FM Cover 1

খাদ্য চাই (১ম পর্ব)

১৯৫৯ সালের খাদ্য আন্দোলন এ রাজ্যের মতো এদেশের ইতিহাসেও গণতান্ত্রিক অধিকারের দাবীতে লড়াই-সগ্রামের অতীত। ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি তখনও অবিভক্ত। পার্টির রাজ্য পরিষদের পক্ষ থেকে আন্দোলনের ইতিহাসকে 'খাদ্য চাই' শিরোনামে প্রকাশ করা হয়েছিল। সেই ঐতিহাসিক দলীলই রাজ্য ওয়েবসাইটে দুই পর্বে প্রকাশ করা হল। মূল দলীলের ভাষা অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে।

বর্তমান মুহূর্তে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য অভূতপূর্ব ঘটনাবলীর মধ্য দিয়া চলিয়াছে। এই রাজ্যের জনসাধারণ সরকারের মজুতদার তোষণকারী খাঘনীতির ফলে কৃত্রিমভাবে সৃষ্ট শোচনীয় বাস্তাবস্থার প্রতিকার এবং নিজেদের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে বাস্তলাভের জন্ম পশ্চিমবঙ্গ মূল্যবৃদ্ধি ও দুর্ভিক্ষ প্রতিরোধ কমিটির নেতৃত্বে একটি গণসংগ্রাম চালাইতেছেন। জন- সাধারণের এই শান্তিপূর্ণ গণসংগ্রাম— গভীরতা, ব্যাপ্তি এবং জনগণের দৃঢ়সংকল্পের দিক হইতে এমন একটি গৌরবোজ্জ্বল রূপ গ্রহণ করিয়াছে যাহা এই রাজ্যে ইতিপূর্বে কখনও দেখা যায় নাই ।

সংগ্রামের প্রথম পর্যায়

গত ১৪ই জুলাই বিভিন্ন জেলার কোর্টগুলিতে এবং স্থানীয় সরকারী অফিসে অফিসে শান্তিপূর্ণভাবে স্বেচ্ছাসেবকগণের সীমাবদ্ধ আইন অমান্য দ্বারা বর্তমান প্রত্যক্ষ সংগ্রাম শুরু হয়। এই পর্যায় চলে ২০শে আগস্ট পর্যন্ত। ১৪ই জুলাই হইতে ২০শে আগস্ট—এই সময়ের মধ্যে কয়েকটি জেলায় ১,৬৩১ জন স্বেচ্ছাসেবক আইন অমান্য করার জন্য গ্রেপ্তার হন।

সংগ্রামের দ্বিতীয় পর্যায়

২১ শে আগস্ট হইতে শুরু হয় আন্দোলনের দ্বিতীয় উন্নত পর্যায়। দ্বিতীয় পর্যায়ের কর্মহী থাকে: কলিকাতা মহানগরী সমেত সমস্ত জেলায় আইন অমান্য সম্প্রসারণ। ৩১শে আগস্ট তারিখে কলিকাতাসহ সমস্ত জেলা সদরগুলিতে যুগপৎ কেন্দ্রীয় গণ অভিযান, জেলাগুলির সদর আদালতে গণ-আইন অমান্য এবং কলিকাতায় রাজ্য সরকারের দপ্তর অভিমুখে গণ-মিছিল ও কয়েকটি দলে আইন অমান্য; এবং ৩রা সেপ্টেম্বর রাজ্যব্যাপী সাধারণ ধর্মঘট ও হরতাল। ৩রা সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আইন অমান্যর জন্য গ্রেপ্তারের সংখ্যা দাঁড়ায় ১৪,২৩২ জন।

৩১শে আগস্ট কলিকাতায় মনুমেন্ট ময়দানে ৩ লক্ষ নরনারীর এক অভূতপূর্ব সমাবেশ ও সভা শেষে লক্ষাধিক নরনারীর শান্তিপূর্ণ বিশাল শোভাযাত্রা এবং সদরে সহরে বিশাল বিশাল জনসমাবেশ ও গণ-আইন অমার হয়। বিপুল সংখ্যাধিক্যের দিক হইতে শুধু নহে, যে পরিস্থিতির মধ্যে ৩১শে-র সমাবেশ, শোভাযাত্রা ও আইন অমান্য হয়, সেই বিশেষ পরিস্থিতিও জনগণের এই বিপুল জাগরণের পূর্ণরূপটি সম্যক হৃদয়ঙ্গম করার পক্ষে একান্ত জরুরী।

