১৯৫৯ সালের খাদ্য আন্দোলন এ রাজ্যের মতো এদেশের ইতিহাসেও গণতান্ত্রিক অধিকারের দাবীতে লড়াই-সগ্রামের অতীত। ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি তখনও অবিভক্ত। পার্টির রাজ্য পরিষদের পক্ষ থেকে আন্দোলনের ইতিহাসকে 'খাদ্য চাই' শিরোনামে প্রকাশ করা হয়েছিল। সেই ঐতিহাসিক দলীলই রাজ্য ওয়েবসাইটে দুই পর্বে প্রকাশ করা হল। মূল দলীলের ভাষা অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে।
জনসাধারণের দৃঢ় সংকল্প আন্দোলনের সম্মুধান হইয়া আতংকিত বৃহৎ ব্যবসায়ীরা চাউলের দাম নিম্নমুখী হইয়াছে এই ধারণা জন্মাইয়া জনমনে আত্মসত্ত্বষ্টি সৃষ্ট করিয়া জনমনকে বিভ্রান্ত করিতে অপচেষ্টা করিয়াছিল। এই উদ্দেশেই খাণ্ডের দামের চাবিকাঠি যাহাদের হাতে সেই বৃহৎ মজুতদার ও ব্যবসায়ীকুল কিছুটা দাম হ্রাস করেন। এই ঘটনা ইহাই প্রমাণ করে যে খাতের গোপন মজুত সম্পর্কে প্রতিরোধ কমিটি ও বামপন্থীদলগুলির বক্তব্য কত নির্ভুল। কিন্তু ইহার পর হইতেই চাউলের দাম ক্রমাগত হ্রাস পাওয়া সম্পর্কে সরকারী উদ্ভট প্রচার ক্রমেই বেপরোয়া হইয়া ওঠে। মুখ্যমন্ত্ৰী দাবি করিয়াছেন রাজ্যে চাউলের দাম নাকি ৬২। টাকা পর্যন্ত কমিয়া গিয়াছে! এবং বর্তমানের দাম গত বৎসরের ভূলনায় কম। আরও প্রচার করা হইতেছে আউশ চাউল বাজারে আসার জন্মই দাম আরো কমিবে। আর আমনের দিন তো আবার নিকটবর্তী হইতেছে; সুতরাং আর ভাবনা কি ?
আউশ চাউল বাজারে আসায় চাউলের দাম কমা সম্পর্কে সরকারের মাত্রা-ছাড়া প্রচারের জবাবে আমরা দৈনিক ‘যুগাস্তর' পত্রিকার একটি মন্তব্য উদ্ধৃত করিতেছি। সকলেরই জানা আছে যে, দৈনিক ‘যুগান্তর’ কখনই সরকার বিরোধী দলের মুখপত্র নহে এবং তাহার মালিকের একজন পুত্র বর্তমান একজন মন্ত্রী। ৭ই সেপ্টেম্বরের যুগান্তর পত্রিকায় “নানাকথা” কলমে নিম্নরূপ সম্পাদকীয় মন্তব্য প্রকাশিত হয় :-
“চাউলের মূল্য কিছু কমিয়াছে বটে, কিন্তু যত রটনা হইতেছে তত নহে । সাধারণ গৃহস্থ যাঁহারা বাজার হইতে চাউল সংগ্রহ করেন তাহাদের অভিজ্ঞতা এই যে, মণপ্রতি আট আনা, এক টাকা, দেড় টাকা বা জোর দুই টাকা মূল্য হ্রাস হইয়াছে। এরূপ অবস্থায় যখন উচ্চকণ্ঠে বারবার প্রচার করা হয় যে, গত বৎসর এই সমনের মূল্য অপেক্ষা মণ-প্রতি পাঁচ সাত টাকা দাম কমিয়া গিয়াছে, তখন স্বভাবতঃই জানিতে