগুলির (বৌদ্ধ, জৈন, শিখ) স্বাতন্ত্র্য, স্বকীয়তা সবকিছুকে অস্বীকার করে এগুলিকে হিন্দু ধর্মের অংশ বলে চালানোর একটা অবিরাম চেষ্টা চলছে। স্বভাবতই এই সমস্ত ধর্মাবলম্বী মানুষদের আর.এস.এস মার্কা হিন্দুত্বের রাজনৈতিক অ্যাজেন্ডায় সামিল করার কাজটা আমাদের সামনে পরিষ্কার হয়ে যায়। অর্থাৎ যা কিছু অন্য সেই সবকিছুকে হয় এক ধাঁচে ফেলো নয়তো ছুঁড়ে ফেলে দাও, এটাই হচ্ছে সাভারকার তথা আর.এস.এস-এর হিন্দুত্বের মূল প্রতিপাদ্য। অন্যদিকে ২৪ ঘণ্টা ধরে এমন একটা হিন্দু ধর্মের কথা বলা হচ্ছে যেটার সঙ্গে ওতপ্রোত জড়িয়ে রয়েছে জাতীয়তাবাদ। হিন্দুত্বের এই রাজনৈতিক আক্রমণের মূল কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছেন মুসলমান ভারতীয় জনগণ। হিন্দুত্বের এই রাজনৈতিক ভাষাকে উপস্থিত করার সবথেকে ভাল উপায় ছিল শত্রুপক্ষের একটা মনগড়া ইমেজ তৈরি করা এবং নিরন্তর তার বিরুদ্ধে প্রচার করা। আর.এস.এস সেই কায়দাতেই শত্রুর মিথ তৈরি করে। অবিরাম প্রচার চালানো হয় যে ভিনদেশী মুসলিম সম্প্রদায় হিন্দু সমাজের কাছে বিপদ। পরিকল্পনা করে মুসলমানদের 'অন্য' বলে চিহ্নিত করা হল। তাই হিন্দু ধর্মের পবিত্রতা রক্ষার জন্য এই মুসলমানদের অর্থাৎ 'অন্য'দের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করা হল। একেবারে স্বৈরতান্ত্রিক কায়দায় শুরু গোলওয়ালকার ঘোষণা করেছেন "the foreign races of Hindusthan must either adopt the Hindu culture and language, must leam to respect and hold in reverence Hindu religion, must entertain no idea but those of the glorification of the Hindu race and culture." (Golwalkar, We-Or Our Nationhood Defined, PP. 104-05)

ভারতে থাকতে গেলে হিন্দুত্ববাদী ধ্যানধারণাকে মেনে নিতে হবে, হিন্দু জাতীয়তাবাদের সঙ্গে একাত্ম হতে হবে এবং অন্য কোন ধর্মের চর্চা এবং পালন করা যাবে না। ব্রাহ্মণ্যবাদী ধারণার এই একমুখী স্বৈরতান্ত্রিক চিন্তাভাবনার রাজনৈতিক পরিভাষাই হল আর.এস. এসের হিন্দুত্বের দর্শনের গোড়ার কথা। অর্থাৎ আর.এস.এসের হিন্দুত্ব হল আদ্যোপ্রাপ্ত রাজনৈতিক দর্শন যেটা ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দুধর্ম এবং জাতীয়তাবাদের একটা নির্লজ্জ মিশেল। রাজনৈতিক হিন্দুত্বের আবির্ভাবই ছিল সাভারকার থেকে গোলওয়ালকারের একমাত্র লক্ষ্য। এ জি নুরানির মতে 'অন্য' জাতি, ধর্মকে ঘৃণার রাজনৈতিক মতাদর্শের ওপর ভিত্তি করেই তৈরি হয় হিন্দুত্বের সূত্রায়ণ। (এ জে নুরানি, সাভারকার ও হিন্দুত্ব, এন বি এ ২০০৪)।

আর এস এস এবং হিন্দু রাষ্ট্র

খুব স্বাভাবিক ভাবেই 'হিন্দু-হিন্দুত্বের ভারতীয় জাতীয়তাবাদ" মার্কা আর.এস.এস-এর লাইন থেকেই হিন্দু রাষ্ট্রের ধারণার জন্ম। কেমন হবে সেই রাষ্ট্র? একমাত্র হিন্দুরাই অর্থাৎ যারা ভারতবর্ষকে মাতৃভূমি অথবা পিতৃভূমি হিসেবে মানেন, যারা হিন্দু পিতা-মাতার সন্তান এবং যারা ভারতবর্ষকে 'পুণ্যস্থান' হিসেবে মনে করবেন, তারাই এই দেশে থাকতে পারবেন। গোলওয়ালকার এই প্রসঙ্গে বলছেন:

Hindusthan, the Hindu Race with its Hindu Religion, Hindu Culture and Hindu Language, (the natural family of Sanskrit and her off-springs) complete the Nation concept: that, in fine, in Hindusthan exists and must needs exist the ancient Hindu nation and nought else but the Hindu Nation. All those not belonging to the national i.e. Hindu Race, Religion, Culture and Language, naturally fall out of the pale of real National' life. (Golwalkar, We Or Our Nationhood Defined, p. 99 )