কলিকাতার সমাবেশে পাশের জেলাগুলির কৃষকগণের যোগদানে বাধা দিবার জন্য রাজ্য সরকার পূর্ব হইতে ব্যাপক প্রস্তুতি চালান। প্রকৃতপক্ষে কলিকাতার প্রবেশ পথগুলিতে বিরাট বিরাট পুলিস বাহিনী অবরোধ সৃষ্টি করে। কিন্তু অবিরাম বৃষ্টিপাতের মধ্যে এবং সরকারের প্রচণ্ডতম অবরোধকে অগ্রাহ্য করিয়া, বিভিন্ন কৌশলে উহাকে সম্পূর্ণ ব্যর্থ ও পরাস্ত করিয়া হাজার হাজার কৃষক নরনারী সেদিনের সমাবেশে কলিকাতা ও শহরতলীর শ্রমিক ও অন্যান্য নাগরিকের সহিত মিলিত হন। সরকারের সকল কুটিল ভ্রূকুটি উপেক্ষা করিয়া তিন লক্ষের সমাবেশ এবং লক্ষ লোকের শোভাযাত্রায় রাজ্যের জনগণের যে সংগ্রামী মনোভাবের আভাস পরিস্ফুট হয়, জেলা সমাবেশগুলিতেও ঠিক অনুরূপ মূর্তিই দৃষ্ট হয়।

পশ্চিমবঙ্গের মহান জনগণের বর্তমান রাস্তা সংগ্রামের মহিমময়ৰূপ আরও স্পষ্ট হয় ৩রা সেপ্টেম্বরের রাজ্যব্যাপী সাধারণ ধর্মঘট ও হরতাল পালনের মধ্যে। ঐদিন ১৫ লক্ষ শ্রমিকসহ সরকারী ও বেসরকারী কর্মচারী যোগদান করেন এবং কলিকাতা মহানগরীসহ পশ্চিমবঙ্গের প্রতিটি শহর ও গ্রামে পূর্ণ ও সর্বাত্মক হরতাল প্রতিপালিত হয়।

৩১শের কেন্দ্রীয় অভিযানের মতই ৩রা সেপ্টেম্বরের সাধারণ ধর্মঘট পালন হয় এমন হিংস্র দমননীতির মধ্যে, যাহা এদেশে কেহ কোন দিন দেখেন নাই।

৩১শে আগস্টের ময়দানে ৩ লক্ষের সমাবেশের পর শান্তিপূর্ণ লক্ষ নরনারীর মিছিল যখন সরকারী দফতর অভিমুখে যাইতে থাকে তখন ১৪৪ ধারার এলাকার বাহিরেই বিশাল পুলিস বাহিনী কর্তন করিয়া মিছিলের পথরোধ করে। কর্মসূচী অনুসারে জনতা শান্তিপূর্ণভাবে দেড় ঘণ্টাকাল রাজপথে অবস্থান করার পর যখন স্বেচ্ছাসেবকদের একটি দল আইন অমান্য করেন সেই সময় অতর্কিতভাবে চারিদিক হইতে বিশাল সশস্ত্র পুলিস বাহিনী স্বল্পপরিসর স্থানের মধ্যে, বাহিরে যাইবার সকল পথ- মুখ অবরুদ্ধ করিয়া জনতার উপর রাতের অন্ধকারে নির্বিচারে টিয়ার গ্যাস ও লাঠি চার্জ করে ৷ ঐ স্থানেই পুলিসব্যুহে অবরুদ্ধ অবস্থায় বৃদ্ধ, নারী ও শিশু নির্বিশেষে সহস্রাধিক মানুষ আহত ও নিখোঁজ হন ৷

এই দিনেই মেদিনীপুর জেলার সদরে, তমলুকে ও ঘাটালে—এই তিন স্থানে এবং বর্দ্ধমান, বহরমপুর, গঙ্গারামপুর (প: দিনাজপুর জেলা) এবং কোচবিহারেও শান্তিপূর্ণ মিছিলের উপর হিংস্র লাঠি চার্জ হয় এবং বহু আহত হন।

৩১শে’র রক্তাক্ত ঘটনার পরের দিন ১লা সেপ্টেম্বর রাজ্যব্যাপী ছাত্র ধর্মঘট হয়। কলিকাতায় দশ সহস্র ছাত্র-ছাত্রীর মিছিল যখন মুখ্যমন্ত্রী ডাঃ বিধানচন্দ্র রায়ের বাসভবনের সম্মুখ দিয়া ৩১শের পুলিসী কার্যাবলীর প্রতিবাদ ধ্বনিত করিতে করিতে শান্তিপূর্ণভাবে যাইতেছিলেন, সেই সময় ৩১শে'র মতনই চারিদিক হইতে সশস্ত্র পুলিস ছাত্র শোভাযাত্রাকে ঘিরিয়া ধরিয়া নৃশংস লাঠিচার্জ করে। পরে বিক্ষুদ্ধ শহরবাসীকে শায়েস্তা করিবার উদ্দেশে অন্ধকার নিবিড় কইবার সঙ্গে সঙ্গে উগ্রতর দমন চালাইয়া, বহু এলাকাতে টিয়ার গ্যাস, বেপরোয়া লাঠিচার্জ, এমনকি গুলিবর্ষণ করিয়া বহু নাগরিক হত্যাও করে। পরদিন ২রা সেপ্টেম্বরও সকাল হইতে টিয়ার গ্যাস ও লাঠিচার্জ এবং শেষ পর্যন্ত গুলিবর্ষণ চলে।