কৌতূহল জাগে যে কোথায়, কোনখানে বা কোন দোকানে ? খাদ্যের মূল্য বৃদ্ধির বিরুদ্ধে এত আন্দোলন হইবার পরে, অবশ্যই এ সম্পর্কে কোন প্রকাশ উক্তি বা বিবৃতিতে সতর্কতা অবলম্বনের প্রয়োজন আছে। উহা বাস্তবের কাছাকাছি না হইলে লোকের বিরক্তি ও হতাশা বাড়ে। যাঁহারা পাঁচ সাত টাকা দাম কমিয়াছে বলেন, তাঁহারা হয়তো কোনো পরে জানিয়াই উহা বলিয়াছেন । অথবা বিশেষ কোন এক শ্রেণীর চাউলে উহা কমিয়াছে শুনিয়া প্রচার করিতেছেন। যেখানেই উহা কমিয়া থাকুক, ক্রেতা সাধারণ অত কমে খুচরা দোকানে প্রয়োজন মত চাউল কিনিতে পারে না, ইহাই আসল কথা। এরূপ অবস্থায় রটনা এবং সত্য ঘটনার মধ্যে একটা সামগ্রস্ত থাকা কি বাঞ্ছনীয় নহে সম্প্রতি বিভিন্ন স্থান হইতে যে সংবাদ আসিতেছে তাহাতে দেখা যায় যে, চাউলের দাম আবার ঊধ্বমুখী হইয়াছে ।
সরকারী প্রচারে সত্যের অবলুপ্তি প্রত্যক্ষদর্শী সাংবাদিকদের রিপোর্টে মিথ্যার স্বরূপ উদ্ঘাটন
কলিকাতা হাওড়ায় চার দিনব্যাপী হত্যালীলার সাফাই গাহিয়া পশ্চিম বঙ্গ সরকার বলিয়াছেন গুণ্ডামি ও সমাজবিরোধী উচ্ছ খলতা বন্ধ করার জন্ম পুলিস লাঠি-গুলি চালাইতে বাধ্য হইয়াছে । সরকারের এই বক্তব্যে রাজনৈতিক রং চড়াইয়া মুখ্যমন্ত্রী ডাঃ বিধান রায় বলিয়াছেন : “পুলিস যাহাতে গুলিবর্ষণ করিতে বাধ্য হয়। তেমন অবস্থা সৃষ্টি করার জন্য কমিউনিস্টরা জনসাধারণকে উত্তেজিত করিয়াছে।” (স্টেটসম্যান, ৩৯-৫১)
সরকারের এই মিথ্যা প্রচারের জবাব ইতিপূর্বে বহুবার আমরা দিয়াছি। সুতরাং আমাদের কথার পুনরাবৃত্তি আমরা আর করিতে চাহি না। কলিকাতার অন্যান্য যেসব দৈনিক পত্রিকা এই আন্দোলনের বিরোধী, তাহাদের প্রকাশিত সংবাদ হইতেই আমরা দেখাইতে চাই যে, গুণ্ডামি ও উচ্ছ, খল আচরণ করি য়াছে পুলিস — জনসাধারণ বা কমিউনিস্ট পার্টি নয়। পুলিস সম্পূর্ণ অকারণে লাঠি গুলি চালাইতে আরম্ভ করিয়াছে এবং তারপর নিরবচ্ছিন্ন মিথ্যা ভাষণ দ্বারা তাহাদের সেই অপরাধের বোঝা জনসাধারণ ও ধায় আন্দোলনের নেতাদের ঘাড়ে চাপাইবার অপচেষ্টা করিতেছে।
কয়েক দিনের ঘটনা সম্পর্কে সরকারের বক্তব্য ও এই আন্দোলন- বিরোধী পত্রিকাগুলির বিবরণ হইতেই আমরা এই বক্তব্য প্রমাণ করিব । ৩১শে আগস্টের মিছিলের উপর লাঠিচার্জের ঘটনা দিয়াই আরম্ভ করি।