এই হিন্দু রাষ্ট্রে হিন্দু ছাড়া আর কারো অধিকার নেই। উল্লেখযোগ্য নির্দিষ্ট একটি সংস্কৃতি কেন্দ্রিক হিন্দু ভাষার কথাও বলা হয়েছে। অর্থাৎ দ্রাবিড় থেকে উদ্ভূত কোন ভাষা ব্যাবহার করেন এমন বিপুল সংখ্যক জাতিগোষ্ঠীকে হিন্দু রাষ্ট্রের কাঠামো থেকে বাদ দেওয়া হচ্ছে। ভারতীয় আদিবাসীদের একটা বড় অংশ সংস্কৃত কেন্দ্রিক কোনও ভাষা ব্যবহার করেন না। তারাও আর.এস.এস মতে ভারতীয় নন এবং হিন্দু রাষ্ট্রের অংশ হিসেবে পরিগণিত হবেন না। হিন্দুত্বকে কেন্দ্র করে তৈরি হওয়া হিন্দু রাষ্ট্রের এই অবয়বে অ-হিন্দু জনগণের পরিণতি সম্পর্কে বলতে গিয়ে একই বইতে গোলওয়ালকার লিখলেন:

Emigrants have to get themselves naturally assimilated in the principal mass of the population, the National Race, by adopting its culture and language and sharing in its aspirations, by losing all consciousness of their separate existence, forgetting their foreign origin. If they do not do so, they live merely as outsiders, bound by all the codes and conventions of the Nation, at the sufferance of the Nation and deserving of no special protection, far less any privilege or rights. There are only two courses open to the foreign elements, either to merge themselves in the national race and adopt its culture or to live at its mercy so long as the national race may allow them to do so and to quit the country at the sweet will of the national race. (Golwalkar, We-Or Our Nationhood Defined, pp. 103-104)

হিন্দু রাষ্ট্রের প্রবক্তাদের এই ধারণায় মুসলমান থেকে শুরু করে দলিত, খ্রিস্টান থেকে আদিবাসী সবাইকে হিন্দুত্বের আবশ্যিক শর্তগুলো পূরণ করতে হবে। আসলে এই হিন্দু রাষ্ট্রের মূলে আছে একটা বাদ দেবার চিন্তাভাবনা যা আমাদের দেশের বহুত্ববাদ ভিত্তিক সংবিধানের একদম উলটপুরান।

আর এস এস-র হিন্দুত্বের স্বরুপ

ব্যাপারটা এমন নয় যে হিন্দুত্বের এই রাজনৈতিক ধারণা সাভারকার থেকে শুরু আর গোলওয়ালকারে শেষ। সাভারকারের হিন্দুত্বের এই ধারণা আজকের রাজনৈতিক সময়ে ভীষণ প্রাসঙ্গিক। আরএসএস আজ একমুখী আগ্রাসী রাজনৈতিক হিন্দুত্বের ধ্বজাধারী। ধরা যাক, ঘর ওয়াপসির মত একটা রাজনৈতিক ঘটনা। গোটা ভারত জুড়ে আর.এস.এস এবং বিজেপি অন্য ধর্মে বিশ্বাসী প্রচুর গরিব মানুষকে বিভিন্ন ছলে বলে কৌশলে হিন্দুত্বের অ্যাজেন্ডায় সামিল করতে চেষ্টা করল। যুক্তি হিসেবে দেখানো হল যে এরা একসময় সবাই হিন্দু ছিলেন, পরবর্তীতে মুসলমান, খ্রিস্টান এবং বৌদ্ধ ধর্মে জোর করে এদেরকে ধর্মান্তরিত করা হয়েছিল। এখন সবাই আবার তাদের পুরনো ঘরে (হিন্দু ধর্মে) ফিরে আসবে। একই সঙ্গে ভুলিয়ে দেবার চেষ্টা করা হল দলিত শ্রেণির মানুষের ধর্মান্ধকরণের আসল কারণকে। আবার অন্য দিক থেকে ধর্মান্তর বিরোধী আইন প্রয়োগ করে বিরাট অংশের দলিত এবং আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষ, যারা এতদিন ভীষণভাবে হিন্দুধর্মের জাতপাত ব্যবস্থার শিকার হয়েছিলেন। আদিবাসী কিংবা অন্য যে কোনও ব্যক্তির বৌদ্ধ এবং খ্রিস্টান ধর্মে ধর্মান্তকরণের পথ আটকানোরও ফন্দি ফিকির খুঁজলেন আরএসএস-বিজেপির প্রবক্তারা। স্রেফ মুসলমান বা খ্রিস্টান বা বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী হবার জন্যই গুজরাট বা মুজফফরনগরের মতো ঘটনা হয়ে যেতে পারে। নৃশংস ভাবে খুন করা হতে পারে সামাজিক দিক থেকে সবচেয়ে পিছিয়ে পড়া দলিত এবং আদিবাসী জনগোষ্ঠীর বিপুল মানুষকে। প্রতিবাদ করতে গেলে জুটে যাচ্ছে দেশ-বিরোধী তকমা, বলা হচ্ছে পাকিস্তানে চলে যেতে। ব্যাপারটা খুব পরিস্কার। যেরকম সাভারকাররা বলেছেন সেটা আজও আরএসএস নেতৃত্ব বলছেন এবং করছেন হিন্দুত্বকে মেনে নিতে হবে নাহলে জুটবে দেশ-বিরোধী তকমা, হয় ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দুধর্মের পায়ে অসহায় আত্মসমর্পণ করতে হবে নচেৎ সংখ্যাগুরুর সাম্প্রদায়িকতার রোষানলে দগ্ধ হতে হবে।

মার্কসবাদী পথ পত্রিকার ফেব্রুয়ারি-মার্চ,২০১৭ সংখ্যায় প্রকাশিত প্রবন্ধ  


শেয়ার করুন

উত্তর দিন