৩১শে আগস্টের সমাবেশে ক্ষিপ্ত কংগ্রেস সরকারের ১লা ও ২রা সেপ্টেম্বরের উন্নত কর্মকলাপের দুইটি উদ্দেশ্যই থাকিতে পারে একদিকে যেমন তাঁহারা প্রতিহিংসা গ্রহণ করিতে চাহিয়াছিলেন, অপরদিকে চণ্ড- নীতির দ্বারা মানুষকে সম্ভ্রান্ত করিয়া ৩রা সেপ্টেম্বরের সাধারণ ধর্মঘট যানচাল করিবার আশ] করিয়াছিলেন। এই পটভূমিকার ওরা সেপ্টেম্বরের সাধারণ ধর্মঘটের চমৎকার সাফল্য এই রাজ্যে সরকারী গায়নীতির বিরুদ্ধে ও দমননীতির প্রতিবাদে গণজাগরণেরই প্রতীক ।

সরকারী দমননীতি

পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যে জনগণের শান্তিপূর্ণ খাদ্য সংগ্রামকে শেষ করার জন্য রাজ্যসরকার যে বীভৎস রুদ্রমূর্তি ধারণ করিয়াছেন, তাহার কিঞ্চিৎ আভাস পূর্বে বর্ণিত বিবরণ হইতে পাওয়া যাইবে। নিম্নলিখিত তথ্যগুলি সরকারী চণ্ডনীতির সম্পর্কে স্পষ্টতর ধারণা লাভে সহায়ক হইবে। পশ্চিমবঙ্গ সরকার ৩১শে আগস্ট হইতে একটি রীতিমত নরমেধ যজ্ঞের অনুষ্ঠান শুরু করেন বলিলে কিছুমাত্র অতিশয়োক্তি করা হইবে না।

৩১শে আগস্ট হইতে ৩রা সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মাত্র এই চারদিনের মধ্যে পুলিস কর্তৃক গুলিবর্ষণ ও লাঠিচার্জে যে বহু সংখ্যক স্বাধীন ভারতের নাগরিকের জীবন বলিদান পড়ে তাহা হইতে সরকারী কর্মকলাপের বীভৎসরূপ একই হয়। মুখ্যমন্ত্রী ডাঃ রায়ের ৮ই সেপ্টেম্বর তারিখে সাংবাদিকদের নিকট স্বীকৃতি অনুসারে এইরূপ মৃতের সংখ্যা হইতেছে ৩১ জন ; কিন্তু ‘স্বাধীনতা’ পত্রিকার স্টাফ রিপোর্টার বিশ্বস্ত সূত্রে সংবাদ সংগ্রহ করিয়া প্রকাশ করিয়া দেন মৃতের সংখ্যা ৮০ জনের অধিক ছাড়া কম হইবে না ৷

ডাঃ বিধানচন্দ্র রায় যে সংখ্যা স্বীকার করিয়াছেন তাহাই তাঁহাদের অপরাধের পরিমাপ সম্পর্কে যথেষ্ট। কিন্তু তাঁহারা যে এখনও সম্পূর্ণ সত্যকে আড়ালে রাখিতে চেষ্টা পাইতেছেন সে বিষয়ে সন্দেহ করিবার পর্যাপ্ত কারণ আছে।

বর্তমান সংখ্যাও তাঁহারা সহজে স্বীকার করেন নাই; প্রথমে তাঁহারা অনেক কম দেখাইতে চেষ্টা করেন। ‘স্বাধীনতা’ পত্রিকা মৃত্যুর খবরগুলি নির্ভীকভাবে বাহির করিতে শুরু করিলেই ডাঃ রায় উক্ত সংখ্যা স্বীকার করেন।

৩১শে আগস্টের পুলিসী ভাবে কলিকাতাতেই সহস্রাধিক নরনারী আহত হন। তাঁহাদের অনেকেই বিকলাঙ্গ হইয়া সারা জীবনের মত পঙ্গু হইয়াছেন । এই আহতের সংখ্যা রাজ্যের বিভিন্ন জেলাগুলির সংখ্যা ধৰিলে চার সহস্রাধিত হইবে।

পশ্চিমবঙ্গ সরকারের নিষ্ঠুরতার ইহাই পূর্ণ চিত্র নহে। এই নিষ্ঠুরতা সম্যক উপলব্ধি করিতে হইলে আরও কয়েকটি দিক স্মরণ রাখিতে হইবে।