৩১শে'র ঘটনা সম্পর্কে সরকারী প্রেসনোটে বলা হইয়াছে : “জনতা সামনের দিকে আগাইয়া আসে এবং তাহাদের মধ্য হইতে কিছু লোক পুলিসের প্রতি ইট, সোডার বোতল ও হাতবোমা নিক্ষেপ করিতে থাকে। ফলে পুলিস লাঠিচার্জ করিতে বাধ্য হয়।" সরকারের এই বক্তব্যের সঙ্গে স্টেটসম্যান, যুগান্তর ও হিন্দুস্তান স্ট্যান্ডার্ডের প্রত্যক্ষদর্শী রিপোর্টারদের বিবরণ মিলাইয়া দেখা যাক ।
স্টেটসম্যান লিখিয়াছেন: “আন্দাজ ১-২ মিনিটের সময় প্রায় বারো জন শোভাযাত্রী পুলিসের। বেষ্টনীর ফাঁক দিয়া সারিবদ্ধভাবে আগাইয়া আসেন। মনে হয়, পুলিস ইচ্ছা করিয়াই বেষ্টনীর মধ্যে ঐ ফাঁকটি রাখিয়াছিল, যাহাতে বাহারা আইন অমান্য করিতে চাহেন, তাঁহারা আগাইয়া আসিয়া গোস্তার বরণ করিতে পারেন। ...কিন্তু বিরাট জনতা আগাইয়া আসিতে থাকিলে পুলিসকে লাঠিচার্জ করার হুকুম দেওয়া হয়।”
'যুগান্তর' লিখিয়াছেন: “কয়েকটি দলে বিভক্ত হইয়া আইন অমার আন্দোলনকারীরা পুলিস বেষ্টনী ভাঙ্গিয়া অগ্রসর হইতে শুরু করিবেন বলিয়া কথা ছিল। এখন দল কর্ডন ভাঙ্গিয়া সামনে আগাইয়া আসিলে তাহাদিগকে গ্রেপ্তার করা হয়। বেষ্টনীর একাংশে যেখানে জনগণের প্রবল চাপ পড়িতেছিল সেখানে একটা ঠেলাঠেলির সৃষ্ট হয়। কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই আবহাওয়া বদলাইয়া যায়। কর্ডনের ভিতরের দিকে যেখানে সাংবাদিকরা দাঁড়াইয়া- ছিলেন সেখান হইতে পুলিসের হাতের লাঠি শুল্কে উঠিতে দেখা যায় এবং আওয়াজ শুনিতে পাওয়া যায়। পুলিস জনতাকে হটাইয়া লইয়া যায়--- তাহাদের পিছনে পিছনে মুখে জালের মুখোস লাগানো লাঠিধারী পুলিসের আর একটি বাহিনী প্রবলভাবে লাঠি চালনা করিতে করিতে অগ্রসর হইয়া যায়।"
হিন্দুস্থান স্ট্যাণ্ডার্ড লিখিয়াছেন :
“প্রথম দল সত্যাগ্রহীর গ্রেপ্তারের পরে জনতা পুলিস বেষ্টনীর ফাঁক দিয়া প্রবেশ করিলে পুলিস লাঠিচার্জ করে। অন্যান্য পত্রিকার উদ্ধৃতি দিলাম না, কেননা তাহাদের বক্তব্যও অনুরূপ প্রত্যক্ষদর্শী সাংবাদিকদের এই সব বিবরণ হইতে নিম্নলিখিত তথ্যগুলি প্রমাণিত হয় :-
(১) জনতা “পুলিসের প্রতি ইট, সোডার বোতল ও হাতবোমা নিক্ষেপ করিতে থাকে" বলিয়া পুলিস লাঠি চালাইয়াছে—সরকারী প্রেস- নোটের এই বক্তব্য সর্বৈব মিথ্যা। লাঠি চালাইবার সময় জনতা শান্তিপূর্ণ ছিল।