(ক) ৩১শে আগস্ট কলিকাতার ঘটনার পর বহু লোকের কোন সন্ধান পাওয়া যাইতেছে না। মৃতদেহগুলি শুম করা হইয়াছে— এরূপ ধারনা হওয়া স্বাভাবিক। (খ) শান্তিপূর্ণ গাঞ্চসংগ্রামকে দমন নীতির তাণ্ডবে শুদ্ধ করার জন্য সরকার তাহাদের হিংস্রতায় বিক্ষুব্ধ মানুষকে শায়েস্তা করিতে পুলিসকে আশ্রয় দিতে মিলিটারীর সাহায্য তলব করেন। (গ) যে সমস্ত ব্যক্তি নিহত হইয়াছেন, পুলিস বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে তাহাদের মৃতদেহগুলি রাতের অন্ধকারে বিভিন্ন দশানে পোড়াইয়া ফেলে। এমন কি, মৃতব্যক্তিদের আত্মীয়-স্বজনদেরও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে কোন প্রকার সংবাদ দেওয়া হয় না। মৃতের শেষকৃত্যের অধিকার হইতে আত্মীয়দের বঞ্চিত করা হয়. (ঘ) ১লা সেপ্টেম্বর ও পরদিন গুলিবর্ষণ করিবার সময় পুলিস কলিকাতার ও হাওড়ার অনেক পরীর বাড়িতে ৰান্ধিতে প্রবেশ করিয়া শিশু-নারী নির্বিশেষে পীড়ন চালায় ; ঘুমস্ত মানুষকেও গুলিবিদ্ধ করিয়া হত্যা করে। মিলিটারী কর্তৃক নারীধর্ষণের সংবাদও সংবাদপত্রে প্রকাশিত হইয়াছে। এইভাবে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কংগ্রেসী সরকার সভ্যতার লেশ-বিবর্জিত এক পৈশাচিক মূর্তিতে আত্মপ্রকাশ করিয়াছেন।

জনসাধারণের খাদ্যের দাবিসমূহ:

রাজ্য সরকারের মজুতদারী ওকালতি

যে খাদ্য-আন্দোলনের জন্য পশ্চিমবঙ্গ সরকার জনসাধারণের উপর এই অমানুষিক অত্যাচার চালাইতেছেন তাহার দাবি সমূহ কী ?

ধান ও চাউলের অস্বাভাবিক উচ্চ দাম এবং তাহার সঙ্গে সঙ্গে নিত্য প্রয়োজনীয় অনার প্রব্যাদির অগ্নিমূল্য আজ পশ্চিমবঙ্গের জনজীবনে শোচনীয় দুঃখকষ্ট ও দুর্দশা করিয়াছে।

এই অবস্থার আশু উপশন যাহাতে হয় সেই উদ্দেশ্যে পশ্চিমবঙ্গ দ্রব্য মূল্যবৃদ্ধি ও দুর্ভিক্ষ প্রতিরোধ কমিটি কয়েকটি আশু দাবি সরকারের নিকট উত্থাপন করেন। দুর্ভিক্ষ প্রতিরোধ কমিটির এই সমস্ত আশু দাবি সম্পর্কে সরকারী বক্তব্য গত ১৫ই আগস্ট মুখ্যমন্ত্রী ডাঃ বিধানচন্দ্র রায় কর্তৃক একটি বিবৃতি মারফৎ প্রচার করা হয়।

পশ্চিমবঙ্গের প্রাপ্ত সংকটের আশু লাঘবের জন্য প্রতিরোধ কমিটি বিশেষভাবে লঞ্চ সংক্রান্ত যে সকল দাবি দেন এবং মুখ্যমন্ত্রীর বিরতিতে সেগুলি সম্পর্কে যে জবাব দেওয়া হয়, তাহা নিম্নরূপ :

প্রতিরোধ কমিটির দাবি: সর্বশ্রেণীর মানুষকে ১৭০ টাকা দরে চাউল সরবরাহ, সমস্ত অঞ্চলে সংশোধিত রেশন চালু করিয়া গ্রামাঞ্চলের জন্যও বর্তমানের ১ সের চাউল ও ১ সের গমের পরিবর্তে—চাউল বাড়াইয়া ১ সের ও গম ১ সের করা হউক।

মুখ্যমন্ত্রীর জবাবে সংশোধিত রেশনিংয়ের চাউলের পর ১৭ টাকা মণ করা সম্পর্কে সম্পূর্ণ নীরব, গ্রামাঞ্চলে চাউলের পরিমাণ ১ সের হইতে ১০০ সের বাড়াইতে অস্বীকার করা হয়। যুক্তি দেখান হয় যে, যেহেতু চাউলের সরবরাহ সীমাবদ্ধ, সেহেতু মাথাপিছু পরিমাণ না বাড়াইয়া বেশী সংখ্যক লোকের জন্য ব্যবস্থা প্রসারিত করাই যুক্তিযুক্ত বিবেচনা করা হইয়াছে।

প্রতিরোধ কমিটির দাবি: খোলা বাজারে চাউলের দর ২০২ হইতে ২২২ টাকার মধ্যে নিশ্চয়তা সৃষ্টির ব্যবস্থা করিতে হইবে।

মুখ্যমন্ত্রীর জবাবে সরকারের পক্ষে ইহা সম্ভব নহে বলিয়া অগ্রাহ্য করা হয়। যুক্তি দেখান হয় যে,

(ক) খুচরা বিক্রেতাদের উপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নহে,

(খ) ইহা করিতে হইলে সরকারের পক্ষে স্বাক্ষণত সংগ্রহের ও বণ্টনের পূর্ণ দায়িত্ব গ্রহণ করা জরুরী হইয়া পড়ে।