(২) জনতা শান্তিপূর্ণভাবে কয়েকটি দলে বিভক্ত হইয়া আইন অমান্ত করিবেন” একথা বহু পূর্বে আন্দোলনের নেতারা ঘোষণা করিয়াছিলেন এবং পুলিসও এই কথা জানিত ।
(৩) আইন অমান্যকারীরা যাহাতে অগ্রসর হইয়া গ্রেপ্তার বরণ করিতে পারেন তাহার জন্য পুলিস তাহাদের বেষ্টনীর মধ্যে একটি ফাঁকও রাখিয়াছিল। কিন্তু প্রথম দল গ্রেপ্তার হইবার পরে দ্বিতীয় দল অগ্রসর হইলেই পুলিস লাঠি চার্জ আরম্ভ করে। প্রত্যক্ষদর্শী রিপোর্টারদের প্রত্যেকের বিবরণীতেই এই কথার উল্লেখ আছে। স্টেটম্যানের রিপোর্টার লিখিয়াছেন, “পুলিস ইচ্ছা করিয়াই তাহাদের বেষ্টনীর মধ্যে ফাক রাখিয়াছিল " আ তারিখ 'বসুমতী' সম্পাদকীয় প্রবন্ধে লিখিয়াছেন, ঐ ফ্রাকটি ছিল আসলে ধার। জনতাকে অগ্রসর হইতে প্রলুদ্ধ করার জনই ঐ ফাঁক রাখা হইয়াছিল, যাহাতে সুযোগ মত পুলিস তাহাদের পিটাইতে পারে। 'বসুমতী' এই সম্পর্কে বিচার বিভাগীয় তদত্ত্বের দাবি জানাইয়াছেন।
১লা তারিখের ঘটনা সম্পর্কে সরকারী প্রেসনোটে বলা হইয়াছে “আন্দাজ দুপুর ১টার সময় ছাত্রদের একটি মিছিল নিৰ্মল চন্দ্র স্ট্রীট ধরিয়া অগ্রসর হইবার কালে মুখ্যমন্ত্রীর বাসভবনের সামনে দাড়ায় এবং কিছুক্ষণ স্লোগান চিৎকার করার পরে মুখ্যমন্ত্রীর বাড়ীতে ইটপাথর ছুড়িতে আস্তে করে। তখন ঐ জনতাকে তাড়াইবার জন্ম পুলিসকে কাঁদুনে গ্যাস-গোলা ছুড়িতে হয়।"
একই ঘটনা সম্পর্কে স্টেটসম্যানের রিপোর্টার লিখিয়াছেন :
“শোভাযাত্রাটি ডাঃ রায়ের বাড়ীর নিকটে আসিলে ছাত্র স্বেচ্ছা- সেবকেরা উহার পুরোভাগটিকে ঘিরিয়া রাখে। মিছিলের কিয়দংশ ডাঃ রায়ের বাড়ী ছাড়াইয়া গেলে একদল পুলিস প্রিন্সেপ স্ট্রীট হইতে বাহির হইয়া আসিয়া মিছিলটিকে তাড়া করে। কয়েকজন ছাত্রকে রাস্তায় পড়িয়া যাইতে দেখা যায়। মিছিলটি ছোট ছোট দলে ভাঙ্গিয়া যায়। তারপর পুলিস লাঠি চালাইতে চালাইতে গলি-খুচির মধ্যে ছাত্রদের পিছু ধাওয়া করিতে থাকে।"
• 'যুগান্তর' লিখিয়াছেন: “মিছিলের সম্মুখ ভাগটি ডা: রায়ের বাড়ী পার হইয়া যাইবার পর পুলিস ছাত্রদের উপর লাঠিচার্জ করে। ...... পুলিস বাহিনী লাঠি চালাইতে চালাইতে ছাত্রদের পিছু ধাওয়া করিলে ওয়েলিংটন স্কোয়ার অঞ্চলের পরিস্থিতি ঘোরালো হইয়া উঠে।”
• হিন্দুস্থান স্ট্যাণ্ডার্ড লিখিয়াছেন: “মিছিলের সম্মুখ ভাগ যখন শাস্তি- পূর্ণ ভাবে স্লোগান দিতে দিতে মুখ্যমন্ত্রীর বাড়ীর সম্মুখ দিয়া যাইতেছিল...
তখন পশ্চাদ ভাগের উপর পুলিস লাঠিচার্জ করে।” প্রত্যক্ষদর্শী রিপোর্টারদের বিবরণী হইতে প্রমাণিত হয় যে :
১। ছাত্র-মিছিলট সম্পূর্ণ শান্তিপূর্ণ ছিল। কোনরূপ বিশৃঙ্খলা যাহাতে না ঘটে তাহার জন্ম ছাত্র ভলান্টিয়ারগণ প্রথম হইতেই সচেষ্ট ছিলেন ।
২। মুখ্যমন্ত্রীর বাড়ীতে ইটপাথর ছোড়ার কোন ঘটনা উপস্থিত রিপোর্টারগণ কেহই দেখেন নাই। বরং ছাত্রদের শাস্তি রক্ষার জন্য উদ্বেগের প্রমাণ তাঁহারা পাইয়াছেন।
৩। পুলিস পিছন হইতে অতর্কিতে শান্তিপূর্ণ মিছিলকে আক্রমণ করে।
৪। প্রেসনোটে লাঠিচার্জের কথা বেমালুম চাপিয়া যাওয়া হইয়াছে।
হিন্দুস্থান স্ট্যান্ডার্ডের ভাষায় "শান্তিপূর্ণ ছাত্রমিছিলের উপর লাঠিচার্জের ফলেই ঐ দিনের হাঙ্গামার সূত্রপাত হয়।"
পরবর্তী দিনের ঘটনাবলী সম্পর্কেও সরকারী ভার ও প্রত্যক্ষদর্শী রিপোর্টারদের বিবরণীতে আকাশ পাতাল তফাৎ। লাঠি ও গুলিতে হতাহতের সংখ্যা সম্পর্কে সরকারী ভায়ের কথাই ধরা যাক ।
৩১শের লাঠিচার্জে কত আহত হইয়াছে ? সরকারী প্রেসনোটে বলা হইয়াছে-: “১২ জনকে আহত অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি করা হইয়াছে।” এবং ইহাদের সকলেও আবার পুলিসের পাঠিতে নয়। ইহাদের কেহ কেই “ভিড়ের চাপে বা জনতার নিক্ষিপ্ত ইটে” আহত হইয়াছেন।
কিন্তু বিভিন্ন হাসপাতাল হইতে তথ্য সংগ্রহ করিয়া স্টেটসম্যান জানাইয়াছেন, রাত ১১-৩০ মিঃ পর্যন্ত প্রায় ৩৪ জন আহতকে হাসপাতালে আনা হইয়াছে ৷ যুগান্তর অমৃতবাজারের সংখ্যা প্রায় ৪- আনন্দবাজার হিন্দুস্থান স্ট্যাণ্ডার্ডের সংখ্যা প্রায় ৩৫। ১লা তারিখের হতাহতের সংখ্যা সরকারী প্রেসনোটের মতে: নিহত-৬, আহত-১১। আনন্দবাজারের সংবাদ : নিহত ৭, আহত প্রায় এক হাজার। অন্যান্য পত্রিকাতেও প্রকাশিত হতাহতের সংখ্যাও প্রায় অনুরূপ ।
৩০শের তারিখের ঘটনা সম্পর্কে প্রেসনোটে বলা হইয়াছে যে, গুলিবর্ষণের ফলে হাওড়ার ৭ জন এবং কলিকাতায় একজনের মৃত্যু হইয়াছে। বিভিন্ন সংবাদপত্রের মতে ঐদিন কমপক্ষে ১২ জন গুলিতে মারা গিয়াছে এবং আহতের সংখ্যা যুগান্তরের মতে প্রায় ১৫০ জন এবং আনন্দবাজারের মতে ১৭২ জন ।
৩০শের তারিখ কয়টি স্থানে কতবার গুলিবর্ষণ হইয়াছে সে সম্পর্কে প্রেসনোট নীরব।