প্রতিরোধ কমিটির দাবি: ৫ লক্ষ টনের খাদ্য রিজার্ভ গঠন করিতে হইবে ।

মুখ্যমন্ত্রীর জবাবে পশ্চিমবঙ্গের মত বিপুল ঘাটতি সম্পন্ন রাজ্যে এ ধরণের কোন বৃহৎ খাদ্য রিজার্ভ গঠন সম্ভব নহে মন্তব্য করিয়া দাবি অগ্রাহ করা হয়। কারণ হিসাবে বলা হয়, (ক) সরকারের নিকট বিক্রয় করিতে উৎপাদকদের উদ্বুদ্ধ করা সম্ভব নহে, কারণ তাহারা বেশী মুনাফা চাহে। (খ) রিজার্ভ গঠনের প্রচেষ্টার অর্থ হইবে যে, সরকারকে জনসাধারণের খাদ্যশস্তের সমগ্র প্রয়োজনীয়তা মিটাইবার পূর্ণ দায়িত্ব গ্রহণ; কিন্তু বর্তমান অবস্থার মধ্যে তাহা সম্ভব নহে। (গ) সরকার কর্তৃক রিজার্ভ গঠনের প্রচেষ্টা হইলে খোলা বাজারে যে চাউল আসে তাহার পরিমাণ আরও হ্রাস পাইবে। তাহাতে কষ্ট ও দুর্দশা আরও বাড়িবে। কারণ যাঁহারা সংশোধিত রেশনের আওতাধীন তাঁহাদেরও প্রয়োজনের বাকী অংশের জন্ত খোলা বাজারে যাইতে হইবেই।

প্রতিরোধ কমিটির দাবি: নিত্য-প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির মূল্য জন-সাধারণের ক্রয় ক্ষমতার ভিতরে নামাইয়া আনিতে হইবে । মুখ্যমন্ত্রীর জবাব : নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির দাম নামাইয় জনসাধারণের ক্রয়-ক্ষমতার ভিতরে আনা দুরূহ। ইহা সারা ভারতের বিষয়, পশ্চিমবঙ্গ একা ইহা কার্যকরী করিতে পারে না।

প্রতিরোধ কমিটির ন্যায়সংগত দাবি

খাদ্য ও নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দামের ক্রমাগত ঊর্ধ্বমুখী গতি, বিশেষ করিয়া ধান চাউলের অত্যধিক দামই যে পশ্চিমবঙ্গে জনসাধারণের জীবনে সংকটের প্রধান কারণ তাহা অস্বীকার করার উপায় নাই। সুতরাং বর্তমান খাদ্য সংকটের হাত হইতে মানুষকে মুক্ত করিতে হইলে খাচ্ছ ও অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির দাম, বিশেষত খাস্তের দাম, ব্যাপক সংখ্যক জনসাধারণের ক্রয়-ক্ষমতার সীমার মধ্যে নামাইয়া আনার আশু ব্যবস্থা প্রথম জরুরী বিষয়। দুর্ভিক্ষ প্রতিরোধ কমিটির খায় সংক্রান্ত দাবিগুলিতে এই বিষয়েই জোর দেওয়া হইয়াছে। বলা হইয়াছে, রেশনে চাউলের দাম ১৭- মণ করিতে হইবে, খোলাবাজারে চাউলের দাম যাহাতে ২০২-২২২ টাকার মধ্যে থাকে তাহার ব্যবস্থা করিতে হইবে, অন্তান্ত নিত্য- প্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে নামাইয়া আনিতে হইবে ।

মুখ্যমন্ত্রীর অসার যুক্তি

চাউলের দামের ব্যাপারে দুর্ভিক্ষ প্রতিরোধ কমিটির দাবি সম্পর্কে, অর্থাৎ, খাজসংকট উপশমের প্রথম আন্ত জরুরী বিষয়ে মুখ্যমন্ত্রীর বিবৃতিতে কী দেওয়া হইয়াছে? মুখ্যমন্ত্রীর বিবৃতিতে খোলা বাজারের চাউলের দাম সম্পর্কে এবং অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম সম্পর্কে মুখ্যমন্ত্রী পরিষ্কার জানাইয়া দেন যে, এই সংক্রান্ত দাবি স্বীকার করা হইবে না ।

খোলা বাজারে চাউলের দাম সম্পর্কে এবং অন্যান্য নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম সম্পর্কে দাবি না মানার জন্য মুখ্যমন্ত্রী যুক্তি কী দেন ?

খোলাবাজারে চাউলের দাম ২০২-২২২ টাকার মধ্যে নামাইয়া আনা সম্ভব নহে; কারণ, প্রথমতঃ খুচরা বিক্রেতাদের উপর সরকারের কোন নিয়ন্ত্রণ নাই। অর্থাৎ মুখ্যমন্ত্রী সকলকে বুঝাইতে চাহেন যে, চাউলের বর্তমান অগ্নিমূল্যের জন্য খুচরা ব্যবসায়ীরাই দায়ী। এই প্রসঙ্গে এবং সমগ্র বিবৃতিটিতে একবারও মজুতদার কিংবা অসাধু মুনাফাবাজ পাইকার- দের কথা কোথাও উল্লেখ কেহ দেখিতে পাইবেন না। দেশবাসী নিশ্চ মুখ্যমন্ত্রীর নিকট জানিতে চাহিবেন যে, মজুতদার অথবা অসাধু পাইকার ব্যবসায়ীর নামোল্লেখ না থাকা কা নিতান্তই ভুলের ব্যাপার। এই সম্পর্কে সরকার পূর্বে কিন্তু অন্য কথা বলিতেন। এই বৎসর পশ্চিমবঙ্গ চাউল-ধান (নাম নিয়ন্ত্রণ) ১৯৫১ আদেশ বলবৎ হওয়ার তিন দিনের মধ্যেই গত ৩রা জানুয়ারী এক প্রেসনোটে বলা হয়, “কিছু বৃহৎ পাইকার ব্যবসায়ী মূল্য নিয়ন্ত্রণ আদেশে তাঁহাদের ইচ্ছানুযায়ী মুনাফা করার অনুমতি না দেওয়ার জন্য 'মুনাফাবাজি নিরোধের সরকারী প্রচেষ্টা ব্যর্থ করার চেষ্টা করিতেছেন”।

২০২-২২২ টাকার মধ্যে চাউলের দাম রাখার ব্যবস্থা গ্রহণে অপারগতা সম্পর্কে মুখ্যমন্ত্রীর বিবৃতিতে যে দ্বিতীয় কারণটি দেখান হইয়াছে তাহা হইতেছে এই যে, এই ব্যবস্থা গ্রহণ করিতে হইলে সরকারের পক্ষে নাকি স্বাক্ষশশু সংগ্রহের ও বণ্টনের পূর্ণ দায়িত্বগ্রহণ অত্যাবশ্যক হইয়া পড়ে। যদি তাহাই পড়ে, তাহাতে মন্ত্রিসভার আপত্তি কোথায়? বিশেষতঃ নীতি হিসাবে খাদ্যশন্ডের রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যবসা প্রবর্তনের সিদ্ধান্ত যখন কংগ্রেস সরকার গ্রহণ করিয়াছেন? কিন্তু সর্বাত্মক রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্য চালু না করিলে চাউলের বর্তমান চড়া দর নামাইতে অসাধু ব্যবসায়ীদের বাধ্য করা যায় না তাহা আমরা বলি না। দেশে যথেষ্ট সংখ্যায় সরকারী রেশন দোকান সংখ্যা বাড়াইলে এবং সকলের পক্ষেই এই ব্যবস্থার সুযোগ অবারিত রাখিয়া নিয়মিত খাইবার উপযুক্ত চাউল সরবরাহের নিশ্চিত ব্যবস্থা করিলে, খোলাবাজারের অসাধু ব্যবসায়ীদের' বা টানিয়া রাখা খুবই সম্ভব। বলা বাহুল্য যে, প্রচলতি সংশোধিত রেশনিং ব্যবস্থা ও ন্যায্য দামের চাউলের দোকান ব্যবস্থা এই স্বীকৃত নীতি অনুসারেই গঠিত।

দুর্ভিক্ষ প্রতিরোধ কমিটি এই দাবিগুলিই বার বার তুলিয়াছেন, বর্তমান সংগ্রাম শুরু করার পূর্বাহ্ণেও এই দাবিগুলিই দিয়াছেন।

মুখ্যমন্ত্রী ধান-চাউল সংগ্রহ করিয়া এ লক্ষ টন রিজার্ড গঠনের দাবি প্রত্যাখ্যান করিয়াছেন কোন যুক্তি দিয়া? একবার বলা হইয়াছে যে, সরকারের নিকট বিক্রয় করিতে ধান-চাউলের উৎপাদকের অর্থাৎ কুরকদের নাকি উদ্বুদ্ধ করা যায় না; আবার বলিতেছেন যে – সরকার রিজার্ভ গঠন করিতে গেলে খোলা বাজারে ধান-চাউল দুষ্প্রাপ্য হইয়া দাম আরও বাড়িবে। কিন্তু দুইটি বুদ্ধির কোনটি আসল মুক্তি ? সরকার হইতে ধান-চাউল সংগ্রহের জন্য গুরুত্ব দিয়া প্রকৃত কোন প্রচেষ্টা করা হয় নাই, প্রকৃত কোন বন্দোবস্ত করা হয় নাই। সুতরাং কৃষককে বিক্রয় করিতে উদ্বুদ্ধ করা যাইবে না—মুখ্যমন্ত্রীর এই যুক্তি 'নেহাৎ বলিবার জন্য' বলা হইয়াছে। সরকার কৃষককে প্রয়োজনীয় প্রকৃত সাহায্য করার ব্যবস্থা করুন। জমির নিশ্চয়তা দিন, পর্যাপ্ত ঋণ, সার ইত্যাদির গ্যারান্টি দিন; কৃষকও বিনিময়ে তাঁহাদের নিকট ধান চাউল বিক্রয় করিবেনই। অবশ্য এই প্রসঙ্গে আরও একটি দিক আছে। সরকার প্রকৃত ভূমিসংস্কার কার্যকরী না করার ফলে কৃষকের মেহনতে তৈরী ফসলের বিপুল অংশ আজও অকৃষক বড় জোতদারের গোলায় চলিয়া যায়। ইহার প্রতিষেধক হিসাবে সরকার প্রকৃত ভূমিসংস্কার করিয়া কৃষককে জমি দান এবং অন্তর্বর্তীকালের জন্য জোতদার, ব্যবসাদার, চাউল কলের মজুত চাউল সরকার কর্তৃ ক সংগ্রহের উপযুক্ত ব্যবস্থা প্রয়োজন ৷