বিভিন্ন সংবাদপত্রে ঐদিনের গুলিবর্ষণের যে বিবরণ প্রকাশিত হইয়াছে তাহা মিলাইলে দেখা যায় যে, তরা তারিখ কলিকাতার ১৭টি স্থানে, ২৪ পরগণায় ৮টি স্থানে এবং হাওড়ায় এটি স্থানে এই মোট ৩০টি স্থানে গুলিবর্ষণ হইয়াছে। পুলিশ বহু লাশ শুম করিয়াছে বলিয়া জনসাধারণের মধ্যে যে সন্দেহ জাগিয়াছে হতাহতের সংখ্যা কম করিয়া দেখাইবার সরকারের এই চেষ্টা দেখিয়া সেই সন্দেহ আরও দৃঢ় হয়। পরিশেষে “গুণ্ডামি” সম্পর্কে একটি কথা বলিয়া আমাদের বক্তব্য শেষ করিতে চাই। সরকারের অভিযোগ—খাদ্য আন্দোলন এখন “গুণ্ডামিতে” পর্যবসিত হইয়াছে এবং “গুণ্ডারা” এখন আন্দোলনের নেতৃত্ব করিতেছে। আমাদের ভাষায় নয়, কট্টর আন্দোলন বিরোধী আনন্দবাজার পত্রিকার ( ৪ঠা তারিখের ) দুইটি সংবাদের উল্লেখ করিয়া সরকারের এই প্রচারের সত্যতা যাচাই করিতে চাই মুচিপাড়া থানা “আক্রমণ” সম্পর্কে আনন্দবাজার লিখিয়াছেন যে, "আক্রমণকারীরা” থানা বা পুলিসের কোন ক্ষতি সাধন করে নাই । আসানসোলের হরতালের বিবরণ দান প্রসঙ্গে আনন্দবাজারের সংবাদদাতা লিখিয়াছেন "এক জায়গায় গুণ্ডা শ্রেণীর একদল লোক হরতাল বানচাল করার উদ্দেশে লাঠি-সোটা ও লোহার ডাণ্ডা লইয়া পিকেটিংকারীদিগকে আক্রমণ করে এবং তাহাদের কয়েকজনকে গুরুতরভাবে জখম করে।
শ্রীভূপেশ গুপ্ত (এমপি)’র অভিযোগের জবাবে ডাঃ রায় বলিয়াছেন যে, ঐ সকল অভিযোগ “নির্ভেজাল মিথ্যা।” ‘সত্যমেব জয়তে সিলমারা সরকারী কাগজে লেখা অভিযোগগুলি সত্য, না, সরকারের বিরুদ্ধে আমাদের অভিযোগগুলি সত্য সাধারণ মানুষ তাহা বিচার করিবেন। (৬ই সেপ্টেম্বরের 'স্বাধীনতা' পত্রিকা হইতে )
জয়ের নব দিগন্ত
৩১শে আগস্ট হইতে ৩রা সেপ্টেম্বর—মাত্র এই চারিদিনের মধ্যে পশ্চিম বাংলার খাদ্ধসংগ্রামে আশিটির অধিক মানুষ শহীদ হইয়াছেন। এইসব শহীদের রক্তে রঞ্জিত পশ্চিম বাংলার জনসাধারণের বাঘসংগ্রামের তৃতীয় পর্যারের উদ্বোধন হইয়াছে।
পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যসরকার শান্তিপূর্ণ বা সংগ্রামকে রীতিমত সাম্রাজ্যবাদী পদ্ধতিতে রক্তের বন্ধায় ডুবাইয়া দিবার চক্রান্ত করিয়াছিলেন।