কিন্তু খাদ্য রিজার্ভ গঠনে মুখ্যমন্ত্রীর দ্বিতীয় যুক্তিটির (প্রকৃতপক্ষে ইহাই তাঁহাদের আপত্তির প্রধান কারণ ) অসারতা স্পষ্ট। সরকার রিজার্ভ গঠনের জন্য ক্রয় করিলে বাজারে সরবরাহ কমিয়া দাম বাড়িবে বলিয়া যে যুক্তি দেওয়া হইয়াছে—তাহার জবাবে বলা যায় যে, সরকারই স্বীকার করিয়াছেন যে বর্তমানে কৃত্রিমভাবে বাজারে চাউল আসিতে দেওয়া হয় না। কাহারা ইহার জন্য দায়ী ? মজুতদারেরা। বৃহৎ জোতদার, ব্যবসায়ী, আড়ৎদাররাই এই মজুতদার। ন্যায্য মূল্যের দোকানের জনসংখ্যানুপাতে অপ্রতুলতা, সরকারী সরবরাহে অনিয়মিত ও অনিশ্চিত অবস্থা, সরকারের হাতে অন্ততপক্ষে খাওয়ার যোগ্য চাউলের মজুতের অপ্রাচূর্ণ- এইগুলি হইতেছে কারণ, যাহা মহুতদার ও অসাধু ব্যবসায়ী- দের খোলা বাজারে কৃত্রিম চাউলাভাবের অবস্থা বজায় রাখিতে ও চাউলের দাম চড়াইতে উৎসাহিত করে ও সুবিধা করিয়া দেয়। সরকার যদি ৫ লক্ষ টন রিজার্ভ করেন অন্ততপক্ষে ঐ পরিমাণ চাউল মজুতদারদের কবলে যাওয়া হইতে রক্ষা পাইবে। সরকারের হাতে যদি পর্যাপ্ত খাওয়ার উপযোগী চাউলের মজুত থাকে, যে কোন সময়ে যে কোন অঞ্চলে ন্যায্য মূল্যের দোকান মারফত্ অন্ততপক্ষে খাওয়ার যোগ্য চাউল মানুষের নিকট পৌঁছাইয়া দিবার একটি বন্দোবস্ত সদাসর্বদা থাকে, মজুতদাররা কখনই কৃত্রিম অভাব সৃষ্টি করিতে প্রেরণা বোধ করিবে না । অন্ততপক্ষে মজুতদারদের অসামাজিক মনোবৃত্তির বিরুদ্ধে উপরিউক্ত ব্যবস্থাবলী শ্রেষ্ঠ রক্ষাকবচরূপে কাজ করিবে। সুতরাং দুর্ভিক্ষ প্রতিরোধ কমিটি যেমন নায্য দামের দাবি রাখিয়া, তেমনি সরকারী রিজার্ভের প্রশ্ন উঠাইয়া বাঘ সংকট উপশমের জন্য ও উহা গভীরতর হইয়া পড়ার বিরুদ্ধে অত্যন্ত কায়সঙ্গত দাবিই উত্থাপিত করিয়াছেন। এই বৎসর ধান উৎপাদনের পড়তা লক্ষ্য রাখিলে মাঝারি চাউলের দাম ২০২—২২২ টাকার ঊর্ধ্বে উঠিবার কোন ন্যায়সঙ্গত কারণ নাই । আরও মনে রাখিতে হইবে, এই বৎসর গোড়ার দিকে যখন ধান চাউল বাজারে আসা শুরু হয় তখন এই রাজ্যে দাম নিয়ন্ত্রণ আদেশ বলবৎ ছিল।

সুতরাং রাজ্য সরকার দুর্ভিক্ষ প্রতিরোধ কমিটির দাবিগুলি অগ্রাহ্য করিয়া ইহাই প্রমাণ করিয়াছেন যে, তাঁহারা মদ্ভুতদার ও অসাধু পাইকার ব্যবসায়ীদের সমাজে বাচাইয়া রাখিতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। তাঁহাদের অর্থনীতিক নীতি হইতেছে মজুতদার মুনাফাখোরদের অর্থনীতি। মুখ্যমন্ত্রীর '১৫ই তারিখের বিবৃতিতে এই অর্থনীতি পরিবর্তন করার জন্য তাঁহাদের কোন ইচ্ছা দেখা যায় না ।

সরকারী প্রচার ও বাস্তব

গত ২রা সেপ্টেম্বর লোকসভায় নূতন কেন্দ্রীয় খাদ্যমন্ত্রী শ্রী এস. কে. পাতিল মন্তব্য করেন যে, পশ্চিমবঙ্গে যখন খাদ্যাবস্থার “উন্নতি হইতেছিল এবং স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়া আসিতেছিল,” সেই সময়ে নাকি এখানে- আন্দোলন শুরু হয় এবং শ্রী পাতিলের মতে ইহা, “সমূহ দুঃখজনক ঘটনা।” শ্রী পাতিল আরও বলেন, “আগস্ট মাস হইতেই পশ্চিমবঙ্গে খাদ্যমূল্যের নিম্নগতি শুরু হয়।”

সন্দেহ নাই যে, কেন্দ্রীয় খাদ্যমন্ত্রী পশ্চিমবঙ্গ সরকার কর্তৃক সরবরাহ করা তথ্যের ভিত্তিতেই তাঁহার বক্তব্য বলেন। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের জনসাধারণ এই কথা বলিতে বাধ্য যে, শ্রীপাতিলের বিবৃতিতে এই রাজ্যের প্রকৃত অবস্থার প্রতিফলন ঘটে নাই। পশ্চিমবঙ্গে বর্তমান খাদ্য আন্দোলন আরস্ত হয় ১৪ই জুলাই হইতে। ২১শে আগস্ট হইতে আন্দোলনের দ্বিতীয় পর্যায় শুরু হয়।

জুলাই মাসে এই রাজ্যে খোলাবাজারে মাঝারী ধরণের চাউলের গড়-পড়তা দর দাড়াইয়াছিল ৩৫ টাকা মণ। কলিকাতা শহরেও গড় দর ছিল ৩৩, ৩৪ টাকা নগদ; মাঝে মাঝে ৩৫ টাকাও উঠিতেছিল। সন্দেহ নাই যে খোলাবাজারের চাউলের এই দর ছিল অস্বাভাবিক; ব্যাপক সংখ্যক মানুষের এই দরে চাউল কিনিয়া খাইবার সঙ্গতি নাই। ন্যায্যমূল্যের দোকানগুলিতে চাউল সরবরাহের অনিয়মিত অবস্থা এবং বেশীর ভাগ সময়ে খাইবার অযোগ্য চাউল তো কিংবদন্তীতে পরিণত হইয়াছে। জেলাগুলিতে অবস্থা ছিল অধিকতর শোচনীয় ।

উপরিউক্ত অবস্থার মধ্যেই খাদ্য আন্দোলন আরম্ভ হয় । প্রথম পর্যায়ের আরম্ভ হইতে দ্বিতীয় পর্যায়ের আরম্ভ পর্যন্ত অর্থাৎ ২১শে আগস্ট পর্যন্ত না কলিকাতার, না জেলাগুলিতে— কোনখানেই চাউলের দরে বিশেষ কোন হ্রাস ঘটে না। সুতরাং রাজ্য সরকার যদি কেন্দ্রকে জানাইয়া থাকেন যে 'রাজ্যে অবস্থার যখন উন্নতি ঘটিতেছিল তখনই আন্দোলন আরম্ভ হয়' তবে তাহা সম্পূর্ণ মিথ্যা কথা।

দুর্ভিক্ষ প্রতিরোধ কমিটি কর্তৃক ১০ই আগস্ট তারিখে এক সাংবাদিক সম্মেলনে খাদ্য সংগ্রামকে দ্বিতীয় পর্যায়ে অগ্রসর করাইবার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করা হয়। ইহার অব্যবহিত পরেই কলিকাতা ও হাওড়ার কয়েকটি বড় বড় ধান চাউল ব্যবসায়ীদের এক প্রতিনিধিদলের সাথে সরকারী দপ্তরে মুখ্যমন্ত্রীর বৈঠক হয়। এই বৈঠকের পর বিভিন্ন সংবাদপত্রের প্রকাশিত সংবাদে জানা যায়, এই যে মুখ্যমন্ত্রী বৃহৎ ব্যবসায়ী প্রতিনিধিদের তাহাদের 'নিরাপত্তা' সম্পর্কে সরকারী সাহায্যের আশ্বাস দেন; এবং বৃহৎ ব্যবসায়ীদের প্রতিনিধিগণ নাকি মুখ্যমন্ত্রীকে আশ্বাস দেন যে, চাউলের দামের নিম্নগতি লক্ষ্যিত হইয়াছে এবং শীঘ্রই দর আরও কমিবে।

মুখ্যমন্ত্রী ও বৃহৎ ব্যবসায়ী প্রতিনিধিগণের উপরিউক্ত বৈঠকের পরেই কলিকাতা ও অন্যান্য বাজারে ২০ টাকা দাম কমিতে দেখা যায়।

উপরে বর্ণিত তথ্যগুলি হইতে কিরূপ উপসংহার টানা যুক্তিসঙ্গত হইবে ?

পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পরিষদ

ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি

লেখার সঙ্গে ব্যবহৃত ছবি মুজফফর আহমদ স্মৃতি পাঠাগার হতে প্রাপ্ত দলীল থেকে সংগৃহীত

দলীলটি স্ক্যানার ব্যবহারে সংগৃহীত। দলীলের কিছু কিছু জায়গা একেবারেই অস্পষ্ট থাকায়, আগে ও পরের লাইন, প্যারা ইত্যাদির ভিত্তিতে সেইসকল অংশগুলির লেখা সাজিয়ে নেওয়া হয়েছে।


শেয়ার করুন

উত্তর দিন