কুখ্যাত নিবর্তনমূলক আটক আইন, নিরাপত্তা আইন, ইত্যাদি প্রয়োগ করিয়া প্রথমেই দুর্ভিক্ষ প্রতিরোধ কমিটির এবং বামপন্থী নেতৃবৃন্দকে ও শ্রেষ্ঠ সংগঠকদের নির্বিচারভাবে গ্রেপ্তার করা হয়। এইসব কাজে সরকারের মতলব খুব স্পষ্ট ছিল: তাঁহারা চাহিয়াছিলেন আন্দোলনকে নেতৃত্বহীন করিয়া জনসাধারণকে ছত্রভঙ্গ করিয়া দিতে। কিন্তু তাঁহাদের সেই অপচেষ্টা পরাস্ত হয়। নির্দিষ্ট দিন হইতে প্রতিটি জেলায় নির্দিষ্ট কর্মসূচী অনুযায়ী শাস্তিপূর্ণ সুশৃঙ্খল সংগ্রাম অগ্রসর হইয়া চলে এবং সর্বত্র কার্যসূচীর প্রতিটি দফা বাস্তবে রূপায়িত করা হয়। জনসাধারণ আইন অনান্তের নূতন নূতন কার্যক্রম গ্রহণ করিয়া সংগ্রামকে করিয়া তোলেন আরও ব্যাপক আরও গভীর।
প্রাথমিক পরাজয়ে ক্ষিপ্ত সরকার পরাজয়ের গ্লানি ঢাকিতে চাহিলেন রক্তাক্ত প্রতিশোধ গ্রহণ করিয়া। তাহারা ৩১শে আগস্ট ও তাহার পরের দিনগুলিতে যাহা কিছু অনুষ্ঠিত করিলেন, তাহা এদেশে বৃটিশ আমলের জালিয়ানওয়ালাবাগ ও রসিদ আলী দিবসের স্মৃতিই সকলকে স্মরণ করাইয়া দেয়। কিন্তু এ সব সত্ত্বেও খাদ্য সংগ্রামের দৃঢ় সংকল্প তৃতীয় পর্যায়ের উদ্বোধন নবদিগন্তেরই সংকেত।
এবং দেশব্যাপী প্রবল গণ বিক্ষোভের মুখে আরও পরাজয়ের মান বহন করিয়া সরকারকে নতি স্বীকার করিতে হইয়াছে। কলিকাতা ও হাওড়া হইতে ১৪৪ ধারা প্রত্যাহার করিতে হইয়াছে, আটক আইন, নিরাপত্তা আইন ও বিভিন্ন ধারায় বন্দী ও ধৃত ও শাস্তিপ্রাপ্ত আরও বহু বন্দীর মুক্তির আদেশ দিতে হইয়াছে। ওয়ারেন্ট ইত্যাদি প্রত্যাহার করিতে হইয়াছে ।
কিন্তু সরকার এখনও হিংসাত্মক কাজে অভিযুক্ত ইত্যাদি বুলি আওড়াইয়া খাদ্য সংগ্রামের বহু বন্দীকে মুক্তি দিতে অস্বীকার করিতেছেন, তাঁহারা ৩১শে আগস্ট ও পরবর্তী দিনগুলিতে অনুষ্ঠিত পুলিসী দুষ্কৃতি- গুলির প্রকাশ্য তদন্তে স্বীকৃত হন নাই।
সংশোধিত রেশনিংয়ের সম্প্রসারণ ও গ্রামাঞ্চলের জন্য তথাকথিত ক, খ, গ শ্রেণী বিভাগের বিলোপ সাধন ও ৪ একরের কম জমিসম্পন্ন প্রত্যেকের জন্য, সংশোধিত রেশনিংয়ের সুযোগ উন্মুক্ত রাখার কথা—
এইগুলি কিছুটা অগ্রগতি কিন্তু খাদ্য সংকটের স্থায়ী সমাধানের ব্যবস্থা কোনক্রমেই নহে। বিশেষভাবে আগামী ফসলের সময় খাদ্যসংগ্রহ করার এবং উহার সাফল্যের জন্য সর্বস্তরে জনগণের কমিটির সহযোগিতা গ্রহণের নীতি সম্পর্কে এখনও তাহারা আশ্চর্য নীরবতা বজায় রাখিয়াছেন। দুর্ভিক্ষ প্রতিরোধ কমিটির নেতৃবৃন্দের সঙ্গে মীমাংসা আলোচনায় বসিবার সদিচ্ছার কোন প্রকাশ নাই৷ রাজ্যসরকার জনসাধারণের খাদ্য লইয়া সুদীর্ঘ এগার বৎসর কাল যে মিথ্যাচার চালাইয়া আসিয়াছেন তাহার ক্লেদাক্ত ইতিহাস মানুষের ভুলিবার কোন উপায় নাই।
খাদ্য সংগ্রামের দাবী সমূহ
ক) রাজ্যব্যাপী সর্বস্তরের মানুষকে ১৫টাকা মণ দরে খাদ্যোপযোগী চাউল সরবরাহ করিতে হইবে ।
(খ) সংশোধিত রেশনিং ব্যবস্থা রাজ্যব্যাপী সম্প্রসারিত করিতে হইবে এবং সর্বস্তরের মানুষকে মাথাপিছু ১১ সের চাল ও ১ সের গম- নিয়মিতভাবে সরবরাহ করিতে হইবে।
(গ) খোলা বাজারে খুচরা দোকান মারফৎ পর্যাপ্ত পরিমাণে ও নিয়মিতভাবে ২০ হইতে ২২ টাকা মণ দরে চাউল সরবরাহ করিতে হইবে।
(ঘ) চাউল কলগুলির উপর শতকরা ৫ ভাগ লেভি বসাইতে হইবে ।
(ঙ) রাজ্য হইতে সংগৃহীত পরিমাণ হিসাবে ৫ লক্ষ টন খাত মজুত- করিতে হইবে।
চ) রাজ্যের ঘাটতি সম্পূর্ণভাবে কেন্দ্রীয় সাহায্যের মাধ্যমে পূরণ করিতে হইবে।
(ছ) টেস্ট রিলিফ ব্যাপকভাবে সপ্তাহব্যাপী মাথা পিছু দৈনিক দেড় টাকা হারে চালু করিতে হইবে ।
(জ) খয়রাতি সাহায্য সমস্ত দুঃস্থ ব্যক্তিদের দিতে হইবে।
(ঝ) অবিলম্বে পর্যাপ্ত পরিমাণ কৃষিঋণ বণ্টন করিতে হইবে।
(ঞ) সর্বস্তরে সর্বদলীয় খাদ্য কমিটী গঠন করিতে হইবে।
(ট) অসাধু ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ ও স্থানীয় জনসাধারণের সহযোগিতায় মজুতদারীর বিরুদ্ধে তীব্র অভিযান চালাইতে হইবে। উদ্ধার প্রাপ্ত খাদ্যশষ্য সস্তাদরে জনসাধারণের সহযোগিতায় বণ্টন করিতে হইবে ।
(ঠ) খাদ্যমন্ত্রী শ্রী প্রফুল্ল সেনের অপসারণ চাই।
খাদ্য আন্দোলনে আটক সমস্ত রকম বন্দীদের মুক্তি চাই !
নিহত ও আহতদের উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ চাই !
পুলিশ ও মিলিটারী কর্তৃক হত্যাকাণ্ডের ও জুলুমের প্রকাশ্য তদন্ত ও বিচার চাই !
নিখোঁজ ব্যক্তিগণের সন্ধান চাই !
পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পরিষদ
ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি
লেখার সঙ্গে ব্যবহৃত ছবি মুজফফর আহমদ স্মৃতি পাঠাগার হতে প্রাপ্ত দলীল থেকে সংগৃহীত
দলীলটি স্ক্যানার ব্যবহারে সংগৃহীত। দলীলের কিছু কিছু জায়গা একেবারেই অস্পষ্ট থাকায়, আগে ও পরের লাইন, প্যারা ইত্যাদির ভিত্তিতে সেইসকল অংশগুলির লেখা সাজিয়ে নেওয়া হয়েছে।